নীরবতা !! Part- 04
বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত বেশি হয়ে যাবার কারণে বাড়ি না ফেরার সিদ্ধান্ত নিল চৈতালি। একদম কাল সকালেই না হয় বাড়ি ফেরা যাবে। তবে বাবাকে খবর খানা পৌঁছে দিতে হবে। অনার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে চৈতালি এগুলো আলাউদ্দীন শেখের ঘরের দিকে। ওঘরে একটি টেলিফোন রয়েছে। যা দিয়েই বাড়ির বাইরে থাকা সকল সদস্যের খবরাখবর নেয়া হয়। তাদের বাড়িতেও অবশ্য একটি টেলিফোন রয়েছে। তবে তা বেশ পুরোনো আমলের। দাদার কালের। গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে ধীর পায়ে লম্বা বারান্দা ধরে এগুচ্ছিল চৈতালি। আচমকা পেছন থেকে হালকা টান অনুভব করলো সে। কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্ধকার আচ্ছন্ন এক ঘরে নিজের উপস্থিতি টের পেয়ে আঁতকে উঠলো বুকের ভেতরটা। তবে পরমুহূর্তেই ঘাড়ে পড়া একেকটি চিরচেনা নিঃশ্বাসে আত্মায় পানি ফিরে এল তার। ঠোঁটে ফুটলো একরাশ মিষ্টি হাসি।
-“খুব প্রেম পাচ্ছে বুঝি?”
জবাবে চৈতালির কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে মুবিন বললো,
-“ভালোবাসি..”
পরম আবেশে চৈতালি চোখজোড়া বুজে সজোরে কিছু নিঃশ্বাস ছেড়ে পেছন ফিরে জড়িয়ে ধরলো মুবিনকে। দুমাস আগে রোযার ঈদের ভেতর শেষ দেখা হয়েছিল তার মুবিনের সঙ্গে। তারপর মাঝেমধ্যে টেলিফোনে কথা হলেও তার স্থায়িত্বকাল খুব বেশি দীর্ঘ ছিল না। তবে ভালোবাসায় দূরত্ব থাকা উচিৎ। দূরত্ব কখনোই ভালোবাসা কমাতে পারেনা, সম্পর্ক নষ্ট করতে পারেনা। এতে শুধুই ভালোবাসা বাড়ে। যে ভালোবাসার নেই কোনো সীমাপরিসীমা।
-“কাঁদছো?”
মুবিনকে ছেড়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চৈতালি বললো,
-“তোমার জন্য কাঁদতে আমার বয়েই গেছে!”
-“না কাঁদলেই ভালো। এখন কাঁদতে দেখলে মার একটাও মাটিতে পড়তো না। তা বই পেয়েছো?”
-“পেয়েছি। নিজে না দিয়ে অনাকে দিয়ে দেয়ানোর কী দরকার ছিল? আবার ওকে এও নাকি বলেছো চৈতালি কে?”
হেসে উঠলো মুবিন। দু’হাতে চৈতালির কোমর চেপে তাকে শরীরের সাথে লেপ্টে নিয়ে বললো,
-“আর নিজে যে আমাকে পানিতে চুবানি খাওয়ালে.. তা কিছুই না?”
-“ইশ! নিজে কেনো আমার উপর চোখ রাঙ্গালেন?”
-“আর নিজে যে বললে আমার নাকি ভার্সিটিতে কাকে মনে ধরেছে!”
-“তো ধরেনি? কাওকে মনে না ধরলে আমাকে ছাড়া দিনের পর দিন কীভাবে কাটাও তুমি? কষ্ট হয় না একটুও বুঝি?”
-“হয় তো.. প্রচুর কষ্ট হয়৷ তাই তো একবার কাছে পেলেই সবটা একেবারে উশুল করতে লেগে পড়ি।”
বলেই চৈতালির গালে এলোপাথাড়ি চুমু দিতে শুরু করতেই নিজেকে মুবিনের বাহুডোর থেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো চৈতালি। দু’হাতে মুবিনের ঠোঁট চেপে ধরে লাজুক এক হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে সে বললো,
-“কেউ দেখে ফেলবে তো! দেখি ছাড়ো। আজ রাতে এখানে থাকবো তা বাবাকে জানাতে হবে। বেশি রাত হয়ে গেলে আবার তোমার আব্বা শুয়ে পড়বেন।”
হাতের বাঁধন শিথিল করে মুবিন বললো,
-“তাহলে চাচাকে খবরটা দিয়ে দ্রুত ছাদে চলে এসো। আমি অপেক্ষা করবো।”
-“মোটেও না। ঘুম ভেঙে অনা আমাকে কাছে না পেলে কেলেংকারী হয়ে যাবে।”
-“আরে! ও উঠবেই না। সারাদিন প্রচুর দৌড়ঝাঁপ করেছে। শুলেই দেখবে ঘুমে তলিয়ে গেছে।”
-“জ্বি না। আপনার চালাকি আমি খুব বুঝি! জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে যান ঘুমিয়ে পড়ুন।”
নিজেকে মুবিনের হাত থেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে অন্ধকারে মিশে গেল চৈতালি। মুবিন গ্রামে এলেই বুকের ভেতরটা সবসময় ছটফট করতে থাকে তার। এই বুঝি মুবিন আসবে আর তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ভালোবাসার অথৈ সাগরে! এত সুখ কেনো ভালোবাসায়?
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগুতেই মেঝেতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা উল্লাসী নজরে এল মেসবাহর। মেয়েটির গায়ে ব্লাউজ এবং পেটিকোট ছাড়া তৃতীয় কোনো বস্ত্র নেই। বিয়ের শাড়ি পরে রয়েছে মাথার কাছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উল্লাসীর দিক থেকে নজর সরিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অনার উদ্দেশ্যে সে বললো,
-“নিচে আসছি। তুই যা।”
তারপর এগুলো ওয়াশরুমের দিকে। চোখমুখে কোনোরকম পানির ঝাপটা মেরে আবারও ফিরে এল ঘরে। উল্লাসীর পাশে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে ডেকে উঠলো তাকে।
মোটা পুরুষালী গলায় নিজের নাম উচ্চারিত হচ্ছে শুনেও চোখ মেললো না উল্লাসী। গতকালের সারাদিনের ধকলের পর মেঝেতে শরীর মেলে দেয়ার পরপরই শরীরের ব্যথায় পুরো শরীর চিনচিন করছিল তার। ব্যথাজর্জর শরীর নিয়ে কখন ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল সেটিও অজানা। তবে আপাতত ঘুমের ভাব কাটিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না তার। আরও কয়েকদন্ড শুয়ে শুয়ে সুহার সঙ্গে কাটানো মধুর কিছু সময়ের স্মৃতিচারণ করতে মন উঠে পড়ে লেগেছে।
-“এই উল্লাসী? উঠো। উঠে দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। আমি নিচে যাচ্ছি।”
মেসবাহর অনুপস্থিতিতে খানিকক্ষণ সেভাবেই কাটানোর পর চোখজোড়া মেলে চারপাশটায় নজর দিল উল্লাসী। এবং প্রায় সাথেসাথেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো তার। তার স্বামী তাকে ডাকছিল, অথচ সে তার কথার অবাধ্য হয়ে নিঃশ্চিন্তায় সেভাবেই পড়ে রয়েছিল? তার এ কাজের ফলে উনি কী অসন্তোষ হবেন? আর অসন্তোষ হলেই বা কী করবেন? বকবেন নাকি মারবেন? আঁতকে উঠা মন নিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো উল্লাসী। মেঝেতে বিছানো চাদর এবং বালিশ উঠিয়ে শাড়ি গায়ে জড়াতেই ঘরে আগমন ঘটলো মোরশেদা বেগমের। একনজরে ছেলের বউকে আদ্যোপান্ত দেখে তিনি বললেন,
-“মেসবাহ তোমার সঙ্গে কোনো বাজে ব্যবহার করেছে কী?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে ঘাবড়ে গেল উল্লাসী। ঢোক চেপে ধীর গলায় বললো,
-“উহু…”
অস্থির মনে শান্তি ফিরে পেলেন মোরশেদা বেগম। এগিয়ে এসে উল্লাসীর চুলে হাত রেখে জানতে চাইলেন,
-“গোছল দাও নি?”
-“উহু…”
-“কেনো? তেমন কিছু কী হয় নি?”
মোরশেদা বেগমের ছোঁড়া প্রশ্ন ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না উল্লাসী। মেঝের দিকে তাকিয়ে সে হাতের নখ কচলাতে শুরু করতেই ওপাশ থেকে মোরশেদা বেগম আবারও বললেন,
-“পাক পবিত্রতা আল্লাহর নেয়ামতের অংশ। এসব করার পর সবসময় গোছল করে নাপাক শরীর পবিত্র করে নিবা। বুঝছো?”
মাথা নেড়ে উল্লাসী সম্মতি জানাতেই তার শাড়ির দিকে নজর দিলেন মোরশেদা বেগম। ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন,
-“শাড়ি পড়তে জানো না?”
-“উহু…”
-“সমস্যা নেই। তুমি গোছলের জন্য ঢোকো। আমি অর্পাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ.. কলা পাতা রঙের শাড়িটা পড়বে। মেসবাহর পছন্দের রঙ ওইটা।”
মিষ্টি এক সকাল। চারিপাশ থেকে বেয়ে আসা হিমেল হাওয়া, নরম দু’টুকরো রোদ, আশপাশের সজীব করা প্রকৃতি, সবুজে ঘেড়া গাছগাছালীর ডালে বসে নির্বিকারভাবে ডেকে যাওয়া পাখির সুমধুর কন্ঠ… সব মিলিয়ে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। মুগ্ধতায় মন ভরে উঠার মত পরিবেশ হলেও তা স্পর্শ করতে পারলো না মেসবাহকে। মনের গহীনে ভেসে বেড়ানো মেয়েটির সঙ্গে কোনো দিক দিয়েই মিল নেই উল্লাসীর। নিজের সহধর্মিণীর বেশে কোনোভাবেই সে বসাতে পারছেনা তাকে। অস্থির লাগছে। বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত এক কষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদের রেলিঙে হাত রাখতেই পেছন থেকে বড় বোন অর্পার গলার স্বর শুনতে পেল মেসবাহ। চাপা গলায় সে কাওকে আদেশ দিয়ে যাচ্ছে, ‘সাঁজ যেনো কোনোভাবেই নষ্ট না হয় এবং মেসবাহ যা বলবে সবটাই চুপচাপ শুনে তা মেনে নেবে। ঠিকাছে?’ বোনের কথা শুনে আর বুঝে উঠতে বাকি রইলো না ঠিক কাকে আদেশ দিয়ে তার কাছে পাঠানো হচ্ছে। লম্বা কিছু দম ছেড়ে আকাশপানে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর পেছন ফিরলো মেসবাহ। তার সম্মুখে দাঁড়ানো উল্লাসীর আপাদমস্তক দেখে গম্ভীরমুখে বললো,
-“কে সাজিয়ে দিয়েছে?”
জবাবে ক্ষীণ গলায় উল্লাসী বললো,
-“অর্পা আপা।”
-“আর সাজবে না ওর কাছ থেকে।”
-“জ্বি, আচ্ছা।”
-“তোমাকে মোটেও ভালো দেখাচ্ছে না এই সাজে। তাছাড়া তোমার বয়সও নয় এখন সেজেগুজে স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবার।”
-“আচ্ছা..”
-“যাও.. গিয়ে শাড়ি বদলিয়ে অন্যকিছু পড়ে নাও। শাড়ি পড়ার সময় এখনো হয়নি তোমার। তাছাড়া ক্যারি করারও একটি ব্যাপার আছে। বুঝি না আমি! যে যা বলবে তাই তুমি করবে? একজন শাড়ি পড়তে বলবে আরেকজন সঙ সাজিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দেবে.. তাই তুমি মেনে নেবে? একবার আয়নায় তাকিয়ে দেখে নেবে না নিজেকে? এই হচ্ছে বাচ্চা মেয়েদের সমস্যা। নিজস্বতা বলতে এদের কিছুই থাকে না।”
ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না উল্লাসীর। সে নিজেকে দেখেছে আয়নায়। দেখতে তো বাজে দেখাচ্ছিল না তাকে। তারপরও কেনো ভালো লাগলো না উনার? ছোটমা বারবার বলে দিয়েছেন স্বামীর মন জুগিয়ে চলতে। কিন্তু ঠিক কী করলে, কীভাবে সাজলে স্বামীর মন জোগাতে সফল হবে সে?
(চলবে)