সে কি জানে Season 2 ! Part- 27
হুট করেই দীঘিকে অপরেসনের জন্য ওটিতে নেওয়া হয়। অপরেসনের আগে দীঘিকে অজ্ঞান করে দেওয়া হয়। যার ফলে অপরেসনের ব্যপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত সে। এদিকে আমি, মামী আর শারমিন ওটির সামনে বসে আছি। আবদ্ধ নেই আমাদের মাঝে। নামায ঘরে সে! দীঘিকে ওটিতে নেওয়ার দু’ঘন্টা পর মনে হলো আবদ্ধকে একবার দেখে আসা উচিত আমার। তা-ই করি!
নামায ঘরের সামনে কাঁচের জানালাটা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিতেই বুক কেঁপে ওঠে আমার। মোনাজাতে বসে কান্না করছে আবদ্ধ। দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম আমি। আল্লার কাছে অনেক করে প্রার্থনা করছি, যেন দীঘিকে সুস্থ করে দেন উনি। নাহলে যে আমার ভাই-টা নিঃশেষ হয়ে যাবে। সাথে শেষ হয়ে যাবে একটা ছোট্ট পিচ্চি মেয়ের জীবন!
_______________
প্রায় ৫ঘন্টা ধরে চলল অপরেসন। ওটি থেকে রেয়ান সহ তার সব বন্ধুবান্ধব বের হলো একত্রে। তাদের সবার চোখে-মুখে বিষন্নতা। তখনই নামায ঘর থেকে মাত্র এসেছে আবদ্ধ। সবার এমন বিষন্ন মুখে দেখে আঁতকে ওঠে সে। মনে এক অজানা ভয় গ্রাস করছে তাকে। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে তার। কোনোমতে ব্যগ্র কণ্ঠে সে বলে ওঠে…
— “সব ঠিকঠাক আছে তো? দীঘি কি এখন সুস্থ?”
তবুও কেউ জবাব দিল না। একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল মাত্র। এতে যেন উত্তেজিত হয়ে পড়ছে আবদ্ধ। হঠাৎ তারা সবাই আবদ্ধের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে জোড়ে জোড়ে চিল্লিয়ে ওঠে…
— “অপরেসন সাক্সেসফুল!”
সাথে সাথে মুখে হাসি ফুটে উঠল সবার। চরম উত্তেজনায় হিতাহিত জ্ঞান হাড়িয়ে ফেলেছে আবদ্ধ। কি করবে বুঝতে না পেরে রেয়ানকে শক্ত করে জড়িতে ধরে সে। প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে উঠে…
— “তোমার এই ঋণ কখনও শোধ করতে পারবো না আমি ভাইয়া। অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।”
রেয়ান হাসলেন। বলে উঠলেন…
— “শোধ করতে হবে না। শুধু তোমার বোনকে আমার কাছে দিলেই হবে।”
সাথে সাথে রেয়ানের বন্ধু রওনক ভাইয়া বলে উঠলেন…
— “ব্যটা সিঙ্গেলদের সামনে এমন আবেগীয় কথা বলতে তোর লজ্জা করে না? ঠাডা পড়ব তোর গায়ে।”
— “তুই আর রিমন ছাড়া এখানে সবাই মিঙ্গেল। আর তাছাড়া তোদের মতো হাফ লেডিসের সামনে এগুলো বললে কিচ্ছু হবে না।”
— “কি বললি?”
রেয়ানের কথায় তাল মিলিয়ে তীর্থ ভাইয়া বলে ওঠেন…
— “রেয়ান ঠিকই বলছে। তোরা মাইয়া গো লগে কথা বলতে যে লজ্জা পাস। মাঝে মাঝে আমারই সন্দেহ হয় তুই পোলাই তো? নাকি মাইয়া?”
এবার রিমি আপু বলে উঠলেন….
— “চুপ থাক তো তোরা। কি আজেবাজে টপিক নিয়ে ঝগড়া করছিস।”
চটে গেলেন তীর্থ ভাইয়া। তবে কিছু বললেন না। চোখ পাকিয়ে তাকালেন মাত্র। তবে রওনক ভাইয়া তার ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলেন…
— “তুই চুপ থাক ডাইনি৷ তোর বান্ধবীর সাথে কথা বলতে লজ্জা পাইছিলাম দেখে এই দিন দেখতে হইতাছে আমার। শালা কপালই খারাপ। এমন বান্ধুবী আমার কপালেই জুটতে হলো।”
ভেঙ্গচি দিলেন রিমি আপু। তা দেখে রওনক ভাইয়া রিমন ভাইয়াকে আফসোস নিয়ে বলে উঠলেন…
— “দেখলি রিমন কেমনে ভেঙ্গচি দিলো। শালা মাইয়ারাও এখন সম্মান দেনা আমাগো।”
বলেই রিমন ভাইয়া কে জড়িয়ে ধরলেন রওনক ভাইয়া। হেসে উঠলেন আদনান ভাইয়া। বললেন…
— “তোদের কি এমনে এমনে হাফ হেডিস বলছে? একটা কাজ কর দুইজন দুইজনরে বিয়ে করে ফেল। সিঙ্গেল থেকে মিঙ্গেল হই যাবি।”
এবার আর হাসি আটকাতে পারলাম না আমি। সবার সাথে জোড়ে জোড়ে হেসে দিলাম। তা দেখে রেয়ান তার এক হাত বুকে বা’পাশে দিয়ে অন্য হাত আদনান ভাইয়ার কাঁধে রাখলেন। বললেন…
— “আহ কি সুন্দর করেই না হাসে আমার মরুভূমিটা। বুঝলি আদনান, আমার বিয়ের পর তোরে আমার বউকে হাসানোর দায়িত্বে রাখবো। তোর বেতন হবে মাসে এক টাকা।”
নাক-মুখ ছিটকালেন আদনান ভাইয়া। তার কাঁধে থাকা রেয়ানের হাত এক ঝঁকটায় সরিয়ে বললেন….
