#প্রেমাতাল পর্ব ৪২ (শেষ)
লেখা- মৌরি মরিয়ম
ড্রইং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে তিতির দেখলো বাবা খবরের কাগজ পড়ছে। তিতির বাবার সামনে গিয়ে ফ্লোরে বসলো। বাবা কাগজ থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,
-“কিছু বলবি মা?”
তিতির কখনো এভাবে একা বাবার সামনে বসে সরাসরি মুগ্ধর ব্যাপারে কথা বলেনি। কিভাবে বলবে? লজ্জা লাগছে, আর ভয়ও করছে। ডাক্তার বলেছিল বাবাকে সাবধানে রাখতে হবে। ওনার হার্ট অনেক দূর্বল। ওর অনেক আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝেই বাবা ওর দিকে তাকালো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হয়েছে তোর? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?”
তিতির অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে অবশেষে বলেই ফেলল,
-“বাবা, আজকে মুগ্ধর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।”
বাবা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়ের দিকে। বাবা কিছু বলার আগেই তিতির কেঁদে ফেলল। বলল,
-“বাবা, প্লিজ কিছু একটা করো। আজও তোমরা মেনে নিলে ও বিয়েটা করবে না। শুধু আমাকে পাবার মিথ্যে আশায় ও এতবছর অপেক্ষা করেছে। কিন্তু এখন ওর মায়ের চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতে রাজী হয়েছে। আমি ও ছাড়া আর কারো সাথে সুখী হবো না বাবা। ওর কিছু দিক হয়তো খারাপ কিন্তু অনেক দিক দিয়েই আবার ভাল। সব মানুষ তো সব দিক দিয়ে ভাল হয়না বাবা। খারাপ-ভাল মিলিয়েই তো মানুষ। ও খারাপ হোক কি ভাল ও ম্যজিক জানে বাবা। যতদিন আমার ওর সাথে সম্পর্ক ছিল ও সেই ম্যাজিক দিয়েই আমাকে ভাল রেখেছে। আজ পর্যন্ত কোনদিন ও আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি।”
বাবা চুপ। তিতির কাঁদতে কাঁদতেই আবার বলল,
-“ওর অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়ে গেলে আমি সহ্য করতে পারবো না বাবা। মাকে আমি সকালবেলাই বলেছিলাম। মা বুঝলোই না। তোমরা আমাকে বোঝ না কেন বাবা? আমার যে খুব কষ্ট হয় বাবা। ও ছাড়া আমার জীবনটা অন্ধকার। বাবা প্লিজ কিছু একটা করো। ছোটবেলা থেকে কোনদিন তোমার অবাধ্য হইনি বাবা, আজও পারবো না। তুমিই কিছু করো বাবা প্লিজ প্লিজ প্লিজ। তুমি আমাকে পারমিশন দাও ওর কাছে যাওয়ার। দুনিয়ার আর কারোর পারমিশনের দরকার নেই আমার।”
তিতির বাবার পা জড়িয়ে ধরলো। বাবা তিয়িরকে উঠিয়ে পাশে বসিয়ে বলল,
-“দেখ মা, আমি বুঝতে পারছি কিন্তু ব্যাপারটা এতই ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে যে তোর সাথে মুগ্ধর সম্পর্কটা আর সম্ভবই না। তান্নার সাথে মুগ্ধর যেটা হয়েছে সে ইস্যুটা ছোট ছিল কিন্তু খুব খারাপ একটা ইন্সিডেন্ট ছিল। ওরা কখনোই স্বাভাবিক আচরণ করতে পারবে না। অনেকবার ভেবেছি তোর মুখ চেয়ে মেনে নেব কিন্তু তোর মা এবং আমিও মুগ্ধকে মন থেকে মানতে পারি না। বিয়ে তো শুধু দুটো মানুষের না। দুটো ফ্যামিলিরও। এই বিয়ে নামক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়েই দুটি অপরিচিত ফ্যামিলি ঘনিষ্ঠ হয়। মুগ্ধর সাথে বিয়ে হলে তোর সাথে আমাদের দূরত্ব বাড়তে থাকবে। কারন, আমাদের দুই ফ্যামিলির ঘনিষ্ঠ হওয়াটা অসম্ভব। সুহাস অনেক ভাল ছেলে মা, আর তোকে খুব ভালওবাসে। তুই সুখী হবি দেখিস, ও তোকে এত সুখে রাখবে যে আজকের কথা ভেবে তুই তখন হাসবি আর ভাববি কত ছেলেমানুষিই না করেছি! সময় সব ঠিক করে দেয় মা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তিতির শেষ আশাটাও ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে থাকলো।
ভাবী ড্রইং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
-“বাবা আসব?”
-“আমরা একটু ইম্পরট্যান্ট কথা বলছি। তুমি পরে আসো মা।”
-“বাবা আমার মুগ্ধ ভাইয়া আর তিতিরের ব্যাপারেই কিছু বলার ছিল।”
বাবা, তিতির দুজনেই চমকে তাকালো। বাবা বলল,
-“এসো।”
ভাবী বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-“বাবা এতদিন আমি ভয়ে চুপ করে ছিলাম, কিন্তু আজও যদি চুপ করে থাকি তাহলে তো আমি মানুষের কাতারেই পড়বো না।”
বাবা বলল,
-“কি বলতে চাচ্ছো বলো।”
-“বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে আপনি, মা আর তিতির কখনো আমাকে বুঝতে দেননি আমি শ্বশুরবাড়িতে আছি। আপনাদের আদরে আদরে এতটা বছর কাটিয়েছি, যথেষ্ঠ শ্রদ্ধাও করি আপনাদেরকে। সেই শ্রদ্ধা বজায় রেখেই কথাগুলো বলছি, বেয়াদবি হলে ক্ষমা করবেন।”
-“আহা বলবে তো কি কথা?”
-“তিতিরের যায়গায় যদি আমি থাকতাম তাহলে ফ্যামিলিকে রাজী করানোর জন্য আমি আরো অনেক আগেই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতাম, সুইসাইড এটেম্পট নিতাম নাহলে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলতাম। শুধু আমি না বাবা, আজকালকার যেকোন মেয়ে হলে এটাই করতো। কিন্তু বাবা তিতির এসব লেইম উপায় বেছে নেয়নি। কেন জানেন? ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে আপনারা কষ্ট পেতেন। সুইসাইড এটেম্পট নিলে আরো বেশি কষ্ট পেতেন, সাথে মুগ্ধ ভাইয়াও কষ্ট পেত। তাই ও এসব না করে নিজে শত কষ্ট সহ্য করে ৩/৪ বছর ধরে শুধু আপনাদেরকে রাজী করানোর চেষ্টাই করছে। হ্যা, একবার চলে গিয়েছিল, অন্য কোন মেয়ে হলে আরো অনেক আগে যেত। তারপরও সেটা তো পালিয়ে যাওয়া না বাবা। ও বলেই গিয়েছে আর জ্বরের ঘোরে গিয়েছিল। সুস্থ্য থাকলে ও কখনোই যেত না। আপনার অসুস্থতার খবর পেয়ে তো ঠিকই সব ছেড়ে চলে এসেছে। কিন্তু বাবা আপনারা কি একটা বারও গভীর রাতে তিতিরের ঘরে গিয়ে খোঁজ করেছেন মেয়েটা কি করছে? গত ৩/৪ বছর ধরে তো আমি ওকে একটা রাতও ঠিকভাবে ঘুমাতে দেখিনি। রাত ৪/৫ টায় ঘুমিয়েছে আবার ৯ টায় অফিসে গিয়েছে। এসব কিছুই কি এক্টাবারের জন্যও আপনাদের চোখে পড়েনি? জানি বাবা ওর সুখের জন্যই সব করছেন কিন্তু ও তো সুখে নেই বাবা। সব একদিন ঠিক হয়ে যাবে সত্যি, কিন্তু যেটা আজই ঠিক করা যাবে সেটা কোন অজানা একদিনের জন্য কেন ফেলে রাখবেন? জানি তিতির আজও সব মেনে নেবে চুপচাপ। কিন্তু একবার ভাবুন তো বাবা সুহাস ভাইয়ের সাথে বিয়ের দিন যদি ও সুইসাইড করে? কি করবেন মেয়ের লাশটা নিয়ে?”
বাবা চিৎকার করে উঠলো,
-“থামো। আর বলোনা।”
তারপর তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আমার মেয়ে এসব করবে না।”
তিতির কেঁদে চলেছে। ভাবী বলল,
-“হ্যা বাবা, ও এসব করবে না আপনি সেটা জানেন। কারন ও অনেক স্ট্রং একটা মেয়ে। তাই আপনারা ওর ইচ্ছেটা মাটিচাপা দিয়ে আপনাদের ইচ্ছেটাকে ওর উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। কেন বাবা? স্ট্রং মানুষদের কি কষ্ট হয়না? হয় বাবা হয়, দূর্বলদের যতটা কষ্ট হয় স্ট্রং মানুষদেরও ঠিক একই কষ্ট হয়। মানুষ বুঝতে পারে না কারন, দূর্বলরা কষ্টটা দেখাতে পারে.. স্ট্রং রা পারে না। একটু আগে ওর লাশের কথা শুনে আপনি আঁৎকে উঠলেন কিন্তু বাবা ও তো অলরেডি লাশ হয়েই আছে, জীবিত লাশ। সেটা কি আপনাদের চোখে পড়ছে না? আমি প্রথম থেকেই এসব দেখছি বাবা, কিন্তু আপনার ছেলের ভয়ে কিছু বলতে পারিনি।”
-“তিতিরের কষ্টটা আমি বুঝতে পারি মা। ও মুগ্ধকে অন্ধভাবে ভালবাসে কিন্তু মুগ্ধর মধ্যে ভেজাল আছে। ওর এই কষ্ট আমি সহ্য করতেও পারবো কিন্তু সারাজীবনের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না। সারাজীবন আমি থাকবো না তাই ভাল একটা ছেলের সাথে ওর জীবনটা বেধে রেখে যেতে চাই। তাহলে নিশ্চিন্তে মরতে পারবো।”
ভাবী তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে ফুটিয়ে বলল,
-“বাবা, একটা কথা না বলেই আপনাকে আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি বলতেই হচ্ছে। হয়তো আমার ঘর ভাঙবে। কি আছে কপালে কে জানে কিন্তু আজ আমি বলবো। আপনার সোনার টুকরো ছেলেকে আপনি যা দেখেন সে আদৌ তা না। তার অনেকগুলো রূপ আছে বাবা। ফ্রেন্ডদের সাথে তার এক রূপ, আপনাদের সামনে আরেকরূপ, আমার সাথে আবার আরেক রূপ। অনেকগুলো মুখোশ তার, যখন যেটা দরকার চুপটি করে পালটে নেয়। বোঝা যায়না কারন, সবগুলো মুখোশের তো একই চেহারা।”
বাবা গর্জে উঠলো,
-“বৌমা, কি বলছ তুমি এসব?”
