00

পরিণতি !! Part- 06

মেজো জা এর সাথে কথা কাটাকাটি কোনো ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে নয়,একটা জমির বিষয় নিয়ে।রিহান তার বাবার কাছ থেকে কিছু জমি কিনেছিলো,যেই জমির ফসল বর্তমান পরিবারের সবাই মিলে খাচ্ছি। কিন্তূ আমার ভাসুর সেটা অন্য জায়গায় বন্ধক দিয়ে তাকে কিছু টাকা দিতে বলছেন, ব্যাবসার জন্য নাকি তার কিছু টাকার প্রয়োজন।পরে যখন তার ব্যবসা একটু ভালো হবে,তখন উনি জমিটা ছাড়িয়ে দিবেন। কিন্তূ রিহান কেনো জানি রাজি হলো না,বললো
– ভাই তুমি আগেও আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছো, ওইগুলা এখনও দাওনি,তাই এখন আমি তোমাকে আর টাকা দিতে পারবোনা।তাছাড়া এই জমির ফসলে আমাদের সংসারের অনেক টা হেল্প হয়,জমিটা বন্ধক দিলে দেখা যাবে চাউল কিনে খেতে হবে।
– ভাশুর মুচকি হেসে বললেন,অনেকবার তো দিয়েছিস,আরেকবার দে।এইবার তোর টাকা ফেরত দিবো,কথা দিলাম।
– না ভাই আমি আর টাকা দিতে পারবোনা।জমিও বন্ধক দিবো না।এমনেই আমার আজকাল‌ অর্থমন্দা চলছে।তাছাড়া আমার একটা মেয়ে আছে,তার কথা আমার ভাবতে হবে।তুমি এর আগেও কয়েকবার আমার কাছ থেকে ধার নিয়ে দাওনি।দেখা যাবে জমিটা বন্ধক দিয়ে তুমি নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াবে,পরে ওইটা আমাকেই ছাড়াতে হবে।
– তাহলে দিবিনা?
– না।
– আচ্ছা।

এই ঘটনা ওইখানেই শেষ।রিহান আর ওর ভাইয়েরা অনেক সহজ সরল।ওনাদের মাঝে কখনো কোনো ঝামেলা হতে দেখিনি। যদিও রিহানের রাগ টাই বেশি,রিহানের ভাইয়েরা ওইভাবেই মেনে নেয়, কিন্তূ এইবার মেজো ভাসুর যে রিহানের ব্যাবহারে কষ্ট পেয়েছেন,সেটা বুঝাই যাচ্ছে।টাকা না দেওয়ায় ভাশুর রিহানের উপর অনেক ক্ষুব্ধ হলেন।
সকাল হতেই মেজো জা, আমাকে ঘরে এসে বকতে লাগলেন।
– রিহান কে তুই নিষেধ করেছিস জমি দিতে,তাইনা?
– আমি নিষেধ করতে যাবো কেন?
– কই আগে কিছু চাইলে তো রিহান এভাবে মুখের উপর মানা করতো না,এখন করলো আর সেটা তোর কারনেই।
– দেখেন আপু,আমি রিহান কে তেমন কিছু বলিনি,তাছাড়া আমি এইসব ব্যাপারে কখনো নাক গলাই ও না।রিহানের টাকা পয়সা ‌আমার কাছে রাখতে দেয় বাস এইটুকুই, কিন্তূ কখনোই আমি ওর জবাব দিহিতা করিনা,ও টাকা দিয়ে কি করলো,কাকে দিলো,কেনো দিলো।আমি মনে করি,এইসব ব্যাপারে আমার না জানলেও চলবে।আমার যখন যা লাগছে দিচ্ছে,সংসার চালাচ্ছেন,বাবা ,মা কে দিচ্ছেন,মেয়ের যা লাগছে আনছেন আর মাস শেষে কিছু টাকা ব্যাংকে জমা ও রাখছেন।তাই আমি এইসব ব্যাপারে কখনো কিছু বলিনা রিহান কে।
– তুই বললি আর আমি বিশ্বাস করলাম,তাইনা?
– আপনি বিশ্বাস করেন বা না করেন তাতে আমার কিচ্ছু আসে যায়না।
– কি এতো বড়ো কথা?সত্যিই কিছু আসে যায় না?