— “ছ্যাঁচড়া!”
২৫.
অপরেসনের পরে দীঘিকে তার অসুখের কথা বলে দেয় আবদ্ধ। তখন খুব কেঁদেছিলো দু’জনেই। তবে এই কান্নার মধ্যে ছিল না কোনো দুঃখ। না ছিল কোন বেদনা। শুধু ছিল একরাশ ভালোবাসা!
এবার আর এস.এস.সি. পরীক্ষা দেওয়া হলো না দীঘির। কিন্তু তাতে কি? পরের বার দিবে সে। সব কিছু মেনে নিলেও একটা কিছু মানছে না আবদ্ধ। আর সেটা হলো দীঘির সাথে তার বিয়ে। এ বছরই দীঘিকে বিয়ে করবে সে। তাও তিন দিন পর! তার এই আজগুবি সিধান্তের নড়চড় কেউ করতে পারি নি আমরা। বরং সে নাছড়বান্দার মতো এটে রয়েছে তার সিধান্তে!
অবশেষে আবদ্ধের কথা মতাবেকই বিয়ের আয়োজন শুরু করা হয়। তিনদিন পরই এঙ্গেজমেন্ট,গায়ে হলুদ আর বিয়ে। তিনটা জিনিস একই দিনে হবে। তাই আমি আর রেয়ান এক রকম কঠিন ব্যস্ততায় আটকে গেছি। সারাদিন দু’জনে মিলে বিয়ের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকি আর দিনশেষে রেয়ানের সাথে ফোনে কথা বলি। এমন ব্যস্ততার মাঝেও একটা জিনিস ভুলি নি আমি। আর তা হলো দিহানকে। তাছাড়া কিভাবে ভুলব? সে যে আমার শ্রেষ্ট বন্ধু। সব বিপদে-আপদে আমার সঙ্গে ছিল সবসময়। তাকে কি ভুলে যাওয়া যায়? মোটেও না! বিয়ের আগের দিন রেয়ানকে জানিয়েই দিহানের সাথে দেখা করতে চাই একটা রেস্টুরেন্ট এ। দিহানও দ্বিমত করে নি।
_______________
বিয়ের আগের দিন বিকেল বেলা ঠিক ৪টায় উপস্থিত হলাম রেস্টুরেন্টে। আমাকে দেখেই দাঁড়িয়ে যায় দিহান। মুখে শুকনো হাসির রেখা টেনে বলে উঠে….
— “বসো।”
বসলাম আমি। সাথে সেও। বলল…
— “কেমন আছো মিরু?”
— “আলহামদুলিল্লাহ! তুমি?”
— “যেমনটা আল্লাহ রেখেছেন। তো কি জন্য ডেকেছো আমায়?”
— “আবদ্ধের বিয়ে কালকে। তোমাকে বিয়ের কার্ড দিতে আসলাম।”
— “ও”
চুপ হয়ে গেলাম দু’জনেই। সব কিছু কেমন যেন অদ্ভুদ লাগছে আমার। যে আমরা কিনা কথা বলতে বলতে রাত পার করে দিতাম, কিন্তু কথা শেষ করতে পারতাম না সে আমরাই আজ কেমন অচেনা হয়ে গেছি। কথা বলার কোনো কিছু খুঁজেই পাচ্ছি না। হঠাৎ-ই দাঁড়িয়ে গেল দিহান। বলল…
— “এখন তাহলে আসি।”
অবাক হলাম আমি। দিহান আসলেই কেমন অদ্ভুদ ব্যবহার করছে আমার সাথে। ও তো এমন না! নিজেকে যথা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললাম…
— “আরেকটু বসো।”
এটারই যেন অপেক্ষা করছিল দিহান। বসে গেল ততক্ষনাত। বলল…
— “কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো। আমার সময় নেই।”
— “এমন করছ কেন দিহান?”
— “কেমন করছি?”
— “এই যে আমার সাথে এভাবে কথা বলছ। আচ্ছা দিহান সব কিছু কি আগের মতো করা যায় না। মাত্র একটা ঘটনার জন্য কি সব উলট-পালট হয়ে যাবে?”
— “না।”
— “তাহলে তুমি সব ভুলে আগের মতো হতে পারছো না কেন?”
— “সম্ভব না।”
— “কেন?”
— “তোমার রেয়ান কি আমাকে তোমার সাথে মিশতে দিবে?”
— “কেন নয়? সে-ই আমাকে তোমার সাথে দেখা করতে বলেছে দিহান৷ আমাদের আবার আগের মতো সম্পর্ক গড়ে তুলতে বলেছে।”
— “কিন্তু আমি যে পারবো না আগের মতো হতে।”
— “চেষ্টা তো করতে পারো।”
একটা লম্বা নিশ্বাস নিলো দিহান। আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল…
— “আমার খুব কান্না পাচ্ছে মিরু। ইচ্ছে করছে তোমাকে জড়িয়ে ধরে খুব করে কাঁদি। কিন্তু পরক্ষনেই যখন তোমার আর রেয়ানের এক সঙ্গে থাকার প্রতিচ্ছবি চোখে ভেসে উঠে, খুব কষ্ট হয়। তোমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। বেঁচে থাকার সব ইচ্ছে শেষ হয়ে যায়। এ অবস্থায় আমি যদি তোমার সাথে আবার মিশতে শুরু করি হয়তো কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলব। বিশ্বাস করো এতটা খারাপ হতে চাই না আমি।”
উঠে দাঁড়ালো দিহান। আমার থেকে আবদ্ধ আর দীঘির বিয়ের কার্ডটা নিয়ে হাসার চেষ্টা করল সে। বলল…
— “চিন্তা করো না। এত কষ্ট করে তুমি আমাকে বিয়ের দাওয়াত দিতে এলে আর আমিই যাবো না? এটা তো হয় না। অবশ্যই আসবো কালকে!”
আমার দিকে তাকিয়ে আবার হাসলো দিহান। সে হাসিতে ছিল শুধু কষ্ট আর এক রাশ বেদনা! চলে গেল সে। আমি এখনও নির্বাক। চোখের সামনে সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে!
_______________
পরেরদিন এঙ্গেজমেন্ট শেষে দুপুর বেলা হলুদের আয়োজন শুরু করা হয়। আবদ্ধ আর দীঘিকে এক স্টেজে রেখে মাঝখানে পর্দা রাখা হয়েছে। যাতে প্রচুর বিরক্ত আবদ্ধ। বারবার দীঘিকে বলছে সে…
— “পিচ্চি কাউকে বল না এ পর্দাটা সরাতে। দেখ আমার খুব ইচ্ছে করছে তোর পেত্নি মার্কা মুখ দেখতে।”
রাগ লাগলো দীঘির। কিছু না বলে চুপ করে রইল সে। এদিকে স্টেজের কাছেই একটা চেয়ারে গাঁধা ফুল হাতে নিয়ে বসে আছে রেয়ান। কাজ শেষ করে রেয়ানের পাশে বসে পড়লাম আমি। আড়চোখে তার দিকে একবার তাকালাম। হলুদ পাঞ্চাবী আর সাদা পায়জামা পড়ে আছেন উনি। কালো ঘড়ি আর চুলে স্পাইক করে রাখা তার। পাঞ্চাবীর হাতা কনুই পর্যন্ত বটা। সুন্দর লাগিছে তাকে! উনার সাথে মিলিয়ে আমিও সাদা-হলুদ রঙের একটা ডালাশাড়ি পড়েছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম রেয়ান মুখে গাঁধা ফুল পুড়ে স্টেজের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার এমন অস্বাভাবিক কান্ডে অবাক হলাম আমি। বললাম…
— “কি হয়েছে আপনার? এভাবে গাঁধা ফুল খাচ্ছেন কেন?”
চোখের কোণ দিয়ে একবার আমার দিকে তাকালেন উনি। কিছু বললেন না। আমি আবারও একই প্রশ্ন করতেই চোখ মুখ কুঁচকে গাঁধা ফুল মুখে থাকা অবস্থায়ই অস্পষ্টভাবে বললেন…
— “আমার থেকে কম বয়সী বাচ্চাদেরও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আর আমি এখানে বসে বসে বুড়ো হচ্ছি। কি কপাল আমার দেখেছো? এমন কপাল পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার!”
এবার বুঝলাম তার এমন করার কারন।তাকে রাগানোর জন্য বলে উঠলাম…
— “তাহলে আপনিও বিয়ে করে ফেলুন। রহিমা কিন্তু অপেক্ষায় আছে আপনার জন্য।”
বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন রেয়ান৷ চোখ মুখ আরও কুঁচকে বলে উঠলেন…
— “ধুর!”
আমার পাশ থেকে উঠে চলে গেলেন উনি। আর আমি হাসতে লাগলাম তার এসব কান্ডে।
.
.
#চলবে🍁