সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 22

বাইরের নিঃস্তব্ধ পরিবেশে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ শোনা যাচ্ছে প্রবল ভাবে। আমি এখনও বইয়ের মাঝে ডুবে আছি৷ আর রেয়ান, সে আগের নেয়-ই তার দু’গালে দু’হাত রেখে একটু ঝুঁকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। একদম বেহায়ার মতো! তবে এবার পাত্তা দিলাম না এসবে। বইয়ের মাঝেই ডুবে রইলাম। খানিকবাদে খেয়াল করলাম উনি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে৷ আমি তার দিকে তাকাতেই সে সোফা থেকে উঠে আমার পাশে এসে বসলেন। ডান হাতটা হেঁচকা টানে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠলেন…
— “তোমার হাতে আংটি কোই মিরা?”
অবাক হলাম আমি! এ প্রথম উনি আমাকে “মরুভূমি” বাদে “মিরা” ডেকেছেন। পরক্ষনেই আবার ভয় লাগতে শুরু করলো। এখন কি জবাব দিবো তাকে? আংটি যে ব্যাগে ছিল, আর ব্যাগটা তো কালকে রাতে রাস্তায় ফেলে এসেছি আমি। এখন? এবার কিছুটা রাগি সরেই উনি বলে উঠলেন…
— “তোমাকে কি জিজ্ঞেস করেছি মিরা? আংটি কোথায়?”
— “আআসলে কালকে ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম আংটি-টা। আর বব্যাগটা তো রাস্তায় ফেলে এসেছি।”
আমি ভাবলাম এ-ই বুঝি উনি বকবেন আমাকে। তবে না! উনি বকলেন না আমায়। উল্টো শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন…
— “ব্যাগে আর কি কি ছিল?”

— “তেমন কিছু না। আমার ফোন, কিছু টাকা আর আংটি।”
আমার দিকে তাকালেন রেয়ান, করুন কণ্ঠে বলে উঠলেন…
— “এগুলোতে তো ওতো সমস্যা নেই। আমি হাজারটা কিনে দিতে পারবো তোমাকে। আংটি-টাও! তবে সেটা তোমাকে দেওয়া আমার প্রথম উপহার ছিলো মরুভূমি! একটু যত্ন করে রাখতে পারলে না? হাত থেকে খুলা কি খুব জরুরি ছিল?”
নিজের কাছে নিজেকেই অপরাধী লাগছে এখন। সত্যিই তো আংটিটা খুলার এত কি দরকার ছিল? হাতে ছিল হাতেই থাকতো। রেয়ানের দিকে করুন চোখে তাকালাম আমি। উনি ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে আছেন। এক হাত দিয়ে চুল আকঁড়ে ধরেছেন বেশ শক্ত ভাবে। আমার দিকে না তাকিয়েই দ্রুত পায়ে বের হয়ে যান রুম থেকে। এতে যেন আমার অপরাধ বোধটা আরও বেড়ে গেল!
.
সকালে ঘুম থেকে উঠেই রেয়ানের মুখ ভেসে উঠে সামনে। উনি আমার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে উঠেন…
— “মিস অলস! তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেস হয়ে নাও। আমরা বাইরে ঘুড়তে যাবো। প্রথমে তোমার জন্য ফোন আর আংটি কিনবো, দেন পার্কে হাঁটবো।”
— “কিন্তু আমার ভার্সিটি আছে।”
— “তো? যাবে না।”
রাগি চোখে তাকালাম রেয়ানের দিকে। উনি দাঁত বের করে হেসে শান্ত সরে থ্রেট দিয়ে চলে গেলেন রুম থেকে! মানুষটা এত থ্রেট দেয় কেন আমাকে? সুন্দর করে বললে হয় না? ভাবতে ভাবতেই প্যাকেট-টা খুললাম আমি। মিষ্টি আর সাদা রঙের একটি “ধুতি-সেলোয়ার”। আমার আর কি। ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। যমরাজ যে অপেক্ষা করছে আমার।
নিচে এসে দেখি সবাই নাস্তা করছে। আমি আর রেয়ানও করে নিলাম নাস্তা! বাড়ি থেকে বের হতেই রেয়ান বলে উঠলেন…
— ” বুঝলে মরুভূমি তোমার সাথে বের হলে কেন যেন গাড়ি নিতে ইচ্ছে করে না। রিকশায় পাশাপাশি বসে প্রকৃতির বাতাস উপভোগ করতে ভালো লাগে। হাতে হাত রেখে হাঁটতে ভালো লাগে। এক অজানা অনুভূতি জানান দেয়- “তুমি আমার। শুধুই আমার”।
তার দিকে তাকিয়ে রইলাম নির্বাক। মানুষটা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে। যা কোনো মানুষকে ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট।
১৩.
রেয়ান আমাকে নতুন ফোন আর আংটি কিনে দিলেন। আংটি হাতে পড়িয়ে দিতে দিতে গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেন…
— ” এ আংটি-টা যেন না হাড়ায় মরুভূমি! নাহলে তোমাকেই লাপাতা করে দেব। আর তুমি তো জানো, আমি আমার কথার খেলাফ করি না। যা বলি তাই-ই করি।”
এমন থ্রেট শুনে কি কেউ আবার কোনো জিনিস হাড়াবে? আমার ক্ষেত্রে তো না। “জান যাবে কিন্তু আংটি হাড়াবে না”। ঠিক তেমনই অবস্থা আমার৷ রেয়ানের দিকে ভীতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে ছিলাম তখন। আর সে মুচকি হেসে ছিল শুধু।
এখন রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছি দু’জন। আমাদের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব! আড়চোখে একবার রেয়ানের দিকে তাকালাম আমি৷ উনি সামনের দিকে তাকিয়েই মুচকি মুচকি হাসছেন। অদ্ভুত! এখানে হাসার কি আছে? এ-র মধ্যে হঠাৎ জেনি এসে হাজির। এ মেয়েটাকে দেখলেই আমার গা জ্বলে যায়। ঐদিন ভার্সিটিতে ওমন ব্যবহার করার পর এ মেয়ে আমার শত্রু। জন্ম জন্মন্তরের শত্রু। তবে অবাক করা বিষয় হলো জেনি আজকে শাড়ি পড়েছে৷ তবুও যেন অশ্লীলতা ছেঁয়ে আছে ওর মধ্যে। হাতা কাঁটা ব্লাউস আর পেটের অধিকাংশ দেখা যাচ্ছে তার। কিন্তু ও এখানে কি করছে? আর এভাবে ঢুলছে কেন? কেমন যেন লজ্জা লজ্জা ভাব জেনির সারা মুখে। লাজুকতা নিয়ে সে রেয়ানকে বলে উঠে…
— ” রেয়ান বেবি আমাকে কেমন লাগছে?”
রেয়ান অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন…
— “ভালো! তুমি এখানে যে?”
— “শপিং করতে এসেছিলাম।”
থামলো জেনি। আমার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে বলল…
— “এই বেবি, আমার দিকে একটু তাকাও না৷ তাকিয়ে বলো কেমন লাগছে।”
এবারও তাকালেন না রেয়ান৷ উল্টো ধমক দিয়ে বলে উঠলেন…
— “একবার বলেছি না ভালো লাগছে। আবার তোমার দিকে তাকিয়ে বলতে হবে কেন? অজব!”
জেনির হয়তো গায়ে লাগলো কথাটা। আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো সে। অদ্ভুত! আমি কি কিছু করেছি? আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছে কেন? আমার পাশে এসে দাঁড়ালো জেনি। ফিসফিসিয়ে কানে বলে উঠল…
— “কিভাবে রেয়ানকে বশ করেছো মেয়ে? তোমার মতো মেয়ে তো আবার সব পারে। লাইক আ কাইন্ড অফ পতিতা তোমরা।”
কথাটুকু বলেই দ্রুত পদে চলে গেল জেনি। আমি এখনও স্তব্ধ। কি বলল মেয়েটা? আমি পতিতা? পিছনে ফিরে তাকালাম আমি। জেনি চলে গেছে এতক্ষনে। রিতিমতো হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে আমার। রাগের জন্য চোখ দিয়ে না চাইতেও পানি পড়ছি। জেনিকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিয়ে পারলে শান্তি পেতাম। এদিকে আমার এমন অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলেন রেয়ান। হাত ধরে আস্থির হয়ে বলে উঠলেন…
— “কি হয়েছে তোমার মরুভূমি?”
