নীরবতা

নীরবতা !! Part- 26

বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ উল্লাসীকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে রয়েছে মেসবাহ। অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে তার বুকের ভেতরটা। পুরো শরীরজুড়ে কাজ করছে তৃপ্ততা। যা নামহীন ভালোবাসার এক জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। এত কেন সুখ সেই জগতে? যে সুখের ছায়ায় নিজেকে হারাতে ইচ্ছে করছে বারেবার! তৃপ্তির শ্বাস ছেড়ে উল্লাসীর চুলে হাত বোলালো মেসবাহ। ঠোঁট জোড়া তার কানের কাছে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
-“উল্লাসী?”
-“হু..”
-“আমি একটু ওয়াশরুম থেকে ঘুরে আসি?”
-“হু..”
উল্লাসীর সম্মতি পেয়ে ধীরেসুস্থে বিছানা ছাড়লো মেসবাহ। পা বাড়ালো ওয়াশরুমের দিকে। আজকের রাতটি কী সত্যিই এসেছিল তার জীবনে? সত্যিই কী উল্লাসীকে পুরোটা নিজের করে পেয়েছে সে? বিশ্বাস হচ্ছে না.. নিজেকে যথাযথভাবে সামলে রেখেও শেষমেশ এত দ্রুত এমন একটি রাত তার জীবনে এসেছে তা মোটেও বিশ্বাস হচ্ছে না। সবটাই কল্পনা নয় তো? প্রশ্নই আসে না। তবে কাজটা কি ঠিক হলো? আরও কিছু সময় কি নেয়া যেত না? ভাবনার গতিপথ বাড়ালো না মেসবাহ। সময় নিয়ে পরিষ্কার হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ঘরের আলো জ্বালালো সে। এগুলো উল্লাসীর দিকে। কাঁথা গায়ে মুড়িয়ে নিস্তেজভাবে শুয়ে রয়েছে উল্লাসী। তার ক্লান্তিমাখা মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। তারপর ক্ষীণ গলায় ডেকে উঠলো তাকে।
-“উল্লাসী, ওয়াশরুমের কাজটা সেরে এসে একেবারে ঘুমোও।”
তবে ওপর পাশ থেকে উল্লাসীর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। মেয়েটি কি এর মাঝেই ঘুমিয়ে পড়লো? তার সাদা ধবধবে কাঁধে হাত ছুঁয়িয়ে আবারও তাকে ডেকে উঠলো মেসবাহ। এবারও উল্লাসীর দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল তার। উদ্বিগ্ন গলায় কয়েকবার ডাকার পরও ওপর পাশ থেকে উল্লাসীর কোনোরকম সাড়াশব্দ না পেয়ে অস্থির হয়ে পানির খোঁজে ড্রইংরুমের দিকে এগুলো মেসবাহ৷ বুকের ভেতরটা অনবরত কেঁপে কেঁপে উঠছে তার। এ কী করে ফেললো সে? উল্লাসী কেনো অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে বিছানায়? অশান্ত পায়ে ঘরে ফিরে উল্লাসীর মুখে পানি ছিটিয়ে দিল মেসবাহ। তবে উল্লাসীর ভাবমূর্তির পরিবর্তন না দেখতে পেয়ে লম্বা কিছু দম ছেড়ে নিজেকে শান্ত করলো। ঢোক গিলে কাঁপা হাতে উল্লাসীর শরীরের উপর থেকে কাথা সঁড়াতেই মাথা ঘুরে উঠলো তার। রক্তপাত এখনো বন্ধ হয়নি। শ্লথ ধারায় তা বেয়েই যাচ্ছে…
-“সরি উল্লাসী.. আই অ্যাম সরি। আমি কী করলাম এটা! এই উল্লাসী আমার কথা শুনছো? সরি উল্লাসী।”
উতলা মনে নিজের ফোন খুঁজতে শুরু করলো মেসবাহ। আপাতত এই পরিস্থিতিতে ইভানা ছাড়া দ্বিতীয় কিছু মাথায় আসছে না তার। সে একজন স্ত্রীরোগবিশারদ। নিশ্চয় তার কাছে এর সমাধান রয়েছে। কাঁপা হাতে ইভানার নাম্বারে ডায়াল করতে করতে উল্লাসীর পাশে এসে বসলো মেসবাহ। তার কপালে হাতে রেখে অধীর গলায় বারবার ডেকে উঠলো তাকে।
অন্ধকার মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরেধীরে। দূর ওই আকাশ থেকে একবিন্দু আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। ভোর হতে আর কত দেরি? ফজরের নামাযের জন্য মোরশেদা বেগম উঠলেই অস্থির মনে স্বস্তি ফিরে আসবে অনার। গতকাল দুপুরে বাড়ি এসে পৌঁছুলেও এখনো তা সে জানাতে পারেনি এমাদকে। তাছাড়া তার বিয়ে নিয়েও যে কথা চলছে তাও জানাতে হবে এমাদকে। ওদিকে নিশ্চয় চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। বাড়ি আসার পর থেকে রাত অব্দি চৈতালির সহচর্য অপরদিকে চৈতালি যেতেই মা! ছেলের বাড়ির খুটিনাটি সব শুনে রাতে ঘুমিয়েছেও তারই ঘরে। অশান্ত মন যে একটি বার এমাদের সঙ্গে কথা বলার আশায় ছটফট করছে তা যদি কেউ বুঝতো! একরাশ বিরক্তি নিয়ে পাশ ফিরলো অনা। সারাদিন জার্নির পর পুরো একটি রাত নির্ঘুমে কাটানো যে কতটা কষ্টকর তা আজ বেশ অনুভব হচ্ছে। তবে বুঝেও বা উপায় কী! আপাতত চোখে ঘুমের অস্তিত্বের দেখা পাওয়া বড়ই জটিল কাজ!
-“আল্লাহরে আল্লাহ! লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ…”
গুনগুনিয়ে মোরশেদা বেগম বিছানা ছেড়ে উঠতেই চারিপাশ থেকে ভেসে এল আযানের সুমধুর সুর। নীরবে আযান পুরোটা শুনলো অনা। ফজরের আযান বাকিসব বেলার আযানের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এটি শুনলেই বুকের ভেতর অদ্ভুত ভাবে কাঁপন শুরু হয়। যা অন্যান্য ক্ষেত্রে হয় কিনা তা নিয়ে বেশ সন্দেহ রয়েছে! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে অযু করে আবারও ঘরে ঢুকলো অনা। নামাজ পড়া হয় না অনেক দিন। কিছু সুরা হয়তো মাঝখানে ভুলেও বসেছে! অজস্র জড়তা নিয়ে জায়নামাজ বিছিয়ে তাতে দাঁড়ালো অনা। সময় নিয়ে দু’রাকাত সুন্নত এবং দু’রাকাত ফরজ নামায পড়ে ফোন হাতে বিছানায় এসে বসলো সে। লম্বা একটি দম ছেড়ে এমাদের নাম্বারে ডায়াল করতেই ওপাশ থেকে ঘুমন্ত গলায় এমাদ বলে উঠলো,
-“এটলাস্ট তুমি কল করেছো! আমি যে কী পরিমাণ টেনশনে ছিলাম তুমি বুঝবে না!”
শান্ত গলায় অনা বললো,
-“আমি বুঝি.. তুমি ঘুমাওনি? এত দ্রুত ফোন ধরলে যে!”
-“ঘুমিয়েছিলাম.. তোমাকে তো বলেছিলাম আমার ঘুম বেশ পাতলা!”
-“অহ হ্যাঁ.. রাতে খেয়েছিলে?”
-“উহু.. রাত এগারোটার দিকে একবার তোমার খোঁজ করতে তোমার ভাইয়ের বাসার সামনে গিয়েছিলাম। তবে তুমি ফোনই ধরলে না!”