– দেখেন আপু,আপনি আমাকে অনেক সময় অনেক রকম কথা বলেন,আমাকে সব সময় কাজের হুকুম দিয়ে যান।কাজ করে দিলে সেটার মধ্যেও আপনি খুদ বের করেন।রান্না সবার কাছে ভালো হলেও আপনার কাছে ভালো হয়না,কেনো আপু?
আপনি সবসময় আমার এতো দোষ খুঁজেন কেনো?
– স্বামী স্ত্রীর মধ্যে খুব ভালোবাসা তাইনা?স্বামী কে কিভাবে কুমন্ত্রণা দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছিস।আমরা কি তোদের জমি নিলে ওইটা পরে ছাড়িয়ে দিতাম না?
– শুনুন আপু,এটা ওদের দুই ভাইয়ের ব্যাপার,ওনারা যেটা ভালো মনে করছেন সেটাই করছেন,আপনি বা আমি এইসবের মধ্যে না গেলেই ভালো হয় না?আপনিও পরের মেয়ে,আমিও পরের মেয়ে, কিন্তূ ওনারা আপন ভাই।একবার ঝগড়া করবেন আবার মিলবেন,তাই আমার মনে হয় ওদের কে ওদের মতো ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
– বাহ্, ভালোই জ্ঞান দিচ্ছিস দেখছি।তর্ক ও দেখি ভালোই করতে পারিস।তর্ক বন্ধ করবি নাকি চর বসিয়ে দিবো গালে?
– কথাবার্তা একটু হিসেব করে বলবেন,আপনি বড় বলে সম্মান করে কিছু বলছিনা আপনাকে।
– কি বলবি রে তুই?তোর এই তর্কের সাজা কিন্তূ পাবি তুই।
– আমার বিয়ের পাঁচ বছর ছয় মাস চলছে,এর মধ্যে কখনো কি আমি আপনার কথার উপর কথা বলেছি? কিন্তূ আপনি আমার ধর্যের বাঁধ ভাঙতে বাধ্য করছেন।কখনো আপনার কথার উপর কথা বলিনা বলে ভাববেন না যে,কখনোই বলবোনা।
– এই তুই কি বলবি আমাকে,সংসার করতে দিচ্ছি তো তাই মুখে এতো বড়ো বড়ো কথার ঝুড়ি।
– আপনি আমাকে সংসার করতে দিচ্ছেন?
– হ্যা,এখনই যদি সব কিছু ফাঁস করে দেইনা,তাহলে তোর গলার আওয়াজ আর এমন থাকবেনা।
– ঠিক আছে ফাঁস করে দিন।যদি রিহান আমাকে সত্যি ভালোবেসে থাকে,তাহলে ও ব্যাপারটা বুঝবে,আর যদি আমার প্রতি ওর ভালোবাসায় ঘাটতি থাকে তাহলে ওর যা করার করবে,আমি তার জন্য প্রস্তুত।
– আচ্ছা তাহলে রেডি থাকিস,সংসার ভাঙ্গার কষ্ট সহ্য করার জন্য।
– কষ্ট?রোজ রোজ এমন আতঙ্ক নিয়ে বাঁচার চেয়ে,একবারেই সব শেষ হয়ে যাওয়া ভালো।
এই বলে ওখান থেকে চলে আসলাম।রাগের মাথায় অনেক কিছু বলে ফেললেও এখন ভয় হচ্ছে,সত্যি সত্যিই না সংসার টা ভেঙ্গে যায়।এমন কিছু হলে আমার মেয়ের কি হবে!
তারপর থেকে রোজ রোজ তার সাথে কিছু না কিছু নিয়ে ঝামেলা চলতেই থাকে।এইসবে আমি রীতিমতো মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছিলাম।একদিকে ওনার আমাকে মেন্টালি টর্চার,অন্যদিকে রিহানের বিশ্বাস হারানোর ভয় আমাকে আষ্টেপিষ্টে জাপটে ধরেছে।আমি ধরেই নিলাম,রিহান এইবার বাড়িতে আসলে হয়তো মেজো জা রিহান কে সবটা জানাবেন।
প্রতিমাসের দশ তারিখের দিকে রিহান বাড়ী আসে।এইবারও আসলো।রিহান আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো
– কি হয়েছে তোমার,তুমি কি অসুস্থ?
– না তো,ঠিক আছি।
– তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছেনা তুমি ঠিক আছো।কেমন শুকিয়ে কালো হয়ে গেছো।চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে,দেখে মনে হচ্ছে কতদিন ধরে ঘুমাও না।সুন্দর উজ্জ্বল মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে।কি হয়েছে তোমার বলো তো?
– বড় জা বললেন,ফারিয়া কে একটা ভালো ডাক্তার দেখাও রিহান।ঠিক মতো খায় ও না আজকাল।
রিহান আর আমি আর কোনো না বলে দুজনেই ঘরে চলে আসলাম।
আমি আর রিহান যখন একসাথে বসে থাকি বা মেয়ে কে নিয়ে দুজন একসাথে হাসি ঠাট্টা করি,মেজো জা এসে রিহান কে ডাকে,এমন ভাব করে যেনো কিছু বলবে বলবে ভাব।প্রতিবার উনি যখন এমনটা করেন,আমি ভাবি এখনই হয়তো সব কিছু বলে দিবেন, কিন্তূ বলতে গিয়েও বলেন না।আমি বুঝতে পারলাম এসব করে আমাকে মেন্টালি টর্চার করা হচ্ছে। যার ভয়াবহতা আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।রাতে মেয়েকে ঘুম পারাচ্ছিলাম।রিহান পাশে এসে আমার গা ঘেঁষে বসে বললো
– চলো কালকে ডাক্তারের কাছে যাই।
– কেনো?

– তোমাকে ডাক্তার দেখাবো।
– আমার তো কিছু হয়নি।
– কিছু না হলে তোমাকে এমন অসুস্থ দেখাচ্ছে কেনো?
– আমি মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে আমার কাছ থেকে একটু দূরে শুইয়ে, আমার পাশে রিহান কে শোয়ার জায়গা করে দিলাম।রিহান আমাকে জড়িয়ে ধরলো,আমি রিহানের বুকে মাথা রেখে বললাম
– একটা কথা বলবো?
– বলো।
– সবাই তো স্বামী স্ত্রী একসাথে থাকে,আমরা কি একসাথে থাকতে পারিনা?
– আমার কথা শুনে রিহান অবাক হলো বটে।তাও বললো,আমরা কি আলাদা?
– আলাদা না,আবার একসাথেও না।হিসেব করে দেখো বছরে কয়দিন তোমার সাথে আমার দেখা হয়।
– তুমিই বলো।
– বারো মাসে,২৪ দিন।প্রতি মাসে বাড়ি এসে দুই দিন করে থাকো।আর এই সাড়ে পাঁচ বছরে,তোমার সাথে আমার মোট দেখা,৩১৪দিন, মানে গড়ে একবছর ও না।
– এটা কি তোমার অভিযোগ?
– অভিযোগ না আখাংকা বলতে পারো।তোমাকে এখনও আমার অচেনা মনে হয়।
– তাই নাকি?
– হুম।আর আমাদের মেয়েই বা,তোমাকে কতক্ষন কাছে পায় বলো।এই দুই দিনে তো তুমি নানান কাজে ব্যাস্ত থাকো,আমার মেয়ের ও তো তার বাবাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে,অন্য বাচ্চাদের মতো।
– আর তোমার?
– সবার মতো আমারও ইচ্ছে করে প্রতিরাতে স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে।
– আমারও যে ইচ্ছে করেনা বলবো না, কিন্তূ…
– রিহান তুমি আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাবে?
– রিহান চুপ করে আছে।
– তুমি না আমাকে ডাক্তার দেখাতে চাও,আসলেই কি ডাক্তার আমার রোগ সারাতে পারবে?আমার রোগ তো শরীরে নয়,মনে। যার সুরাহা একমাত্র তোমার কাছেই।
রিহান কোনো প্রতিউত্তর করলো না,লম্বা একটা নিশ্বাস ছেড়ে আমাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।আমার এইসব বলার কারন,আমি এখান থেকে দূরে চলে যেতে চাইছি। এখান থেকে দূরে চলে গেলেই হয়তো আমি ভালো থাকবো।রোজ রোজ এই ভয়,মেন্টালি টর্চার আমি আর নিতে পারছিনা।রিহান এমনিতে আমাকে অনেক ভালোবাসে,আমার কষ্ট ও সহ্য করতে পারেনা। রিহান কে উপর থেকে দেখে রাগী মনে হলেও,ভিতর থেকে ও ততোটাই নরম মনের মানুষ।আর আমি এখন এই মানুষটাকে ভালোবাসি।সত্যি ভালোবাসি। তবে জানিনা এই ভালোবাসা টিকবে কতোদিন।আপাতত এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাই,তাই রিহান কে ওইগুলো বলা।তবে জানিনা এই নরক থেকে মুক্তি পাবো কি না।

সকালে যখন সবাই একসাথে নাস্তা করছিলাম,রিহান বলে উঠলো
– মা,অফিস থেকে আমাকে অন্য জায়গায় বদলি করে দিয়েছে।
– তাই নাকি!কোথায়?
– মিরপুর এক এ।
– ওহ।
– কিন্তূ মা,এখন সমস্যা হলো, ওইখানে কোনো ব্যাচেলর ভাড়া দিতে চায়না,আর আমিতো বিবাহিত ব্যাচেলর,কোনো বাসাই খুঁজে পাচ্ছিনা।যেখানেই যাই খালি একটাই শর্ত পরিবার নিয়ে থাকতে হবে।আর নতুন জায়গা হওয়াতে আমার খাওয়ার ও খুব সমস্যা হয়ে গেছে,তাই ভাবছি তোমাকে নিয়ে যাবো সাথে করে।
– কি বলিস এইসব, আমাকে তোর বাবা যেতে দিবে নাকি?আর আমার ঢাকা তে মন টিকেনা।একবার তোর মামার বাসায় গিয়েছিলাম,দুই দিন থাকার পর তিনদিনের দিন পাগলের মতো ছুটে এসেছিলাম।
– তাহলে কি করবো থাকার কষ্ট, খাওয়ার কষ্ট, এতো কষ্ট করে কি চাকরি করা যায়?
– বড় ভাশুর বললো,তাহলে মা কে না নিয়ে তোর বৌ কে নিয়ে গেলেই তো পারিস।
– নাহ,ফারিয়া কে নিয়ে গেলে কেমন খারাপ দেখা যায়।ফারিয়া চলে গেলে মা বাবা কে দেখবে কে!
– মেজো জা ব্রু কুচকে বললো,যেভাবে বলছো যেনো তোমার বৌ শুধু মা,বাবা কে দেখে,আমরা দেখিনা।
– না ভাবি আমি আসলে ওইভাবে বলতে চাইনি কথাটা।
– শাশুড়ি বললেন, হ্যা তুই তোর বৌ কেই নিয়ে যা,আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।বড় বৌ আর মেজো বৌ তো আছেই।তাছাড়া আমার ছেলের বৌ থাকতে এতো কষ্ট করবেই বা কেন।
– তাহলে কি সত্যিই তোমাদের কোনো সমস্যা হবেনা?
– নারে বাবা।ফারিয়া যদি যায়,তুই ও কে নিয়ে যা।
– ফারিয়া কে বলেছিলাম,ও যেতে চায়না,তাইতো তোমাকে নিয়ে যেতে চাইছি।
আমি এতক্ষন ভেবেছিলাম রিহান যা বলছে সত্যি সত্যিই বলছে, কিন্তূ এখন বুঝতে পারলাম, সবটাই সাজানো।শাশুড়ি আমাকে বুঝাচ্ছেন
– কেনো যাবেনা তুমি?তোমার স্বামীর কষ্টের চাইতে কি,তোমার এখানে থাকা বেশি জরুরি?
– আমি চুপ ।
– রিহানের সাথে তুমিও যাবে বুঝতে পেরেছো?
-জী মা।
ঘরে আসতেই আমি রিহান কে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু দিলাম।এই প্রথম নিজের থেকে কিছু করলাম।
– কি এখন খুশি?
– হুমম অনেক।

– আচ্ছা কালকে তাহলে আমি চলে যাই,আগামী মাসে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।ফ্যামিলি বাসা খুঁজতে হবে,আমি তো মেসে থাকি।
– আমি রিহানকে আবারও জড়িয়ে ধরে বললাম,ঠিক আছে।
তারপর পরের মাসে এসে রিহান আমাকে নিয়ে গেলো।শুরু হলো আমার নতুন জীবন।
প্রথম দিন গিয়েই সংসারের টুকিটাকি যা লাগে সব কিনলাম।তবে একটু খারাপ লাগছে বাড়ীর কথা ভেবে,এর আগে কখনো ঢাকায় আসিনি তো তাই।এখানে সবাই কেমন জানি নিজের মতো থাকে, কেউ কারো বাসায় যায়না,প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলেনা।তবে নিজের সংসার যে এতোটা সুখের হয় ঢাকা না আসলে বুঝতেই পারতাম না।আমরা দুই রুমের একটা ছোট ফ্ল্যাটে থাকতাম।বাসাটা খুব সুন্দর করে,একদম নিজের মত করে সাজালাম।সব কিছুই কেমন যেনো স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছিলো।আমার ও এমন একটা সংসার হবে কখনো ভাবিনি। হ্যা এটা আমার সংসার, আর এই সংসারটা উপহার দিয়েছেন আমার স্বামী রিহান।
সকালে নাস্তা বানানো,দুপুরে মেয়ে নিয়ে স্বামী স্ত্রী একসাথে খাওয়া,রাতে স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমানো,এ যেনো অন্যরকম এক সুখ।
কিন্তূ আমি বুঝিনা এখানে মানুষ কারো সাথে তেমন কথা বলেনা কেনো,অচেনা বলে?
গ্রামে তো আমরা অচেনা মানুষ এলেও, পিরি এগিয়ে দিয়ে বসতে বলি, কিন্তূ এখানে…
আমি গ্রামের মেয়ে,আমি আবার কারো সাথে কথা বলা ছাড়া থাকতে পারিনা।পাশের বাসার এক ভদ্র মহিলা আমার মতোই এক মেয়ের মা।প্রায় দেখতাম বারান্দায় বসে ফোন টিপাটিপি করতো।তার বারান্দা আর আমাদের বারান্দায় চার আঙ্গুলের তফাৎ মাত্র।একদিন আমি তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম
– এইযে আপু,একটু কথা বলতে পারি?
– হ্যা বলেন।
– আপনাদের বাড়ি কোথায়?
– হাহাহা।
– হাসলেন যে?
– আপনি যেভাবে বলেছিলেন যে কথা বলবেন,আমি ভাবলাম, না জানি কি কথা বলবেন।বাই দা ওয়ে,আপনারা মনে হয় নতুন ভাড়াটিয়া,তাইনা?
– জী।
– ওহ। তা আপনাদের বাড়ি কোথায়?
– কিশোরগঞ্জ।
– আপনার?
– বগুড়া।
– আপনার নাম কি?
– ফারহানা নিশো।
– আপনার?
– ফারিয়া জান্নাত।
– বাহ্,আপনার নামের সাথে তো আমার নামের প্রথম অক্ষর মিল আছে দেখছি।
– জী।
সেদিনের পর থেকে তার সাথে আমার কথা হতো,মন খুলে কথা হতো।ঢাকাতেও তাহলে মন খুলে কথা বলার মতো মানুষ আছে,ফারহানা কে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।
দিন গুলো খুব সুন্দর চলছে।বিকেলে ফারহানার সাথে বাইরে হাটতে বের হতাম,রিহান ই বলেছে বাসায় ভালো না লাগলে মেয়েকে নিয়ে বাইরে ঘুরে আসতে,রিহান তো আর সবসময় বাসায় থাকেনা,আর ফারহানার ব্যাপারে আমি রিহান কে বলার পর,রিহান বললো ইচ্ছে হলে,রাইমা কে নিয়ে ওনার সাথে বিকেলে বাইরে ঘুরে আসতে।ও বলা হয়নি,রাইমা আমার মেয়ের নাম।

মাঝে মাঝে রিহান,রাইমা আর আমি ঘুরতে বের হতাম।ঘুরতে গেলে ফুচকা,চটপটি খেতাম।বাসায় আসার সময় রিহান মেয়েকে আর আমাকে আইস্ক্রিম কিনে দিতো।
প্রতিদিন রিহান অফিস থেকে আসার পর ওর সাথে অনেক গল্পঃ করতাম।সারাদিন কি কি করলাম,ফারহানার সাথে কি কি কথা হলো।বিকেলে ঘুরতে গিয়েছিলাম,ইত্যাদি।অনেক রকমের কথা বলতাম,একদম মন খুলে কথা বলতাম।রিহান বাসায় আসার পর টিভির রিমোট ওর দখলে চলে যেতো,আমিও কোনো আপত্তি করতাম না,বরং ওর পাশে শুয়ে বা বসে,একসাথে দুজনে খেলা দেখতাম।যখন বিপিএল খেলা চলতো,রিহান আমাকে খেলা দেখার দায়িত্ব দিয়ে যেতো।ও কাজের চাপে খেলা দেখার সময় না পেলে আমার উপর এই দায়িত্ব আসতো,যেনো রাতে ও বাসায় আসলে আমি তাকে ডিটেইল এ সব বলতে পারি।আমি তাই করতাম।
রিহান বাসায় আসলে,পুরো খেলার বর্ণনা দিতাম ও কে।কে কিভাবে আউট হলো,কে কেচ মিস করলো,কিভাবে কয় রান নিলো,ইত্যাদি।
মাঝে মাঝে রিহান আমার প্যাচালে অতিষ্ট হয়ে টিভি অফ করে দিতো।যদি জিজ্ঞেস করতাম টিভি অফ করলা কেন?
বলতো,তোমারটা ই শুনবো নাকি টিভির টা?তাই টিভি অফ করে দিয়ে তোমারটা ই শুনি।আমি তখন মুখ কালো করে রাখলে,বলতো,রাগ করো কেন মজা করেছি।
আমি তখন মুচকি হাসি দিয়ে আবার বলা শুরু করতাম।
এমন ভালো একজন স্বামী পেয়ে আমি অনেক খুশি। কতোটা ভাগ্য ভালো হলে এমন স্বামী পাওয়া যায়,রিহান কে না পেলে বুঝতাম ই না।
দেখতে আমাদের বিয়ের ছয় বছর পূরণ হতে চললো,আর আজকেই আমার জন্য সব চেয়ে বড় গিফট টা অপেক্ষা করছে,জানা ছিলো না।
কলিংবেল এর শব্দে ঘুম ভেংগে গেলো।রিহান গিয়ে দরজা খুলতেই,পিয়ন একটা চিঠি এগিয়ে দিয়ে বললেন
– এখানে একটা শই করে দিন।

– এটা কিসের চিঠি,কে দিয়েছে?
– সেটা ভাই আমি কিভাবে বলবো,আমার কাজ ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে দেওয়া,পৌঁছে দিলাম।
– ফেসবুক,ইমো,হয়াট’স অ্যাপ,ইমেইল থাকতেও এই আধুনিক যুগেও মানুষ চিঠি পাঠায়!
দরজা লাগিয়ে দিয়ে,রিহান আমার কাছে এসে বলতে লাগলো,কে যেনো চিঠি পাঠিয়েছে,এই যুগে কোন পাগল এমন করতে পারে বলো তো।
আমি বললাম
– খুলে দেখলেই তো হয়।
রিহান খুলে পড়তে লাগলো,চিঠিটা পড়ার পর ওর চোখ কেমন লাল হয়ে গিয়েছিলো।আমি কিছু বুঝতে না পেরে হাত থেকে চিঠিটা কেরে নিতেই দেখলাম,সেই ছয় বছর আগের আরিফের চিঠি।
ঠিকানা টা আরিফের বাড়ির ঠিকানাই।অবশ্য আমি জানি এটা কার কাজ,আর ঠিকানা টা এক হওয়াই স্বাভাবিক, কারন ওদের বাড়ি তো কাছাকাছিই।চিঠি টা এতোদিন খুব যত্নকরে রেখে দিয়েছিলেন উনি,এই সময়টার অপেক্ষাতেই হয়তো।
কথায় আছে না
কপালে নাইকো ঘি
ঠকঠকালে হবে কি?
আমার দশা ও তেমনি হলো।আমার সুখের সংসারে অন্ধকার নেমে এলো।
চলবে…