-“আমি ঠিক বলছি বাবা। শুরু যখন করেছি সব বলব আজ। আপনার ছেলে যা বলল আপনি বিশ্বাস করে নিলেন। একবার নিজে মুগ্ধ ভাইয়ার ব্যাপারে খোঁজ নিতে কি পারতেন না বাবা? নেননি কারন, আপনার ছেলের উপর আপনার অগাধ বিশ্বাস। আপনার ছেলে আপনার বিশ্বাসের মান রাখেনি। সে মুগ্ধ ভাইয়ার সম্পর্কে যত আজেবাজে কথা এসে বলেছে সব বিশ্বাস করেছেন, তিতিরের কাছেও জানতে চাননি। মুগ্ধ ভাইয়া আপনার ছেলেকে মেরেছে, গালি দিয়েছে.. কিন্তু বাবা আপনার ছেলেকে মুগ্ধ ভাইয়া কেন মারলো? আপনার ছেলে আপনাকে পুরো ঘটনাটা বলেছে নিজের আকামের অংশটা হাইড করে। শুধু শুধু কেউ কাউকে এতটা মারে না বাবা। আপনার ব্যাপারটা তলিয়ে দেখা উচিৎ ছিল। আমি জানি আপনার ছেলে আপনাকে ভাইয়ার ব্যাপারে আরো অনেক কথাই বানিয়ে বলেছে। সেসব কথা তিতিরের সামনে আমি আর বলতে চাচ্ছি না। কিন্তু আপনি তো জানেন বাবা, আপনি যা জানেন তার সব মিথ্যে। ভাবছেন এতকিছু আমি কিভাবে জানি? আপনার ছেলে নিজেই কলার ঝুলিয়ে আমাকে বলেছে, ‘দেখেছো বাবা মা আমকে কতটা বিশ্বাস করে? এবার দেখবো শালা মুগ্ধ কিভাবে জেতে।’ সে মুগ্ধ ভাইয়াকে নিজের শত্রু ভাবে। নিজের ইগো বাঁচাতে সে মুগ্ধ ভাইয়াকে আপনার কাছে খারাপ করেছে। মুগ্ধ ভাইয়া আজ এত উপরে উঠেছে, এত উন্নতি করেছে এটাও আপনার ছেলের চক্ষুশূল। তিতিরকে বিয়ে করতে পারলে নাকি মুগ্ধ ভাইয়ার কাছে ও হেরে যাবে। কিন্তু বাবা এটা কোন ধরণের একতরফা প্রতিযোগিতায় নেমেছে আপনার ছেলে? এতদিন আমি ভয়ে কিছু বলতে পারিনি বাবা আমার সংসার বাঁচানোর জন্য। আজ আর এই সংসারের প্রতি আমার কোন টান নেই। আপনার ছেলের মত নরপশুর সাথে থাকতে এখন আমার গা ঘিনঘিন করে। কেন নরপশু বললাম জানেন বাবা? কারন আমার তিন তিনটা সন্তান সে পৃথিবীতে আসার আগেই মেরে ফেলেছে। বাবা না হওয়ার পেছনে কি সব অদ্ভুত যুক্তি তার আমি আপনাকে তা বলতেও পারবো না।”
শেষের কথাগুলো বলতে বলতে ভাবী কেঁদে ফেলল। বাবা ভেঙে পড়লেন। বললেন,
-“তুমি আমাকে আগে এসব কেন বলোনি?”
ভাবী বলল,
-“এসব কথা আজ থাক বাবা, যারা শেষ তারা শেষ কিন্তু যে আছে তাকে বাঁচান। প্লিজ বাবা তিতিরকে মুগ্ধ ভাইয়ার সাথে বিয়ে দিন। অনুমতি দিন বাবা ও ফোন করে মুগ্ধ ভাইয়ার বিয়েটা বন্ধ করুক।”
-“কিন্তু ওর তো সুহাসের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। সুহাসের ফ্যামিলি কে কি বলবো এখন?”
-“বাবা সেটা ইম্পরট্যান্ট না। এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে বিয়ে তো আর হয়ে যায়নি। তাছাড়া তিতিরের সুখটা এখন আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্ট। অনেকগুলো ভুল হয়ে গিয়েছে বাবা, আর কোন ভুল হতে দিয়েন না। হাতজোর করছি আমি মুগ্ধ ভাইয়ার সাথে তিতিরের বিয়ে দিন।”
ভাবীর কথা শেষ হতে না হতেই তান্না ঘরে ঢুকলো। শুধু শেষের কথটাই শুনেছে ও। ওইটুকু শুনেই ভাবীর গালে আচমকা একটা চড় মেরে চুলের গোছা ধরে বলল,
-“ঘরের শত্রু বিভীষণ না? আজকে তোর খবর আছে তোর।”
বাবা তান্নাকে বলল,
-“তান্না, ওকে ছাড়ো।”
-“না বাবা, ওর সাহস হয় কি করে আমার বোনের ব্যাপারে কথা বলার?”
-“কে তোমার বোন?”
তান্না অবাক হয়ে বউকে ছেরে বাবার সামনে এসে বলল,
-“কি বলছো বাবা? আর কে তিতির আমার বোন।”
-“নাহ, তিতির তোমার বোন না। তিতির আমার মেয়ে। আর তুমি আজ থেকে আমাকে আর বাবা বলে ডাকবে না।”
তান্না বলল,
-“বাবা! কি হলো তোমার?”
বাবা তান্নার কথার উত্তর না দিয়ে তিতিরকে বলল,
-“মা, তাড়াতাড়ি মুগ্ধকে ফোন করে বিয়েটা আটকা।”
তিতিরের খুশি হওয়ারও সময় নেই। দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে ফোন তুলে কল করলো। একি মুগ্ধর ফোন বন্ধ কেন? আবার ডায়াল করলো, বন্ধ। আবার ডায়াল করলো, এবারও বন্ধ। এভাবে ৫ বার ফোন করেও মুগ্ধকে না পেয়ে তিতির দৌড়ে ড্রইং রুমে গিয়ে কেঁদে ফেলল,
-“বাবা, মুগ্ধর ফোন বন্ধ। প্লিজ তুমি অনুমতি দাও, আমি ওর কাছে যাই। ওর কাজিনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে, ফুপাতো বোন। বিয়ে বাসাতেই হবে। ফুপীর বাসাও আমি চিনি। যাই বাবা?”
-“চল, আমিও যাব।”
তারপর চিৎকার কিরে বলল,
-“চম্পা, কই আছিস আমার পাঞ্জাবি আর ওয়ালেট টা ঘর থেকে নিয়ে আয় তো।”
তান্না বলল,
-“বাবা তুমি এতদূর যাবে? হার্ট এ্যাটাকের পর তো তুমি কোথাও যাও না।”
-“আমার ভুলের মাশুল দিতে আর আমার মেয়ের জীবন বাঁচাতে আজ আমাকে যেতে হবে। আর হ্যা, তুমি ভেবোনা তোমাকে আমি ছেড়ে দেব। তোমার সাথে বোঝাপড়াটা আমি এসে করবো। চল তিতির।”
তান্না বলল,
-“বাবা পাগলামি করোনা। আচ্ছা ঠিকাছে আমি তিতিরকে নিয়ে যাচ্ছি।”
বাবা বলল,
-“আমি তোমাকে বিশ্বাস করিনা।”
চম্পা বাবার পাঞ্জাবি আর ওয়ালেট নিয়ে হাজির। বাবা পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে তিতিরের হাত ধরে মেইন দরজার দিকে গেল। তিতির বলল,
-“বাবা, ভাইয়া ভাবীকে যদি কিছু করে। ভাবীকে নিয়ে চলো।”
বাবা ডাকলো,
-“বৌমা, বৌমা..”
ভাবী এসে বলল,
-“জ্বী বাবা?”
-“তুমি আমাদের সাথে চলো।”
-“আমি যাব! কিন্তু কেন?”
-“আগে চলো। এত কথা বলার সময় নেই এখন।”
ততক্ষণে মা বেড়িয়ে এল ঘর থেকে। বলল,
-“কি ব্যাপার? এত হইচই কিসের? চম্পা পাঞ্জাবি আনলো দেখলাম, কোথায় যাচ্ছো?”
বাবা বলল,
-“ফিরে এসে সব বলব।”
তান্নাও ড্রইং রুম থেকে বেড়িয়ে এল। বলল,
-“বাবা, তুমি যদি ওই হারামজাদার সাথে তিতিরের বিয়ে দাও তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।”
বাবা বলল,
-“আমি ফিরে এসে নিজেই তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেব।”
ট্যাক্সি খুব দ্রুত চলছে। তিতির অনবরত কাঁদছে আর ড্রাইভারকে আরো জোরে চালাতে বলছে। ভয়ে ওর আত্মা শুকিয়ে গিয়েছে। এতকিছুর পর বাবাকে রাজী করাতে পেরেছে এখন যদি যাওয়ার আগেই মুগ্ধ-ইকরার বিয়ে হয়ে যায়? উফফ মরেই যাবে তিতির। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“বাবা, যদি বিয়ে হয়ে যায়?”
-“কাঁদেনা মা, ও যদি তোর ভাগ্যে থাকে তাহলে বিয়ে হবে না। ধৈর্য ধর, আর আল্লাহকে ডাক। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
বাবার চোখেও জল দেখলো তিতির। খুব মায়া হলো বাবার জন্য। এতদিন ভাইয়া এইভাবে বাবাকে ভুল বুঝিয়ে এসেছে! ভাবীও কাঁদছে। তিতির মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো।
ইকরাদের বাসার সামনে গাড়ি থামতেই তিতির দৌড় দিল। বাবা ভাড়া মিটিয়ে পেছন পেছন এল। বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো তিতির। পা দুটো থরথর করে কাঁপছে। কে একজন এসে দরজা খুলে দিল। ভেতরে ঢুকতেই ড্রইং রুমে অনেক লোকজন দেখতে পেল তিতির। এত লোকজনের মধ্যে চেনা মানুষটি ওকে দেখেই চমকে উঠে দাঁড়াল। দূর থেকেই বলে উঠলো,
-“তিতির! তুমি?”
তিতির কোন কথা বলতে পারলো না। মুগ্ধ তিতিরের সামনে এসে দাঁড়াল। তিতির কাঁদতে কাঁদতে কোনরকমে জিজ্ঞেস করলো,
-“বিয়ে কি হয়ে গেছে?”
খুশিতে মুগ্ধর চোখে জল এল। হেসে জবাব দিল,
-“নাহ। কনে এখনো পার্লারে।”
তিতির-মুগ্ধ দুজনেই একসাথে হেসে উঠল। তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“ফোন বন্ধ কেন? জানো কতবার ফোন করেছি?”
-“ফোন তো রাগের চোটে ভেঙে ফেলেছি।”
ততক্ষণে তিতিরের বাবা আর ভাবীও চলে এল। তিতিরের বাবাকে দেখে মুগ্ধ অবাক হয়ে বলে উঠলো,
-“আঙ্কেল আপনি?”
বাবা বলল,
-“আমি তিতিরকে তোমার হাতে তুলে দিতে এসেছি।”
মুগ্ধ যে কি করে কৃতজ্ঞতা জানাবে বুঝতে পারলো না। মাথা কাজ করছে না এখন।
তিতিরকে দেখতে পেয়ে মুগ্ধর মা কাছে এল। অবাক হয়ে বলল,
-“তিতির তুমি কখন এলে? কি করে এলে? আর একি অবস্থা হয়েছে তোমার চেহারার?”
সাথে সাথেই তিতিরের বাবাকেও দেখতে পেল। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এল,
-“ভাই আপনি এখানে!”
বাবা হাতজোড় করে বললেন,
-“আপা, আমি নিজের ভুলের জন্য লজ্জিত। ছেলের কথা অন্ধভাবে বিশ্বাস করে আমি আমার মেয়েকেও কষ্ট দিয়েছি, আপনার ছেলেকেও। এই ভুলের শাস্তি আমার মেয়েটাকে দিয়েন না। দয়া করে আমার মেয়েকে আপনার ঘরের বউ করে নিন।”
মা হেসে বলল,
-“ছিঃ ছিঃ ভাই কি বলছেন এসব! যা হয়েছে তাতে আমার মনে হয়েছিল আপনারা ওদের সম্পর্কটা কখনোই মানবেন না। তাই আমি ছেলের বিয়ে দিচ্ছিলাম। ও সারাজীবন একা থাকবে এটা মানতে পারছিলাম না। যাই হোক, তিতির যখন এসেছে, তখন তো আর মুগ্ধর সাথে অন্য কারো সাথে বিয়ে দেয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। কিন্তু তার জন্য হয়তো আমার ননদের সাথে আমার সম্পর্ক সারাজীবনের জন্য নষ্ট হবে। হলে হোক, আমার ছেলের সুখ আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্ট।”
ইকরা বউ সেজে এসে এই অবস্থা দেখে অনেক চিল্লাপাল্লা করলো। তাই তিতির-মুগ্ধর বিয়ের বাকীসব কথাবার্তা মুগ্ধদের বাসায় গিয়ে হলো। ঠিক হলো যেহেতু পিউ আর তিতিরের মা উপস্থিত নেই সেহেতু বিয়ে আজ হবে না। তবে দেরীও করতে চাচ্ছে না কেউ। তাই বিয়ে হবে পরশুদিন। তাছাড়া সময় কম তবু একমাত্র মেয়ের বিয়ে উনি চুপিচুপি দিতে চান না। তিরিরের মায়েরও একই ইচ্ছা। তাই কাল সব আয়োজন করবে, পরশুদিন বিয়ে। রাত ১০ টার দিকে মুগ্ধ ওদেরকে পৌঁছে দিল। মুগ্ধর মা খুব জোরাজুরি করলো ডিনার করার জন্য। কিন্তু তিতিরের বাবার এক কথা, ‘মেয়ে বিয়ে দিয়েই এঘরে খাব। তার আগে না।’ মুগ্ধ পৌঁছে দিতে গেলে তিতিরের বাবা রিকোয়েস্ট করে ভেতরে যেতে। মুগ্ধ হেসে বলে,
-“নাহ, পরশু একেবারে জামাই হয়েই ঢুকবো।”
বাবা হেসে বলল,
-“আমার কথা আমাকেই ফেরত দেয়া হচ্ছে? আচ্ছা বাবা, তাই হবে।”
মুগ্ধ হাসলো। বাবা ভেতরে ঢুকে গেলেন। ভাবী ভেতরে ঢুকতে যাবে এমন সময় মুগ্ধ ডাকলো,
-“ভাবী..”
ভাবী ঘুরে তাকালো। মুগ্ধ বলল,
-“থ্যাংকস।”
-“কেন?”
-“বাবাকে রাজী করানোর জন্য।”
-“আপনি কি করে জানলেন?”
-“তোমার ননদ বলেছে।”
-“কখন বলল? সারাক্ষণ তো একসাথেই ছিলাম। ও তো আপনার সাথে কোন কথাই বলেনি।”
-“অনেক কথাই বলেছে। আমরা সবার সামনে দিয়েও কথা বলতে পারি যা সবাই শুনতে পায়না।”
-“বাহ, তা ভাল কিন্তু শুকনো থ্যাংকস দিলে হবে না। তোমাদের হানিমুনে আমাকে নিয়ে যেতে হবে।”
-“ওহ, এই ব্যাপার! অবশ্যই নিয়ে যাব। তখন কিন্তু না করলে শুনছি না। আর হানিমুনে গেলে কিন্তু বউয়ের চাকরী করতে হবে। তখনও না বললে মানবো না।”
তিতির হেসে ফেলল। ভাবী বলল,
-“এমা, আপনি কি অসভ্য।”
-“বারে! তাহলে তুমি বড় অসভ্য। তুমিই প্রথম যেতে চেয়েছো।”
-“না বাবা আমার যাওয়া লাগবে না, তাই বলে শুকনো থ্যাংকস ও নিচ্ছি না। পরে অন্যকিছু চেয়ে নেব।”
এই বলে ভাবী চলে গেল। মুগ্ধ চিৎকার করে বলল,
-“আইএম অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ।”
ভাবী চলে গেলেও তিতির গেল না। বলল,
-“শেষপর্যন্ত তোমাকে সাদা পাঞ্জাবিতে লাইভ দেখতে পারলাম। সত্যিই হিরো লাগছে।”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির আবার বলল,
-“সত্যিই কি আমাদের বিয়ে হচ্ছে?”
-“হুম, বেঁচে থাকলে আর আল্লাহ কপালে রাখলে হবে।”
-“তুমি আর কোনদিনও এভাবে কাঁদবে না প্লিজ।”
-“আরে, ছিঃ তুমি আবার সেই কথা মনে করিয়ে দিচ্ছো? লজ্জা লাগছে।”
-“লজ্জা ফজ্জা জানিনা। তোমার ওই কান্না আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। যদি আর ওভাবে কাঁদো, তোমাকে আমি এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক দিয়ে তালাক দিয়ে দেব।”
মুগ্ধ হেসে তিতিরের হাত ধরে বলল,
-“হাতে এত আঁচড়ের দাগ কিসের?”
-“আমি রাগের মাথায় খামচি দিয়েছিলাম।”
-“কেন? তোমাকে না বলেছিলাম যাই হয়ে যাক, কখনো নিজের শরীরের ওপর রাগ দেখাবে না?”
-“সরি।”
-“পরশু রাতে সারা শরীরে দাগ বসাব দাঁড়াও।”
-“উফ, অসভ্য কোথাকার। আমি গেলাম।”
-“শোনো, আমার ফোন ভাঙা। যদিও কাল সকালে একটা ফোন কিনে নিব কিন্তু আজ রাতে আর কথা হবে না।”
-“প্রব্লেম নেই, পরশু থেকে তো আর ফোন লাগবে না, লাইভ কথা বলবো সারাক্ষণ।”
-“না রসগোল্লা। সারাক্ষণ পারবো না কারন সারাদিন আমার অফিস থাকবে।”
-“জানি। সারাক্ষণ বলতে রাতে।”
-“রাতে তো অন্য কাজ থাকবে। কত যুদ্ধের পর তোমাকে পেতে যাচ্ছি, কথার চেয়ে কাজই বেশি হবে।”
তিতির লজ্জা পেয়ে বলল,
-“গেলাম, টাটা।”
রাতের বেলা মুগ্ধ খুব আফসোস করতে লাগলো ফোনটা ভাঙার জন্য। মুগ্ধ বাসায় ফিরতে ফিরতে মা ঘুমিয়ে পড়েছে, সারাদিন যা ধকল গেল! আর স্নিগ্ধর কাছেও ফোন চাওয়া যাবে না। কারন, মরে গেলেও ও এই রাতের বেলা ফোন দেবে না। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে কেটে গেল মুগ্ধর সারাটা রাত। ওদিকে আজ বিছানায় শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমে তলিয়ে গেল তিতির। এত নিশ্চিন্তে বহুদিন ঘুমায়নি তিতির।
বিয়ের দিন সকাল সকাল মুগ্ধর বাসা থেকে লোকজন এল তিতিরকে হলুদ দিতে। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো পিউ ৮ মাসের বেবি পেটে নিয়ে চলে এসেছে হলুদ দিতে। পিউ এসেই তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“উফ, ভাবী কি যে শান্তি লাগছে। ইকরাপুর সাথে ভাইয়ার বিয়েটা আমি মানতেই পারছিলাম না, তাই যাইনি। শেষপর্যন্ত তোমার সাথে বিয়ে হচ্ছে শুনে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না।”
-“তুমি এসেছো, কি যে ভাল লাগছে আমার।”
তারপর তিতির পিউয়ের পেটে হাত রেখে বলল,
-“ইশ রে, আমার পিউ বাবুটার আবার একটা বাবু হবে।”
পিউ হেসে বলল,
-“কয়েকদিন পর তোমারও হবে।”
তিতির লজ্জা পেয়ে হাসলো। পিউ বলল,
-“কেমন জানি ফিলিংস ভাবী। একদম ডিফ্রেন্ট।”
সন্ধ্যাবেলায় মুগ্ধ-তিতিরের বিয়ে হয়ে গেল। কবুল বলতে বলার সাথে সাথে মুগ্ধ এক নিশ্বাসে কবুল কবুল কবুল বলে নিজেই হেসে দিল। আশেপাশের সবাইও হাসলো। ওদিকে তিতিরকে কবুল বলতে বললেও প্রায় কাছাকাছি অবস্থা হলো। যতই প্রেমের বিয়ে হোক, সাধারণত মেয়েরা তো চুপ করেই থাকে.. মুরুব্বিরা অনেক বার কবুল বলতে বলার পর কনে কবুল বলে। কিন্তু তিতিরকে কাজী কবুল বলতে বলার সাথে সাথেই বলল, ‘কবুল’ কাজী আবার বলল, ‘আরেকবার বলুন মা’
তিতির সাথে সাথেই আবার বলল, ‘কবুল’। তৃতীয়বারও একই ঘটনা ঘটলো।
তান্না অনিচ্ছাসত্ত্বেও সব হাসিমুখে করছে। বাবার কথা না মানলে তো ত্যাজ্যপুত্র করবে। গাড়িতে ওঠার সময় তিতির আর ওর মা জড়িয়ে ধরে এমনভাবে কাঁদছিল যেন ওকে জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে, আর জীবনেও ওদের সাথে দেখা হবে না। বাবাও কাঁদছিল, তান্না আর ভাবীও কাঁদছিল। গাড়িতে উঠে মুগ্ধ তিতিরের কানে ফিসফিস করে বলল,
-“এমনভাবে কাঁদছিলে যেন আমি তোমাকে খুন করতে নিয়ে যাচ্ছি। আমার অপরাধবোধ হচ্ছিল খুব।”
-“তুমি বুঝবে না। আমি নিজেও বুঝতে পারছি না কেন এমন হলো। আমি তো এই দিনটার জন্যই কত কি করলাম। আর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরই আমি এত কান্নাকাটি করলাম!”
-“কি বললে? বিয়ে হয়ে গিয়েছে? বাহ আসলেই তো আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। খেয়ালই ছিলনা আমার।”
তিতির হাসলো। স্নিগ্ধ, মুগ্ধ আর তিতির বসেছে পেছনের সিটে। সামনে পিউ, ড্রাইভ করছে ওর বর। স্নিগ্ধ সিওসিতে এ্যাটাক দিতে ব্যস্ত। মুগ্ধ চুপিচুপি তিতিরের কোমরে হাত দিয়ে হালকা একটু চাপ দিয়ে একদম নিজের কাছে নিয়ে এল। কানে কানে বলল,
-“ও বউ, আজকে থেকে তো তুমি আমার সত্যি সত্যি বউ। ভাবতেই কেমন যেন লাগছে।”
তিতির তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধরও পলক পড়ছে না। তিতিরকে এই প্রথম এত সাজে দেখছে, ব্রাইডাল সাজ যেমন হয় তেমনই। লিপস্টিক ও আজ ভাল লাগছে মুগ্ধর। আবার কানে কানে বলল,
-“আজ তো তুমি শেষ।”
তিতিরও ফিসফিস করে বলল,
-“পাশে ভাইবোনরা আছে, একটু তো সামলে কথা বলো।”
-“ধুর এত সামলাসামলির কি আছে? আজ থেকে আমার সবকিছু বেসামাল।”
-“উফফ থামো তো।”
-“আচ্ছ রাতে দেখছি ব্যাপারটা, আপাতত থামলাম।”
বাসায় ফিরে যখন সবাই লিফটে উঠতে যাচ্ছিল তখন তিতিরকে টেনে ধরলো মুগ্ধ। তারপর আচমকাই তিতিরকে কোলে নিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। সব কাজিনরা হাততালি আর সিটি বাজিয়ে মুগ্ধকে উৎসাহ দিচ্ছিল। তিতির বলল,
-“তুমি আমাকে কোলে নিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠছো কেন?”
মুগ্ধ উঠতে উঠতে বলল,
-“যেদিন আমাদের সম্পর্ক হয়েছিল সেদিন বৃষ্টিতে তোমাকে কোলে নিইনি বলে তোমার মন খারাপ হয়েছিল তখন আমি তোমাকে বলেছিলাম যত উপর তলাতেই থাকিনা কেন বিয়ের দিন আমি তোমাকে কোলে করে সিড়ি দিয়ে ওঠাব।”
-“তুমি কি পাগল? ওটা কোন সিরিয়াস কথ ছিল নাকি? আমি এমনি ঘুমের তালে বলেছিলাম”
-“হুম সব সময়ের সব কথাই আমার কাছে সিরিয়াস ছিল, আছে, থাকবেও। আর তোমাকে উঠানো কোন ব্যাপার না।”
-“আগে ব্যাপার ছিল না, কারন আমি শুকনা ছিলাম, এখন তো মোটা হয়ে গেছি তোমার কষ্ট হচ্ছে।”
-“চুপ থাকোনা বাবা। চলেই তো আসছি।”
তিতির খুব খুব খুশি হলো, সাথে অবাকও হলো মুগ্ধ এতবছর আগের কথা এখনো মনে রেখে সেই মত কাজ করছে? ও এত ভাল কেন!
সবাই ড্রইং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। পিউ তিতিরকে নিয়ে মুগ্ধর ঘরে ঢুকলো। তিতিরের চুল খুলতে, মেকাপ উঠাতে হেল্প করলো। তারপর বলল,
-“যাও যাও ভাবী, গোসল করে আসো। নাহলে যেই মেকাপ এখনো আছে তাতে আমার ভাইয়ের পেট খারাপ হবার সম্ভাবনা প্রবল।”
তিতির লজ্জা পেয়ে বলল,
-“ছিঃ পিউ কি বলছ এসব?”
