নীরবতা

নীরবতা !! Part- 28

ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরলো মেসবাহ। নানান চিন্তাভাবনায় পুরো মাথা ব্যথায় টনটন করছে। আজও আরেকটি নিঃসঙ্গ রাতে কাটাতে হবে। এবং যে রাতে পাশ ফিরে সে দেখা পাবেনা উল্লাসীর। এতটা অবুঝ কেনো মেয়েটি? একটুখানি কম অবুঝ হলে কী এমন হতো! অস্থির মনে কলিংবেল চাপতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিল উল্লাসী। ফিসফিসিয়ে বললো,
-“নানা এসেছেন..”
-“কে এসেছে?”
-“নানা.. আপনার না, আমার নানা।”
কপাল কুঁচকে ফেললো মেসবাহ। ভেতরে প্রবেশ করে এগুলো ড্রইংরুমের দিকে।
-“মেসবাহ?”
সিকান্দার মির্জা উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটি করতেই দ্রুত পায়ে তার দিকে এগুলো মেসবাহ। সৌজন্য সূচক একটি হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে বললো,
-“জ্বি.. আসসালামু আলাইকুম।”
-“ওয়ালাইকুম সালাম। বসো..”
-“জ্বি.. আপনি বসুন।”
সিকান্দার মির্জা সোফায় শরীর এলিয়ে দিতেই তার পাশে বসলো মেসবাহ। আগ্রহী চোখে তাকিয়ে রইলো কালো জুব্বা পরিহিত বৃদ্ধ লোকটির দিকে।
-“আমি বাস্তববাদী মানুষ.. বাস্তবতা বড় জটিল হলেও আমি তাকে আঁকড়ে ধরে চলতেই বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করি।”
সোজা হয়ে বসলেন সিকান্দার মির্জা। গম্ভীরমুখ খানিকটা ব্যথিত করে বললো,
-“মেয়ে আমার গত হয়েছে বছর পাঁচেক আগে। অথচ তা আমার কানে এসেছে দিন পাঁচেক হলো। খবর শুনে বড়ই ব্যথিত হয়েছিলাম। তবে কাঁদিনি। জীবনের প্রায় সব সিদ্ধান্ত আমি শক্ত থেকে নিয়েছি। সেখানে আমার মতো মানুষকে মেয়ে বিয়োগে কাঁদতে নেই বলেই আমি মনে করি। যেখানে মেয়েকে আমি বহু বছর আগেই ত্যাজ্য করে দিয়েছিলাম।”
নড়েচড়ে বসলো মেসবাহ। মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান চললেও তার চিপের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। হঠাৎ করে এই লোকের আগমনের সঠিক কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সে।
-“যেতে চাই নি। কিন্তু মনকে সামান্য নরম করে গেলাম। তবে দু’রুমের সেই বাড়িতে আমি আমার মেয়ের স্মৃতি খুঁজে পেলাম না। পেলাম আমার নাতনি সুহাকে। ময়লা জামাকাপড় গায়ে উসকোখুসকো চুল নিয়ে মাটিতে বসে ক্ষিধের জ্বালায় গড়াগড়ি করছিলো সে.. বিশ্বাস করবে কিনা জানি না তবে সেই দৃশ্য আমার চোখে পানি এনে দিয়েছিল। সেদিন আমার বুকের ভেতরের শক্ত পাথরটা প্রথম নাড়া দিয়েছিল… তারপর আর কী! বদমাশটার দু’গালে দু’চড় বসিয়ে নিয়ে এলাম আমার নাতনিকে আমার কাছে।”
-“বদমাশটা কে?”
-“উল্লাসীর বাবা। বদমাশটাকে খুন করতে পারলে আমার মন শান্ত হতো। ছোটলোকের ঘরের ছোটলোক একটা।”
থামলেন সিকান্দার মির্জা। লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেলে আবারও গম্ভীরমুখে বললেন,
-“তোমার বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে। বেশ সুবিধাবাদী একজন লোক তিনি এবং চতুর। তবে তার একটি দিক ভালোলেগেছে আমার।”
ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেললো মেসবাহ। লোকটির ভারী ভারী কথা ক্রমশ তার বোঝার বাইরে চলে যাচ্ছে।
-“কদিন ধরে তোমার সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার পর আমি পা দিয়েছি তোমার এখানে। আমি প্রথমেই বলেছিলাম আমি বাস্তববাদী একজন মানুষ। ন্যায় অন্যায় পর্যবেক্ষণের আগে আমি পর্যবেক্ষণ করি চারিপাশের পরিস্থিতি। তা তোমার কী কখনো অনুশোচনা বোধ হয় তুমি অল্প বয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করে বাল্যবিবাহর মতো অপরাধ করেছো বলে?”
সময় নিল না মেসবাহ। ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“হয়…”
-“হলেও তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। ওই বদমাশ হাজারটা ভুলের মাঝে একটি ভালো কাজ করেছে। তা হলো, তোমার হাতে আমার নাতনিকে তুলে দিয়ে। আর ঠিক একারণেই আমি ওই বদমাশটার গালে জুতোর বারি না মেরে হাতের বারি মেরেছি। মেয়ে হয়ে জন্মালে বিয়েশাদী একদিন দিতেই হবে। ধিঙ্গি করে একটা পাত্ৰ জুটিয়ে বিয়ে দেওয়ার পর মেয়ে যে সেখানে শান্তিতে সংসার করতে পারবে এমন কথা জোর গলায় বলতে পারবে কেউ? পারবে না। বরং মেয়েকে লিখিয়ে পড়িয়ে বড় করে যদি সেও তার মায়ের মতো কোনো ড্রাইভারের হাত ধরে পালাতো তাহলে সমাজে ছিছি পড়ে যেতো। সেক্ষেত্রে ছোটকালেই একজন চরিত্রবান এবং প্রতিষ্ঠিত ছেলের হাতে মেয়ে তুলে দেয়ার মাঝে আমি দোষের কিছু দেখছি না। আমার মেয়ে যদি ড্রাইভারের জায়গায় কোনো প্রতিষ্ঠিত ছেলেকে এনে আমার সামনে হাজির করতো আমি নির্দ্বিধায় তাদের মেনে নিতাম৷”
গোপনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সিকান্দার মির্জা। মেসবাহর উদ্বিগ্ন মুখের তাকিয়ে বললেন,
-“আমি আবেগী কথাবার্তা বলবো না। না বলবো মা মরা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও তাকে মায়া করতে। উল্লাসী তোমার বিয়ে করা বউ। তোমার দায়িত্ব। আমি উল্লাসীর অবিভাবক হিসেবে তখনি কিছু বলবো, যখন দেখবো তুমি তোমার দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালন করছো না। আমি কি আমার কথা বোঝাতে পেরেছি তোমায়?”
জবাব দিল না মেসবাহ। হালকা মাথা নেড়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো সিকান্দার মির্জার দিকে। লোকটির কথা এখনো ঠিকভাবে বোধগম্য হচ্ছে না তার।
-“উল্লাসীর এখন যে বয়স এটাই একদম উত্তম বয়স তোমার নিজের মতো করে ওকে গড়িয়ে নেবার। প্রথমবার কথা নরম করে বোঝাবে, দ্বিতীয়বার একটু কঠোর, তবে তৃতীয়বার কোনো ছাড় দেবে না। বুঝতে না চাইলে দু’গালে দু’চড় বসিয়ে হলেও বোঝাবে। কারণ ওর ভালো খারাপ দেখার দায়িত্ব সবটাই তোমার। আর আজ এ অধিকার আমি তোমায় দিয়ে যাচ্ছি। গো এহেড ইয়াং ম্যান। আই লাইক ইউ এন্ড ইউর বিহাভিউর। যাও, উল্লাসীকে গিয়ে বলো ওর হাতের খাবার খেয়ে তারপর আমি বেরুবো।”
উঠে দাঁড়াতে গিয়েও আবারও বসে পড়লো মেসবাহ। লোকটির কথাগুলো এখনো কানে বিধছে তার। প্রথমবার কথা নরম করে বোঝাবে, দ্বিতীয়বার একটু কঠোর, তবে তৃতীয়বার কোনো ছাড় দেবে না। বুঝতে না চাইলে দু’গালে দু’চড় বসিয়ে হলেও বোঝাবে। তবে এমন কিছু করলে আদৌ কী এই পৃথিবীতে নিজের ছায়া খুঁজে পাবে সে?
-“আপনার নাতনি যেখানে আদরই সহ্য করতে পারেনা সেখানে আমার হাতের মাইর? আমায় আস্ত রাখবে বলে আপনার মনে হয়? কেটে টুকরো টুকরো করে তা হাড়িতে বসিয়ে আমাকে কসিয়ে আপনাকে রাতের খাবার খাইয়ে দেবে।”
গুনগুনিয়ে মেসবাহ কথাগুলো বলতেই ভ্রু কুঁচকে ফেললেন সিকান্দার মির্জা। ভারী গলায় বললেন,
-“কিছু বললে?”
-“জ্বি না.. কী আর বলবো! ওইতো.. মাংস। আমি যাই। দেখি ওর রান্নাবান্না কতদূর।”
(চলবে)