পূর্ব রোদ

পূর্ব রোদ !! Part- 36

মেঘের কোনো উত্তর না পেয়ে করুণ কন্ঠে নাবিলা আবার জিজ্ঞেস করলো,”ভাই,নিলয়ের সাথে তোর ইন্ডিয়ায় মিট হয়নি?”
প্রতিত্তোরে এবারেও মেঘ চুপ করে রইলো।মূলত মেঘের অবস্থা এখন এমন যে কথা বললেই চোখ থেকে জল পড়বে।মেঘ জানালার চারপাশে তাকালো।নাবিলা মেঘের আচরণে অবাক থেকে যেমন অবাক হচ্ছে তেমনি ভয়ও পাচ্ছে।নিলয়ের কথা বলায় মেঘ চুপ কেনো হয়ে গেলো?
নাবিলা হার মেনে নেবার পাত্রী না।চর্তুথ বারের মতো নিলয়ের প্রসঙ্গে আবার প্রশ্ন করলো।নাবিলা মেঘের সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে বললো,”তুই আমার কথা পাত্তা দিচ্ছিস না কেনো?মেঘ আমি কিছু বলছি।নিলয়…”
“হি ইজ নো মোর!”
চার অক্ষরের বাক্যটা বুঝতে নাবিলা’র সামান্য বেগ পেতে হলো।”হি ইজ নো মোর!”এই বাক্য ধারা মেঘ কী বুঝাচ্ছে তা আড়ষ্ট হয়ে নাবিলা জিজ্ঞেস করলো,
“মা..মানে?” তখনি ঝড়ের গতিতে মেঘ এসে নাবিলা’কে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিলো।নাবিলা’র আর বুঝতে বাকি রইলো না একথা সঠিক অর্থ কী!নাবিলা বুকটা দুমড়ে-মুষড়ে উঠলো।ভিতরের কিছু একটা ছিড়ে ফেলার মতো ব্যাথা অনুভব হচ্ছে।মনে হচ্ছে সে এ জগতে নেই।যেনো শূন্যে ভাসছে আর তার সামনে নিলয় নামের মানুষটি!নিলয়!এ মানুষটা নাবিলা’র জীবনটা কেমন করে দিলো?কোন স্রোতের দিকে চলছে সে?

“জানো তো পূর্ব আমাদের সম্পর্কটা পরিপূর্ণ হওয়ার পরও আমার কেনো জানি মনে হয় কোনোকিছু কমতি কমতি।”
“কমতি,কমতি?আমম..তুমি কী ইনডাইরেক্টলি বেবি’র কথা বলছো রোদ?”
কথাটা বলে ওপাশে পূর্ব হু হু করে হেঁসে উঠলো।কিন্তু রোদের কাছে বিষয়টা মোটেও রসিকতা মনে হলো না।সে সিরিয়াস!সব ঠিক থাকলে বেবি তো আসবে।রোদ নিজেকে প্রশ্ন করলো তার কমতি কমতি কেনো মনে হয়?পূর্ব নেই বলে?নাকি পূর্ব’কে বেবির কথা বলা হয়নি দেখে?
রোদ নিজের দেহে থাকা ছোট্ট প্রাণ’টা দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।এ’কে নিয়ে কতো হাজারো স্বপ্ন বুনে রেখেছে রোদ!পূর্ব’কে বাবা হওয়ার খবরটা জানাতে রোদের বেশ ইচ্ছে করে।কিন্তু রোদ চাই না পূর্বের স্বপ্ন থেমে যাক।তাই রোদ ঠিক করে রেখেছে বাচ্চা হওয়ার পরই পূর্বকে জানানো হবে।নয়তো অনেকটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।
“ও হ্যালো রোদ?রোদ?”
“হু হু।”
“কোন রাজ্যে হারিয়ে গেলে?”
“আমাদের রাজ্যে!”
রোদের আবেগ ছোঁয়া বাক্য শুনে পূর্বের মুখের হাসি নামক বাকা রেখা ফুটে উঠলো।আজকাল রোদ বড্ড বাচ্চামো করে।অনেকটা কিশোরী’র মতো!যেন মনে প্রেম নায়ক রঙটা প্রথম কেউ ছোঁয়ালো।অবশ্য প্রথম ছোঁয়া’টা পূর্ব ছোঁয়ে দিয়েছে।সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরী যেমন তার প্রেমিকের জন্য শত আবদার,আকাঙ্খা,অভিমান পুষে রাখে রোদও ঠিক তেমন!রোদের ব্যবহারে পূর্বেরও মাঝেমধ্যে মনে হয় সেও আবেগ নামক অনুভূতি’র শহরের বাসিন্দা!অবশ্য প্রতিটা মানুষ অনুভূতি নামক শহরের বাসিন্দা।
“পূর্ব,আমাদের যদি বেবি হয় তাহলে কী নাম রাখবো?”
রোদের কথা শেষ না হতেই পূর্ব ফটাফট উত্তর দিলো,”নক্ষত্র!”
পূর্বের এতো জলদি উত্তরে রোদ অনেকটা ভ্যাচকা খেলো।সে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,”নক্ষত্র?এটা কেনো?”
“নক্ষত্র কেমন জানো তো?নক্ষত্রের নিজস্ব সম্পত্তি থাকে।নিজে ত্যাগি হয়।আর সবমিলিয়ে আমাদের সবার নামের সাথে মিলে।”
“মানে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে প্রথম সন্তানের নাম ‘নক্ষত্র’ হবে?”
“হুম।বাট তুমি এসব কেনো তুলছো?”
“জানতে ইচ্ছে হলো।”
দুজনে এভাবেই কথা চালিয়ে গেলো।কথা বলার এক পর্যায়ে রোদ ঘুমিয়ে পড়বে।তখন পূর্ব মুচকি হেসে কল কেটে দিবে।এটা তাদের দৈনন্দিনের রুটিন!কথা বলতে বলতে রোদ ঘুমিয়ে পড়বে।পূর্ব পুরাতন স্মৃতি’র অধ্যায়’টা খুলে বসবে!

“মা আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি।”
“কী?নীরা কী বলছিসটা কী?”
“মা..তুমি এতো হাই লেভেলের কোনো হয়ে যাও বলোতো?”
“হাই লেভেলের হবো না?কী আবোল তাবোল বকছিস?”
“তুমি শান্ত হয়ে বসো।আমি সব বলছি।”
নাবিলা কথায় বিচলিত হয়ে নিনা হাসান সোফায় বসলেন।তিনি অস্থির হয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করার জন্য ঠোঁট জোড়া নাড়তেই নাবিলা তার মুখের সামনে পাঁচ আঙ্গুলের বাম হাতটা রেখে বললো,”আমি যা বলছি চুপটি করে শুনো।”
নিনা হাসান সম্মতিসূচক দৃষ্টি জানার দিলেন।নাবিলা খানিক সময় নিরব থেকে বললেন,”বাবা’র থেকে দূরে আছি অনেক দিন।তোমাকে পেয়ে যে বাবা’কে একেবারে ভূলে যাবো তা কিন্তু নয় মা।গত রাতে ফাহিয়া মানে বাবার দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে ফোন করে কান্নাকাটি করছিলো।বাড়িতে নাকি ছোটমা প্রবলেমে আছে বললো।আমাকে বললো আমি যেনো জলদি আমেরিকা চলে যায়।তাই মা ভাবছিলাম আমেরিকা কিছুদিন গিয়ে ঘুরে আসি।”
“কিন্তু তুই…”
“মা,আমি জলদি চলে আসবো।রোদের ডেলিভারি হওয়ার আগে।”
“আমাকে এভাবে ফেলে যাবি?”
“তাহলে তুমিও চলো।ঘুরে আসবে।”
“এ্যাএএ..না না না।আমি যাবো না।”
“তাহলে আমাকে যাওয়াী অনুমতি দাও।প্লিজ প্লিজ..”
“কখন যাচ্ছিস?”
“কাল রাতে ঢাকা যাবো।ঢাকায় গিয়ে পাসপোর্ট,ভিসা সব চেক করবো,রোদের সাথে দেখা করবো।তারপর এসে একেবারে চলে যাবো।”
“তাহলে কিন্তু তুই রোদের ডেলিভারি’র আগে আসবি।”
“একদম।”

