প্রেমে পড়া বারণ

প্রেমে পড়া বারণ !! Part- 15

আজ রবিবার। বাঙালি গেট টুগেদারে আমি আর রেহানও এসেছি। দেশের মানুষদের দেখে মন ভরে গেলো।।
সবাই খুব ফ্রেন্ডলি। এখানে থাকার সুবাদে অনেকেই আমার পরিচিত।
রেহান ওর পরিচিত, বন্ধুদের সাথে কথা বলছে।
আমিও সবার সাথে গল্পে মজে গেছি।
এর মধ্যে এক ভদ্রমহিলা এসে কথা জুড়ে দিলেন। আমার বাড়িতে কে কে আছে! আরও অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন।
তারপর শুরু হলো উনার সংসারের গীত।ওরে বাবা! এই মহিলা কথা বলছে তো বলছেই।আমি শুধু মাথা নেড়ে,হা,না বলে সায় দিয়ে যাচ্ছি।।
আল্লাহ! কেউ এসে উদ্ধার করুক আমাকে!!
– কেমন আছো তুমি?
ফিরে দেখি আফরিন! আফরিন কখন এসেছে সেটা খেয়াল করিনি।
– আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
– আমিও ভালো আছি।
যে মহিলার সাথে কথা বলছিলাম,উনার কাছ থেকে উদ্ধার পেতে আফরিনের দিকে মনোযোগ দিলাম আর মহিলাও উনার পরিচিত অন্য একজনকে পেয়ে বেশ খুশি মনে চলে গেলেন।
– তুমি কি এখানে আরও কিছু দিন থাকবে?
– খুব বেশি দিন না।রেজাল্টের পরে চলে যাবো।
– তুমি দেখতে অনেক সুইট!
মৃদু হেসে বললাম – আপনি কিন্তু অনেক সুন্দর। আপনার এইজ কেউ দেখে অনুমান করতে পারবে না।
– তাই নাকি! হাহাহা…
ভালো বলেছো তো! তাহলে সারাজীবন এই এইজ লক হয়ে গেলে ভালো হতো, তাই না?
আফরিনের কথায় আমিও হাসলাম।
কিছু সময় চুপ করে থেকে আফরিন বললো
– তুমি কি আমাকে চিনো?
ওর প্রশ্নে একটু চমকে উঠলাম।
– হা,বেশ অনেক দিন আগেই তো পরিচয় হলো আপনার সাথে। তখন থেকেই তো চিনি।
– তার আগে কি চিনতে না?
– নামেই চিনতাম। কিন্তু সরাসরি তো পরিচয় ছিলো না, চিনতামও না।
– রেহান বলেছে, তাই না?
– হা।রেহান ছাড়া কোথা থেকে জানবো বলুন?
আফরিন মৃদু হাসলো।।
– তোমাকে আমার অনেক ভালো লেগেছে।
একটা কথা বললে কিছু মনে করবে নাতো?
– বলুন, কিছু মনে করবো কেন?
– এই যে আমি এখানে, রেহানও! এতে তোমার ভয় হচ্ছে না?
– কেন ভয় হবে?
– না মানে, অধিকাংশ মেয়েরাই স্বামীর এক্সকে সহ্য করতে পারে না। কোনো ভাবে যোগাযোগ হলে ভাবে – এই বুঝি স্বামী ছিনিয়ে নিলো!
হাহাহা…
আমি অবাক হয়ে দেখছি।কি সাবলীল ভাবে আফরিন কথাগুলো বলছে!
– সত্যি কথা বলবো? আমার প্রথমে একটু অস্বস্তি হয়েছিলো যেদিন আপনাকে আর রেহানকে এক সাথে রাস্তায় দেখি।
আর হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়?
আফরিন একটু চমকে গেলো যখন শুনলো ওদের রাস্তায় দেখেছিলাম আমি।
– হুম। এখন হচ্ছে না?
– না।।
– কেন জানতে পারি?
– কারণ রেহানকে আমি চিনি। He is straightforward & loyal!
– Yeah! He is perfectly gentleman I’ve ever seen!
