হারিয়ে খুজবে আমায়

হারিয়ে খুজবে আমায় !! Part- 16

বিকেলে অনন্যর বায়নায় অনু তাকে সামনের পার্কে নিয়ে গেল সাথে সাদ ও আছে। সকাল থেকেই পিমনির পিছনে পড়ে আছে সে। আর তাকে দেখে অনন্য রেগে আগুন। এই ছেলে কেন তার মায়ের সাথে থাকবে। এ নিয়ে কয়েক দফা ঝগড়া হলো তাদের দুজনের মধ্যে। কিন্তু এক পর্যায়ে বিষয়টি খারাপের দিকে যায়,

অনন্য:তুমি সব সময় আমার মায়ের কাছে থাক কেন তোমার কি মা নেই? গো টু ইউর মাদার। হোয়াই আর ইউ টেকিং মাই মাদার ফ্রম মি?

মায়ের কথা শুনে সাদ চুপ হয়ে গেল তারপর দৌড়ে অন্যদিকে চলে গেল। অনু তাকে থামাতে পারল না। অনু সাদের মন খারাপের কারণ বুঝতে পারল। জন্মের পর থেকে ছেলেটা মাকে কাছে পাইনি মায়ের আদর পায়নি তাই তো একটু মমতার জন্য পিমনির কাছে আসা।সারাদিন তার পিছনে পিছনে ঘোরা অনু বেশ বুঝতে পারে।তাই ভাবে আগে তাদের দুজনের মধ্যে বোঝাপড়া করাতে হবে।তাই আগে সে অন্যের কাছে গেল,

অনু:অনন্য এগুলো কেমন ধরনের ব্যবহার হু? সাদ তোমার বড় ভাই হয়। আর আমি সাদের পিমনি হই। তোমার যেমন বাবাই নেই তাদেরও তেমন মা নেই তুমিও তো তোমার মামাইর সাথে থাকো তখন কি সাদ তোমাকে কিছু বলে?

অনন্য মন খারাপ করে অপরাধীর মতো মাথা নাড়লো। তারপরে বলল।

অনন্য: সাদ ভাইয়ার মা কোথায় গেছে মা?

অনু: উনিতো আকাশের তারা হয়ে গেছে।

অনন্য: তাহলে তাকে সেখান থেকে আসতে বল তাহলেই তো আর তোমার কাছে বারবার আসবেনা।

অনু: সেখান থেকে তো কেউ ফিরে আসতে পারে না বাবা যে একবার চলে যায় আর কখনো ফিরে আসেনা।

অনন্য: তাহলে কি আমার বাবা আকাশের তারা হয়ে গেছে মা। হি ডোন্ট ইভেন কাম টু আস।

অনন্যর বাবার কথা শুনে অনু আর কিছু বলতে পারলো না কথা ঘুরানোর জন্য বলল।

অনু: যাও সাদভাইয়া মন খারাপ করেছে তাকে গিয়ে সরি বলে আসো। তুমি কি চাও তোমার জন্য কেউ মন খারাপ করুক।

তারপরে অনন্য সাদকে সরি বলে আর সেও সরি মেনে নিয়ে খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। সাদ এখন অনন্যকে পরী বলে ডাকে ।দুজনের মধ্যে খুব ভাব হয়ে গেছে।দুজনেই সারাদিন খেলা করে এখন বায়না ধরেছে তাদের নিয়ে ঘুরতে যেতে তাই বাধ্য হয়েই বাইরে আসা।

অনু বাচ্চা দুটোকে নিয়ে বাড়ির সামনে পার্কে গিয়ে বসলো। তারা অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলা শুরু করলো। কিন্তু সাদ তার পরীকে কারো সাথে খেলতে দিচ্ছে না। সে শুধু তার সাথে খেলবে বলে এক প্রকার জোর করেই তার সাথে খেলতে লাগলো। আর এসব দেখে অনু একা একাই জোরে হাসতে লাগল।

