বোবা বর

বোবা বর !! Part- 03 ( Last-Part)

শেষ পর্ব,

আমি সে-সময় অষ্টম শ্রেণিতে পড়তাম। মা সহ ছোট খালার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি, সব ভাই বোন একসাথে হৈ,চৈ আনন্দে মেতে ছিলাম সবাই।

রোজ বিকেলে খালাতো ভাই আর পাড়ার ছেলেরা মিলে ক্রিকেট খেলা হতো। খেলার এক পর্যায় বল গিয়ে পড়ে পাশের এক বাড়িতে। সবাই মুখ কালো করে আছে, আজ আর সেই বলটা তাদের পাওয়া হবে না বলে। সে বাড়ির মেয়েটা অনেক ঝগড়াটে নাকি, যেই বল আনতে যাবে তার জন্য কানে ধরে ওঠাবসা অবধারিত, খেলার ছোট মাঠটার পাশেই বাড়িটা ছিলো।

আমি নতুন জন্য সবাই জোরজবরদস্তি করে আমাকেই পাঠালো বলটা আনতে। আমি বল আনতে গেলাম, দেখি একটা মেয়ে বলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। ভালো করে দেখলাম এমন সুন্দর মেয়ে কি করে এতটা ঝগড়াটে হতে পারে, টানা টানা চোখ, জোড়া ভ্রু যুগল যেন শ্যামা মেয়েটার সৌন্দর্য অনেক গুন বৃদ্ধি করেছে।

মেয়েটা আমাকে নতুন দেখে একটু অপ্রকৃতস্থ হয়ে গেলো, আমি নিজে থেকে বললাম ম্যাডাম বলটা আমার।
মেয়েটি কোনো কথা না বলে বলটা আমার সামনে এগিয়ে দিলো।

বল নিয়ে ফিরে আসছি, কিন্তু মেয়েটাকে আরো একবার ভালো করে দেখতে ইচ্ছে করছে এখন খুব আমার। ঠিক তখনি মেয়েটা আমায় বলওয়ালা বলে ডাক দিলো।
সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়ালাম, বললাম আমাকে বলছেন?

জ্বী, আপনাকেই। এ পাড়ায় আগেতো আপনাকে দেখিনি কে আপনি? আমি নিহানের খালাতো ভাই মুরাদ, আপনি?
মেয়েটা — আমি সামিহা।
আমি আবার জিঙ্গাসা করলাম কোন ক্লাসে পড়েন আপনি?

মেয়েটা — ক্লাস এইটে, আপনি?
আমি — এমা আমিও ক্লাস এইটে পড়ি, তাহলে আমরা তো এখন বন্ধু, বান্ধবী হয়েই গেলাম। সামিহা কিছু না বলে বাড়ির ভিতরে চলে যায়।

বল নিয়ে ফেরার পর সবাই আমার আর সামিহার কথোপকথন শুনে অবাক হয়, তারপর থেকে সবাই সামিহা কে দিয়ে ক্ষ্যাপায় আমাকে।
আমার খারাপ লাগে না, খালার বাড়িতে যতদিন ছিলাম সবসময় সামিহার সেই চোখ, মুখের মায়াভরা দৃশ্য ভাসতো আমার সামনে।

আরো তিনদিন দেখা হয় সামিহার সাথে আমি প্রথম কথা বলি দু’দিন, তিনদিনের দিন সামিহা নিজে থেকেই কথা বলে।
একই ক্লাসে পড়লেও সামিহা আমাকে আপনি আর আমি সামিহাকে তুমি সম্মোধন করি।
মেয়ে মানুষ মনেহয়না সহজে কোনো ছেলে মানুষকে তুমি বলতে পারে।

সামিহাকে আমার ভালো লাগে, সামিহাও কথা বলার সময় আমার দিকে আঁড় পানে তাকায়। সেবার খালার বাড়ি থেকে চলে আসতে, বুকের ভিতর প্রথম এক অজানা কষ্ট অনুভব করি।

এরপরে যতবার ছুটি পেতাম স্কুলে ততবারই ছুটে যেতাম খালার বাসায়। দেখা হলেই টুকটাক কথা হয় সামিহার সাথে, আমি রাতে ঠিক করে রাখতাম কাল দেখা হলে কি বলবো কিন্তু সামিহা সামনে আসলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় আমার।

এসএসসি পরীক্ষার পর সামিহার আম্মুর মোবাইল নাম্বার নিয়ে আসি, তারপর থেকে মোবাইলে এসএমএস এ কথা বলতাম আর এইচএসসি পরীক্ষার পর অনার্স ফাস্ট ইয়ারে মোবাইল কিনে সামিহা। সামিহার আম্মু আমাকে অনেক পছন্দ করেন, বাসার আশেপাশে দেখলেই বাড়িতে ডেকে নিতেন গল্প করতে।