-জি।রেহানের মনে যা মুখেও তা,কখনো মিথ্যার আশ্রয় নেয় না।
– তুমি অনেক লাকি! রেহানকে পেয়েছো!
আমি মৃদু হাসলাম।
– আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি? যদি মাইন্ড না করেন..
– আমি জানি কি জিজ্ঞেস করবে!
– জানেন?
– হা। আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে কেন! সেটাই তো?
একটু হেসে বললাম – আপনার ধারণাটা ভুল!
– ভুল?
– জি!
– তবে জিজ্ঞেস করো!!
– আপনি তো রেহানের হাত ধরে দেশেই চলে যেতে পারতেন। যাননি কেন?
আফরিন স্তব্ধ মুখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো আমার দিকে।।
– তুমি অনেক অদ্ভুত একটা মেয়ে! এটা জিজ্ঞেস করছো কেন যাইনি!?
– হা। এটাই জানার আগ্রহ হচ্ছে এখন।
– এখন হচ্ছে! মানে আগে ছিলো না।তো এখন আগ্রহ হবার কারণ টা কি শোনা যাবে?
– নিশ্চয়ই! আপনি অন্যদের মতো না। তাই এভাবে সাবলীলভাবে কথাগুলো বলতে পেরেছেন।
আফরিন একটু হেসে বললো
– আমি এই দেশ ছেড়ে যেতে চাইনা। তাই রেহানের হাত ধরতে পারিনি।
– সত্যিই কি তা-ই?
– সত্যিই তা-ই। অনেক ভাববে এই আরামের জীবন ছেড়ে যেতে চাইনা, তাই দেশে ফিরতে চাইনা। কিন্তু এই প্রথম তোমাকে সত্যি টা বলতে ইচ্ছে করছে। কারণ তুমিই বুঝতে পেরেছো।
– আমার ধারণা তাহলে ভুল না।এর পিছনে অন্য একটা কারণ নিশ্চয়ই আছে।
– আমার দাদু একজন দেশ বিরোধী ছিলেন। উনার জন্য আমরা লজ্জিত। সেই জন্যই বলতে পারো মুখ লুকিয়ে দেশের বাইরে পড়ে আছি।অবশ্য রেহান সেটা আজও জানে না।
আরও একটা কারণ আছে।
– কি?
আমার বোন! আমার একটাই বোন ছিলো আমার বড়।
– ছিলো মানে?
– মারা গেছে। ব্লাড ক্যান্সার হয়েছিলো। আমরা প্রায় সমবয়সী ছিলাম।দেড় বছরের ব্যবধান! সারাক্ষণ দুজনে একসাথে থাকতাম। একটা মুহূর্ত মনে হয় না আমরা আলাদা থাকতাম। অনেকে ভাবতো আমরা টুইন!!
ও যখন মৃত্যুশয্যায়,আমাকে বলেছিলো- আমার ভীষণ ভয় লাগছে। তুই হাতটা ছাড়িস না।
সেদিন ওকে রেখে জরুরি একটা কাজে বের হয়েছিলাম। আব্বু আম্মু ছিলো ওর কাছে।
মাত্র আধা ঘণ্টা! এসে দেখি সব শেষ!
ও চলে গেছে। আমি ওর পাশে থাকতে পারিনি। ও বলেছিলো – তুই আমার পাশে বসে থাক, তোকে দেখি।
মরে গেলে তো দেখতে পাবো না!
ওর শেষ সময়ে ধরা পড়ে। অনেক চিকিৎসা করিয়েও লাভ হয়নি।শেষ কটা দিন ওর ইচ্ছে অনুযায়ী বাসায়ই রাখা হয়।
বোন আমার মৃত্যুর দিন গুনেছে!!
আমি শুধু দেখেছি।
বলতো- আমি মরে গেলে একা কিভাবে থাকবো? তুই রোজ দেখতে যাবি তো?!
আফরিনের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে!
আমার চোখ থেকে কখন পানি গড়িয়ে পড়ছে টের পাইনি।
– আমি ওকে রোজ দেখতে যাই।।
জানো, রেহান খুব ভালো ছেলে। কিন্তু আমার বোনের থেকে বেশি ভালো ওকে বাসতে পারিনি। হয়তো ভালোবাসা কি সেটাই আমি বুঝিনা।
কিন্তু এতো টুকু বুঝি, আমি মেহেরিনকে একা করে কোথাও যাবো না।মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ওর কাছাকাছি থাকবো।
একটাই দোয়া করি সবসময়- মৃত্যুর পরে যেন ওর পাশেই আমার সমাধি হয়।
আমি আর আফরিন একটু দূরে বসেছিলাম।ভাগ্যিস কেউ আমাদের কাঁদতে দেখেনি।দেখলে একটা বিশ্রী অবস্থা হয়ে যেতো।
– আমার বিয়েটা আব্বু আম্মুর পছন্দে করেছিলাম।রেহানের সাথে এনগেজমেন্ট ভাঙার পরে উনারা খুব প্রেশার দিতে থাকেন।শেষ পর্যন্ত কিছু না ভেবেই বিয়েটা করি।
কিন্তু পরে আস্তে আস্তে বুঝতে পারি উচ্চ শিক্ষিত! প্রতিষ্ঠিত হলেও কিছু মানুষের মন-মানসিকতা অনেক সংকীর্ণ হয়!
নিত্যদিনের অশান্তি থেকে আমার স্বাধীন জীবন ই বেছে নিয়েছি।
– কি বলবো! কি বলা উচিত আমি বুঝতে পারছি না!
আফরিন আমার দিকে তাকিয়ে বলে
– কিচ্ছুটি বলার দরকার নেই। আজ অনেক হালকা লাগছে জানো! মনে হয় রেহানকে ঠকিয়েছি! কিন্তু আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি।।
রেহান তোমার হবে বলেই আমার হয়নি।
– অনেক দিন তো হয়ে গেছে। আপনি নতুন করে জীবন শুরু করছেন না কেন?
আফরিন মুচকি হেসে দূরে একটা লোককে দেখিয়ে বললো
– অই যে উনি! উনার সাথে আমি এনগেজড!ভালো মনের মানুষ।।
গতমাসেই রিং পড়িয়েছে।
আরও ৩-৪ মাস আগেই হবার কথা ছিলো কিন্তু একটা সমস্যার কারণে পিছিয়ে গেছে।
২-১ মাসের মধ্যেই বিয়ে টা হয়ে যাবে। এই লোকটা ভালো। অনেক টা সময় নিয়েছি সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য।
উনার সাথে লাইফ কাটানো যাবে।
– আপনি অনেক সুখী হবেন। দোয়া থাকবে সবসময়।
– তুমি অনেক ভালো মনের মানুষ। রেহান ই লাকি।তোমাকে পেয়েছে।
– আপনার সাথে কথা বলে আজ অনেক ভালো লাগছে।
– আমারও। কিন্তু একটা প্রমিজ করতে হবে যে!
– কিসের?
– মেহরিনের মৃত্যুর পরে এই প্রথম কারো সাথে মন খুলে কথা বললাম। কথা দাও এককথা গুলো আমাদের মাঝেই থাকবে।
একটু ভেবে বললাম
– ঠিক আছে কথা দিলাম।
– না চাইতেই কেমন বন্ধুত্ব হয়ে গেছে তোমার সাথে। একদিনের বন্ধুত্ব! আজীবন মনে থাকবে।
– একদিনের কেন হবে?
– একদিনের ই।কারণ এর পরে আর কখনো আমাদের দেখা হবে না। তাই।
– দেখা না হলে যোগাযোগ তো হতেই পারে ।
– না।
– কেন?
– তুমি এখনো বাচ্চা মেয়ে রয়ে গেছো।
আফরিন আলতো করে গালে ছুঁয়ে বললো।
কিছু মানুষ জীবনে দ্বিতীয় বার না ফিরে আসাই উত্তম।
সেটা আমার জন্যও, তোমার জন্যেও।
চলো ওদিকে যাই।অনেক সময় ধরে এখানে।
অবাক হয়ে দেখছি এই মেয়েটাকে!
এমন ও মানুষ হয়!
বাস্তববাদী!
– হুম চলেন।
রেহান দেখেছে আমি আফরিনের সাথে কথা বলে হেঁটে আসছি।
চলবে….

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *