তোমার আঁচলের উঠোনে !! Part- 12
রুশার এভাবে অট্টহাসি টা মেনে নিতে পারেনি বিভাবরী। এই বাড়ির কাউকেই সে এখন অবদি বুঝতে পারলো না। খানিকটা আতংকিত হয়েই সে রুশাকে জিজ্ঞেস করে,
— তুমি এভাবে হাসছো কেন? তোমার ভাই জেলে। এটা তো নিশ্চয়ই খুশির খবর না?
রুশা কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে উত্তর দেয়,
— হাসির খবর না, তবুও আমার হাসি পাচ্ছে। কি করি বলো তো?
বিভাবরী হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। রুশা মেয়েটা তো ঠিক ছিল। সহজ-সরল মেয়ে, কত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতো! ভাইয়ের শোকে পাগল হয়ে যায় নি তো? বিভাবরীর হুট করে খারাপ লাগা শুরু করলো। সে কি ভুল কিছু করলো?
রুশা কিছুটা সময় পর পুরোপুরি স্বাভাবিক ভাবে বললো,
— আসলে কি জানো বিভু, এই ছেলেটা দু’দিন পর পর পুলিশ স্টেশনে যায়। বাবা তখন মাথায় আইস প্যাক আর মা এখানে এভাবে বসে নাক টানে। বাবাও জানে এটা তেমন কিছু না, মাও জানে। তবুও তারা দায়িত্ব নিয়ে এ কাজ গুলো করে। তাই আমার হাসি পাচ্ছিল।
বিভাবরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এ বাড়ির মানুষগুলো আসলেই রোবোটিক। বিভাবরী উপরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তখনই গাড়ির শব্দ হয়। রুশা ফের হেসে বললো,
— এই যে, দেখো চলে এসেছে রাজপুত্তুর।
রিশাদকে দেখে তার বাবা উঠে দাঁড়ান। বিভাবরী নিশ্চিত উনি আজ রিশাদকে থাপড়িয়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দেবে। উনার গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখ দেখে এটাই মনে হচ্ছে তার। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে উনি বললেন,
— কি কান্ড ঘটিয়ে জেলে গিয়েছো??
রিশাদের ভাব দেখে মনে হলো সে শুনতেই পায়নি তার বাবা কি বলেছে তাকে। সে পাত্তা না দিয়ে তার মাকে বললো,
— মা, কড়া লিকারে এক কাপ চা করে দাও তো।
কথাটা শুনে সে এক মুহুর্তও অপেক্ষা করেনি। ধুপধাপ পা ফেলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
বিভাবরীর পাশ ঘেঁষে যাওয়ার সময় তার মনটা ধুকপুক করছিল। এই বুঝি ছেলেটা তাকে চ্যাংদোলা করে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসে। কিন্তু রিশাদ তার দিকে তাকায়ও নি। নিজের মতো চলে গেছে সে। এটা কি কঠিন কোনো ঝড়ের পূর্বাবাস?
রিশাদ চলে গেলে তার মা কিচেনের দিকে পা দেয়। পেছন থেকে উনার হাসবেন্ড বলে উঠে,
— এই করেই তো ছেলেকে মাথায় তুলেছো। যখন হাতের বাইরে চলে যাবে, তখন বুঝবে ঠ্যালা।
নাজনীন সুলতানা বিড়বিড় করে বললেন,
— বাইরে যাক। তখন লাল টুকটুকে একটা বউ এসে সব ঠিক করে দেবে।
বিভাবরী ঘুমুতে যাওয়ার আগে ঘরের ছিটকিনি টা বেশ ভালো করেই আটকায়। তার মনে হচ্ছে, রিশাদ মাঝরাতে আসবে। এসে তার মুন্ডুটা ঘাড় থেকে আলাদা করে দিয়ে যাবে। কিংবা সিলিং ফ্যানের সাথে তাকে ঝুলিয়েও দিতে পারে..
কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। বিভাবরীর রাত বেশ ভালো ভাবেই কাটলো। কিন্তু তার
ঘুম ভালো হয়নি। সকালে ফ্রেশ হয়ে চুপিচুপি ভার্সিটি যায় সে। ভার্সিটি গিয়ে মনে হলো, সে মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে এখানে এসে। এটাতো রিশাদেরই জায়গা। পড়াশোনার নাম করে গুন্ডামি তো এখানেই হয়। কিন্তু এখানেও তেমন কিছু হয়নি। শান্তি বজায় রেখেই সব ক্লাস শেষ হলো। তবে বিভাবরী মনোযোগ দিতে পারে নি একটা ক্লাসেও।
ভার্সিটি শেষে রিক্সা না পেয়ে সে হাঁটা শুরু করে দেয়। বলা তো যায় না, কখন গুন্ডাটা এসে তাকে বেদম মারতে শুরু করে!
কিছুটা পথ যেতেই তার পাশ ঘেঁষে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে হর্ণ দেয়। কাঁচ খুলে ড্রাইভার সিটে বসে থাকা মানুষটা বলে,
— গাড়িতে উঠে এসো।
বিভাবরী লম্বা করে একটা ঢোক গিলে। আজ তার শেষ দিন, সে এটা জেনে ফেলেছে। মরার আগে তার একটাই ইচ্ছা। শেষবারের মতো তার বাবাকে একবার দেখতে চায় সে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে যায়।
— জাহান্নামে নিয়ে যাচ্ছি না। বাড়িতেই যাচ্ছি।
বিভাবরী কাঁদকাঁদ চেহারা বানিয়ে গাড়িতে বসে। হাত কাঁপার কারণে সিট বেল্ট টাও লাগাতে পারে নি। রিশাদকে লাগিয়ে দিতে হয়েছে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করছে তার। নিচের দিকে তাকিয়ে হাতের আঙুল মুচড়ে যাচ্ছে সমানে।
— তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছো? কেউ আমাকে ভয় পেলে আমার খুব ভালো লাগে। থ্যাংক্স!
বিভাবরী কথা টা শুনে বেশ চমকে উঠে। সে খেয়াল করেছে, রিশাদ তাকে কিছু বলার আগে “কেশবতী” সম্বোধন করে বলে। কিন্তু আজ বলেনি। সে আরও বেশি চমকেছে এটা ভাবার পর। সে কি রিশাদের কেশবতী না বলার কারণে শূণ্যতা অনুভব করছে?
রিশাদ বিভাবরীর দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা কুঁকড়ে আছে। জড়সড় হয়ে বসে আছে। নিঃশ্বাস টাও বেশ সতর্কতার সাথে ফেলছে। সে ঠোঁট বাকা করে রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে পানির বোতল এগিয়ে দেয় বিভাবরীর দিকে। বিভাবরী ডগডগ করে এক বোতল পানি শেষ করে দেয়। তারপরও মনে হচ্ছে, আরো পানি খাওয়া দরকার তার। রিশাদ বোতলটা রেখে বিভাবরীর দিকে তাকায়। বিভাবরী আগের মতোই ভয়ার্ত চেহারা বানিয়ে বসে আছে। রিশাদ বিরক্তিকর একটা শব্দ করে বললো,
— বি নরমাল, বিভাবরী। এভাবে কাঁচুমাচু মুখ করে বসে আছো কেন? মনে হচ্ছে, তোমার পঞ্চাশোর্ধ বয়সের কোনো ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে। আর তুমি তার জন্য বাসর ঘরে ভোঁতা মুখ করে অপেক্ষা করছো।
বিভাবরী মুখ কুঁচকে ফেলে। রিশাদের দিকে তাকিয়ে দেখে, সে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বসে আছে। ঘাড় কাত করে চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে শার্টের কলারে আটকে দেয়। চোখের ছোট ছোট মনি তারার মতো ঝকঝক করছে। হালকা গোলাপি আভার ঠোঁট দেখে বিভাবরীর তাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে,
— আচ্ছা, আপনার ঠোঁট গুলো কি মেয়েদের থেকে ধার করে আনা?
ফর্সা ছেলেদের এমন ঠোঁট দেখলে মেয়ে মেয়ে ভাব আসে। রিশাদের গায়ের রং উজ্জল শ্যাম বর্ণের। কিন্তু তাকে একটুও খারাপ লাগছে না। বরং, মনে হচ্ছে কোনো উপন্যাস থেকে উঠে আসা নায়ক। এমন অসাধারণ একটা ছেলে তাকে ভালোবাসে। ভাবতেই তার ভিষণ লজ্জা লাগছে।
বিভাবরী একমনে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে যাচ্ছে। হুট করেই সে আৎকে উঠে। এসব কি ভাবছে সে? ছিঃ! কি ভয়ঙ্কর কথা!
— আমার সর্বনাশের জন্য তোমার এমন দৃষ্টিই কি যথেষ্ট নয়, কেশবতী?
রিশাদের কথায় বিভাবরী বেশ অপ্রস্তুত হয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। এমন লাগাম ছাড়া কথায় তার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। ইশশ..! কি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি!!
রিশাদ কিছুক্ষণ বিভাবরীর দিকে তাকিয়ে থেকে লম্বা শ্বাস টেনে বললো,
— আমার বাবা-মা আমাকে অস্বাভাবিক আদর-যত্নে বড় করেছেন। কিছু চেয়েছি, কিন্তু পাইনি এমনটা কখনোই হয়নি। তাদের উপরটা দেখতে যতটা কঠিন, ভেতরটা ততটাই সহজ-সরল। কিন্তু আমাকে যতটা চঞ্চল দেখায়, আমি ততটাই শক্ত, কঠিন। আই নিড ইউ, কেশবতী! তুমি চাও বা চাও, তোমায় তাদের সাথে, ইন ফ্যাক্ট আমার সাথেই আমার থাকতে হবে। আমার রাগ সম্পর্কে তোমার আইডিয়া নেই। কারণ, আমি বদরাগী না। কিন্তু রেগে গেলে নিয়ন্ত্রণ হারাতে সময় লাগে না। তাই এমন কিছু করো না যাতে, আমায় নিয়ন্ত্রণ হারাতে হয়।
কিছুক্ষণ থেমে সানগ্লাস চোখে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। পুনরায় মুচকি হেসে বলে,
— আ’ম গেটিং অলরেডি ক্রেজি এবাউট ইউ, কেশবতী!
সিরিয়াস কথা বার্তায় এমন কথা শুনে বিভাবরী চমকে উঠে। রিশাদ গাড়ি টান দিয়ে বলে,
— এমন বাকা চোখে তাকালে শুধু পাগল না, পৃথিবী ছাড়তে দেরি হবে না গো কেশবতী।
বিভাবরী জানলার কাঁচ গলে বাইরে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয়। সে নিজেও জানে না এই হাসিটার কারণ। বাকি রাস্তা রিশাদ আর কোনো কথা বলে নি। তবে বার বার আড়চোখে দেখে গেছে তাকে। মাঝে মাঝে চোখে চোখ পড়তেই বিভাবরী লজ্জায় বাইরে চোখ সরিয়ে নেয়। সারাটা রাস্তা তার কাঁপা-কাঁপির মধ্যে কেটেছে। ধুকপুক শব্দে তার অবস্থা কাহিল…
চলবে…