00

মিছে মায়া !! Part- 03

মুখে পানির ছিটা পেয়ে লাফ দিয়ে উঠলাম। বাসায় অনেক লোক। আমার মাথাটা ব্যথা করছে। মাথায় হাত দিয়ে কোন মতে উঠে দাঁড়ালাম। বাসায় আসার পরে শুনতে পেলাম মহিলারা বলাবলি করছে “মাইয়াটা কত ভালো আছিলো। এই অকালে প্রান হারাইলো। আল্লাহ যে কখন কারে কি করব তা কেউ কইতে পারে না।” এটা শুনে কেন জানি স্থির থাকতে পারলাম না৷ বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। নিজেকে সামলাতে না পেরে ঢলে পড়ে গেলাম। চোখ খুলে দেখি আমি আমার ঘরে। আর বাইরের দিকে অনেক মানুষের কথার আওয়াজ। কান্নার শব্দ পাচ্ছি। কিন্তু আমি এখনো জানিনা ঠিক কি হয়েছে।
ঘর থেকে বের হতেই আমার বন্ধু শাওন, শিহাব, লাবিব, রকি ওরা সবাই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। সবাই কান্না করছে। আমি ওদের ছাড়িয়ে উঠোনে গেলাম। সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটা লাশ রাখা হয়েছে খাটিয়ার ওপরে। আমি মুখ খুলতে গেলাম। কিন্তু হাত কাঁপছে। কারন শক্তি ও পাচ্ছি না। ভেতর থেকে কিছু একটা বলছে এটা খুলিস না। এমন কিছু দেখবি যেটা সহ্য করতে পারবিনা। তারপরেও মুখ টা খুললাম।
মুখ খুলে দেখি নিরা। নিরা এখানে কেন? ওকে এখানে শুইয়ে রেখেছে কে? কি সুন্দর ঘুমুচ্ছে। আস্তে করে ডাকলাম।
– নিরা, এই নিরা। এই অবেলায় পরে পরে ঘুমাচ্ছিস কেন? ওঠ।
– আরে ওঠ না, কতদিন পরে আমি আসলাম আর তুই ঘুমাচ্ছিস।
– এই তুই কি আমার ওপর রাগ করেছিস? এই বোন, ওঠ।
কিন্তু নিরা উঠছে না। জোরে চিৎকার করে ডাকলাম। আশেপাশে অনেকেই দেখছে। সবার চোখে পানি। শিহাব এসে পাশে বসলো।
– ও আর কোনদিন ও উঠবে না মিহির।

– কে কেন? কি বলছিস তুই এসব?
– মিহির তুই বুঝতে পারছিস না? নিরা মারা গেছে। কাল রাতে কারেন্ট এর শক লাগে ওর। আন্টি আমাদের ফোন করে বলে। আংকেল তখন বাসায় ছিলো না। আমরা এসে ওকে হস্পিটাল নিয়ে যাই। কিন্তু বাঁচাতে পারিনা। আজ ভোরে ও পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ওপারে চলে যায়।
শিহাব খুব কাঁদছে। আমার কাধের ওপর একটা হাত রেখে বাকি হাত ওর চোখের ওপর। ওর কথাগুলো আমি ঠিকভাবে বুঝতে পারলাম না। আশেপাশের কারো কথাই আমার কানে যাচ্ছেনা। আমি কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিনা। আমার কানে কেবল নিরার কথাগুলো লুটোপুটি খাচ্ছে।
“আইস্ক্রিম না দিলে আজই মাকে বলে দেব তুই সিগারেট খাস”
“বিছানা তো ঠিক করে দিতেই পারি কিন্তু তার জন্য আমাকে টাকা দিতে হবে।
– কেন কেন? তোকে টাকা দিতে যাব কেন?
– নিশু আপুর সাথে রিকশায় কে যেন ঘোরাঘুরি করে ভাইয়া? চিনিস তুই?
– তুই আর ভালো হলি না। বদ কোথাকার। আচ্ছা ভালো করে ঠিক কর। তারপরে আমার মাথার চুলগুলো ও টেনে দিবি। তাহলে ৫০০ টাকা দিব।
– তুই না পচার মধ্যে সবথেকে ভালো।
– আর তুই পচার মধ্যে টপ।
” এই ভাইয়া জানিস আজ না নিশু আপুর সাথে একটা ছেলেকে হাত ধরে হাটতে দেখেছি।
– কি? সত্যি?
– আমি কি তোকে মিথ্যে বলছি?
– না তা না, তুই কি চিনিস ছেলেটাকে?
– আলবাত চিনি।

– বল কে সে।
– আগে টাকা দে।
– সবসময় টাকা টাকা করবিনা। আমি এত টাকা দিতে পারব না।
– ঠিক আছে না দিলে নাই। আমি যাচ্ছি, স্কুল লেট হচ্ছে।
– আরে আগে বলে তো যা।
– আমি ফ্রিতে খাটিনা। টাকা দিলে কাজ হয়ে যাবে।
– আচ্ছা নে। এইবার বল কে সে?
– ওমা তুই জানিস না? ওটা তো তুই ছিলি। হোয়াইট শার্ট পরা ছেলেটাকে তো মিহির এর মতো লাগছিলো। তাহলে ওটা তুই না?
– তবে রে দুষ্টু, আজ দাঁড়া তুই।
ততক্ষণে দৌড়ে স্কুলে চলে গেছে। আমার বোন টা আমাকে বড্ড ভালোবাসতো। আমার কাছ থেকে নেওয়া টাকা জমিয়ে আমার জন্মদিনে কেক আর উপহার হিসেবে একটা ঘড়ি দিয়েছে।
– কিরে বুচি এতকিছু করলি টাকা পেলি কোথায় রে?
– কেন তুই ই তো দিস। হতে পারে আমি ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নেই। কিন্তু আমি এতটাও খারাপ না হুহহহ।
– পিচ্ছিটা তো আসলেই বড় হয়ে গেছে। এইবার বুড়ো দেখে এক লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে।
– তুই না খুব খুব খুব খারাপ। আমার সাথে আর কথা বলবি না। যা ভাগ এখান থেকে।
এসব ভাবছি হঠাৎ আমাকে কে যেন জোরে ধাক্কা দিলো। শাওন আমাকে ধাক্কাচ্ছে।
– মিহির, এই মিহির। দেখ নিরা মারা গেছে। তুই কাঁদছিস না কেন? তোর আদরের বোন তোকে ছেড়ে চলে গেছে আর তোর চোখে একফোঁটা ও পানি নেই? একটু কাঁদলে হালকা লাগবে। অন্তত কিছু বল। মিহির কথা বল।
আমার মাথায় এসব কিছু ধরছে না। চোখের সামনে সব অন্ধকার মনে হচ্ছে। আরেকবার চোখ বন্ধ করলাম। চোখ খোলার পরে দেখলাম নিশু পাশে বসে আছে। আমি দৌড়ে উঠোনে চলে গেলাম। নিরার খাটিয়া নিয়ে সবাই কবরস্থানের দিকে যাচ্ছে। বন্ধুরা আমাকে দেখে দৌঁড়ে আসলো। ওদের সাথে নিয়ে গেল। নিরাকে কবরে রাখার সময় মনে হচ্ছিলো আমার জীবনের অনেক কিছু আমি হারিয়ে ফেলছি। এই মুখটা আমি আর কোনদিন দেখতে পাব না। ভাইয়া বলে কেউ ডাকবে না। অযথা কেউ জ্বালাবে না। ঘুম থেকে ডেকে তুলবে না কেউ আমাকে। আমি আর ভাবতে পারছি না। মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার কলিজা টাকে কুচি কুচি করে কেটে ফেলছে।
নিরার মৃত্যুর শোক সামলাতে পারিনি। এইদিকে মাও মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে গেছে। ঠিকমতো খায়না। মাঝরাতে উঠে কার সাথে যেন কথা বলে, হাসে, কান্না করে। আবার কখনো কখনো নিরার কবরের কাছে চলে যায় গভীর রাতে। মাকে একজন ভালো সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে হবে। কিন্তু তার জন্য শহরে যেতে হবে।
বাবার সাথে আমি এখনো কথা বলিনা। আমার কেন যেন মনে হয় তার কারণে নিরার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু নিরার মৃত্যুর পরে তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগের মতো মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করে না। মাঝে মাঝে দেখি চোখের জল মুছছেন। ইদানীং মায়ের ও যত্ন করা শুরু করেছেন। মাকে খাইয়েও দেন মাঝে মাঝে। হুহহ সব নাটক। কদিন পরে আবার ওনার আসল রূপ দেখাবেন।

দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেল। গত এক মাসে এত কিছু সহ্য করতে হয়েছে! মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাই। কিন্তু তাহলে আমার মায়ের কি হবে? আর তাছাড়া আমার এতসব সমস্যার মধ্যে একটা মানুষ সবসময় আমার সঙ্গ দিয়েছে। সে হলো নিশু। আমাকে টাকা দিয়েও সাহায্য করেছে। সেদিন নিরার দাফন দেয়ার পরে আর বাসায় ফিরিনি। প্রতিদিন দুইবার করে মাকে গিয়ে দেখে আসি। নিশু ওর এক কাজিন এর বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমি যদি মরে যাই তবে এই মেয়েটার সাথে মস্ত বড় অন্যায় হয়ে যাবে৷ যে খারাপ সময়ে পাশে থাকে তার ভালোবাসার অবমূল্যায়ন কোনদিন ও করতে হয়না। আমিও পারবনা এই মেয়েটাকে কষ্ট দিতে।
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম এসব। তখনই নিশু কল দিয়ে জানায় ঢাকায় আমার জন্য একটা জব ঠিক করেছে ওর কোন এক বন্ধুর মাধ্যমে। আমাকে কাল ই যেতে হবে। আমি রাজি হচ্ছিলাম না। মা কে এই অবস্থায় রেখে কি করে যেতে পারি? তাও অই অমানুষ টার কাছে একা রেখে? কিন্তু নিশু বুঝালো যে মায়ের জন্যই আমাকে যেতে হবে। মায়ের চিকিৎসা করাতেই হবে।
পরদিন ঢাকায় চলে গেলাম। নিশু এবং আমার বন্ধুদের মাধ্যমে মায়ের খোঁজ খবর রাখলাম। বাবা আগের মতো নেই। সে মায়ের যত্ন নেয়। মায়ের সাথে কথা বলার চেস্টা করেছি কিন্তু সে কারো সাথেই কথা বলে না। নিরা ছাড়া কাউকে চিনেও না।
দু মাস জব করার পরে বাড়িতে গেলাম। মাকে আমার কাছে নিয়ে আসব। তারপর ভালো ডক্টর দেখাবো।
বাসার সামনে এসে দেখলাম দরজায় তালা ঝুলানো।আর কারো কাছে জানতে পারলাম না তারা কোথায় আছে….
[চলবে….]