“আজ চার বছর পর তোমার মুখের হাসিটা দেখতে পেলাম খুব মিস করতাম তোমার হাসি-হাসি মুখ। এই হাসিটা দেখার অপেক্ষায় তো ছিলাম আজ সারা দিন চার চারটা বছর। আমার অপেক্ষাটা তাহলে সার্থক হলো”

সকালে শাফিন ছুটির জন্য ইমেইল দিয়ে তারপর কোনো রকম হাত মুখ ধুয়ে আবার বেরিয়ে পড়ল অনুদের বাসার উদ্দেশ্যে খাওয়া-দাওয়া আর করল না।তারপর সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করতে লাগল অনুর বাইরে আসার জন্য কিন্তু সে বের হয়না। দুপুরের একবার বারান্দায় এসেছিল গোসল করে কাপড় শুকাতে।শাফিন তখন আড়ালে চলে গিয়েছিল নয়তো অনু আর ঘর থেকে বের হবেনা সিনক্রেট করবে।

আগে থেকে যথেষ্ট সুন্দরী হয়ে গেছে অনু। স্বাস্থ্য কিছুটা বেড়েছে।আর গোসল করে আসার কারনে মুখটা স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে আজ কতদিন পর সে অনুকে দেখল।আড়ালে দাঁড়িয়ে তার চোখের তৃষ্ণা মিটাচ্ছে শাফিন। কিন্তু অনু বেশিক্ষণ থাকলো না। তারপর একেবারে বিকেলে বেরিয়েছে সে বাচ্চাদের নিয়ে।তখন সে তাদের পেছনে যায় কথা বলতে কিন্তু পরবর্তীতে ভাবে রাস্তায় কথা বলাটা ঠিক হবে না। তাই তাদের পিছু নেয়। তাদের একটা পার্কে ঢুকতে দেখে সেও অনুর পেছনে পেছনে যায়।আগে দূর থেকে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখে সে অনুকে ।অনুকে হাসতে দেখে তখন আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারল না সামনে চলে আসলো।আর কথাটা বলে ফেলল।

আচমকা কারো কন্ঠ শুনে অনুর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল পেছন ফিরে দেখল শাফিন দাঁড়িয়ে আছে।আগের থেকে অনেকটা শুকিয়ে গেছে চুলগুলো অগোছালো চোখ গুলো লাল হয়ে আছে যেন কত রাত ধরে ঘুমায় নি। মুখটা শুকিয়ে আছে কিন্তু চোখের গভীরতা সে আগের মতোই মনে চায় বারবার ডুব দিতে। এ ছলনাময়ী চোখের কারণেই সে বারবার ধোকা খেয়েছে। আর না।

হঠাৎ শাফিনকে চোখের সামনে দেখে কেমন যেন শুরু হলো মনের মধ্যে কিন্তু বাইরে নিজেকে শক্ত রেখে মুখে মুচকি হাসি বজায় রেখে শাফিনকে বলল।

অনু: হাসিটা সরে যাবার কারণটাও তো আপনি ছিলেন তা নয় কি? কথাটা শুনে শাফিন চোখ নামিয়ে নিল। তারপর অনু বলল ওইসব কথা বাদ দিন অতীতকে টেনে হিঁচড়ে সামনে আনে মুড খারাপ করার কোন মানেই হয়না। তা কেমন আছেন। আর আপনার স্ত্রী বাচ্চারা কেমন আছে?

স্ত্রী আর বাচ্চার কথা শুনে শাফিন মুচকি হেসে বলল,

শাফিন: আমি কেমন আছি তা তো আমার চেহারা দেখে তুমি ভালো বলতে পারবে। কারণ আমাকে তো আমার চেয়ে বেশি তুমি চেনো। আর স্ত্রী আর বাচ্চার কথা বলছো তো সেটাও তুমি ভালো জানো তুমি কেমন আছো আমাদের মেয়ে কেমন আছে?