নিনা হাসানের সম্মতি লাভ করে নাবিলা নিজের রুমে গেলো।এখন তার মন তৃপ্ত!বাংলাদেশে দিন দিন তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো।প্রতিটা দিন নিলয় সামনে ভাসে।এই যেনো ডাক দিলো,”পাখি?”নাবিলা বুক চিড়ে কান্না আসলো।নিলয়কে ছাড়া থাকাটা অভ্যাস করে নিচ্ছিলো তো।কিন্তু নিলয় তার লাইফে আবার এসে সবকিছু এলোমেলো করে দিলো।নাবিলা’র অজান্তেই চোখ থেকে দু’ফোটা অভি গড়িয়ে পড়লো।ছোট বেলায় থাকতে মা-বাবা আলাদা হয়ে যায়!আস্তে আস্তে সে বেড়ে উঠে ‘পর’ দেশে!জন্মস্থানের সাথে তো আর সবদেশের তুলনা হয় না!তখন না কোনো বন্ধু পেলো সে আর না খেলায় সাথী।তখন থেকে নাবিলা নিজেকে যতোটা সম্ভব বাইর থেকে কঠিন রাখে।কিন্তু ভেতরেরটা আজও একি রকম।নিলয়’কে পেয়ে মনে হয়ে ছিলো একপলাশ স্থায়ী সুখের ছায়া তার মন দখল করছে।হ্যা,সত্যিই সুখের ছায়া তার মন দখল করে নিয়েছিলো কিন্তু সেটা সাময়িক!তারপর তার জীবনে নিলয় নামের অধ্যায়টা আবার শুরু হলো।কিন্তু পরিণাম?পরিমাণ তো কষ্ট দিয়েই শেষ হলো।
নাবিলা নিজের চোখের নিচের নোনা জল মুছে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করলো।কান্না তো বাঁধ ভাঙ্গা নদী!একবার শুরু হলে থামানো কষ্টকর।
সিলেট আসার পনেরো দিন পার হলো।এ ক’দিনে মেঘ অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছিলো।কিন্তু নাবিলা তাকে পুরোপুরি ভাঙ্গতে দেইনি।”মৃত্যু এক কঠিন সত্য” বলে মানিয়েছে।নিজের ভেতরে থাকা কষ্টের পাখিদের একদম পাখা ঝাপটাতে দেইনি মেঘের সামনে।তা নাহলে আজ মেঘ’কে সামলানো যেতো না।নাবিলা জানতে পেরেছে নিলয়ের ক্যান্সার ছিলো।তার মায়ের পাশাপাশি তারও ক্যান্সার হলে নিলয় সেটা এড়িয়ে যায়।যার ফলে দিন দিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেলো।নাবিলা’র আশেপাশের মানুষ জন এমন কেনো?শুধু তাকে কষ্ট দে!তারা কর একবারও বুঝে না তার কষ্ট হয়।অবশ্য মানুষের ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি কৃত্রিম না প্রকৃত সেটা ক-ম মানুষই বুঝে!

“ইন্না-লিল্লাহ!নাবিলা’র বাচ্চা তোরে এমন আবোল মার্কা ডিসিশন কে নিতে বললো?”
“তাইলে কী করবো আমি?”
“তিহান তুই শান্ত হো।নাবিলা তুই আমেরিকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলি ক্যান?”
“ভাবলাম ঘুরে আসি।”
ফোনের তিন প্রান্তে থাকা তিন ব্যাক্তি কিছুটা সময় চুপ ছিলো।পূর্ব হয়তো নাবিলা’র মনের অবস্থা আন্দাজ করতে পারছিলো কিছুটা।তাই সে খানিকটা সময় ভাবলো।শেষে মুখ ফুটে বললো,”আচ্ছা যা আমেরিকা।কিছুদিন ঘুরে আয়।”
পূর্বের কথা শুনে নাবিলা এপাশে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।যাক তাহলে এখন বাংলাদেশ থেকে মোটামোটি বিদায়!কিন্তু তখনি ব্যাঘাত ঘটিয়ে তিহান বললো,
“ইন্না-লিল্লাহ!পূর্ব তুই বলে দিলি ক্যান যেতে?”
“তিহান বাদ দে।ঘুরে আসুক।এখন তুইও শরীয়তপুর,আমিও কানাডা তাই মনে হয় নাবিলা’রও ঘুরা দরকার।আন্টি পারমিশন দিলে ঠিক আছে।”
পূর্বের কথায় তিহান আর উল্টো প্রশ্ন করলো না।এভাবে কিছুটা সময় থাকার পর নাবিলা তাদের জানিয়ে দিলো ঢাকায় যাওয়ার কথা।পরে অনেকটা সময় তিন বন্ধু মোবইল নামক প্রযুক্তি’তে আড্ডা জমালো।
[চলবে]