নীরবতা !! Part- 21
-“আসল আম্মু.. ও আসল আম্মু! তুমি জানো, আমার ওই আম্মুও আমাকে ছেড়ে মেজ বাবার সাথে এসে এখানে থাকে?”
-“আমি আসল আম্মু না মা। আমি তোমার আম্মু। শুধু আম্মু।”
-“তুমি আম্মু হলে ওই আম্মু কী? বাবা তো বলেছে ওটাই আম্মু।”
-“বাবা সামান্য ভুল বলেছে। আমি আম্মু, আর ওইটা ছোট আম্মু। তোমার ছোট আম্মু তোমায় আদর করে?”
মাথা নাড়িয়ে মায়ের গালে হাত বুলিয়ে দিল মৌমি। ভাঙা ভাঙা নরম স্বরে বললো,
-“অনেক করে। এখানে আসার সময় তো ছোট আম্মুই আমাকে সাজিয়ে দিয়েছে। আমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে না?”
-“খুব সুন্দর লাগছে আমার মাটাকে। এইযে তোমার আইসক্রিম এসে পড়েছে। আমি খাইয়ে দেই?”
-“দাও.. আগে বাবা আর ফুপু খাইয়ে দিত। এখন থেকে তুমি দেবে। ও আম্মু তুমি সবসময় আমায় খাইয়ে দেবে তো?”
জবাব দিল না জ্যোতি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আইসক্রিম তুলে যত্নসহকারে মুখে পুরে দিল মৌমির। প্রায় আড়াই বছর হতে চললো নিজের সাজানো গোছানো সংসার ফেলে চলে এসেছে জ্যোতি। কম কষ্টে এ কদম উঠায়নি সে। ধৈর্যের বাঁধ যখন কোনোভাবেই বাধা মানছিল না তখন একরকম নিরুপায় হয়ে কাজটি করতে হয়েছিল তাকে। তবে সেই বাড়ি ছেড়ে আসার পর মেয়ে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কারণে কখনোই কোনো আফসোস হয়নি তার। স্বাধীন ভাবে চলতে হস্তক্ষেপ করা, বাজে ব্যবহার, বাড়িতে কাজের লোক থাকতেও সংসারের সকল কাজ তার উপর চাপিয়ে দেয়া.. সবটা সামলে উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে পড়েছিল সে। তার সামনে আজ যে লোকটি নির্বিকার ভাবে বসে রয়েছে সেই দিনগুলোতেও সে নির্বিকারই ছিল। না তার ছিল আত্মসম্মানবোধ, না হৃদয়। গায়ে মাখার সাবান থেকে শুরু করে দু’টাকার জিনিস কিনতেও তাকে হাত পাততে হতো তার বাবার কাছে। যা আদৌ কোনো মেয়ের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব কিনা জানা নেই.. তবে তার পক্ষে এসব মেনে নেয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। কষ্ট হতো নিজের স্বামীকে আত্মমর্যাদাহীন ভাবতে। এমন এক লোকের পাশে নিজেকে কল্পনা করতেও অস্বস্তি হতো। বাবা কেনো তাকে এমন এক ছেলের হাতে তুলে দিল যার নিজস্বতা বলতে কিছুই নেই? পায়ের পাতা থেকে মাথার চুল অব্দি যার ছিল বাবার দখলে। বাবার কথা চোখবুঁজে মেনে নেয়াই ছিল যেনো তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য। তাই তার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর যখন আলাউদ্দিন শেখ নানান আজেবাজে কথা রটালো, তখনও সে তা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে নিয়েছে। কখনো খোঁজ নিয়ে দেখলোনা আদৌ সে কোনো ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে কিনা! নির্বোধদের যেমন বুঝিয়ে লাভ নেই, তেমন সেও আর বোঝাতে যায়নি মাজহারুলকে। অবশ্য সত্যটা জেনেও কিছুই করার ছিল না তার। বাবার সিদ্ধান্তের উপর কথা বলার সাহস তার নেই। তবে লোকটি সৎ ছিল, চরিত্রবান ছিল। কিন্তু বেকুব এক লোকের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে চলা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল।
-“আম্মা.. তাড়াতাড়ি খাও। আবার বাসায় যেতে হবে!”
মাজহারুলের কথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেললো জ্যোতি। বিষন্ন মুখে বললো,
-“এত জলদি কেনো? আমি আজ সারাদিন মৌমির সঙ্গে সময় কাটাতে চাই।”
এতক্ষণ যাবৎ মা মেয়ের মধুর মিলনের দৃশ্য হাসি মুখে অবলোকন করলেও এপর্যায়ে চোখমুখ গম্ভীর হয়ে এল মাজহারুলের। ভারী গলায় সে বললো,
-“শুধুশুধু মায়া বাড়িয়ো না…”
-“মায়া কি কখনো কম ছিল?”
-“কম ছিল কিনা জানা নেই.. তবে মায়ার ঘাটতি তো ছিল। নয়তো তুমি সাতমাসের একটি দুধের বাচ্চাকে ফেলে ওভাবে অন্য ছেলের হাত ধরে চলে যেতে পারতে না।”
গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জ্যোতি বললো,
-“আমার মেয়ের প্রতি আমার মায়া নিয়ে কথা উঠিয়ো না। আমি ওকে ছেড়ে নয়, নিয়েই আসতে চেয়েছিলাম। তোমার বাবামা…”
-“আমার আব্বা আম্মা ভুল কিছু করেনি।”
-“তুমি পরিবর্তন হওনি.. কোনোদিক দিয়েই পরিবর্তন হওনি।”
-“তুমি তো হয়েছো.. এটাই কি যথেষ্ট নয়?”
মাজহারুলের কথার জবাব দিল না জ্যোতি। মেয়ের মাথায় আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতেই ফোন বেজে উঠলো তার। স্ক্রিনে একবার চোখ বুলিয়ে রিসিভ করে ধরা গলায় জ্যোতি বললো,
-“আমার হয়ে গেছে। তুমি গাড়ি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াও। আমি আসছি।”
-“তুমি কি কাঁদছো?”
-“না.. তুমি এসো।”
-“এত দ্রুত মেয়েকে দেখা হয়ে গেল? আরও কিছুক্ষণ থাকো। আমার সমস্যা নেই। আমি আছি আশেপাশেই।”
-“তোমার সমস্যার কথা আমি কখনোই ভাবি নি আর না আজ ভাবছি। তুমি এসো..”
কল কেটে মেয়ের মুখ নিজের দিকে ঘোরালো জ্যোতি। সময় নিয়ে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিল পুরো মুখে।
-“আম্মু লাভস ইউ আ লট মা.. খুব ভালোবাসে আম্মু তোকে। খুব…”
-“আবারও কাঁদছো? এত কাঁদো কেন তুমি?”
-“জানিনা মা। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না।”
উঠে দাঁড়ালো জ্যোতি। গম্ভীরমুখে বসে থাকা মাজহারুলের কোলে মৌমিকে দিয়ে ব্যাগ এবং ফোন হাতে সে দ্রুত পা বাড়ালো রেস্তোরাঁর বাইরে দিকে। সেখানে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে এক ভদ্রলোক। এই লোকই কি সে যার জন্য সকল কিছুকে তুচ্ছ করে তাকে এবং তার সন্তানকে ফেলে চলে গিয়েছিল জ্যোতি? বুকের ভেতরটা অদ্ভুত এক যন্ত্রণা শুরু হলো মাজহারুলের। লম্বা একটি দম ছেড়ে সেদিক থেকে নজর সরিয়ে মেয়ের দিকে দিল সে। চুপচাপ বসে আইসক্রিম খাচ্ছে মৌমি। তার সেই অতি আকাঙ্খিত মা তাকে ফেলে আবারও চলে যাচ্ছে সেদিকে সামান্য ভ্রুক্ষেপও নেই তার..
শুক্রবারের মতো একটি দিনে বাসায় থেকেও উল্লাসীর দেখা পাওয়া অমাবস্যার চাঁদ হয়ে উঠেছে মেসবাহর। রাতে সেই যে তার কপালে পিচ্চি আদর দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো.. সেই শেষ! রান্নাঘরে গিয়ে মেয়েটিকে দু’দন্ড মন ভরে দেখবে সেই উপায়ও নেই! মুন্নি সরকার এবং অনা বেশ আটঘাট নেমে পড়েছে উল্লাসীর পেছনে। অবশ্য একদিকে ভালোই হয়েছে। কোনো কাজ উল্লাসীর একা করতে হচ্ছে না। মেয়েটির উপর চাপ কম পড়ছে। তাছাড়া অনাকে নিয়ে যে ভয় ছিল আপাতত সেটিও আর নেই। সবটা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে সে অনাকে। অবশ্য তা মানতে প্রথমে অনা আহ্লাদ করলেও পরবর্তীতে টাকা ঢেলে শান্ত করা হয়েছে তাকে। মাঝেমাঝে নিজের বোনকে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ হয় তার। এত দুষ্ট কেনো মেয়েটি? তাদের তিন ভাইয়ের মাঝে এমন তো হয়নি কেউ!
-“আপনার চা..”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিল মেসবাহ। রাত আটটার উপরে বাজে। এখন আবার কিসের চা? চা তো সন্ধ্যায় একবার সে খেয়েছেই! উদ্বিগ্ন মনে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বেড সাইড টেবিলে রেখে আবারও বইয়ের পাতায় নজর দিল মেসবাহ। ছোট্ট এই মেয়েটির জন্য সে যতটা ব্যাকুল, মেয়েটিও কি ততটাই ব্যাকুল? তা জানার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা…
-“শুনুন…”
-“বলো..”
-“বই থেকে চোখ উঠান।”
বইয়ের পাতায় তাকানোর নিজেরও কোনো ইচ্ছে ছিল না মেসবাহর। তাই একবার উল্লাসীর বলামাত্র বই ফেলে তার দিকে নজর দিল মেসবাহ।
-“এবার হয়েছে?”
-“হয়েছে.. এবার উঠে দাঁড়ান।”
-“কেনো? উঠে দাঁড়াবো কেনো?”
-“দাঁড়ান না! একটু দাঁড়ালে কী হয়?”
-“তোমার কথাবার্তায় আমার সন্দেহ লাগছে।”
দুষ্টু এক হাসির রেখা ঠোঁটের কোণায় ফুটলো উল্লাসীর। বালিশে হেলান দিয়ে বসে থাকা মেসবাহকে হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে তার বুকে মাথা গুঁজলো সে। নিজের হাতজোড়া দিয়ে আঁকড়ে ধরলো মেসবাহর পিঠ। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল মেসবাহ। তবে পরমুহূর্তেই উল্লাসীর স্পর্শে বুকের বাম পাশটায় ধকধকানি শুরু হলো তার। হাতপা জমে ঠান্ডা বরফে রূপ নিতেই অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ভরে উঠলো তার পুরো শরীর।
-“মুন্নি ভাবি বলেছে, স্বামীরা যখন স্ত্রীর জন্য অস্থির হয়ে ছটফট করতে থাকে তখন তাকে শান্ত করতে এভাবেই আদর দিতে হয়।”
দুইহাতে উল্লাসীকে নিজের বুকে চেপে ধরলো মেসবাহ। চোখজোড়া বুজে সজোরে একটি নিঃশ্বাস ভেতরে টেনে নিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“তাই?”
-“হ্যাঁ.. একটু ধীরে ধরুন না! দম বন্ধ হয়ে আসছে..”
মৃদুস্বরে হেসে উঠলো মেসবাহ। হাতের বাঁধন শিথিল করে উল্লাসীর চুলের মাঝে নাক ডুবিয়ে বললো,
-“এখন ঠিকাছে?”
-“হ্যাঁ..”
-“এই তোমরা কী করছো আমাকে ফেলে? ও মেজবাবা, তুমি ছোট আম্মুর চুল খাচ্ছো কেনো? চুল কী খাওয়ার জিনিস?”
হঠাৎ দরজার পাশ মৌমির কথ শুনে দ্রুত উল্লাসীকে ছেড়ে দিল মেসবাহ। উজ্জ্বল চোখে মুখভর্তি হাসি নিয়ে সে পা বাড়ালো মৌমির দিকে। তাকে কোলে তুলে নিয়ে হাসিমুখে বললো,
-“হ্যাঁ, আম্মা। চুল তো খাওয়ার জিনিসই। তুমি কখনো খাওনি? এসো আমরা দুইজন মিলে তোমার ছোট আম্মুর চুল খাই। ছোট আম্মুর চুল কিন্তু হ্যাব্বি টেস্টি…”
ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেললো উল্লাসী। বিস্ময় নিয়ে বললো,
-“কী বলেন এসব? চুল কখনো খাওয়া যায়?”
-“ওমা! তুমিও জানো না? চুলও খাওয়া যায়। খুব খাওয়া যায়!”
-“ধুর! কী যে বলেন না!”
দ্রুত পায়ে উল্লাসী এগুলো রান্নাঘরের দিকে। মুন্নি ভাবির কথামতো অসময়ে চা এনে এ কী শুনলো সে! তার চুল নাকি হ্যাব্বি টেস্ট!
ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠেছে অনা। রান্নাবান্না তার ধাচে নেই। আর না সে কখনো নিজের ইচ্ছেতে রান্নাঘরে ঢুকেছে। তবে আজ উল্লাসীর জন্য ঢুকতে হলো। ছোট একটি মেয়ের উপর সকল কাজ চাপিয়ে পায়ের উপর পা তুলে খেতে অস্বস্তি হচ্ছিলো। ঘরে এসে ফ্যান চালিয়ে বিছানায় শরীর মেলে দিল অনা। কিছুক্ষণ সেভাবেই কাটানোর পর হঠাৎ ফোনের কথা স্মরণ হতেই চারপাশে নজর বুলিয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো সে। ছোট্ট একটি নোকিয়া সেট। ফোনটি বেশ কদিন আগেই তাকে দিয়েছে এমাদ। যা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বেশ ভালোই প্রেম চালাচ্ছে দু’জনে। তবে এ কী? এমাদের এতগুলো মিসড কল! অস্থির মনে বেলকনিতে এসে এমাদের নাম্বারে কল দিল অনা। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো ওপাশ থেকে এমাদের সাড়ার।
-“তুমি ফোন কোথায় রাখো বলো তো! একসময়ও ফোন করে খবর পাওয়া যায় না!”
এমাদের গলার আওয়াজে স্বস্তি ফিরলো অনার মনে। শীতল কন্ঠে সে জবাব দিল,
-“আরে! লুকিয়ে লুকিয়ে এর চেয়ে বেশি সম্ভব নয়। তাছাড়া ভাইয়ারা সবসময় আশেপাশে থাকেই। এতবার কল করেছিলে কেনো? কিছু বলবে?”
-“হ্যাঁ.. তুমি একটু বেলকনিতে এসো। আমি দুই মিনিটের মাঝে আসছি।”
অবাক হলো অনা। ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“বেলকনিতে আসবো মানে? তুমি ঢাকায় এসেছো?”
-“জ্বি, ম্যাম। আসতে হলো।”
স্তব্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারলো না অনা। ঠোঁটে মুখে একরাশ হাসির ঝলক ফুটিয়ে বললো,
-“তুমিও না! আচ্ছা তাড়াতাড়ি এসো। আমি বেলকনিতেই আছি…”
-“এইতো.. এসে পড়েছি।”
ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোয় এমাদকে দেখামাত্র মধুর আবেগে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো অনার৷ সুদর্শন এক পুরুষ এমাদ। মাথা ভর্তি ঘন কোঁকড়ানো চুল। বেশ ছোট ছোট দুটি চোখ, পুরু ঠোঁট, চওড়া কাধ, ফর্সা গাল ভর্তি খোঁচাখোঁচা দাড়ি। সব মিলিয়ে এমাদের মাঝে রয়েছে চোখ ধাঁধা লাগানোর মতো রূপ। যা একজন মেয়েকে নিজের দিকে আকর্ষিত করার মতো যথেষ্ট। সেই সুদর্শন পুরুষ যখন সমস্ত পৃথিবী ভুলে তার মতো একটি মেয়েতে মত্ত থাকে সেখানে কী নিজেকে ভাগ্যবতী ভাবলে ভুল হবে?
-“ভালোবাসি অনা.. খুব ভালোবাসি।”
চোখজোড়া জলে ভরে উঠলো অনার। ধরা গলায় নাক টেনে সে বললো,
-“আমিও বাসি…”
-“পাগল মেয়ে! কাঁদছো কেনো? দাঁড়াও একটি গান শোনাই… মন রাগে অনুরাগে
আজ আরো কাছে ডাকে
না যেওনা….
তুমি ছাড়া যে শূন্য লাগে!”
সকলে মিলে খেতে বসেছে রাতের খাবার। পাশের বাড়ির হাসান সাহেব সহ তার স্ত্রীও যোগ দিয়েছেন এই আয়োজনে। পাশেই মৌমিকে কোলে চাপিয়ে একটি চেয়ারে বসে পোলাও খাইয়ে দিচ্ছে উল্লাসী। তার দিকে তাকিয়ে গোপনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাজহারুল। সকালে আইসক্রিম শেষ হতেই মৌমি খোঁজ করেছিল জ্যোতির। ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল তার কাছে যাবে বলে। তবে বাড়ি ফিরে উল্লাসীর দেখা পাওয়ামাত্র জ্যোতিকে ভুলে গেছে সে। মুখের ফাঁকে একটিবারও উচ্চারণ করেনি জ্যোতির নাম। অথচ তার এই অবুঝ মন বারেবারে ভাবছে জ্যোতিকে। জ্যোতি কেনো চলে গেলো তাকে ফেলে? একটু কষ্ট হলেও কি ছোট্ট মৌমিকে নিয়ে সুখে ছিল না তারা?
-“বাবা তুমি খাচ্ছো না কেনো?”
মৌমির ডাকে চিন্তার বেড়াজাল ছিঁড়ে বাস্তবে প্রবেশ করলো মাজহারুল। ম্লান হেসে খাবার মুখে পুরতেই আবারও মৌমি বললো,
-“ও বাবা.. জানো? মেজ বাবা একটু আগে ছোট আম্মুর চুল খাচ্ছিলো!”
উল্লাসীর হাতের পোলাও মাংস বেশ আরাম করেই খাচ্ছিলো মেসবাহ। হঠাৎ মৌমির এমন কথা শুনে চোখ কপালে উঠে গেলো তার। মুখের উচ্ছিষ্ট খাবার কোনোমতে গিলে মৌমিকে ইশারায় চুপ করতে বলতেই পাশ থেকে উল্লাসী বললো,
-“আরে বোকা মেয়ে! চুল খাচ্ছিলো না। চুলে আদর করছিলো। চুল কী খাবার জিনিস নাকি!”
-“হ্যাঁ তো। মেজ বাবাই তো বললো চুল খাওয়া যায়। আমি আর মেজ বাবা মিলে তোমার চুল খাবো।”
মৌমির কথা শেষ হতেই হেসে উঠলো মুন্নি সরকার। মেসবাহর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“শুনেছিলাম প্রেমে পড়লে নাকি প্রেমিকেরা অখাদ্য কুখাদ্য সবই পেটে পুরে নেয়। তাই বলে চুল?”
-“আরে ভাবি চুল খাচ্ছিলো না তো। আদর করছিলো!”
-“ওমা তাই? চুলেও আদর করা যায়? কিভাবে করে রে?”
খাবার থালা ছেড়ে হাত উঠিয়ে হালকা কেশে উঠলো মেসবাহ। তবে তাকে উপেক্ষা করে আবারও উল্লাসী বললো,
-“হ্যাঁ। রোজ রাতেই তো করে। অনেক্ক্ষণ সময় নিয়ে চুলের ঘ্রাণ নেয়। তারপর কিছু চুমু…”
মাঝপথে উল্লাসীকে থামিয়ে দিল মুন্নি সরকার। এই মেয়ে আসলেই অবুঝ। পাশেই ভাসুর বসে থাকতে তার প্রশ্নে যে এত খোলামেলা ভাবে উত্তর দেবে উল্লাসী তা জানলে কখনোই এধরনের প্রশ্ন করতো না সে। নিজেরই এখন লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এই মেয়েকে কবে বুঝ দেবে উপরওয়ালা?
সকল কাজ সেরে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে ঘরে এল উল্লাসী। সারাদিন আজ কম ধকল যায় নি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তাকে লেগে পড়তে হয়েছে রান্নাবান্নার কাজে। পরবর্তীতে দুপুরের দিকে একটু সময় পেলেও মুন্নিভাবির সঙ্গে বসে সে এবং অনা আপা দুজনে মিলে একটি সিনেমা দেখেছে। সিনামাটি বাংলা নয়, অন্যভাষার। যার পুরোটা দেখে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি সে। ফ্যানের পাওয়ার বাড়িয়ে বিছানায় বসলো উল্লাসী। প্রচুর গরম পড়েছে। ফ্যান ছাড়া একমুহূর্ত টেকাও যেনো দায় হয়ে পড়েছে! ওড়না বিছানার এক কোণায় খুলে রেখে চুল গুলো ছেড়ে দিল সে। চুলের ভেতর ঘেমে ভিজে একাকার হয়ে পড়েছে। না শুকিয়ে এভাবে শুয়ে পড়লে অর্ধেক চুল ঝড়ে যাবে। তাছাড়া যেভাবে চুল পড়া শুরু হয়েছে, তাতে টাকলা হতেও আর বেশি দিন বাকি নেই!
বেলকনি ছেড়ে ঘরে ঢুকে নীরবে উল্লাসীকে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করলো মেসবাহ। দিনেদিনে মেয়েটি যেনো দুইচোখের মণি হয়ে যাচ্ছে তার। যতদূর চোখ পড়ছে শুধু তাকেই দেখতে পাচ্ছে সে। তবে তার মনের গহীনে যে মেয়ের কাল্পনিক ছবি আঁকা সে তো উল্লাসীর মতো নয়। উল্লাসী ছোট, অবুঝ। তবে তার পছন্দ প্রাপ্তবয়স্ক একটি পরিণত মেয়ে। যার চিন্তাভাবনা কাজকর্ম সবটাই হবে একেবারে নিখুঁত। কিন্তু উল্লাসী একদম তার উল্টো। সে এতটাই অবুঝ যে আজ তাদের মাঝের কিছু মুহূর্তের কথা খাবার টেবিলে সকলের সামনে বলে বেশ লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল তাকে। চৌদ্দবছরের কোনো মেয়ে এতটাও অবুঝ হয়? বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। উল্লাসী যেভাবে বেড়ে উঠেছে তাতে কী অবুঝ হওয়াটাই স্বাভাবিক নয়? সকলের নিজস্ব একটি কল্পনার জগৎ থাকে। তাকে ঘিরে বিচরণ করে, নানান স্বপ্ন দেখে তা ভরে তুলতে ব্যকুল কিশোরী কাতারে কোনো ভাবেই ফেলা যায় না উল্লাসীকে। কল্পনার জগতে বিচরণ করতেও লাগে একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন। রসহীন জীবনে আর যাই হোক, প্রেম ভালোবাসা নিয়ে ভাবার মতো অবস্থা থাকে না। মায়ের মৃত্যুর স্মৃতিচারণ, প্রতিবন্ধী বোনকে নিয়েই যেখানে তার চিন্তাভাবনা থেমে ছিল, সেখানে এসব রঙিন দুনিয়ার মাখামাখি নিয়ে তার ধারণা না থাকা অসম্ভব কিছু নয়।
-“আপনি ওখানে কী করেন? ঘুমোবেন না?”
