চন্দ্রাবতী আসছে ! Part- 06
আমি বাসায় যাওয়ার পর হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার পেট থেকে একটা আওয়াজ আসছে।আমি স্পষ্ট শুনতে পারছিলাম আমাকে কেউ বলছে মা সাবধানে।ঠিক এ মুহুর্তে আমি খেয়াল করলাম সামনে পানি পড়ে আছে আর আমার পিছলে যাওয়ার সম্ভবনা ছিল।আমি বেশ অবাক হলাম এটা ভেবে যে, তার মানে আমার পেটের বাচ্চাটা সব জানে কি হচ্ছে না হচ্ছে।
একের পর এক দিন কাটতে লাগল।চন্দ্রাবতীকে এবার কেন জানি না নিজের মেয়ের মত মনে হতে লাগল।মনে হতে লাগল মাতৃত্বের সুখটা পেয়েছি।এ মাতৃত্বের সুখের জন্য কত কাল অপেক্ষা করেছি।সৃষ্টিকর্তা আজকে যেন আমার সব ইচ্ছা পূরণ করেছে।চন্দ্রাবতীর সাথে মাঝে মাঝে একা একা কথা বলতাম মনে হত সে আমার সব কথা বুঝছে।আমার কথার জাবাব দিচ্ছে।মাঝে মাঝে বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলেও আমি আর অরন্য সেটা ঠিক করে নিতাম।চন্দ্রাবতীকে এখন আমার নিজের মেয়েই মনে হয়।মনে হয় চন্দ্রাবতী কোন অসাধারণ মেয়ে না,চন্দ্রাবতী আমার মেয়ে।দিনের পর দিন কাটতে লাগল আর চন্দ্রাবতীর প্রতি মায়া বাড়তে লাগল।
দেখতে দেখতে সাতটা মাস কেটে গেল।হুট করে আমি আমার পেটে প্রবল ব্যাথা অণুভব করতে লাগলাম।অরন্য তখন অফিসে ছিল।আমি এখন কি করব বুঝতে পারছিলাম না।অরন্যকে ফোন দিয়ে বললাম
-অরন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাড়াতাড়ি বাসায় আস।
অরন্য বেশ চিন্তিত হয়ে জাবাব দিয়ে বলল
-তুমি ডাক্তার সায়মাকে কল দাও আমি যত তাড়াতাড়ি পারছি আসতেছি।
আমি অরন্যের ফোনটা কেটে ডাক্তার সায়মাকে কল দিলাম।ডাক্তার সায়মাকে বললাম
-আমার পেটে খুব ব্যাথা হচ্ছে আপনি একটু আসুন
ডাক্তার সাময়া আমাকে বললেন
-আমি আসতেছি আপনি চিন্তা করবেন না।
আমি ফোন টা কেটে ব্যাথায় চিল্লাতে লাগলাম।চারদিকে খেয়াল করলাম প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে।অরন্য আমাকে কল দিয়ে বলল
-অধরা তুমি ঠিক আছ তো।
আমি ব্যাথায় অরন্যের কথার জবাব ও যেন ঠিক করে দিতে পারছিলাম না।শুধু বললাম
-আমার কষ্ট হচ্ছে খুব তুমি বাসায় আস।
অরন্য আমাকে বেশ চিন্তিত হয়ে বলল
-একটু ধৈর্য ধর অধরা। চারদিকে খুব ঝড় হচ্ছে।বের হওয়ার মত কোন উপায় পাচ্ছি না।কি করব আমি বুঝতেছি না।তুমি চিন্তা কর না আমি যেভাবে পারছি আসতেছি।
এ বলে অরন্য ফোনটা কেটে দিল।আমি কি করব কিছুই যেন বুঝতে পারছি না।ডাক্তার সায়মাকে ফোন দিতে লাগলাম।কোন ভাবেই উনার ফোনে কল ডুকছিল না।প্রতিবারেই উনার ফোন থেকে নট রিচেবল আওয়াজটা আসছে।আমি এবার বেশ হতাশ হয়ে গেলাম কি করব বুঝতে পারছিলাম না।ব্যাথায় আমি কুকড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলাম।ব্যাথার চুটে আমি ফ্লোরে পড়ে এপাশ ওপাশ হতে লাগলাম।কোনভাবেই ব্যাথা আমার কমছিল না।
বাইরে খেয়াল করে দেখলাম চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে।ঝড়ে যেন গাছপালা সব উপড়ে যাচ্ছে।অরন্য এবং ডাক্তার সায়মা কারও কাছেই ফোন ঢুকছে না।এবার নিজেকে অনেক অসহায় মনে হতে লাগল।ব্যাথায় আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে লাগল।ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে আমি ঘরের সমস্ত জিনিস উলট পালট করতে লাগলাম।আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলাম।আমার মনে হচ্ছে এবার আমার পাশে কেউ বসে আছে।বুঝতে পারছি না কে বসে আছে।আস্তে আস্তে আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল।কখন যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম টের পাই নি।
জ্ঞান ফিরার পর খেয়াল করলাম।চারদিকে সব আলোকিত হয়ে গিয়েছে।ঝড় ও কমে গিয়েছে।আর আমার পেটের ব্যাথাটা ও কমে গিয়েছে।পেটে হাত দিয়ে দেখলাম পেট টা আর ফুলা নেই।তার মানে চন্দ্রাবতী জন্ম নিয়েছে।কিন্তু চন্দ্রাবতী কোথায়?কোথাও তো বাচ্চার কান্নার শব্দ পাচ্ছি না।বুকের ভিতর টা হুহু করতে লাগল চন্দ্রাবতীকে দেখার জন্য।হুট করে মাথার কাছে কিছু একটার স্পর্শ অণুভব করতে লাগলাম।মাথার কাছে চোখ ফিরিয়ে যা দেখলাম।তা দেখে মাথাটা যেন আরও ঘুরিয়ে গেল।এ তো সেই মোমের পুতুলটার মত দেখতে যে পুতুলটা আমি স্বপ্নে বারবার দেখেছি।আর সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি এটা দেখে যে একটা সাতমাসে সদ্য জন্ম নেওয়া নবজাতক বসে আছে।আমার মাথাটা আস্তে আস্তে আস্তে ঘুরতে লাগল।আবার কখন জ্ঞান হারালাম বুঝতে পারলাম না।
২য় বার জ্ঞান ফিরার পর খেয়াল করলাম আমার পাশে ডাক্তার সায়মা আর অরন্য বসে আছে।আমি অরন্য আর ডাক্তার সায়মাকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলাম।মনে হল মনের জোরটা আমার বেড়ে গিয়েছে।পাশে খেয়াল করে দেখলাম চন্দ্রাবতী শুয়ে আছে।মনটা বেশ প্রশান্ত হল চন্দ্রাবতীকে এভাবে দেখে।আমি অরন্যকে কাছে পেয়ে অরন্যের হাতটা ধরে বললাম
-চন্দ্রাবতীকে আমি যখন প্রথম দেখেছিলাম তখন দেখেছিলাম চন্দ্রাবতী পাশে বসে আছে।এরকম কেন হয়েছে অরন্য?
অরন্য একটু শান্ত হয়ে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল
-অধরা আমি জানি তুমি চন্দ্রাবতীকে নিজের মেয়ের মত ভাবতে শুরু করেছে।বাস্তবতা যত কঠিনেই হোক তোমাকে এটা মেনে নিতেই হবে যে চন্দ্রাবতী কোন সাধারণ মেয়ে না।এটা একটা অতৃপ্ত আত্না।আর চন্দ্রাবতীর এরকম বসে থাকাটা তো তোমাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিতে হবে অধরা।অধরা আপাদত সাতদিন এ বাসা থেকে আমরা কেউ এই বের হতে পারব না।
আমি কিছুটা অবাক হয়ে অরন্যকে বললাম
-বাসা থেকে বের হতে পারব না কেন?
-কারন প্রফেসর বিশ্বাস নিষেধ করেছে।এতে পরিস্থিতি হিতে বিপরীত হতে পারে।
-আচ্ছা তা ঠিক আছে।কিন্তু ডাক্তার সায়মা কোথায় থাকবে।
ডাক্তার সায়মা বলল
-আমাকে নিয়ে আপনাদের টেনশন করতে হবে না।
পাশ থেকে অরন্য বলে উঠল
-উনাকে পাশের রুমটাই থাকতে দিলেই হবে।আপাদত তুমি কিছু খেয়ে নাও অনেকক্ষণ যাবৎ কিছু খাও না।
আমি একটু স্বস্তি নিয়ে বললাম
-কিন্তু চন্দ্রাবতী কি খাবে?
অরন্য হতাশ হয়ে বলল
-রক্ত।
অরন্যের এরকম জবাব শুনে আমি বেশ চমকে গেলাম।আর অরন্যকে জিজ্ঞেস করলাম
-রক্ত খাবে মানে?
-হ্যা চন্দ্রাবতী জন্ম নিয়েছে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ও কোন সাধারন মেয়ে না এটা কেন ভুলে যাও অধরা।ওকে ওর মত থাকতে দাও।
পাশ থেকে চন্দ্রাবতী জবাব দিয়ে বলল
-আমাকে আমার মত থাকতে দাও মা।আমাকে বিরক্ত কর না।
সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চার মুখে এমন জবাব শুনে আমি চমকে গেলাম।কিন্তু চমকে গেলেই বা কি? সত্যি তো এটাই ও কোন মানুষ না।কিন্তু এতদিন পেটে নিয়ে ওকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি আমি।একটা মায়া ওর প্রতি আমার কাজ করে।কিন্তু বাস্তবতা এটাই ও আমার মেয়ে না।ও একটা আত্না।
আমি উঠে কিছু খেয়ে নিলাম।একদিন পার করলাম।পরদিন খেয়াল করলাম চন্দ্রবতী হাঁটছে আর হেঁটে অরন্যের কাছে এসে অরন্যে দিকে তেড়ে আসছে।অরন্যকে আঘাত করতে থাকল।আমি চন্দ্রবতীকে ধরলাম।সাথে সাথে চন্দ্রাবতী বেশ শান্ত হয়ে গেল।
সাতটা দিন আমাদের এ বাসার ভিতর পার করতে হবে।জানি না এ সাতটা দিনে আর কি কি ঘটবে।আজকে সারাদিন আমি খেয়াল করলাম চন্দ্রাবতী বারবার অরন্যের দিকে তেড়ে যাচ্ছিল।এর কারন আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
সারাটাদিন এভাবে পার করলাম।রাত ৩ টায় খেয়াল করলাম ডাক্তায় সায়মা দরজায় নক করছে।আমি আর অরন্য তারাতাড়ি গিয়ে দরজা খুললাম।খেয়াল করলাম ডাক্তার সায়মা বেশ ভয় পেয়ে আমাদের বলছে
-চন্দ্রাবতী।
নামটা বলেই চুপ হয়ে গেল।আমি জিজ্ঞেস করলাম
-চন্দ্রাবতী কি করেছে?
-ঐ যে দেখ চন্দ্রাবতী।চন্দ্রাবতীকে দেখে মনে হচ্ছে সাত বছরের একটা বাচ্চা।ওর কাছে যেতেই ওর চোখ গুলা কেমন জানি ঝলসে যাচ্ছিল।
ডাক্তার সায়মার কথা গুলো শুনে আমি আর অরন্য চন্দ্রাবতীর কাছে গেলাম।গিয়ে দেখলাম চন্দ্রাবতী দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে আর ওকে দেখে সাত বছরের বাচ্চার মত লাগছে।আর অরন্যকে দেখেই অরন্যের দিকে তেড়ে এসে হাতে কামড় দিয়ে বসল।আমি চন্দ্রাবতীকে ধরে সরাতে নিলাম।সাথে সাথে চন্দ্রাবতী আমার স্পর্শ পেয়ে শান্ত হয়ে গেল।
একের পর এক কাহিনী একের পর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মধ্য দিয়ে সাতটা দিন পার করলাম আমরা।সাতটা দিনে শুধু এটাই খেয়াল করলাম চন্দ্রাবতী অরন্যেকে বারবার আঘাত করতে চেয়েছে।আমি,অরন্য আর ডাক্তার সায়মা এর কারন বুঝতে পারছিলাম না।অপরদিকে সাতদিনে চন্দ্রাবতীকে এখন দেখলে মনে হয় সে এক ১২ বছরের কন্যা।আমরা সময় নষ্ট না করেই প্রফেসর বিশ্বাসের কাছে গেলাম।
গিয়ে দেখলাম প্রফেসর বিশ্বাস সেই আগের মতই চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে।আর আমাকে দেখে বলছে
-আরে মিসেস অধরা। তা আপনার মেয়ে তো দেখি অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।
আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে জবাব দিলাম
-হেয়ালি না করলে কি আপনার ভালো লাগেনা?
হুট করে পাশ থেকে চন্দ্রাবতী বলে উঠল
-আমার কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।তাহলে আপনাকেও আমি ছাড়ব না প্রফেসর বিশ্বাস
প্রফেসর বিশ্বাস হেসে বলল
-আমি কেন তোমার কাজে বাধা দিব।আমি বরং তোমাকে সাহায্য করব বোকা।
খেয়াল করলাম চন্দ্রাবতী এবার বেশ খুশি।ঠিক এ মুহুর্তে প্রফেসর বিশ্বাস কি একটা যেন চন্দ্রাবতীর নাকে ধরল আর চন্দ্রাবতী নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল।
আমি তখন প্রফেসর বিশ্বাসকে সাতদিনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা বললাম।প্রফেসর বিশ্বাস এবার আমাদের বসিয়ে আগের মত পাশের রুমটাই গেলেন আর কিছুক্ষন পর ফেরত আসলেন।আর বললেন…