এক ঝটকায় হাত সরিয়ে ফেলল আমি। রাগী দৃষ্টিতে রেয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম…
— “ধরবেন না আমাকে। আপনার জন্য আজকে আমার এসব কথা শুনতে হয়েছে। আপনিই বলুন আমি কি আপনার কাছে আসি নাকি আপনি আসেন? ওই মেয়ের সাহস কিভাবে হয় আমাকে ওগুলো বলার?”
— “জেনি কি কিছু বলেছে তোমাকে মরুভূমি! আমি তো শুনলাম না। বিশ্বাস করো সত্যিই কিছু শুনি নি আমি। নাহলে ওকে কথা শুনিয়ে দিতাম। ও কি বলেছে তোমাকে?”
জবাব দিলাম না আমি৷ এ মুহুর্তে রেয়ানের সাথে কথা বলার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই আমার। সোজা হাঁটতে লাগলাম শুধু। রেয়ানও পিছু পিছু হাঁটছেন আমার। বারবার থামতে বলছেন। কিন্তু আমি থামছি না। এক পর্যায়ে উনি কোলে তুলে নিলেন আমায়। হতবাক আমি! ডক্টর কি আসলেই পাগল হয়ে গেল নাকি? আশেপাশে মানুষ আছে সেটা কি ভুলে গেছে? সবাই যে আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে আর হাসছে। তবে সেখানে কোনো পাত্তা নেই রেয়ানের। সে নিজের মতো একটা সিএনজি ডেকে ভেতরে বসিয়ে দিলো আমায়। আর নিজেও বসলো।
গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। আমি গাল ফুলিয়ে বসে আছি আর রেয়ান আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে রেয়ানের ফোন বেজে উঠে। কে কল দিয়েছে জানি না,তবে কলে কথা বলার পরই রেয়ানের হাসি-উজ্জ্বল চেহারা উবে যায়। এর বদলে ছেঁয়ে যায় একরাশ কালো মেঘ। উনি গম্ভীর কন্ঠে সিএনজি চালককে বলে উঠেনে পাশের হাসপাতালে নিয়ে যেতে। হাসপাতালের নাম শুনতেই রেয়ানের দিকে অবাক দৃষ্টি তাকাল আমি। বললাম…
— “হঠাৎ হাসপাতালে কেন?”
রেয়ান শক্ত করে আমার হাত ধরলেন। শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন…
— “তোমার ভাই মানোসিক ভাবে ভেঙ্গে পরেছে মরুভূমি! ওকে সামলাতে হবে তোমার।”

১৪.
জেনি মাত্রই ভার্সিটিতে ঢুকছিল হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে যেতে লাগলো সে। কিন্তু সামনে থাকা ব্যক্তি হাত ধরে ফেললো তার। ভয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো জেনি। চোখ খুলয়েই দেখে দিহান তার হাত ধরে আছে। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে সে…
— “ঠিক আছো?”
মাথা নাড়ালো জেনি। দিহানকে কেন যেন তার অনেক ভালো লাগে। যদিও দিহান ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। তবুও জেনি তাকে পছন্দ করে। সে ভেবে রেখেছে যদি রেয়ান তাকে একসেপ্ট না করে তাহলে সে দিহানকে বিয়ে করে ফেলবে। ভাবনার মাঝেই দিহান পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে জেনি পথ আটকায়। ঢং করে বলে উঠে…
— “কেমন লাগছে আমাকে দিহান?”