পিউ হেসে বলল,
-“আমার আগে যদি তোমার বিয়ে হতো তখন আমার বিয়ের সময়ও তুমি এরকম দুষ্টু দুষ্টু কথা বলতে। এটাই তো নিয়ম।”
তিতির বলল,
-“ইশ, কি ভালই না হতো। তোমার বিয়ের আগেই যদি আমি তোমার ভাবী হতে পারতাম।”
-“আচ্ছা যাই হোক, এখনো যা হয়েছে ভালই হয়েছে।”
-“হুম।”
-“আর হ্যা, আমি কিন্তু দুষ্টুমি করলেও সত্যি গোসল করতে বলেছি। এত মেকাপ নিয়ে ঘুমালে তোমারই স্কিনে প্রব্লেম হবে যদিও কে জানে আজ ঘুমাবে কিনা!”
তিতির খুব উৎসাহ নিয়ে বলল,
-“এই পিউ, তোমরা ঘুমিয়েছিলে বাসর রাতে?”
পিউ হেসে বলল,
-“হুম, ভোর ৫ টায়।”
-“হায় হায়, উঠেছো কখন?”
-“৮ টায়, তারপর তো সারাদিন আমি শুধু ঢুলি, হি হি। পরের রাতে তো টাচই করতে দিইনি, সারারাত ঘুমিয়েছি।”
তিতির হাসলো। পিউ বলল,
-“এরেঞ্জ ম্যারেজে যদিও বা বাসর রাতে হাসবেন্ড ছাড় দেয়, লাভ ম্যারেজে কখনো ছাড়বে না।”
-“স্বাভাবিক, বেচারা! কত অপেক্ষা করে তারা তাই না?”
-“উউউউউউ, আচ্ছা আমার ভাইয়ের তো তাহলে চাঁদ কপাল। বউ তার স্বামীর এত বছরের অপেক্ষার কথা ভেবে বাসর ঘরে রেডি হয়ে বসে আছে। উফফফ, ভাইয়ারই দিন।”
-“ধ্যাত, তুমি যে কি বলো না! আমি তো ওভারঅল বললাম।”
-“আরে লজ্জা পাচ্ছো কেন? আমরাও তো বাসর রাতের জন্য অনেক এক্সইটেড ছিলাম। সেই ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় ওর সাথে প্রেম হয়েছিল, তখন থেকে আমরা দুজন বাসর রাতের জন্য অপেক্ষা করতাম।”
-“কি? এত পাক্না ছিলে?”
পিউ হেসে বলল,
-“হ্যা। যাই হোক, ভাবী এখন আমি যাই। আবার কাল গল্প হবে। কদিন তো আছি আমি। ভাইয়া নিশ্চই বাইরে উসখুস করছে।”
তিতির মুগ্ধকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য রেডি হয়ে বাথরুমে অপেক্ষা করছে। কিন্তু মুগ্ধ ঘরে আসছে না কেন? মুগ্ধ ঘরে না এলে তো তিতির বাথরুম থেকে বেরও হতে পারছে না। আরো কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ ঘরে এল। পাজামা, পাঞ্জাবি খুলে আলমারি থেকে একটা ট্রাউজার বের করে পড়ে নিল। টি-শার্ট পড়তে নিয়েও পড়লো না কারন, তিতির বুকের লোমগুলো পছন্দ করে! সুন্দর করে বাসর ঘর সাজানো হয়েছে। ঘরের দুপাশে ৩ টা ৩ টা বড় ৬ টা মোম জালিয়ে রাখা হয়েছে।
তিতির দরজা খুলে বের হলো। মুগ্ধ বেখায়ালিভাবে তাকাতেই দেখতে পেল তিতিরকে। তিতিরকে দেখামাত্রই মুগ্ধর চোখ আটকে গেল। হাতের টি-শার্টটা হাত থেকে পড়ে গেল। সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। বুকের ভেতরটায় কোন এক সমুদ্রের উত্তাল স্রোত বয়ে গেল। করেছে কি তিতির! ব্লাউজ ছাড়া শুধু শাড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পড়েছে। সেই যে ওদের প্রেমের ৪ মাসের সময় যখন ওরা বান্দরবান গিয়েছিল তখন ও তিতিরকে বলেছিল যে ও এভাবে শাড়ি পড়া খুব পছন্দ করে। সেটা মনে রেখে আজ পড়েছে। ইশ, না জানি ওর কতদিনের প্ল্যান এটা। বিয়ে না হলে তো জানতেই পারতো না। মুগ্ধ কয়েক পা এগিয়ে গেল তিতিরের কাছে। তিতিরের শরীর কাঁপছে, লজ্জায় কুঁকড়ে আছে। কোন সাজ নেই মুখে, তাকাচ্ছে না মুগ্ধর দিকে। চুল বেয়ে বেয়ে পানি পড়ছে। মুগ্ধ আস্তে আস্তে একদম ওর কাছে চলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-“তিতির কি করেছো তুমি! মাথাটায় আগুন ধরিয়ে দিলে যে। বলেছিলাম আজ রাতে তুমি শেষ, এখন তো মনে হচ্ছে আমিই শেষ।”
তিতির লজ্জা পেয়ে হাসলো। মুগ্ধ আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে তিতিরকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গেল। তিতিরকে ও আজ ভালবাসার নতুন এক পর্ব দেখাবে। তিতিরকে পাগল করে তারপর ওর পাগলামি দেখার বেস্ট সময় আজ! আজ কোন ভয় নেই, দুঃখ নেই, হতাশা নেই, নেই কোন বাধা! আজকের রাত যেন শেষ না হয়, আজকের রাত ভালবাসার রাত।
The End..