পূর্ব রোদ !! Part- 08
চাঁদনি মোহাম্মদের পিছু পিছু কাপড়ে ব্যাগ নিয়ে রোদ নিচে গেলো।চাঁদনি মোহাম্মদ আর সূর্য মোহাম্মদ থেকে দোয়া চেয়ে পূর্ব-রোদ সিলেটের উদ্দেশ্য রওনা দিলো।
রোদ আর পূর্ব সিলেট গিয়ে নিজেদের পুরাতন বাড়িতে উঠলো।বাড়িটা মূলত তৈরি করেছিলো পূর্বের দাদা।পূর্বের দাদিমা ঘুরতে ভীষণ পছন্দ করতো।আর উনি সময় কাটানোর জন্য শান্ত পরিবেশ বেচে নিতেন।সেই কারণে পূর্বের দাদা উনার জন্য আলাদা করে এই বাড়ি তৈরি করেন।উনারা দু’জন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করার পর পূর্বের বাবা-মা ঘুরতে আসতেন।
চারকোনা একটি খোলা মাঠের শেষ অংশে দু’তালা বাড়ি।একপাশে একটি গোল আকৃতির পুকুর,সেই পুকুরে মাছের চাষ হয়েছে।তার পাশে ফুলের বাগান।সাদা,লাল,হলুদ,কালো গোলাপ সব রকমের গাছ আছে।ফুলের বাগানটা বানানো হয়েছে পূর্বের মায়ের ইচ্ছায়।বাড়িটার পেছন দিকে শাক-সবজি’র বাগান।পূর্বের দাদিমা’র ইচ্ছে ছিলো তিনি যখন সিলেটে থাকবেন তখন কোনো রকমের আয়েশ করে খাবেন না।নিজে গাছ রোপন করে,নিজে কাজ করে খাবেন।আর উনার কথায় সাই দিয়ে পূর্বের দাদা সবটা তৈরি করেন।
রোদ হা করে চারপাশ’টা ঘুরে ঘুরে দেখছে।তার শ্বাশুড়ি বলেছিলো এই বাড়িটাতে নাকি প্রায় আসতো।পূর্বের মা শান্ত পরিবেশ পছন্দ না করলেও সিলেটের এই পরিবেশটা তার ভীষণ ভালো লাগে।তিনি এটাও বলেছেন যে ফুলের বাগানে নাকি সব রকমের ফুল আছে।রোদ ফুলের বাগানের দিকে পা বাড়ালে পূর্ব বললো,
“সবকিছু পরে দেখিস জাদুমন্ত্রী।আগে বাড়ির ভিতর গিয়ে সবকিছু দেখ।যত্তসব!”
পূর্ব বিরক্তি নিয়ে বাড়ির ভিতর ডুকে গেলো।রোদ হা করে তাকিয়ে রইলো।গত দেড় মাস হলো পূর্ব তুই-তোকারি করে না।আজকে হঠাৎ কী হলো?এমন কেনো করলো?রোদ কী খারাপ কিছু বলেছে?তবে রোদ এইটা অনুভব করতে পারছে যে পূর্বের ব্যবহার তার ভালো লাগছে না।মন খারাপ করে রোদও বাড়িতে ঢুকে পড়লো।
রোদ বাড়ির ভিতর ঢুকে শকট খেলো।নিচ তলা খুব সুন্দর ভাবে গোছানো।রোদের যতটুকু মনে আছে লাস্ট বার পূর্বের মা-বাবা সিলেট এসেছিলো একবছর আগে।তাহলে এতো সুন্দর করে গুছালো কে?পূর্ব গোলাকৃতি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলো।তখন পেছন থেকে রোদ বললো,
“বাড়িটা এতো সুন্দর করে সাজালো কে হরিচন্দন?”
“ভূওওত!”
পূর্বের কথা শুনে রোদ ভালো ভাবে বুঝলো পূর্বের মাথায় অতীতে’র ভূত চেপে।পরক্ষণে আবার বিড়বিড় করে বললো,
“দেড় মাস ভালো ভূত ভর করেছিলো।এখন সেই ভূত ভাগছে।”
উপরের তলায় উঠে রোদ আবার শকট হলো।নিচেরটা যেমন খুব সুন্দর করে গুছানো ঠিক তার উল্টো হলো উপরের তলা।চারিদিকে মাকড়শা ছড়ানো।দরজায় অবধি ধূলা জমা।উপরের তিনটে রুম আছে।যার মধ্যে একটি রুম পরিষ্কার বাকি দুটো ধূলায় ভরা।পূর্ব রোদ একে অন্যজনের দিকে তাকিয়ে সেই রুমের দিকে দৌড় দিলো।পূর্ব আগে থাকায় সে গিয়ে দরজা খুললো।দরজা বন্ধ করার আগে রোদও ঢুকে পড়লো।পূর্ব বিছান দখল করলে রোদ সোফা দখল করে।রোদ রেগেমেগে বললো,
“হরিচন্দন তুই এখান থেকে যা।আমি থাকবো এই রুমে।”
“এ্যাহহ!শখ কতো?আমি আগে আসছি এই রুমে।তুই ভাগ।”
“আমি এখানে মানে এইখানেই থাকবো।”
“এই রুমে থাকবি ক্যান?পাশের দুটো রুম ময়লা’য় ভরা।যা গিয়া ও গুলাতে থাক।”
“তুই পরিষ্কার করে দে।তাইলে থাকুম।”
“জীবনেও না।মেয়ে হয়েছিস তুই।পরিষ্কার করবিও তুই।”
“করতাম না।নিচে রুম নেই?”
“জানি না।”
পূর্বের উত্তর শুনে রোদ সোফা থেকে উঠে নিচে নেমে গেলো।চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো মাত্র দুটো রুম।তার মধ্যে একটি স্টোররুম অন্যটা কারো থাকার ঘর মনে হচ্ছে।রোদ বা’পাশে গিয়ে দেখলো যথেষ্ট বড় রান্না ঘর।আর রান্না করার জন্য সমস্ত জিনিস আছে।
এতো কিছু দেখে রোদের মনে হলো এই বাড়ি দেখা শুনার জন্য কেউ আছে।কিন্তু আসার সময় পূর্বের মা তেমন কিছু বলে নি।রোদ রুমে গিয়ে দেখলো পূর্ব আরামে বসে মোবাইল টিপছে।দেখেই রোদের রাগ উঠলো।এতো দূর এসে ফ্রেশ না হয়ে এক জায়গায় বসে আছে।রোদ পাশ থেকে ব্যাগ নেওয়ার ভান করে ব্যাগের বারি দিয়ে পূর্বের হাত থেকে মোবাইল ফেলে দিলো।তা দেখে পূর্ব বললো,
“হুয়াট দ্যা হ্যাল আর ইউ ডুয়িং?”
“আমার যা কাজ করে নিচ্ছি।তোর মতো ফ্রেশ না হয়ে মোবাইলে চ্যাট করছি না।হরিচন্দন!”
“আমার যা ইচ্ছে করবো তোর কী?”
“কর।”
রুম থেকে বেরিয়ে রোদ পূর্বের মা’কে কল দিলো।দুবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করলো,
“আম্মি?”
“হ্যা বল।পৌঁছে গেছিস তোরা?”
“হুম।একটু আগে।কিন্তু আম্মি তুমি তো আমাকে বলোনি যে এখানে এই বাড়িটা কেউ দেখাশুনা করে।”
“একজন মহিলা আর তার স্বামী দেখা শুনা করে।কিন্তু উনারা কয়েক আসবেন না।তোকে করতে হবে সব কাজ।”
“কাজ তো আমি করে নিবো।কিন্তু আম্মি এখানে দুটো রুম খুব অপরিষ্কার।একটা রুম ফাঁকা আছে।”
“সমস্যা কী?তোরা দুজন এক রুমে থাকবি।”
“কীহ?তুমি পাগল হয়ে গেছো আম্মি?আমি আর হরিচন্দন ঘুমাবো?তাও একরুমে?”
“ও মা!এভাবে বলার কী হয়েছে?তোরা দুজন স্বামী-স্ত্রী।এক রুমে থাকলে কী হবে?”
“আম্মি তুমি জানো আমাদের সম্পর্ক’টা কেমন।”
“আগের চেয়ে তো এখন অনেক বেটার।”
“বেটার মাই ফুট।হরিচন্দন আবার আগের মতো বিহেভ শুরু করেছে।আমার মনে হয় আম্মি ওর মাথায় ক’দিন “ভালো ভূত” বসেছিলো এখন ঠিক হয়েছে।”
“পূর্ব তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে?”
“হ্যা।তা তো আগেও করতো।”
“ওহ।খেয়েছিস কিছু?”
“নাহ।ফ্রেশই হলাম না এখনও।”
“শুন পূর্ব যে বড় ব্যাগটা নিলো না ঐটাতে আমি আলুর দমের সাথে লুচি দিয়েছি।ফ্রেশ হয়ে দুজনে খাস।”
“আচ্ছা।মামুনি’কে বলে দিও আমরা পৌঁছে গেছি।”
“ঠিক আছে।”
কথা শেষ করে রোদ রুমে গিয়ে দেখলো পূর্ব এখনো আগের মতোই আছে।বিরক্তি নিয়ে রোদ ব্যাগ থেকে কাপড় বের করতে লাগলো।আড়চোখে তা দেখতে পেয়ে পূর্ব ব্যাগ থেকে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।সাথে পূর্বকে ধাক্কা দিয়ে রোদও ঢুকে পড়লো।পূর্বের হাতের সাথে লেগে ঝর্ণার কল ছেড়ে গেলো।উপর থেকে পানি পড়ে পূর্ব-রোদ দুজনেই ভিজে গেলো।মুখের উপর থেকে জল মুছে দুজনে তর্জনী আঙ্গুল একে অপরের দিকে তাক করে বললো,
“তুই ক্যান ঢুকেছিস?”
দুজনের কথা একরকম হওয়ায় আবারো রেগে বললো,
“আমি আগে ঢুকেছি।” এবারেও একরকম হয়ে গেলো।পূর্ব চোখ বড় বড় করে রোদের দিকে ক্রোধিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“তুই যেখানে যাস আপদ নিয়ে আছিস ক্যান?”
“তুই এতোক্ষণ ধরে মোবাইল টিপছিলি আর আমি ঢুকতে তোরও ঢুকতে হলো?”
“এখন তুই বের হ।আমি আগে ধুয়ে নিই।”
“তুই বের হ।”
“তুই!”
“তুই!”
“বললাম না তুই।”
“আমিও বলছি তুই।”
দুজনের মাথার উপরে জল পড়ছে।কিন্তু কেউ কারো থেকে কম না।তাই ঝগড়া থামাচ্ছে না।আধঘন্টা’র বেশি সময় দুজনে ভিজে গেলো।হঠাৎ পূর্বের আয়নার দিকে দৃষ্টি যাওয়ায় দেখলো রোদের ওড়না ঠিক জায়গা থেকে সরে গেছে।পূর্ব তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিলো।আর এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে পূর্ব বাথরুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
পূর্ব হঠাৎ বেরিয়ে যাওয়ায় রোদ অবাক হলো।বিড়বিড় করে বললো,”হরিচন্দন কী হার মেনে নিলো?”আবার আয়নায় চোখ গেলে দেখলো তার ওড়না ঠিক নেই।মুহূর্তে লজ্জায় রোদের গাল দুটো গোলাপি হয়ে গেলো।
রোদের গোসল শেষ হলে মনে পড়লো তাড়াহুড়ু’তে সে জামা আনতে ভূলে গেছে।ভেজা কাপড়ে বাথরুমের ফাঁক দিয়ে দেখলো পূর্ব রুমে নেই।রোদ নিচে তা তাকিয়ে পা ফেলতেই স্লিপ খেয়ে টাস করে পড়ে গেলো।
“আহহহ!এতো পানি আসলো কোথা থেকে?ওরে!আমার কোমর’টা গেলো।আহ!”
