তুমি আমারই থাকবে

তুমি আমারই থাকবে !! Part- 05

জানালার পর্দা সরে গিয়ে সকালের মিস্টি রোদ এসে লাগছে চোখে-মুখে। ঘুমে নিভু নিভু চোখ মেলে রুমের চারদিকে দেখতে লাগলো তানহা। আকাশি-সাদা কম্বিনেশনের দেওয়ালটায় উজ্জ্বল রোদের আভা পড়ে ঝিলমিল করছে।অপূর্ব সুন্দর রুমটি তানহার বেশ পছন্দ হয়েছে।
নিজের দিকে তাকিয়ে তানহা দেখলো রুমের মালিক মহা আয়েশে ঘুমাচ্ছে। তাও তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরে! এই দৃশ্য দেখে চোখ থেকে সব ঘুম উড়ে গেলো তানহার। শ্বাস যেন আটকে গেলো তার। ভাবলো ঘুমের ঘোরে চেপে ধরেছে হয়তো তাই আস্তে করে তনয়ের হাত সরাচ্ছিলো সে কিন্তু যেই না হাত সরিয়েছে আর তনয় সেই হাত ধরে আবার তাকে জাপটে ধরলো। তানহা এখন বোকার মতো চেয়ে আছে। কি করবে না করবে বুঝতে পাচ্ছেনা।কেননা তনয় উঠলে খুব লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। তানহা তনয়ের দিকে চেয়ে দেখলো ঘুমের মাঝে হালকা মুচকি মুচকি হাসছে সে, যেন খুব সুন্দর কোন স্বপ্ন দেখছে! ইশশ,কতটা ইনোসেন্ট ভাব এখন এই মুখে! কেউ এখন দেখলে বলতেই পারবেনা যে জেগে থাকলে কিসব কুবুদ্ধিই না চলে এই ছেলের মাথায়!
তানহার তাকিয়ে থাকার মাঝেই হঠাৎ করে তনয় চোখ খোলে আর চোখ খুলতেই তানহার চোখে চোখ পড়ে তার। কয়েক মুহুর্ত পলকহীনভাবে চেয়ে থাকে যেন সে বুঝার চেস্টা করছে যে এখানে কি হচ্ছে।তনয়ের এইরকম চাহনি দেখে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেনি তানহা। একরাশ লজ্জা এসে ভর করলো তার চোখে-মুখে।
কি হচ্ছে বুঝতে পেরে ঝট করে হাত সরিয়ে নেয় তানহার উপর থেকে। তারপর হুট করেই উঠে বসে তনয়। মাথা নিচু করে আছে সে। তানহাও উঠে বসে এবং তনয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। আস্তে করে তানহার দিকে তাকিয়ে তনয় বলে,
-আম স্যরি। আসলে ঘুমের ঘোরে কখন জড়িয়ে ধরেছি নিজেও জানিনা।
-ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি আমি সেটা।
-বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছা করে ধরিনি।
-আচ্ছা মেনে নিলাম তো আমি।
তনয় তাও উশখুশ করছে দেখে তানহা বললো
-কি ব্যাপার বলুন তো?কি ভাবছেন আপনি এত?
-তুমি হয়তো ভাবছো যে আমি কালকেই বন্ধুত্ব করে আজকে তোমার থেকে সুজোগ নিচ্ছি তাই না? আমি সত্যিই এইরকম করতে চাইনি(তানহার দিকে তাকিয়ে)
-আরে না, আমি এইরকম কিছুই মনে করিনি। আপনি ভুল ভাবছেন
-সত্যি?
– হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ।
-থ্যাংক ইউ ভুল না বুঝার জন্য (খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে)
-(পিঠে আলতো করে হাত রেখে) ইটস ওকে।
-স্যরি।(তানহাকে ছেড়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে)
তানহা এইবার হেসে ফেললো তনয়ের আচরণ দেখে।তা দেখে তনয়ও হাসিতে যোগ দিলো!
,
,
,ফ্রেশ হয়ে দুইজন একসাথে নিচে নেমে আসলো। ইকবাল সাহেব সোফায় বসে আছেন তনয় তার সাথে বসলেন।
-এখানে তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছেনা তো মা?
– না আংকেল, কোন সমস্যা হচ্ছেনা
-তনয়,তোমার বউকে এই বাড়ির নিয়ম বলোনি তুমি?
-কোন নিয়ম বাবা?(অবাক হয়ে)
-এই বাসায় আমি কারও আংকেল না,আমাকে বাবা বলে ডাকতে হবে(তানহার দিকে তাকিয়ে হেসে)
তানহাও হেসে জবাব দেয়,
-ঠিকাছে বাবা
এরপর সে রান্নাঘরে যায় এবং দেখে তার শাশুড়িমা রান্না করছেন।
-এসে গেছো মা তুমি?
-জি মা। আপনি এখন বসেন।আপনার কাজ করতে হবেনা
-নতুন বউ প্রথমদিন থেকেই কাজ শুরু করবে এটা কিভাবে হয়??
অগত্যা তানহা সব রান্না করতে চাইলেও শাশুড়ির জোরাজুরিতে বেশি কিছু করতে পারলো না।
খাওয়া-দাওয়া শেষে তনয় অফিসে যেতে চাইলে ইকবাল সাহেব বলেন,
-আজ তোমার কোথাও যেতে হবেনা। একটু পরে বউমা কে নিয়ে তার বাসায় যাবে তুমি।
-কিন্তু বাবা,আমার নতুন প্রোজেক্ট?
-বল্লাম তো, তোমার অত চিন্তা করতে হবেনা। আজ তোমার ম্যানেজারকে বলে দিও সে ঠিক করবে সব।
তনয় মাথা নেড়ে সায় জানালো।
তানহা নীল রঙের জর্জেট শাড়ি পড়েছে, সাথে কালো ব্লাউজ। চোখে গাঢ কাজল, ঠোটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। খুব মিস্টি লাগছে তাকে দেখতে। আর তনয় আকাশি রঙের সুতির পাঞ্জাবির সাথে সাদা পায়জামা।সাথে তার সেই ভুবনভোলানো হাসি। দুইজনকেই একসাথে অনেক মানিয়েছে!! ঠিক যেন মেইড ফর ইচ আদার!
তনয়ের মা দেখে বল্লন,
-মাশাআল্লাহ, কারও নজর না লাগুক আমার ছেলে আর ছেলের বউয়ের উপর!
মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে তানহার বাড়ির উদ্দেশ্যে তারা রওনা হয়।
,
,
,
দুপুরে তানহাদের বাসায় পৌঁছায় তারা। নতুন জামাই এর বেশ খাতির-যত্ন হয় তানহার বাসায়। আজ তানহার কিছু কাজিন এসেছে তারা তনয়ের সাথে চিপকে থেকে গল্প করছে। তানহা শুধু তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থেকে দেখছে। তনয় সেই চাহনি খেয়াল করে তানহার কাছে উঠে আসে।
-কি ব্যাপার? তুমি আবার ঝালমরিচ মোডে কেন বলো তো? (ভ্রু কুচকে)
-মানে? আমাকে কোনদিক থেকে ঝালমরিচ মনে হয় আপনার কাছে?(দাত চেপে)
-এই যে লাল হওয়া নাকের ডগা,(নাকে হাত দিয়ে)তীক্ষ্ণ চোখের চাহনি-ই (চোখের দিকে চেয়ে) তো বলে দিচ্ছে ম্যাডাম এখন ঝালমরিচ মোডে আছেন।
-ধুর। (তনয়ের থেকে সরে গিয়ে)
-তো আমি কি জানতে পারি আপনার এই রাগ করার কারণ? (আবার কাছে এসে)
-এই,,আপনি এগিয়ে আসছেন কেন আমার দিকে??(এক ধাপ পিছিয়ে গিয়ে)
-হায় কপাল, বিয়ের পরেরদিনই বউ বলে এগিয়ে আসছেন কেন। ভবিষ্যতে কি বলবে কে জানে? (মাথায় হাত দিয়ে)
তানহা কিছু বলবে তার আগেই তার মা খাওয়ার জন্য ডাকে তাই সেখানে চলে যায় তারা। খাওয়াদাওয়া শেষে গল্পগুজব করে সবার থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বিকেলে বের হয় একটু ঘুরে বেড়ানোর জন্য।
,
,
,
আজকের বিকেলটা অন্যরকম সুন্দর। শরতের আকাশ, নীল নীল মেঘ উড়ছে আকাশে। তানহা আর তনয় হাটছে। অবশ্য তানহাই মানা করেছিলো গাড়ি না নিয়ে আসতে। পাশাপাশি হাটলেও হাত ধরার সুযোগ মিলেনি এখনো।মাঝে কিছু দূরত্ব রেখে দুইপাশে হাটছে দুইজন খোলা আকাশের নিচে। তানহা আকাশ দেখতে দেখতে আপন মনে হাটছে। সে খেয়াল করলে দেখতে পেতো,তনয় একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে।
তানহা সেইদিকে তাকাতেই তনয় চোখ সরিয়ে নিলো।
-কিছু বলবেন?
-আচ্ছা তুমি এইভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাটছিলে কেন?
-আজ আকাশটা কত্ত সুন্দর দেখুন! বেশি সুন্দর জিনিসের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকতেই মন চায়। (আকাশের দিকে চেয়ে)
-হুম, আমারও।(তানহার দিকে চেয়ে)
-মানে??(তনয়ের দিক তাকিয়ে)
-কিছুনা। চলো এক জায়গায় নিয়ে যাই তোমাকে।
তনয় তানহাকে নিয়ে এক নদীর পাড়ে আসে। এখানে কিছু নৌকা সাড়ি বেধে ছিলো নদীর পাড়ে। তনয় বললো,
-নৌকায় উঠবে? নাকি ভয় পাও?
-হাহ!আমি আর ভয়?শুধু ভুত,বিদ্যুৎ আর…(থেমে যায়)
-ওহ আচ্ছা। মানে আমি তুমি কিছুই ভয় পাওনা আবার সবকিছুই ভয় পাও (হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে)
-দেখুন,,একদম ভালো হচ্ছেনা কিন্তু বলে দিচ্ছি। আমি মোটেও সবকিছুকে ভয় পাইনা। (গাল ফুলিয়ে)
-আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি। তুমি তো এখনও বাচ্চাই আছো।বাচ্চারা ভয় পেতেই পারে ব্যাপার না (গম্ভীর মুখে)
-আপনি কিন্তু এখন বেশি বেশি করছেন। ভার্সিটিতে উঠেছি আমি এখন। মোটেও বাচ্চা না বুঝেছেন(ভাব নিয়ে)
-ওহ তাই নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি এখনো এইচএসসিও দেওনি (বাকা হেসে)
-আমার কিন্তু ভাল্লাগছে না আর।(কাদো কাদো মুখ করে)
-সত্যিই কেদে দিলো আল্লাহ। একে নিয়ে আমি কি করব!
-কিচ্ছু করতে হবেনা আপনার। আমি বাসায় চলে যাচ্ছি।
বলে তানহা যেতে নিলে তনয় ওর হাত ধরে ফেলে।
-আচ্ছা বাবা স্যরি। এখন চলো নৌকায় উঠি।এসেছি যখন নৌকায় না উঠে যাবোনা। (বলে তানহার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো)
,
,
,
পড়ন্ত বিকেল, আকাশে পাখি উড়ছে, তাদের কিচিরমিচির আওয়াজে মুখরিত পরিবেশ। শরতের মৃদু হাওয়া যেন প্রতিটি হৃদয়ে ভালোবাসার সৃষ্টি করছে।
তনয় বসে আছে নৌকায় আর এক হাত দিয়ে ধরে আছে তার বউকে যে এখন নৌকা থেকে নদীর পানিতে হাত ডুবাতে ব্যস্ত। তানহা ভয়ও পাচ্ছে কিন্তু হাতও ডুবাচ্ছে। অদ্ভুত এক ভরসার বন্ধন গড়ে উঠেছে তার তনয়ের সাথে। হিসাব করলে তাদের পরিচয় হয়েছে মাত্র তিনদিন। কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই আমাদের জীবনে অল্প সময়েই কিছু মানুষের উপর চোখ বুজে আস্থা করা যায়, তানহার জীবনে তনয় সেইরকম একজন।
পানি নিয়ে খেলতে খেলতে তানহা শুনতে পেলো তনয় গুনগুন করে গান গাচ্ছে।
-এই যে শুনছেন
-হ্যা বলো।
-একটু জোরে গাইলে কি এমন হবে??
-আরে,,তুমি শুনতে পেয়েছো?
– হ্যাঁ। আমি শুনতে চাচ্ছি গানটা। আপনি একটু জোরে গান প্লিজ! (হেসে)
– এই হাসি দিয়ে অনুরোধ করলে ফেলতে পারি কি কিরে বলো? (চোখ টিপে)
,
,
,
চলবে…