-“আমি তো গ্রামে চলে এসেছি..”
-“গ্রামে চলে গিয়েছো মানে? তোমাদের তো বেশ কিছুদিন থাকার কথা ছিল! আমাদের তো একসাথে ঘুরতে বেরুনোর প্ল্যান ছিল। তাছাড়া আমার ক্যাম্পাস, ফ্রেন্ড সার্কেল সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার কথা ছিল।”
-“অন্য একসময় না হয় করিয়ে দিও।”
-“হঠাৎ এভাবে চলে যাবার কারণ টা কী?”
অনার বুকচিরে বেড়িয়ে এল একটি দীর্ঘশ্বাস। থেমে থেমে সে বললো,
-“আমার বিয়ের কথা চলছে এমাদ.. পরশু দেখতে আসবে। তাই হয়তো বড় ভাই বিনা নোটিশে এভাবে নিয়ে এসেছে।”
-“হঠাৎ?”
-“জানি না.. একটা কথা রাখবে?”
ফোনের ওপাশ থেকে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো এমাদ। ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“বলো..”
-“চলো আমরা বিয়ে করে নেই।”
-“তা তো অবশ্যই করবো.. কিন্তু এখন আমার পক্ষে বিয়ে করা কিভাবে সম্ভব?”
-“ইচ্ছে করলেই সম্ভব। তাছাড়া তুমি বুঝছো না ব্যাপারটা! অর্পা আপাকে কিন্তু দেখতে এসেই বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল!”
একদন্ড ভেবে এমাদ বললো,
-“ঠিকাছে.. আমাকে একটা দিন সময় দাও। আমি কিছুক্ষণের মাঝেই রওনা হচ্ছি। তারপর দেখি বাবার সাথে কথা বলে!”
অবাক হলো অনা। বিস্মিত গলায় বললো,
-“তোমার বাবাকে এর মাঝে কেনো টানছো?”
-“তো টানবো না? বাবা ছাড়া তোমার আব্বার সাথে এবিষয়ে কথা বলবে কে?”
-“সর্বনাশ! তুমি কী পাগল হয়েছো! ভুলেও এই চিন্তা মাথায় এনো না। তুমি আমার আব্বাকে চেনো না? এসব শুনলে আব্বা আমায় কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।”
উদ্বিগ্ন হয়ে এমাদ বললো,
-“তাহলে কী করবো?”
-“পালাবো..”
-“পালাবো মানে? অসম্ভব!”
-“সম্ভব.. প্লিজ এমাদ!”
-“না.. তাছাড়া আমার জানামতে তোমার আব্বা তোমায় অনেক ভালোবাসেন। তোমার কথা উনি ফেলবেন না।”
-“এসব আবদার শুনবেনও না। তুমি বোঝার চেষ্টা করো এমাদ। আব্বা এসব প্রেম ট্রেমের কথা শুনলে আমাকে জানে মেরে ফেলবে নয়তো জোর করে ধরে বিয়ে দিয়ে দেবে।”
-“তাই বলে পালানো কোনো সমাধান না।”
-“এছাড়া উপায় আছে?”
একমুহূর্ত থেমে গম্ভীর স্বরে এমাদ বললো,
-“আচ্ছা.. ঠিকাছে। আমাকে ভাবতে দাও।”
-“ভাবো.. তবে শেষমুহুর্তে এসে আমায় কষ্ট দিও না..”
ধীরেধীরে চোখ মেলে ঝাপসা দৃষ্টিতে চারিপাশটায় নজর দিল উল্লাসী। তার নির্জীব দেহটি বিছানার সাথে একদম সেটে লেগে রয়েছে। যেনো নিথর এই দেহ থেকে সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। তার হাতের সাথে ঝুলছে নালিকা জাতীয় কিছু। উঠে বসতে চেয়েও শরীরের সায় না পেয়ে আবারও চোখজোড়া বুজলো উল্লাসী। পুরো শরীর তার ব্যথায় জর্জরিত। মাঝেমাঝে জ্বলে জ্বলে উঠছে। ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তার দুচোখ ফেটে বেরিয়ে এল পানির ধারা। কিভাবে পারলেন উনি এতটা বাজে আচরণ করতে!
-“উল্লাসী.. এই তুমি কাঁদছো কেনো?”
সকাল হবার পর থেকে পায়চারী করেই যাচ্ছে মেসবাহ এঘর ছেড়ে ওঘর। কখন মেয়েটির ঘুম ভাঙ্গবে কখন মেয়েটিকে আত্মার ভেতর আবিষ্ট করতে পারবে এনিয়ে অস্থির ছিল তার মন। মেয়েটির এঅবস্থার কারণে প্রচুর অনুতাপ হচ্ছিল। ঘোরের বশেই হোক বা অন্যভাবে, অন্যায় সে করে ফেলেছে। মেয়েটি তো অবুঝ.. তাই বলে কি সেও অবুঝ ছিল?
-“আপনি আমার কাছে আসবেন না..”
আচমকা উল্লাসীর মুখ থেকে এমন কথা শুনে বিছানার কাছে এসেই থেমে গেল মেসবাহ। হতবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
-“কেনো?”
-“জানি না.. আপনি যান এঘর থেকে।”
-“ঠিকাছে, যাচ্ছি। স্যালাইনটা খুলে দিয়েই চলে যাচ্ছি।”
-“কিচ্ছু লাগবে না আমার। আপনি ছোঁবেন না আমায়।”
-“স্যালাইন শেষ হয়ে এসেছে উল্লাসী। এখন না খুললে রক্ত আসবে।”
-“আসুক। আপনি যে আমায় মেরে ফেলতে চান তা খুব ভালো করেই বুঝেছি আমি।”
ক্রন্দনরত অবস্থায় উল্লাসীর কথাগুলো শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো মেসবাহর। কয়েক মুহূর্ত নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার পর খানিকটা দুরত্ব রেখে বিছানার এক কোণায় নিঃশব্দে বসলো সে। তারপর ভাঙা গলায় বললো,
-“সরি.. উল্লাসী। আমি জানতাম তুমি ছোট। তোমার বয়স কম। তুমি আন্ডার ওয়েট। তারপরও আমি ভুল করে ফেলেছি। অ্যান্ড আই এক্সেপ্ট ইট।”
মেঝেতে নিজের দৃষ্টি আবদ্ধ করলো মেসবাহ। উল্লাসীর ব্যথাতুর মুখের দিকে তাকানোর সাহস তার নেই। নিজেকে এতটা সামলে রাখার ফল যদি এই হয়, তাহলে পুরুষ হয়ে এ পৃথিবীতে জন্মানোই তার জন্য পাপ। এ কী করে ফেললো সে? হাসিখুশিতে মেতে থাকা মেয়ের মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিল! সে প্রাপ্ত বয়স্ক। তার কাছে গতরাতের মতো সুখময় আরেকটি রাত দ্বিতীয় বার না এলেও উল্লাসীর কাছে এ রাত হয়ে উঠলো সকল নিকৃষ্ট রাতের মাঝে একটি। এমনটা তো চাওয়ার ছিল না তার।
-“তোমার যে এতটা কষ্ট হবে তা বুঝতে পারলে আমি কখনোই এমন কাজ করতাম না। আমি কিন্তু বারবার তোমায় জিজ্ঞেস করছিলাম, তোমার লাগছে কিনা। কিন্তু তুমি তখন কোনো কথা বলছিলে না। তাছাড়া আমি অনেক দেখেশুনেই আস্তেধীরে… তারপরও তোমার এঅবস্থা…”
কথা গুলিয়ে ফেললো মেসবাহর। লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেলে দু’হাতের মুঠ চেপে উল্লাসীর দিকে চেয়ে সে আবারও বললো,
-“সব কিছুর উর্ধ্বে আমি একজন পুরুষ। আমি চাইলে অনেক কিছুই নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনা। কিছু পরিস্থিতিতে সবটা আয়ত্তে থাকে না।”
-“তাই বলে আপনি আমায় ব্যথা দেবেন! আমার বড় আদর চাওয়াটাই কি ভুল ছিল?”
-“সরি বাবা! আমি তো বলছি সবটাই আমার ভুল।”
-“ভুল বললেই হলো? আপনি আমায় বড় আদরের কথা বলে কেনো ব্যথা দিলেন?”
-“প্রথম প্রথম বড় আদর নিতে গেলে একটু ব্যথা লাগেই উল্লাসী। এটা সাময়িক। সময় দাও একটু। ঠিক হয়ে যাবে।”
-“মিথ্যে বলছেন আপনি! বড় আদরে কোনো ব্যথা নেই। আদর তো আদর। আদরে কখনোই ব্যাথা লাগে না।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। বাল্যবিবাহের কুফল যখন নিজের জীবনে কার্যরত হয়, তখন এর ফলাফল নিয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকেনা কারো জীবনে…
-“আচ্ছা একটা কথা বলো আমায়। তুমি এক্সাক্টলি বড় আদর বলতে কী বোঝো?”
চোখের পানি মুছে মেসবাহর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উল্লাসী বললো,
-“পুরো শরীরে আদর দেয়া। আর আপনিই বলেছিলেন, আদর মানেই চুমু। অথচ আপনি আমায় ব্যথা দিয়েছেন। কী পরিমাণ কষ্টে যে আমি আছি তা যদি আপনি বুঝতেন! আজ থেকে আমি রাতে একাই থাকবো। আপনি আমার কাছে আসবেন না। একদম আসবেন না।”
গোপনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। সে ভুল বুঝেছিল। ভেবেছিল উল্লাসী নিজে থেকেই তার সঙ্গ কামনা করছে। অথচ তার মাথায় এটা কাজ করেনি উল্লাসীর আর যাই হোক এধরণের সঙ্গ কামনা করার মত বুঝ আসেনি! নিজের নির্বুদ্ধিতার জোরেই আজ না চাইতেও এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে। যা চেয়েও পরিবর্তন করা এখন আর সম্ভব নয়…
-“আপনি কী মনে করেছেন আপনি আমায় ব্যথা দিয়ে রক্ত বের করে দিয়েছেন তা আমি দেখিনি? খুব দেখেছি। ভোরে যখন আপনি চাদর পালটাচ্ছিলেন তখন আমার কথা বলার মতো শক্তি না থাকলেও দেখার শক্তি ছিল। আপনি আমায় মেরে ফেলে ওই মেয়ের কাছে যেতে চান তা আমি খুব বুঝেছি। আপনি যান। ওই মেয়ের কাছেই যান। আমি আর কিছুই বলবো না।”
উল্লাসীর কথার পিঠে কী জবাব দেবে ভেবে পেল না মেসবাহ। তাকে কী পুরো ব্যপারটি বুঝিয়ে বলবে? তাতে যদি স্বামী স্ত্রীর মাঝের সম্পর্কের ব্যাপারটি পরিষ্কার হয় মেয়েটির কাছে! লম্বা একটি দম ছাড়লো মেসবাহ। ধীর গলায় বললো,
-“আমি তুমি স্বামী স্ত্রী। এসব স্বামী স্ত্রীর মাঝে হয় উল্লাসী। একে সহবাস বলে। আর এই সহবাস কালে অনেক নারীরই রক্তপাত হয়। তুমি কিশোরী। আন্ডার ওয়েট.. আমি প্রাপ্ত বয়স্ক একজন পুরুষ। আমার যা হাইট বা ওয়েট তাতে অতি সাবধান থেকেও রক্তপাত হয়েছে। হ্যাঁ, মানছি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয়েছে.. তবে এই রক্তপাতেরও কারণ রয়েছে। হাইমেন বা সতীচ্ছদের কারণে এই রক্তপাত হয়। হাইমেন হলো একধরনের পর্দা যেটা যোনিমুখের সামনে অবস্থান করে। তবে সকল নারীর সতীচ্ছদ সমান থাকে না। কারো হাইমেন অনেক পুরু, কারো খুব পাতলা, কারোবা প্রাকৃতিকভাবেই কোন হাইমেন থাকে না। যা পরবর্তীতে দৈহিক বৃদ্ধির সাথে সাথেই অপসারিত হয় বা ছিঁড়ে যায়। অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রেই হাইমেন আপনাআপনিভাবে অপসারিত হয়ে থাকে। দৌড়ঝাঁপ বেশি করলে, ব্যায়াম করলে, সাইকেল চালালে, এমন কী গাছে চড়লেও! তাই যে নারীর হাইমেন বড় বা পুরু অথবা কোনো ভাবে অপসারণ না হয়, তাদের ক্ষেত্রে প্রথম যৌনমিলনে রক্তপাত হবার সম্ভাবনা থাকে। যেমনটা তোমার ক্ষেত্রে ঘটেছে। এটি স্বাভাবিক একটি ঘটনা..”
থামলো মেসবাহ। উল্লাসীর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো তার মনের অবস্থা। তার কথাগুলোর অর্থ কী বুঝতে পারছে উল্লাসী? কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে আবারও মেসবাহ বললো,
-“আমাদের দেশে একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। যে নারীর তার প্রথম সহবাসের সময় রক্তপাত হয় না সে কুমারী নয়। কোনো ছেলের সঙ্গে সহবাস করে সতীত্ব নষ্ট করেছে। যা আদৌ কোনো যুক্তিসঙ্গত কথা নয়। যাদের হাইমেন প্রাকৃতিকভাবেই পাতলা বা ছোট, তাদের দৈহিক বৃদ্ধি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে হাইমেনেরও অপসারিত হবার প্রবণতা বেড়ে যায়। যার হাইমেন একবার ছিঁড়ে গেছে বা অপসারিত হয়েছে, তার প্রথম বারের মিলনে কখনই রক্তপাত হবেনা। তবে অবাক হলেও সত্য যে অধিকাংশ শিক্ষিত পরিবারও নিজের ছেলের বউয়ের সতীত্ব পরীক্ষা করার জন্য প্রথম মিলনের আগে বিছানায় সাদা চাদর বিছিয়ে দেয়। হুইচ ইস ভেরি শিটি!”
কান্নার রেশ থেমে গেল উল্লাসীর। আতংকিত মুখ খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে এল। আগ্রহী গলায় সে বললো,
-“তাহলে যাদের রক্তপাত হয় না তারা ব্যাথাও পায় না?”
-“প্রথম সহবাসে একটু আকটু সবাই ব্যথা পায়।”
-“একটু আকটু আর বেশি.. আপনি ইচ্ছে করেই আমাকে বেশি ব্যথা দিয়েছেন। আমি আর কখনোই আপনার পাশে ঘুমোবো না। আর কখনোই বড় আদরের কথা বলবো না। আর মুন্নি ভাবিকেও দেখে ছাড়বো! উনি আসলেই একজন ভুটকি মহিলা।”
উল্লাসীর সাথে না পেরে তার কথামতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল মেসবাহ। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। আজ তার কারণেই উল্লাসীকে এত কষ্ট পেতে হচ্ছে। তাদের সুন্দর স্বাভাবিক একটি সম্পর্ক নষ্ট হতে বসেছে। ছোট মেয়েটির উপর দিয়ে যা যাচ্ছে তা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। কিছু একটা করা উচিৎ তার। তবে কী? কী করলে মানসিক এবং শারীরিক সব দিক থেকেই একটু হলেও সুস্থ বোধ করবে উল্লাসী?
(চলবে)