রোদ সামনে তাকিয়ে দেখলো ভেজা পায়ের চাপ।আর বিন্দু বিন্দু পানি।রোদ বুঝতে পারলো পূর্ব ভেজা কাপড়ে বের হওয়ার কারণে পানি আছে।মুহুর্তে রোদ রেগে উঠতে যাবে তখন আবার স্লিপ খেয়ে পড়ে গেলো।আগের বারের চেয়ে রোদ এবারে বেশি ব্যাথা পেলো।রোদ আবার উঠার চেষ্টা না করে সেই অবস্থায় বসে ন্যাকা কান্না শুরু করলো।
” হরিচন্দওওওন!তুই পানি মুছে ফেললি না ক্যান?এখন আমার কোমর গেলো।”
রোদের চিৎকার শুনে পূর্ব বেলকোনি থেকে রুমে এলো।রোদ পানিতেই বসে আছে ভেজা কাপড়ে।এভাবে রোদ’কে দেখে পূর্ব ফিক করে হেসে ফেললো।হাসির শব্দ শুনে রোদ মাথা তুলে পূর্বকে দেখে আবার উঠতে গিয়ে পরে গেলে পূর্ব রোদ’কে কোমর জড়িয়ে ধরে ফেলে।রোদের চোখ বন্ধ করে পরে যাওয়ার ভয়ে চেহেরা ভয়ার্ত করে রেখেছে।চোখ বন্ধ করার কারণে কপাল কুঁচকে গেছে,গাল দু’টো চেপে যাওয়া বেলুন হয়েছে।ঠোঁট দুটো অজান্তে নড়ছে।
আজ প্রথম বার পূর্ব রোদ’কে এতো কাছ থেকে দেখছে।রোদে’র সৌন্দর্য নিজের মনে এঁকে নিচ্ছে।এতো মধুর চেহেরা পূর্ব প্রথমবার দেখলো।তখনি রোদ আলতো আলতো করে চোখ খুললো।চোখের সামনে পূর্বের ‘জুম’ চেহেরা দেখছে।ধাক্কা দিয়ে রোদ দাঁড়াতে যাবে তখনি অনুভব করলো পূর্ব তাকে শক্ত করে নিজের সাথে আবদ্ধ করে রেখেছে।রোদ চোখ ঘুরিয়ে পূর্বের হাতের দিকে তাকালো।তারপর পূর্বের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকাতেই দেখলো এক অন্যরকম চাহনি।যে চাহনির সামনে রোদ নিজেকে অদ্ভুত মনে হচ্ছে।রোদ বুঝার চেষ্টা করলো পূর্ব দৃষ্টি কী বলছে?
তখনি রোদকে পূর্ব দাঁড় করায়।অসস্তি’তে পূর্ব স্থান ত্যাগ করে।রোদ ব্যাগ থেকে জামা নিয়ে চেঞ্জ করতে গেলো।বিড়বিড় করে পূর্ব’কে গালি দিতে লাগলো।
“পূর্ব তুই কিন্তু তোর দেওয়া কথা না রাখিস তাহলে আমিও তোর কথা রাখবো না।”
“মা আমি তোমার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি।রোদ’কে সাথে করে আনতে বললে তাও করলাম।তাহলে আর কী?”
“সিলেট গিয়ে রোদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করবি এমন তো শর্তে ছিলো না।”
“মা..মানে?”
“রোদ আমাকে সবটা বলেছে।তুই যদি ভেবে থাকিস ওখানে গিয়ে রোদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করবি আর আমি আমি কিছুই জানবো না তা কিন্তু নই!আমি সব খবর পেয়ে যাবো।আর যদি তুই ভূল করিস তাহলে আমিও আমার কথা অমান্য করবো।”
“মা প্লিজ!ভূল করে ওমন ব্যাবহার করেছি।সরি!কিন্তু তুমি তোমার কথা রাখবে।”
“আচ্ছা।তাহলে এখন গিয়ে রোদ’কে “সরি” বলে আয়।”
“মা!আমি তোমার ছেলে হয়ে রোদের পক্ষ নিচ্ছো?”
“হ্যা।নিচ্ছি!বিনিময়ে তুই ও কিছু পাচ্ছিস।”
পূর্ব কিছু না বলে ফোন কেটে দিলো।আড়চোখে পাশে তাকিয়ে দেখলো রোদ ফুলের বাগানে হাঁটছে।ফুলগুলা হাতে ছুঁয়ে দিচ্ছে।একটু আগে খাবার খেয়ে বাড়ির বাইরে এসেছে।আর রোদ বাইরে বেরিয়ে বাগানের দিকে ছুটে গেলো।রোদ মহা আনন্দে সবকিছু অনুভব করছে কিন্তু চাঁদনি মোহাম্মদে একটা ফোন কল’এ পূর্বের মুড নষ্ট হয়ে গেলো।
[চলবে]