শাফিনের কথার মানে অনু বুঝলো না তাই সে আবার জিজ্ঞেস করল,
অনু: আপনি কেমন আছেন তা আপনি ভালো বলতে পারবেন আমি না ।কারণ মানুষ ভালোবাসার মানুষের চেহারা দেখেই বলতে পারে সে কেমন আছে তার মনে কি চলছে। আর আপনি আমার ভালোবাসার মানুষ নন ।আপনার জন্য আমার মনে কোন ধরনের অনুভূতি বেঁচে নেই ভালোবাসা বা ঘৃণা কোনটাই নেই। আপনাকে তো আমি চিনিনা।

আর আপনার স্ত্রী কেমন আছে আপনার মেয়ে কেমন আছে তা আমি কিভাবে বলবো মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?

“আমার মনে আপনার জন্য কোন অনুভূতি বেঁচে নেই ভালোবাসা বা ঘৃণা কোনটাই না” কথাটা শুনে শাফিনের শাফিনের বুকটা মোচর দিয়ে উঠল তার পরেও মুখে হাসি বজায় রেখে বলল,

শাফিন: আমার স্ত্রী তো তুমি।আর তুমি কেমন আছো তা তো তোমার থেকে ভালো আর কেউ বলতে পারবেনা। আর আমার মেয়েও খুব ভালো এবং হাসিখুশি আছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি।

তাহলে কি শাফিন বিয়ে করেনি ?কেন? সে কি কারো অপেক্ষায় ছিল নাকি তাদের ডিভোর্স হয়নি বলে বিয়ে করতে পারছে না? (মনে মনে) কিন্তু মুখে বলল,

অনু: তারমানে আপনি বিয়ে করেননি কেন ডিভোর্স হয়নি এই কারণে। সমস্যা নেই আপনি পেপার পাঠিয়ে দেবেন আমি সাইন করে দেব।যেখানে মনে সম্পর্কটা শেষ হয়ে গেছে তাহলে শুধু শুধু কাগজে-কলমে সম্পর্কটা রেখে লাভ কি। আর আপনি বিয়ে করে নিলেও আমি ঝামেলা করতাম না দেশে ফিরেই ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিতাম।

প্রতিউত্তরে শাফিন কিছু বলল না এসব কথাই আশা করেছিল সে। এখন আর আগের মত সব সময় সব কথায় রাগ ওঠেনা। ধরতে গেলে কোন কথায় রাগ উঠে না। রাগ মানুষকে ধ্বংস করে দেয় তা সে নিজে ধ্বংস হওয়ার পরে বুঝেছে। কিন্তু ততক্ষণে সে সব হারিয়ে ফেলেছে আগেই যদি সে অণুর কথামতো রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো তাহলে হয়তো এতগুলো বছর তাঁর স্ত্রী-সন্তানের থেকে দূরে থাকতে হতো না। আগেই সব শান্তশিষ্ট ভাবে মিটমাট করে নিতে পারত।

শাফিন:অনু এসব কথা বাদ দাও যার জন্য এসেছি, তোমার সাথে কি আমি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি? প্লিজ বেশি সময় নেবো না শুধু কিছু কিছু কথা বলব। কথাগুলো শুনে তুমি যে ডিসিশন নেবে আমি রাজি থাকব কোন ধরনের বিরোধিতা করবো না।

শাফিনের শান্তস্বরে কথাগুলো শুনে অনু খুব অবাকই হল কারণ অনু যে কথাগুলো বলেছে অন্য সময় হলে শাফিন এতক্ষনে রেগে কোন কোন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতো আর সেই সুযোগে অনু বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি চলে যেত।কিন্তু এখন সে কিছু করছে না বলে আর না করতে পারলো না। সে নিরব রইল। আর নিরবতাই সম্মতির লক্ষণ ভেবে শাফিন ঝটপট অনুর হাত ধরে নিল।

শাফিনের হাত ধরা দেখে সে জড়াজড়ি শুরু করল ছোটার জন্য কিন্তু শাফিন রিকোয়েস্ট করলো

শাফিন:খুব বেশি সময়ের জন্য ধরবো না শুধু কিছু সময় ধরে থাকতে দাও অনেকদিনের তৃষ্ণার্ত আমি।কিছু কথা বলবো তারপর হাত ছেড়ে দেবো তুমি চাইলে আবার ধরবো না চাইলে জোর করবো না।

অনু আর কিছু বলল না চুপচাপ বসে রইল শাফিন বলা শুরু করলো।

শাফিন:অনু আমি জানি আমি অন্যায় করেছি অন্যায় বললে ভুল হবে অনেক বড় পাপ করেছি আর তার প্রায়শ্চিত্ত আমি করছি। একটা সময় ধোঁয়াশার পিছনে ছুটে এসেছি কিন্তু জানতাম না ধোঁয়াশা শেষ হলেই বাস্তবতা আমাকে এভাবে পিষে মারবে। আমি তোমাকে অনেক অপমান করেছি গায়ে হাত তুলেছি এমনকি ঘর থেকে বের করে দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করো একটাও আমি মন থেকে করিনি রাগের মাথায় এসব করেছি। তোমার সাথে এমন করে আমিও ভালো ছিলাম না অনেক ডিপ্রেসড ছিলাম একটা রাত ঠিকঠাক ঘুমাতে পারতাম না আমি।তারপর বাধ্য হয়ে তোমার বাড়ির সামনে সারারাত অপেক্ষা করতাম সকাল পর্যন্ত যদি তোমার এক ঝলক দেখা যায়।

আর যে দিন আমি জানতে পারি আমি বাবা হবো আমার থেকে বেশি খুশি হয়তো আর কেউ ছিল না বিশ্বাস করো সে অনুভূতিটা যদি তোমাকে বোঝাতে পারতাম।কিন্তু সেই অনুভূতিটা কে আমি নিজ হাতে শেষ করে দিয়েছি সেদিন রাস্তায় সাদাত এর সাথে তোমাকে দেখে মাথা ঠিক ছিল না তাই এসব কথা বলে ফেলেছি। কিন্তু আমিতো জানি তুমি কতটা পবিত্র।

সবকিছুর জন্যই আমি তোমার কাছ থেকে ক্ষমা চাইছি অনু তুমি বললে তোমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবো আমাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না? তোমাকে আর আমার সন্তানকে খুব প্রয়োজন আমার। তুমি ভেবেচিন্তে উত্তর দিও আমি অপেক্ষা করব দরকার পড়লে সারা জীবন।

তোমার কাছ থেকে একটা অনুমতি চাইব দেবে?

এতক্ষণ অনু শাফিনের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল হঠাৎ শাফিন অনুমতি চাওয়ায় তার দিকে ফিরল,

অনু: কি অনুমতি এমন কোন কিছু চাইবেন না যেটা আমি দিতে পারব না।

শাফিন: আমি আমার মেয়ের সাথে কিছুক্ষণ খেলা করতে চাই। প্লিজ আমি তো ওর বাবা আমারও তো অধিকার আছে।

শাফিনের ছল ছল চোখের চাউনি দেখে আনু আর না করতে পারল না অনুমতি পেয়ে শাফিন যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল সে সারা বিকেল অনন্য সাথে খেললো। তারপর সন্ধ্যার দিকে তাদের নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল।এই মধ্যে অনন্য আর সাদের শাফিনের সাথে ভাব হয়ে গেছে যাওয়ার সময় অনন্য শাফিনের কোল থেকে নামতে চাচ্ছিল না।আর শাফিনের ও মন মানছিল না তাকে ছেড়ে যেতে কিন্তু অনু ধমক শুনে অনন্য বাধ্য হয়ে কল থেকে নেমে গেল তারপর কেঁদেকেটে বাড়িতে গেল।আর শাফিন নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে আজ সে একটা শান্তির ঘুম দিবে। অনুকে সে চোখের দেখা হলেও দেখেছে। তৃষ্ণার্ত মন কিছুটা হলেও শান্ত হয়েছে।

চলবে…

One thought on “হারিয়ে খুজবে আমায় !! Part- 16

  • অসাধারণ লাগলো গল্পটা।
    রাইটিংটাও খুব ভালো লাগলো।
    তবে গল্পের শেষটা অন্য রকম
    হ‌ওয়া উচিত ছিল।
    আশা করি এরকম গল্প আরো
    অনেক উপহার দিবেন।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *