তোমার আঁচলের উঠোনে !! Part- 15 ( শেষ )
রিশাদকে বলা মাত্রই সে বিভাবরীর রুমে আসে। কিন্তু এসে দেখে বিভাবরী টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সে মুচকি হেসে তাকে পাঁজাকোলে করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। মেয়েটার মাঝে তো অসাধারণ কিছু নেই। আর দশটা মেয়ের মতোই সে। বোঁচা নাক, বাকা চোখ, চিকন ঠোঁট। তবুও কেন এত ভালো লাগে তার মেয়েটা কে? দেখলেই কেমন পাগল পাগল লাগে নিজেকে। ইচ্ছে করে, মেয়েটা কে জড়িয়ে ধরে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে। বিভাবরীর গায়ে কাথা টেনে দিতে গিয়ে তার একটা মনে একটা ভয়ঙ্কর অভিলাষ চলে আসে। রিশাদ চোখ বন্ধ করে কয়েকবার ডোক গিলে। দীর্ঘ শ্বাস টেনে তার মুখটা ধীরে ধীরে বিভাবরীর দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ার আগেই বিভাবরীর ঘুমের মধ্যেই হাঁচি দেয়। রিশাদের মুখের উপর হাঁচি দেওয়ায় সে তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে মুখ সরিয়ে নেয়। বিভাবরীর গায়ের উড়না দিয়ে নিজের মুখ পরিষ্কার করে। সে আর এক মুহুর্তও এখানে থাকতে চায় না। এখানে থাকলে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটে যাবে।
রিশাদের ধুপধাপ চলে যাওয়ার পায়ের শব্দে বিভাবরী উঠে বসে। বাবাকে ফোন দেওয়া দরকার তার। তিনি বলেছিলেন, কাল সকালে আসবেন। এটা নিশ্চিত হওয়া দরকার। সে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হওয়ার জন্য। আজ সে ঘুমুবে না। সারারাত জেগে থাকবে। তাকে তার জীবনের সব চেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আজ। ঘুমুলে চলবে না তাকে….
——————————————–
রিশাদের মা বিভাবরীর মাথায় হাত রেখে বিষণ্ণ সুরে বললেন,
— তুমি চলে যাচ্ছো! রিশু তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে কি বলবো আমি? কিছুক্ষণ পর যাওয়া যায় না?
বিভাবরী হেসে উত্তর দেয়,
— আমি উনাকে সব জানিয়েছি। আপনি চিন্তা করবেন না, আন্টি। আসছি আমি!
বিভাবরী গাড়িতে বসে ভাবছে, রিশাদ ঘুম থেকে উঠলে কি করতে পারে। যখন বিছানার কাছে চিরকুট টা পড়ে বুঝতে পারবে বিভাবরী চলে এসেছে, তখন সে কি করবে? বাবাকে বলতে পারে, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি, বাবা। পুলিশ স্টেশনে যাওয়া লাগতে পারে আমার।
রিশাদের যা রাগ! সে এটাই করতে পারে। এবং ভবিষ্যতেও এটাই ঘটলো।
বিভাবরী চট্টগ্রামে গিয়ে বাড়ি না ফিরে ধ্রুবর অফিসে যায়। সরাসরি ধ্রুবকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— আমি শেষবারের মতো আপনার কাছে এসেছি। আপনি কি আমায় ফিরিয়ে নিবেন?
ধ্রুব নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে। সে চায় না তার জন্য বিভাবরী সাফার করুক। বিভাবরী কে কঠিন একটা কথা শুনিয়ে দিতে হবে তাকে। তার জন্য বিভাবরী কষ্টে থাকবে সে এটা কখনোই চায় না। কখনোই না। সে চোয়াল শক্ত করে বিভাবরীকে বলে,
— আমাকে করুণা করতে এসেছো? ধ্রুব কে করুণা?? তুমি কি ভেবেছো, ধ্রুব তোমার করুণার জন্য বসে আছে??
— ধ্রুব..
— গেট লস্ট!
— তুমি আমায় ভুল বুঝছো, ধ্রুব। দেখো..
ধ্রুব তাকে থামিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে,
— কি বললাম, শুনতে পাওনি? জাস্ট গেট লস্ট!
বিভাবরী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে দেখে সে অন্য দিকে মুখ ফিরে আছে। সে একপ্রকার ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে আসে ধ্রুবর কেবিন থেকে। একবারের জন্যও পেছন তাকায় নি। পেছনে তাকালে দেখতে পেত, ছেলেটা কত কষ্টে তার কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে।
বিভাবরী চলে গেলে ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সে না হয় বিভাবরীর (সবার) কাছে খারাপই থাকলো। তার তো অধিকার নেই এই বোকা মেয়ে টাকে দুঃখ দেওয়ার। সারা জীবনের জন্য তাকে কষ্টে রাখার…
সেদিনের পর ধ্রুবর সাথে বিভাবরীর যোগাযোগ নেই। না ধ্রুব জানে বিভাবরী কি করছে। না বিভাবরী জানে ধ্রুব কোথায় আছে, কি করছে। ধ্রুব চায়ও না বিভাবরীর সাথে তার কখনো দেখা হোক। কিন্তু মানুষ না চইতেও অনেক কিছু পেয়ে যায়। অনেক গুলো বছর কেটে যাওয়ার পর সে ঠিকই দেখেছিল বিভাবরী কে। শুধু বিভাবরী কেই না, তার সাথে আরো দু’জন মানুষকে।
ধ্রুব দেশের বিখ্যাত বিজনেস আইকন হিসেবে তাকে একটা কনফারেন্সে দাওয়াত দেওয়া হয়। যেখানে দেশের খ্যাতিসম্পন্ন আরো অনেকেই যায়। ধ্রুব বেশ সেজেগুজে সেখানে উপস্থিত হয়। কিন্তু একজোড়া দম্পতিকে দেখে সে থাকতে পারেনি বেশিক্ষণ। সে এমন একটা মেয়েকে দেখেছিল যে কিনা শাড়ি সামলাতে পাড়তো না। হোঁচট খেয়ে পড়ে যেত, নয়তো কুঁচি খুলে যেত। কিন্তু এখন সে ঠিকই শাড়ি সামলাতে পারছে। পাশাপাশি একটা তিন বা চার বছরের বাচ্চা মেয়েকেও সামলাচ্ছে। সেদিনের বোকা মেয়েটাকে আজ পরিপূর্ণ নারী লাগছে। ভালোই হলো। সে তো পারতো না মেয়েটা কে এমন খুশি রাখতে! থাকুক না সে তার মতো…
মেয়েটার সামনে দাঁড়ানোর কোনো অর্থ নেই। তার ক্ষমতাও নেই দাঁড়ানোর। ধ্রুব চলে আসে সেখান থেকে।
গাড়িতে বসে রাতের শহর দেখছে ধ্রুব। তার ভালো লাগে না এসব দেখতে। হু হু করে উঠে ভেতরটা। রাতে ঘুমুতে গেলে ঘুম ধরা দেয় না চোখে। ধরা দেয় কিছু স্মৃতি, যেগুলো সে খুব করে ভুলে যেতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। তখন সে আনমনে বলে,
— বিভাবরী, তুমি জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলো হয়ে যেতে পারো না? যে আলোর ছোঁয়ায় আমি ঘুমুতে পারতাম..!!
আচ্ছা, বিভাবরী! তোমার কি কখনো আমার কথা মনে পড়ে? কোনো ঝুম বৃষ্টির দিনে কিংবা কোনো পূর্ণিমার রাতে? তখন কি তুমি আমার জন্য অশ্রু ঝরাও নাকি তোমার প্রিয়তমেষুর কাঁধে মাথা রেখে জ্যোৎস্না বিলাস করো?? তুমি কি আমায় ভুলে গেছো, বিভাবরী? আমি কেন এখনো ভুলতে পারছি না?
একটা কথা বলায় হয় নি তোমায়, বিভাবরী। সেদিন বেগুনি শাড়িতে তোমায় অপূর্ব লাগছিল। সেদিন তোমায় না দেখলে জানতেই পারতাম না, পৃথিবীতে শুধু নীল বা লাল পরী না, বেগুনি পরীও হয়। বিভাবরী, তুমি কি সত্যিই শাড়ি সামলাতে শিখে গেছো? তোমার আঁচলের উঠোনে তোমার প্রিয়জন কি লুটোপুটি খায়? তোমার চুলে মুখ লুকিয়ে সে কি তোমায় এলোকেশী বলে? খুব জানতে ইচ্ছে করে, তুমি ভালো আছো তো, বিভাবরী??
আমি হয়তো ভালো আছি। কিংবা নেই…
কিন্তু তোমার কথা মনে হলে, এখনো চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। চিনচিন করে বুকের বা পাশটায়। তখন নিজেকে ছন্নছাড়া লাগে। আমার জীবনের সব ছন্দ কোথায় হারিয়ে গেল, বলো তো?
সমাপ্ত