নীরবতা

নীরবতা !! Part- 38

গতকাল রাতে আলাউদ্দিন শেখ কল করেছিলেন। অনুনয় করেছেন, ক্ষমা চেয়েছেন তার কৃতকর্মের জন্য। ফিরে যেতে অনুরোধ করেছেন নিজের সংসারে। লোকটি কি সত্যিই পরিবর্তন হয়েছেন? নয়তো শেষ বয়সে এসে অভিনয়ই বা করবেন কেনো? বিষয়টি কোনোভাবেই বোধগম্য হচ্ছে না জ্যোতির। এই লোককে যতটুকু চেনে সে তাতে উনি ভাঙবে তবে মচকাবে না। ছোট কিছু নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিল জ্যোতি। অফিসে এলেও কাজে মন দিতে পারছেনা সে। মেয়ের জন্য মনটা আনচান করছে। আসলে একটা সময় জীবন এতোটাই দুর্বিষহ হয়ে পড়ে যে তখন মানুষ আত্মহত্যা করে মুক্তি পেতে চায় স্বার্থপর এই পৃথিবী ছেড়ে। তবে সে তা করেনি। নিজের জীবনের মূল্য বুঝে সে সরে এসেছে দূর্বিষহ জীবন ছেড়ে। নিজেকে নিজের চেষ্টায় স্বাধীন করে তুলেছে। তবে অতীতের পিছুটান কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। আসলে নাড়ী ছেঁড়া ধন ফেলে আসলে কোনো মায়ের পক্ষেই অতীতের পিছুটান পুরোপুরি ফেলে আসা সম্ভব নয়। নিজেকে শক্ত প্রমাণ করতে যদিও সে সবসময় বলে আসছে তার কোনো পিছুটান নেই। নেই কোনো আফসোস.. বুকচিরে আরও কিছু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল জ্যোতির। মেয়ের জন্য হলেও আলাউদ্দিন শেখের কথায় মন সায় দিতে চাইলেও বিবেক চাইছে না। ওই বাড়িতে আবারও ফিরে গিয়ে নিজের জীবনটা দূর্বিষহ করতে চায়না সে। তবে আলাউদ্দিন শেখ তো পরিবর্তন হয়েছেন। তার চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটেছে। তাছাড়া মানুষ মাত্রই তো ভূল হয়। সেখানে আলাউদ্দিন শেখের দ্বারাও না হয় ভুল হয়েছে! মেয়ের মৃত্যুর পর হয়তো নিজের কৃতকর্মের জন্য সত্যিই অনুতপ্ত সে!
-“আসবো?”
জ্যোতির মন এবং বিবেকের যুক্তিতর্ক থেমে গেল রুমে রাশেদের উপস্থিতিতে। চোখ মেলে সোজা হয়ে উঠে বসে সে বললো,
-“এসেই তো পড়েছো..”
হাসলো রাশেদ। জ্যোতির মুখোমুখি চেয়ারে বসে বললো,
-“তোমার সাথে লাঞ্চ সারতেই চলে এলাম। ফ্রি ছিলাম..”
-“ফোন দিয়ে আসতে পারতে। আমিতো ফ্রি নাও থাকতে পারতাম!”
-“হয়তো.. তবে তুমি তো ফ্রি আছো।”
অজস্র ক্লান্তি মুখে ফুটিয়ে জ্যোতি বললো,
-“ফ্রি থাকলেও বাইরে খেতে যাবার ইচ্ছে নেই। আমি টায়ার্ড। আমার একটু সময় প্রয়োজন।”
-“তুমি কি জানো, তুমি মাঝেমধ্যে এমন কিছু কথা বলো যা আমায় হার্ট করে?”
-“জানি.. তবে তুমি সব জেনেশুনেই আমার সাথে রিলেশনশিপে এসেছো। এমনকি বিয়ের মতো একটি জটিল সম্পর্কে জড়াতে আমাকে প্রস্তাবও দিয়েছো!”
-“এবং তুমি তা মেনেও নিয়েছো.. তারপরও বিয়ের ডেইটটা ফাইনাল করতে কেনো দিচ্ছো না?”
লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেললো জ্যোতি। নীচু স্বরে বললো,
-“কারণ আমি এখনো কনফিউজড। মাজহারকে ছেড়ে চলে আসার পর ফ্যামিলির সাপোর্ট পাইনি আমি। উঠতে বসতে কথা শুনিয়েছে তারা। আমাকে ফিরে যেতে বলেছে। তবে আমি যাইনি। কেনো যেনো যেতে ইচ্ছে করেনি। তারপর যখন ফ্যামিলির কাছ থেকে এমন কথা শুনলাম, আমি যদি মাজহারের কাছে ফিরে না যাই তাহলে যেনো আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। আমার জন্য নাকি তাদের সমাজে চলতে ফিরতে কষ্ট হয়, লজ্জায় পড়তে হয়। তখন ছেড়ে এলাম বাবার বাড়ি। তুমি জানো আমি প্রথম প্রথম ঢাকায় আসার পর গার্মেন্টসেও পর্যন্ত কাজ করেছি? জানো না.. কারণ আমি আমার কষ্টগুলো নিজের মাঝে জমিয়ে রাখতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করি।”
মন দিয়ে জ্যোতির কথাগুলো শুনলো রাশেদ। মাথা নেড়ে তাতে সম্মতি জানিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,
-“তো তুমি এখন কী চাইছো?”
-“যদি বলি আমার অতীতে ফিরে যেতে?”
-“যেতে পারো.. আমার কোনো বাধা নেই।”
-“তুমি বাধা দিলেও আমার সিদ্ধান্তে কোনো হেরফের হতো না.. বাই দ্য ওয়ে, তুমি কবে বিয়ে করতে চাও আমায়?”
-“যদি বলি আজ? করবে?”
-“আগে চলো খেয়েদেয়ে মাথাটা ঝালাই করে নিয়ে আসি। ফাঁকা মাথায় কোনো।সিদ্ধান্ত আমি নিতে চাই না।”
ম্লান হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে কোটের একটি বোতাম লাগালো রাশেদ। জ্যোতির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“চলো..”
ইভানাকে নিয়ে শাহানাজ তালুকদারের চেম্বারে বসে রয়েছে মেসবাহ। মন মেজাজ অসম্ভব খারাপ তার। চেকআপের জন্য উল্লাসীকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ায় খানিকটা ভয়ও লাগছে।
-“এত টেনশন করছিস কেন বলতো?”
পাশ থেকে ইভানার কথা শুনে বিরক্ত হলো মেসবাহ। কপাল কুঁচকে বললো,
-“টেনশন করাটা কী স্বাভাবিক না?”
-“স্বাভাবিক.. তবে এতটা হাইপার হওয়া স্বাভাবিক না। তাছাড়া তুই এত হাইপার হলে উল্লাসী কী করবে?”
-“উপদেশের জন্য ধন্যবাদ। তবে ওর সামনে আমি যথেষ্ট কুল থাকি। প্লাস আমি ওকে এটাও বুঝিয়েছি এটা হওয়ারই ছিল।”
-“অবশ্যই হওয়ারই ছিল। তোর মতো স্টুপিডের কাছ থেকে তো হওয়ারই ছিল। কই? লিমনের বিয়ের তো একবছর হয়ে এল! ওর বউকে কী ও প্রথম রাতেই প্রেগু বানিয়ে দিয়েছে?”
-“অশ্লীল কথাবার্তা বলিস না।”
-“ওরে আমার শালীন রে!”
গম্ভীরমুখে মেসবাহকে বসে থাকতে দেখে হাসিতামাশা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল ইভানা। ফিরে যাবার সময় তার হয়ে এসেছে। খুব বেশি হলেও পাঁচদিনের মতো এদেশে রয়েছে সে। এর মাঝে শুধুশুধু মেসবাহকে রাগিয়ে কী লাভ? এমনিতেই তার যাবার খবর শুনে প্রচুর রেগে রয়েছে মেসবাহ। কিন্তু সে এখানে থেকে করবেই বা কী? তার বুঝি কষ্ট হয় না? মেসবাহ এবং উল্লাসীকে একসাথে দেখলে কলিজা ছিঁড়ে যায় তার। তারপরও তো নিজের কষ্ট টা সামলে তাদের বিপদেআপদে সর্বসময় পাশে থাকার চেষ্টা করে। অথচ মেসবাহ সেসব বোঝেই না! অবশ্য দরকার কী বোঝার? সে নিজেও তো বোঝাতে চায় না..
-“তুই পাশে থাকলে আমি সাহস পেতাম। ভেবেছিলাম তোর আন্ডারেই ওকে রাখবো। অথচ তুই…”
-“আমি কি তোর পাশে নেই? সবসময় আছি। তাছাড়া শাহানাজ আপা তো ভালো একজন ডক্টর। আর তা তোর বা আমার কারোই অজানা নয়!”
-“তবুও…”
ম্লান হেসে মেসবাহর কাঁধে হাত রেখে তাকে আস্বস্ত করে ইভানা বললো,
-“কী তবুও? দেখলিনা আপা কী বললেন? ভালো আছে উল্লাসী। ঠিকঠাক আছে। টেনশন করিস না। শুধু উল্লাসীর দেখাশোনা টা ঠিকঠাক ভাবে কর।”
বাড়িতে জানাতে হবে, উল্লাসীর নানাজানকে জানাতে হবে। ব্যাপারটি কে কিভাবে নেবে কে জানে! তবে বুঝিয়ে সবটা খুলে বলতে হবে তাদের। কিন্তু কিভাবে বুঝিয়ে বলবে? সেভ পিরিয়ড বা পিল না খাওয়ানোর কারণ এসব তো আর বলা যাবেনা তাদের। তাহলে ঠিক কি বলবে? কী বলে বুঝ দেবে? মাথায় আসছে না মেসবাহর। ডাক্তার দেখিয়ে রিপোর্ট দেখিয়ে উল্লাসীকে বাসায় নিয়েছে ঘন্টাখানেক হয়েছে। যদিও ডাক্তার বলেছে চিন্তার কিছু নেই, তবুও তার চিন্তা কমছে না। অস্থির লাগছে। উল্লাসীর প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেনা। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে চিন্তার জগতে বিচরণ ছেড়ে বেরিয়ে এল মেসবাহ। ওয়াশরুমের দরজায় নক করে উল্লাসীকে দ্রুত গোসল সারবার তাড়া দিয়ে সে এগুলো সদর দরজার দিকে।
-“কী ব্যাপার? কখন এলে? আর ডাক্তার কী বললো?”
দরজা খুলে মুন্নি সরকারকে দেখে বিব্রত বোধ করলো মেসবাহ। ড্রইংরুমের দিকে এগুতে এগুতে সে নীচু গলায় বললো,
-“সব ঠিকঠাক আছে। খাওয়াদাওয়া, চলাফেরার দিকে নজর দিতে বললো। মা হবার জন্য উল্লাসীর ওজন খুবই কম।”
মেসবাহর পিছুপিছু সোফায় এসে বসলো মুন্নি সরকার। আশেপাশে নজর দিয়ে বললো,
-“অহ.. তা এই বয়সী বউকে প্রেগন্যান্ট বানানোর জন্য কিছু বললো না ডাক্তার?”
-“না.. এটা সম্পূর্ণই আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।”
মেজাজটা প্রচন্ড খারাপ হলেও নিজেকে সংযত রাখলো মেসবাহ। সে নিজেও যেখানে বুঝতে পারছে তার দ্বারা ভুল হয়েছে সেখানে বাইরের মানুষ তা বললে দোষের কী?
-“সরি সরি। মজা করছিলাম। যাইহোক কংগ্রাচুলেশনস।”
মেজবাহর কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে কপাল কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বললো,
-“কী ব্যাপার? তুমি কী খুশি নও?”
-“এটা কী আদৌ খুশি হবার মতো নিউজ?”
-“হবে না কেনো? তোমাদের মাঝে নতুন অতিথি আসছে। অবশ্যই এটি খুশি হবার মতোই একটি নিউজ।”
-“আমার তা মনে হয়না।”
-“কেনো?”
-“উল্লাসীর বয়স কম। আপনি আমি সবাই জানি এই বয়স কোনো মেয়ের পক্ষেই মা হবার জন্য সঠিক সময় নয়। প্রচুর রিস্ক আছে। তাছাড়া ও অবুঝ। যার ভেতরের বাচ্চামিগুলোই এখনো যায়নি। সে কিভাবে আরেক বাচ্চাকে সামলাবে? সব ভেবে আমার প্রচুর অস্বস্তি হচ্ছে। মেনে নিতে পারছিনা।”
সোফায় আরাম করে বসলো মুন্নি সরকার। মাথা নেড়ে মেসবাহর কথায় সম্মতি জানিয়ে বললো,
-“সব ঠিক আছে। তবে তোমার মেনে নেবার ব্যাপারটি মোটেও ভালো লাগলোনা আমার। একটা কথা বলোতো.. আমাদের নানী-দাদীদের কি বাচ্চা হয়নি? এমনকি তোমার মাকেও জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো উনার কত বছর বয়সে প্রথম সন্তান হয়েছে!”
-“তখন আর এখনকার যুগ! প্রচুর পার্থক্য আছে।”
-“এক্সাক্টলি। এটাই তো আমি বলছি। তখন ডক্টর, হসপিটাল এসব তেমন ছিল না। ভালো চিকিৎসা ছিল না। অথচ এখন সব আছে। কোনো সমস্যা হলে তুমি আছো পাশে। প্রযুক্তির কথা আর নাই বললাম!”
-“তারপরও রিস্ক তো থেকে যায়।”
-“তা প্রতিটি প্রেগন্যান্ট মেয়েরই থাকে। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও তুমি তো খুশির এই নিউজটি পেয়েছো। আর যে বছরের পর বছর অপেক্ষা করে আছে শুধুমাত্র এই নিউজটি শোনার জন্য কিন্তু পাচ্ছে না একবার গিয়ে তার ফিলিংস গুলো শুনে এসো। আর কেউ নয়, একবার হাসানের সাথেই কথা বলে দেখো! বুঝতে পারবে বাচ্চার জন্য ঠিক কতটা পাগল সে!”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“সব বুঝলাম। তবে আমি উল্লাসীর উপরে কাওকে প্রায়োরিটি দিতে পারবো না। আর যে আমার দুনিয়ায় আসেইনি তাকে তো আরও নয়। আমি জাস্ট উল্লাসীর কষ্ট দেখতে পারবোনা।”
-“বিশ্বাস রাখো.. কিচ্ছু হবে না।”
-“বিশ্বাসটাই রাখতে পারছি না। সত্যি বলতে অনার মতো আমি আর কাওকে হারাতে চাইনা। আপনজনকে হারানোর কষ্ট যে কতটা তীব্র হয় তা আজও আমি পদেপদে অনুভব করতে পারি।”
(চলবে)