-“না.. তুমি ঘুমোও।”
-“বললেই হলো! একা একা আমার ঘুম আসেনা। তাছাড়া আমার আদর? ওটা কে দেবে শুনি?”
উল্লাসীর কথার কোনো জবাব না দিয়ে স্টাডি টেবিলে এসে বসলো মেসবাহ। সামনে থাকা একটি বই খুলে একেরপর এক পেইজ উলটানো শুরু করলো ধীরেধীরে…
প্রতিদিন মেসবাহর আদরমাখা চুমু নেয়া যেনো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে উল্লাসীর। অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করে লোকটি আশেপাশে থাকলে। কপালে ঠোঁটের ছোঁয়া, মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে ঘুম যেনো কেঁদে বলে উঠে, ওসব ছাড়া আমরা তোমার কাছে আসবোই না! একরাশ হতাশা নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো উল্লাসী। মেসবাহর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আহ্লাদী গলায় বললো,
-“দেবেন না আদর? সত্যিই দেবেন না?”
-“উহু..”
-“কেনো? কেনো? কেনো? কিছু কি করেছি আমি?”
বই থেকে নজর উঠিয়ে উল্লাসীর দিকে তাকিয়ে মেসবাহ বললো,
-“কী করোনি তুমি? স্বামী স্ত্রীর মাঝে যাই হোক না কেনো তা কী সবার সামনে ওভাবে বলতে হয়?”
-“ওরা যে ভাবছিল আপনি চুল খাচ্ছিলেন। তাই তো ওদের বললাম।”
-“ভাবলে ভাবুক। মৌমি পিচ্চি। একা বলে বলেই থেমে যেত। তোমাকে এই মাঝে মাতব্বরি কে করতে বলেছে? বড় ভাই ছিল, হাসান ভাই ছিল.. উনারা কী ভাবলো? লজ্জায় আমি উনাদের মুখোমুখি হতে পারছি না।”
একমুহূর্ত নীরব থেকে ধীর কণ্ঠে উল্লাসী বললো,
-“ঠিকাছে। আর কখনোই বলবো না। কসম।”
-“গুড…”
-“এবার তো আসুন।”
মাথা নেড়ে মেসবাহ বললো,
-“মোটেও না। আমি আর তোমার কাছেই ঘেষবো না। দেখা যাবে আজ রাতে কিছু করলেই কাল সকালেই তুমি সবাইকে বলে আমার ইজ্জতের রফাদফা বানিয়ে দেবে।”
-“সত্যিই বলবো না আর।”
-“উহু..”
-“হ্যাঁ..”
-“উহু..”
-“হ্যাঁ.. হ্যাঁ.. হ্যাঁ। আর বলবো না তো। এই যে কান ধরলাম।”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু হাসলো মেসবাহ। কী আছে এই বাচ্চা মেয়েটির মাঝে? যা চৌম্বকের মতো সর্বক্ষণ টানতেই থাকে তাকে!
-“উঠুন না!”
-“উঠছিরে বাবা…”
-“উঠুন.. উঠুন।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। দুই হাতের আঁজলে উল্লাসীর মুখ ধরে কপালে একটি চুমু দিতেই ফোন বেজে উঠলো তার।
-“হ্যালো মশা!”
ফোনের ওপাশ থেকে ইভানার স্বর শোনামাত্র কপাল কুঁচকে ফেললো মেসবাহ। একরাশ বিস্ময় নিয়ে বললো,
-“তুই? এই নাম্বার কার? তুই কি বাংলাদেশে?”
-“হ্যাঁ.. তোকে ছেড়ে আর কয়দিন থাকবো বল? তাই চলে এলাম সব ছেড়ে।”
-“ঠাট্টা রাখ। কবে এলি? আর জানালিও না তো!”
-“তুই জানিয়েছিস তোর বিয়ের কথা? লিমন না বললে আমি এখনো কিছুই জানতাম না! তা আছিস কেমন তোর বাচ্চা বউকে নিয়ে?”
-“আর বউ!”
-“কেন কেন? আমি তো ভালা না.. এখন ভালা লইয়াই থাকো!”
(চলবে)