আমি ঢাকার এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই আর সামিহা ফেনীর এক কলেজে ভর্তি হয় বাড়ির থেকে কাছে জন্য ।
এভাবে কথা বলতে বলতে কখন যে আমারা দু’জন এক হয়ে যাই ঠিকভাবে বুঝতে পারি না আমি।

সারাদিন রাত সামিহার খোঁজ না নিলে নিজেকে অসমাপ্ত লাগতো আমার। আর সামিহাও একবার মোবাইলে চার্জ না থাকার কারনে বন্ধ হয়ে যায় পরেরদিন কল দিলে কান্নায় ভেঙে পড়ে মেয়েটা।

তখনই সিদ্ধান্ত নেই আমরা সারাজীবন একসাথে কাটাবো, কেউ কাউকে ছাড়া একদিনও চলতে পারি না। একদিনের কষ্ট হাজার দিনের মতো হয়ে যায়।
এতোদিনের কথায় কখনো আমাদের ঝগড়া হয়নি, কোনো কারনে কেউ রাগ করলে অন্যজন নিজেকে শান্ত রাখতাম।

বেশ চলছে এভাবে হঠাৎ বাড়ি থেকে সামিহার বিয়ে দেওয়ার জন্য সামিহার বাবা অস্থির হয়ে পড়েন।
সামিহা আমার কাছে অনেক কান্নাকাটি করে কিছু একটা করতে বলে।
আমি তখন আন্টির (সামিহার আম্মু) সাথে কথা বলে বুঝাতে সক্ষম হই।

কিন্তু আমাকে শর্ত দেওয়া হয়েছিলো, নিজের একটা চাকরি জোগাড় করতে হবে যতদ্রুত পারি তবেই সামিহা কে বিয়ে করতে পারবো, তার আগে নয়।
সামিহার বাবা বেকার কোনো ছেলের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দেবেনা বলে, তাহলে যে তিনি সমাজের মানুষের কাছে ছোট হয়ে যাবেন।

আমাদের বাড়িতে আব্বা, আম্মা সবাই রাজি ছিলেন
সামিহা সুন্দরী, মেয়ে ভালো জন্য।
অনার্স শেষ করেই একটা বেসরকারি চাকরি তে যোগদান করি। তারপর ঘরোয়া ভাবেই বিয়েটা সম্পন্ন হয় আমাদের।

বিয়ের পর একবছর ঢাকায় থাকি আমরা, জীবনের এতো প্রশান্তি, সুখ আর কখনো পাইনি আমি যতটা সামিহার সাথে থাকা কালিন পেয়েছি। একবছর পর সামিহা প্রেগন্যান্ট হলে, আমার খুশির অন্ত থাকে না। অফিসের কাজের চাপের জন্য সামিহা কে বাড়িতে রেখে আসি, এসময় ওর অনেক যত্নের প্রয়োজন বলে।

সামিহাকে বাড়িতে রেখে আসার পর আমার দিন গুলো অনেক কষ্টে কাটে। সামিহা আমার অবস্থা বুঝে ওই অবস্থায় ঢাকা আসতে চাইলে আমি বারণ করি।

সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে আমাদের এক কন্যা সন্তান পৃথিবীতে আসে। আমার আর সামিহার নামের সাথে অক্ষর মিলিয়ে মেয়ের নাম সামাহ্ রাখি।
আগে মাসে দুই /তিন বার বাড়িতে গেলও সামাহ্ হওয়ার পর প্রতিটা সপ্তাহে বাড়িতে যেতাম।

সন্তানের প্রতি এক বাবার কতটা আত্নার সম্পর্ক, টান তা এই প্রথম বুজতে পারলাম।
মা, মেয়েকে ছেড়ে আসার সময় কষ্টে আমার বুকের ভিতরটা কেঁদে উঠতো কিন্তু চোখ কাঁদত না ছেলে মানুষ বলে কথা। ছেলেদের এতো সহজে কাঁদতে হয়না।

ছয়মাস পর সামিহা, মেয়ে সহ ঢাকায় গেলাম।
গাড়ি থেকে নামার পর আমি কি একটা কাজের জন্য সামিহা আর মেয়েকে রাস্তার একপাশে রেখে অন্যপাশে যাই।

অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি, সামিহা হঠাৎ সামাহ্ কে কোলে নিয়ে এপাশে আসতে চাইছে আমি হাত দিয়ে বার বার নিষেধ করছি যে আমি আসছি তোমাদের কাছে। কিন্তু সামিহা কি বুঝলো কে জানে আমার চোখের সামনে রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা বাস এসে সামিহার উপর দিয়ে চলে যায়। আমি চিৎকার করে দৌড়ে ওদের কাছে আসি, মূহুর্তে সেখানে অনেক লোক জড়ো হয়। সামিহার মাথার মগজটা রাস্তায় লাফাচ্ছিলো আর সামাহ্ কে আমি দেখতে পারি নাই কোথায় হারিয়ে গেছে আমার কলিজাটা , মাথার মগজটা নিয়ে সামিহার রক্তাক্ত মাথার ভিতর রাখছিলাম আর আল্লাহ আল্লাহ বলে চিল্লাতে থাকি।

তারপর আমার আর কিছু মনে নেই, অতিরিক্ত কষ্ট সহ্য করতে না পারায় আমার ব্রেইন স্ট্রোক করে।
বয়স কম থাকায় সেবার বেঁচে যাই কিন্তু কথা বলার শক্তি টুকু হারায় ফেলি আমি। অবশ্য আমি চাই না কথা বলতে যেখানে আমার সামিহা আর সামাহ্ নাই।
গ্রামের বাড়ির সামনে ওদের কবর দেখে কবরের পাশে বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি আমি।
সেসময় পরিবারের মানুষ, আম্মার কাছে অনেক মানসিক সাপোর্ট পাই।

কোনোদিন রাতে ঘুম ভাঙলে আমার বুকের ভিতরটাই ভেঙে চুরমার হতো কষ্টে, চারিদিকে হাহাকার, শূন্য লাগতো সবকিছু এতটা খারাপ লাগতো ভাষায় বুঝাতে পারবো না, গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট লাগে তখন নিজের ।

সবসময় নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখতাম জন্য আব্বা ওনার ব্যবসার দায়িত্ব আমায় দেন, আমি কথা বলতে পারি না জন্য সবকিছু দ্রুত লিখে দিই। অল্পদিনে ব্যবসায় সফল হই, কিন্তু কষ্ট লাগে খুব বাড়ির সামনে কবর দুটো দেখে তাই সপরিবারে শহরের বাড়িতে এসে থাকা শুরু করি।

এই পাঁচ বছরে আল্লাহর রহমতে ব্যবসাটাকে সফলভাবে অনেক দুরে নিয়ে যাই।

আজ অনেক বছর পর নানার বাড়িতে গেলে একটা মেয়ে কে আমার চোখে লাগে, তার নাম আমার অজানা,,,,

এরপর আরো কয়েক পৃষ্ঠা ভর্তি লেখা আমার আচরণের কথাই লিখছেন মনেহয়, আর পড়তে পারলাম না।

আমার চোখের পানি কোনো কথা শুনছে না ডাইরির পাতা ভিজে গেছে, মানুষটার জীবনে এতো কষ্ট আর আমিও কতো অত্যাচার করেছি। ডাইরিটা বন্ধ করে, ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ওনার আনা নীল রঙের শাড়ী আর চুড়ি পড়লাম। খোঁপা করছি কিন্তু বেলি ফুলের মালা আজ কোথাও নাই, আবার চোখ থেকে পানি পড়ছে।

নিজেকে সামলিয়ে চুল খোলা রেখেই রুম থেকে বের হলাম, ওনার খোঁজে পুরো বাড়ির প্রতিটা রুম তন্নতন্ন করে খুঁজলাম কিন্তু কোথাও নেই।
এখন আমার বুকের ভিতরে ঝড় উঠছে কালবৈশাখী, যতক্ষণ খুঁজে না পাচ্ছি ওনাকে এ ঝড় থামবে না।

ছাঁদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, হঠাৎ মনে হওয়ার দৌড়ে ছাঁদে যাই। ছাঁদের একপাশে দাঁড়িয়ে পশ্চিম আকাশের রক্তিম সূর্য দেখছিলেন তিনি।

একদৌড়ে পিছন থেকে জড়ায় ধরি ওনাকে আর কেঁদে ক্ষমা চাই আমার এতোদিনের আচরণের জন্য, তখন উনি আমার ঠোঁটে ওনার একটা আঙ্গুল রেখে চুপ করতে বলে আমায় সেই সাথে চোখের পানি মুছে দেয়।
এপাশ ফিরে উনিও জড়িয়ে ধরে আমায় মাথায় হাত বুলায়, খোলা চুল দেখে নিজেই খোঁপা বেঁধে তাঁর বাগানের কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে গুঁজে দেয় খোঁপায় সেই সাথে আমার কপালে তার দুই ঠোঁটের আলতো ভালোবাসার ছোঁয়া দেয়।

আমি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরি তাকে, আর বলি সারাজীবন এভাবে জড়িয়ে থাকবো আপনাকে যেনো আমাদের কলিজা দু’টো মিশে এক হয়ে থাকে।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *