প্রেমের পাঁচফোড়ন

প্রেমের পাঁচফোড়ন !! Part- 03

আহানা পিছনে তাকিয়ে দেখলো শান্ত বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে,তার পাশে ১৫/২০টা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে,তাদের মধ্যে কেউ কেউ আহানার দিকে তাকিয়ে হাসতেসে আবার কেউ কেউ কিসব বলে যাচ্ছে,সবাইকে দেখতে গুন্ডাদের মতন,মেইন শান্তকেই দেখতে মুভির ভিলেনের মত মনে হয়
.
আহানা চোখ নামিয়ে আরেক দিকে ফিরে বসলো
.
আহানা?এত ভাব দেখাইস না,বুঝার চেষ্টা কর ওরা খুব মারাত্মক!
আমার কোনো কিছু বুঝার দরকার নাই
আহানা উঠে ব্যাগ নিয়ে ক্লাসের দিকে চলে গেলো
.
এই টুকু মেয়ের ভাব দেখসো?শান্ত ভাই এখনও ঠাণ্ডা
হয়ে আছে কিভাবে সেটাই বুঝতেসি না
.
নওশাদের কথা শুনে শান্ত হাতের পেপসি শেষ দিয়ে হেসে একটু নড়ে দাঁড়ালো,তারপর মাথার খয়েরী রঙের চুলগুলো ঠিক করে রিয়াজকে বললো পানির ব্যবস্থা করতে
.
আমি শান্ত থাকার কারণটা দেখাবো এখন!
.
কি করবি পানি দিয়ে?

ভেজা বিড়াল বানাবো এরে,ভাবের ভূত নামাতে যা লাগে আর কি!
সবাই হেসে দিলো শান্তর কথায়
.
নওশাদ তোর পরীক্ষা কেমন হলো?বললি না যে
.
আমার পরীক্ষার কথা ছাড় ভাই,আমার মন ভালো না,তোকে এই মাইয়া চড় মারছে,মন তো চাচ্ছে ধরে চড় মেরে ওর গালটাই ফাটাই দিই আমি,এত সাহস দেখায় কি করে সেটাই বুঝি না
.
চিল!ওরে টাইট দিতে জাস্ট ২/৩দিন লাগবে আমাদের
রিয়াজ বাদ দে এখন,খেলা শুরু আজ থেকে😎

আহানা চল আমাদের বাসায় যাবি আজকে আমাদের বাসায় তোর দাওয়াত,চল আমার সাথে
.
নাহ রুপা,আমার টিউশনি আছে,পড়াতে যেতে হবে তুই যা,পরে একদিন যাব তোদের বাসায়
.
তুই তো সকাল থেকে কিছুই খাস নি,এখন এই খালি পেটে টিউশনি করাতে যাবি?
.
আমি বাসায় ফিরে খেয়ে নিব,একটাই তো
.
আচ্ছা বাই
রুপা চলে গেলো,আহানা রুপার চলে যাওয়া দেখতেসে,রুপার কত ভাগ্য ভালো,ওর মা বাবা বেঁচে আছে আর আমার তো!
আহানা হেঁটে হেঁটে টিয়াদের বাসায় যাচ্ছে
টিয়া ক্লাস ২তে পড়ে,আহানা প্রতিদিন ওকে দুপুর ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত পড়ায়
কি রোদের তাপ মনে হয় মাথা ফেটে যাবে,তাও হেঁটে যেতেই হবে
শুধু ১০টাকা আছে হাতে,সেটা দিয়ে ফিরার সময় রিকসা নিবো
আহানা রুপাকে বললো জাস্ট একটাই তো টিউশন কিন্তু এটা সত্যি কথা না,সত্যি কথা হলো আহানা আরও দুটো টিউশন করিয়ে ৭টার দিকে বাসায় পোঁছাবে,খালি পেটেই,মাঝে মাঝে টিউশনিতে নাস্তা দেয় আবার মাঝে মাঝে দেয় না,আহানার অভ্যাস হয়ে গেছে তাতে
আপন বলতে এই দুনিয়ায় তার কেউ নেই,আগে আশ্রমে থাকতো,সেই আশ্রমের ম্যানেজার ছিলেন সালেহা বেগম,উনি আহানাকে পড়াশুনা করিয়েছেন নিজের টাকায়,আহানাকে নিজের মেয়ের মত বড় করেছেন তিনি,আহানাও উনাকে খুব ভালোবাসতো নিজের মায়ের মত,কিন্তু আহানার ১৮বছর পূর্ন হতেই তার কয়েক মাস পরে তিনি মারা যান,তারপর থেকে আহানার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার,কারন ১৮বছর হওয়ার পর সেই আশ্রমে কারোরই থাকার নিয়ম নেই,তাই আহানা সেখান থেকে বের হতে বাধ্য হয়

এখন সে একটা বাসায় ভাড়া থাকে যেখানে তার সাথে ২টা মেয়ে থাকে,আহানা টিউশনি করে তার ভার্সিটির খরচ আর খাওয়া দাওয়ার খরচ চালায়,আশ্রম থেকে বেরিয়ে এই টিউশনি আর বাসা খুঁজতে কতদিন রাত না খেয়ে থাকতে হয়েছে তাকে
টিউশনির সব টাকা মিলিয়ে মাসে ৮হাজার টাকা দিয়ে বেশ চলে ওর,মাঝে মাঝে শরীর আর কুলায় না এত দৌড়াদৌড়িতে কিন্তু সে ঘরে বসে থাকলে তার মুখে খাবার দিবে কে,কবে মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছে সেটায় ভুলে গেছে
মাত্র ২টাই জামা আছে তার ভার্সিটিতে পরে আসার জন্য,একটা ধুয়ে আরেকটা পরে আসে,আর যেগুলো ছিঁড়ে গিয়েছে সেগুলো বাসায় পরে,নতুন জামা কেনার টাকা কই,ব্যাস এরকম ছোট ছোট জিনিসে কিপটামু করেই বেশ চলছে দিন
এটাই ভেবে হাসে আহানা,সে তো জানেও না তার মা বাবা দেখতে কেমন ছিল,তাকে আশ্রমে কে রেখে গিয়েছিল
হাঁটতে হাঁটতেই থেমে যায় আহানা,৫হাত দূরে শান্ত পকেটে হাত ঢুকিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে
ওর পিছন থেকে ২জন বেরিয়ে আসলো,দুজনের হাতেই পানি ভর্তি বালতি
আহানা বুঝতেসে না ওরা কেন তার পথ আটকিয়েছে
শান্ত দাঁত বের করে হেসে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো
একটা জামগাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত বললো দে একশান শুরু
রিয়াজ তার হাতের বালতির পানি আহানার গায়ে ছুঁড়ে মারলো
আহানা হা করে আছে,ওরা এরকম করবে সে একদমই ভাবেনি,রাগে আবারও তাকালো ওদের দিকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নওশাদ তার হাতের বালতির পানিও আহানার গায়ে ঢেলে দিলো
আহানা চিৎকার দিয়ে বললো stop it!
জামা পুরো ভিজে গেছে,রাগে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই শান্তর বাইকে ওরা দুজন উঠে চলে গেলো
আহানা গালি গালাজ করলো কিছুক্ষন,চড় এর প্রতিশোধ এভাবে নিলো,বেয়াদব!
আমি এখন কি করবো,টিউশন মিস করলে টিয়ার মা টাকা কেটে নেয়,এই ভিজা জামাতেই যেতে হবে কিছু করার নেই,আসার সময় জামা যেটা ছিল সেটা ধুয়ে দিসিলাম সেটা তো এত তাড়াতাড়ি শুকাবে না
আহানা গায়ের থেকে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে টিয়াদের বাসায় গেলো
টিয়া বললো ম্যাম আপনার জামা এত ভিজলো কি করে
আহানা হেসে বললো কিছু না এমনি,তুমি পড়ায় মন দাও
আজ খুব খিধা পেয়েছে,আমি জানি আজ টিয়ার মা কিছু দিবে না,৩দিন আগে দিসিলো চা বিসকিট,আবার ৪দিন পর মানে কাল দিবে,একটা নিশ্বাস ফেলে আহানা টিয়াকে পড়ানোয় মন দিলো

টিয়াদের বাসা থেকে বেরিয়ে রোডে একটা গাছের ছায়ায় একটু দাঁড়ালো,আজ আর শরীর টিকতেসে না,সকাল থেকে শরীর ভালো না এখনও দুটো টিউশনি করা বাকি,ব্যাগ থেকে পানি নিয়ে খেয়ে হাঁটা ধরলো আহানা জামা গায়ে থেকেই শুকিয়ে গেছে
অনেক কষ্টে সব টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরলো সে
আজ কেউ খেতে দেয়নি,এখন আবার রান্না করতে হবে,খিধায় মাথা ঘুরতেসে
তার উপর মাথাও ধরে আছে অনেক,চুলটা বেঁধে খোঁপা করে রান্নাঘরে গিয়ে চুলা জ্বালালো সে,বাকি যে ২জন মেয়ে ওর সাথে থাকে তারা হলো এয়ার হোস্টেস,আহানা যখন ভার্সিটিতে যায় তাদের তখন ডিউটি শেষ হয় তারপর তারা বাসায় আসে,আবার আহানা ফেরার আগেই চলে যায়,তাই বেশিরভাগ সময় আহানা একা থাকে
তরকারি কেটে চুলায় বসিয়ে বিসকিট খুঁজে মুখে দিয়ে পেট টাকে একটু দমালো আহানা,সকালে একটা রুটি আর ডিম খেয়ে বেরিয়েছিল শুধু
রাত ৮টার দিকে ভাত আর তরকারি রাঁধা হয়ে গেছে,এবার প্লেট নিয়ে খেয়ে নিলো সে,তারপর খাটে গিয়ে মাথাটা বালিশে রাখতেই রাজ্যের ঘুম এসে গেলো চোখে,কিন্তু এত ঘুমালে তো হবে না,ভার্সিটির কত পড়া,ভাগ্যিস রাত ১১টার এলার্ম দিসিলাম,১১টায় উঠে পড়তে বসলো সে,১টা পর্যন্ত পড়ে আবারও ঘুমিয়ে গেলো

শান্ত একটা শো পিস নিয়ে বসে আছে,শো পিসটা একবার উল্টো করছে আবার সোজা করছে
শো পিসটার ভেতরে গুড়িগুড়ি চুমকি,সেগুলো ওলটপালট করলে কি সুন্দর দেখায়,কিন্তু এই সুন্দর দেখার জন্য শান্ত শো পিসটাকে এভাবে উল্টোচ্ছে না,তার মন আরেক দিকে
আজকে আরেকটা চড় খেয়েছে সেটাই ভাবতেসে সে
পাশের রুম থেকে সূর্য আর নওশাদের কথা শোনা যাচ্ছে,সম্ভবত ঐ মেয়েটাকে নিয়ে কিসব বলছে ওরা

আহানা ভোর হতেই চোখ মেলে অনুভব করলো সারা শরীর জুড়ে যন্ত্রনা ছাড়া আর কিছু নেই,কাল কি বেশি কাজ করেছিলাম,উঠতেও তো পারতেসি না
অনেক কষ্টে উঠলো সে,মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে,চাপাতা দুধের যে দাম,রঙ চা খেতে খেতে বিরক্তি এসে গেসে,রঙ চা তে কি আর মাথা ব্যাথা যায়?
ভাবতে ভাবতে রেডি হয়ে নেয় আহানা,আলমারি খুলে এক হাজার টাকার ৪টা নোট বের করে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে সে,তারপর সেগুলো নিয়ে সোজা হেঁটে যায় মালিকের বাসার দরজার সামনে
কলিং বেল বাজাতেই মালিক মানে তারেক রহমান এসে দরজা খুললো
আহানাকে দেখে মুখটা ফ্যাকাসে করে বিরক্তি নিয়ে তাকালেন উনি,এই বিরক্তির কারন হলো আহানায় তার একমাত্র ভাঁড়াটিয়া যে ঠিকমত মাসে মাসে ভাড়া দেয় না,আহানাকে দেখলেই তার বিরক্তি আসে
আহানা সালাম দিয়ে একটু হেসে টাকাগুলো বাড়িয়ে ধরলো
উনি আহানার দিকে আর তাকালেন না,টাকার দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে পকেট থেকে একটা ছোট নোটবুক আর কলম নিয়ে কিসব লিখে মুখটা ছোট করে আহানাকে বললেন এটা তো এক মাসের ভাড়া তোমার যে এখনও ২মাসের ভাড়া বাকি জানো তুমি?
আহানা ইতস্তত বোধ নিয়ে বললো তাড়াতাড়ি দিয়ে দিব আঙ্কেল
তারেক রহমান ব্রু কুঁচকে বাসার ভেতরে চলে গেলেন,এভাবে চলে যাওয়ার কারনটা হলো উনি আর আহানার সাথে কথা বলতে চান না
আহানা নিচের দিকে তাকিয়ে চলে আসলো ওখান থেকে
হাতে আর ৪হাজার টাকা আছে,এই ৪হাজার দিয়ে পুরো মাস চলতে হবে,তার উপর ফার্স্ট ইয়ারের বইখাতা কিনেছি রুমমেট কনিকার টাকায়,তাকেও তো সেই টাকা ফেরত দিতে হবে,ভাবতে ভাবতে বাসা থেকে বের হলো অাহানা
সোজা হেঁটে ভার্সিটিতে যাবে সে,তেমন একটা দূরে না তবে বেশি কাছেও না,৪টা গলি ক্রস করলেই ভার্সিটির গেট সামনে এসে যায়
ওড়না ঠিক করে হাঁটতেসে সে,আজ দিনটা মেঘলা দিন,বাতাস বইছে মাঝে মাঝে,পথঘাটে প্রতিদিনের মত জ্যাম,হেঁটে যাওয়াই উত্তম,এসব জ্যামে কে বসে থাকবে এতো
আবার আহানা ভাবলো “আঙ্গুর ফল টক”
আমার টাকা নেই বলে হেঁটে যাচ্ছি আর দোষ দিচ্ছি জ্যামের
শান্ত বাইক নিয়ে জ্যামে বসে আছে সেই কখন থেকে,সানগ্লাস খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে পরিবেশটা বুঝার চেষ্টা করছে আবার মাঝে মাঝে পকেট থেকে ফোন নিয়ে ফেসবুকে ঢুকে নিউজফিড ঘুরে আসতেসে,তাও এই জ্যাম শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছে না
বাইকের আয়নাতে তাকিয়ে নিজের চুলটা ঠিক করতে গিয়ে তার চোখে পড়লো তার নতুন শত্রু আহানার দিকে,দূর থেকে হেঁটে আসতেসে সে
বাইক থেকে চোখ নামিয়ে শান্ত পিছনে তাকালো,আহানা নিচের দিকে তাকিয়ে ফুটপাতের উপর দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে,কোনোদিকে তার খেয়াল নেই
আজ এই মেয়েটাকে আরেকটা টাইট দিব,আমার গালের চড়ের জ্বালা এখনও মিটে নাই
গালে হাত দিয়ে আহানার দিকে তাকিয়ে আছে শান্ত
জ্যাম শেষ,বাইক নিয়ে আহানার আগেই ভার্সিটিতে ঢুকে গেলো সে
আহানা ক্লাসরুমে চুপচাপ বসে আছে,রুপা এখনও আসে নাই,আজ এত দেরি করছে কেন কে জানে
শান্ত ক্যামপাসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে
রিয়াজ বললো শান্ত ব্রো তোমার সখিনা আইতাছে

নওশাদ দাঁত কেলিয়ে বললো আহ হা রিয়াজ! সখিনা বলিস কেন,বলবি চুইংগাম,সারাক্ষণ শান্তর সাথে চুইংগামের মত লেগে থাকে সে
.
সূর্য হেসে বললো আমিও একটা নাম দিসি,তোমরা যদি আজ্ঞা দাও পেশ করতে পারি
রিয়াজ আর নওশাদ একটু নড়েচড়ে বললো জাঁহাপনা নামটা বলুন আজ্ঞা দিলাম!
সূর্য মুখটা গোল করে দাঁত বের করে বললো জরিনা!
নওশাদ আর রিয়াজ হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে
সখিনা মানে হলো এলিনা?উফ!
শান্ত সানগ্লাস পরে বাইকে বসলো ভার্সিটি থেকে চলে যাওয়ার জন্য মানে এক প্রকার পালানোর জন্যই কিন্তু তার আগেই এলিনা এসে শান্তকে জড়িয়ে ধরে ফেললো
.
জান তুমি এমন কেন?আমি কাল ভার্সিটিতে আসি নাই আর তুমি কিনা আমাকে কল করলে না আর আমার একটা কল ও রিসিভ করলে না?কি হয়েছে তোমার জান?আর ইউ অলরাইট?টেল মি
.
শান্ত একটু কেশে বললো কিছু না বেব,আই ওয়াজ বিজি,সরি ফর দ্যাট
চলবে♥