এ মুহুর্তে দিহান যেন বিরক্তির শেষ প্রান্তে। এ মেয়েকে তার একদমই সহ্য হয় না। এখন আসছে আবার কেমন লাগছে তা জানার জন্য। আসলেই মেয়েটা নির্লজ্জ। দিহান কিছু বলছে না দেখে জেনি ফের প্রশ্ন করে। এবার জেনির পা থেকে মাথা অব্ধি একবার তাকালো দিহান। তারপর বলল…
— “শেঁওড়া গাছ চেনো?”
— “না তো।”
— “পেত্নি?”
— “হুম।”
— “তুমি হোচ্ছ শেঁওড়া গাছের পেত্নি। তোমাযে এমনি যেমন পেত্নি লাগে তার চেয়ে কয়েক গুণ পেত্নি ভুত লাগে সাজলে।”
কথাটা বলেই হুর হুর করে সেখান থেকে চলে গেল দিহান। আর জেনি, দুই দুই বার অপমান হওয়ায় তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে।
১৫.
পাথরের নেয় বসে আছে আবদ্ধ। দৃষ্টি তার শূণ্য। মনে হচ্ছে জীবিত হয়েও মৃত সে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মামী আর দীঘির মা। তারা কাঁদছে, তবে আবদ্ধ কাঁদছে না। এদিকে আমি আর রেয়ানও চলে আসি হাসপাতালে। আবদ্ধকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বুকে মোচড় দিয়ে উঠল আমার। তার কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম আমি। “কি হয়েছে” জিজ্ঞেস করতেই আবদ্ধ জড়িয়ে ধরল আমায়। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল…
— “আমার সাথেই এমন কেন হয় মিরাপু। সবই তো ঠিক ছিল। এমনটা হওয়া কি খুব জরুরি ছিল?”
— “শান্ত হো ভাই। কি হয়েছে খুলে বল।”
আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আবদ্ধ আমায়। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল…
— “পরীক্ষার হল থেকে আজকে সকালে কল আসে। দীঘি নাকি মাথা ঘুরে পরে গেছে৷ আমি যাই ওখানে। মুখে কয়েকবার পানি ছিটানোর পরও জ্ঞান ফিরছিল না ওর। পরে হাসপাতালে নিয়ে আসি। ডাক্তাররা বিভিন্ন টেস্ট করে বলেছে ওর নাকি ব্রেন টিউমার। সেকেন্ড স্টেজে। দেখ না আপু এই ছোট্ট মেয়েটার কত বড় অসুখ হয়ে গেল। কোথায় ভেবেছিলাম ওর পরীক্ষা শেষ হলে ওকে বিয়ে করে নতুন এক পৃথিবী শুরু করব কিন্তু এখন?”
— “কাদিস না ভাই৷ সবে তো সেকেন্ড স্টেজ৷ শোকর কর লাস্ট স্টেজে ধরা পরে নি। এখনও ওকে বাঁচানোর চান্স আছে আমাদের কাছে।”
আমার কথায় তাল মিলিয়ে রেয়ানও বলে উঠল…

— “ও ঠিক বলছে আবদ্ধ। আমরা আমাদের বেস্ট করব দীঘিকে ঠিক করার। তাছাড়া আমার ফ্রেন্ড গ্রুপের কম-বেশি সবাই ডাক্তার। ৩জন তো এখন বিদেশে ডাক্তারি করছে। ওদের সবাইকে একত্র করব আমি। তুমি চিন্তা করো না দীঘির চিকিংসা আমরা আমাদের সবটা দিয়ে করব। দেখবে ও ঠিক হয়ে যাবে।”
খানিকতা ভরসা পেল আবদ্ধ। তবে কান্না বন্ধ করল না সে।
.
দীঘির পুরো একদিন পর জ্ঞান ফরলো। চোখ খুলতেই আগে আবদ্ধকে দেখলো সে। কিভাবে যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে৷ ভয়ে ঢোক গিললো দীঘি। সামান্য মাথা ঘুরানোর জন্য কি এখন আবদ্ধ তাকে বকবে? তবে তার ধরাণা ভুল প্রমাণ করে আবদ্ধ দীঘিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলে উঠল…
— “আমাকে ছেঁড়ে যাস না পিচ্চি। আমি থাকতে পারবো না ”
.
.
#চলবে🍁