তোমারই আছি আমি

তোমারই আছি আমি !! Part- 21

ছবিগুলো দেখার পর আকাশের মাথা কাজ করছিল না। যা দেখল তাতে আকাশের ভীষণ কষ্ট পাওয়ার কথা অথচ তার কোনো কষ্ট-ই হচ্ছিল না। অল্প কয়েক মুহুর্তের জন‍্য যেন সে সব ধরনের অনুভূতির বাহিরে চলে গিয়েছিল। অতিরিক্ত কষ্ট মানুষের কষ্ট পাওয়ার অনুভূতিটাই মেরে দেয়। আকাশের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছিল। তবে আকাশের মন কিছুতেই চোখে দেখা ছবিগুলোকে সায় দিচ্ছিল না; কিছুতেই না। তার পুতুল ফুলের মতো পবিত্র, জলের মতো স্বচ্ছ। আকাশ তো জানে তার পুতুলের ছোট্ট হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে সে আকাশকেই রেখেছে। তার চোখের সামনৈ যা দেখাচ্ছে সব ভুল, সব মিথ্যা। চোখের সামনে যাই দেখাক কিচ্ছু বিশ্বাস করবে না সে এমন অদ্ভুত পাগলামি চেপে বসেছিল আকাশের মধ্যে।
নিবিড়ের ডায়েরীটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের মনে হলো সবটা জানতে ডায়েরীটা তার দরকার, খুব দরকার। এখান থেকে সবটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে তার চোখের সামনে। এমন বিশ্বাসেই আকাশ ডায়েরি পড়তে লাগল।
নিবিড়ের ডায়েরি শুরু হয়েছে ২১-০৩-২০১২ থেকে। প্রথমেই লেখা,,
২১-০৩-২০১২
আমি জানি না ডায়েরি কিভাবে লিখে। কিন্তু অনেকটা বাধ্য হয়েই আমি ডায়েরী লিখতে বসেছি। কারণ আজ আমি এমন একটা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি যা আমি কাউকে বলতে পারব না। কোনদিন কাউকে বলতে পারব না এবং বলব-ও না। কারণ আজ যা ঘটল তা আমি নিজেই ভুলে যেতে চাই।
সন্ধ‍্যাবেলা অদ্বিতী, আমি, মাইশা ক‍্যারাম খেলছিলাম। হঠাৎ করেই সারা আসল। সারাকে দেখে অবাক লাগলো। কারণ আকাশভাইয়া বাসায় না থাকলে সারা তেমন আসে না। সারা তো জানে আকাশভাইয়া এখন প্রাইভেটে তাহলে কেন আসল? যদিও অদ্বিতী ওর অনেক ভালো বান্ধবী। সারা অদ্বিতীর সঙ্গে অনেক গল্প করল। অদ্বিতীর হয়ে ক‍্যারাম খেলে দিল। খেলার মধ্যে সারা আর আমি পাশাপাশি ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম সারা আমার দিকে বেশি বেশি ঘেঁষে আসছে। আমি যতই দূরে যাই ততই ও আরও ঘেঁষে দাঁড়ায়। আমার গায়ে গা লাগাতে থাকে। পা দিয়ে কয়েকবার পায়ে পাড়া দেয়। আমি রেগে তাকালাম। সাথে সাথেই সারা অদ্ভুতভাবে হেসে চোখ টিপ দেয়। আমার এতো লজ্জা লাগছিল কি বলব। সারাকে আমি পছন্দ করি। সত্যিই খুব ভালো লাগে ওকে। কিন্তু আমি তো জানি ও আকাশভাইয়ার।
হঠাৎ ক‍্যারাম খেলার মাঝখানে সারা আমার হাতটা কোলের মধ্যে নিয়ে একটা কাগজ গুজে দেয়।
আমি কারো সামনে কিচ্ছু বললাম না। খেলা শেষে অদ্বিতী আর মাইশা চলে গেলে আমি কাগজটা খুলি।
“নিবিড়ভাইয়া আমি ছাদে যাচ্ছি। প্লিজ তুমি এসো। অনেক দরকার। পড়া বুঝব। প্লিজ এসো। যদি না আসো আমি অনেক কষ্ট পাব।”
সারার চিঠি পড়ে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সারাকে সব পড়াশোনা আকাশভাইয়াই করায়। তাছাড়া সারা নিজেই অনেক ভালো ছাত্রী আমার চেয়ে। তাহলে পড়ার জন্য আমাকে কেন ডাকল? কিন্তু সারা ডাকছে বলে আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠল। আমি তো সারাকে সত্যিই খুব পছন্দ করি।
ছাদে উঠে দেখি পুরো ছাদ ফাঁকা। সারা কোথাও নেই। আমার সঙ্গে মজা করল ও?
এমন সময় পেছন থেকে কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরল।।আমি চমকে পিছনে ফিরে দেখলাম সারা। সারা আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে।
: সারা ছাড়্ আমাকে। কি করছিস, ছাড়্। ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম।
: এই সবসময় ছাড়্ ছাড়্ করো কেন? আমি ধরলে কি তুমি অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
: সারা তুই বড় হয়েছিস না? বুঝিস না কিছু? এগুলো দেখলে মানুষ খারাপ বলবে।
: বলুক। আমার কি?
বলেই সারা আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।
: কি পড়া বুঝাতে হবে বল্। আমি বেশিসময় থাকতে পারব না। আমার পড়তে বসতে হবে।
সারা বলল, নিবিড়ভাইয়া আসলে আমি মিথ্যা বলেছি। আমি পড়ার জন্য ডাকিনি তোমায়। তোমাকে একটা কথা বলার আছে।
বলেই সারা কেমন একটা লজ্জা পেতে লাগল। মাথা নিচু করে ফেলল। মুখ নিচের দিকে দিয়ে হাসছে। আঙ্গুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওড়না পেচাচ্ছে‌।
: কি বলতে চাস তাড়াতাড়ি বল্। আমার সময় নেই।
সারা: নিবিড়ভাইয়া তোমাকে একটা কথা বলব। অনেকদিন ধরেই বলতে চাই কিন্তু পারছি না।
: আচ্ছা এখন বল্। তাড়াতাড়ি বলবি।
: বললে তুমি রাগ করবে না তো?
: দ‍্যাখ সারা আমি সিরিয়াস। আমার কিন্ত তোর ওপরে প্রচুর রাগ উঠছে। যদি কিছু বলতে চাস বল্ নাহলে আমি চলে গেলাম।
আমি চলে যেতে নিলেই সারা আমার হাত টান দিয়ে ওর দিকে ঘুরায়। তারপর হঠাৎ করেই আমার সামনে মাটিতে বসে ওড়নার নিচ থেকে একটা লাল গোলাপ বের করে বলে আই লাভ ইউ নিবিড়ভাইয়া। তোমাকে খুব ভালবাসি।
আমি কি বলব সারাকে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না
: সারা এগুলো কি বলছিস? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
: হ‍্যা মাথা তো খারাপ হয়েছেই। তোমার জন্য খারাপ হয়েছে আমার মাথা। এই বাসায় যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। আমার সারাক্ষণ শুধু তোমাকে দেখতে মন চাইত। তাই তো প্রতিদিন এই বাসায় আসতাম। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম তোমায়। বুঝতে পারলাম তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। কিন্তু আকাশভাইয়ার ভয়ে বলতে পারি নি।
কিন্তু আর পারছি না। তোমাকে মনের কথা না বললে আমি যেন দম ফেটেই মরে যাব। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তোমাকে ছাড়া।
: ছিঃ সারা। কি বলিস এইসব? আকাশভাইয়া কত ভালবাসে তোকে।
: উনি বাসে আমি তো আর বাসি না। তোমাকে দেখে আমার কেমন যেন হয়। বুকের ভেতরটা ধ্বুকপুক করে তুমি যখন সামনে দিয়ে যাও মনে হয় আমি শ্বাস আটকে মরেই যাব। তোমাকে দেখলেই খুব খুব লজ্জা করে। আকাশভাইয়াকে দেখে কখনো আমার এরকম হয় নি। উনাকে তো আমি সায়ানভাইয়ার মতোই মনে করি। তাছাড়া উনি আমাকে সবসময় সবকিছুর মধ্যে বাধা দেয়,,আমাকে কোথাও যেতে দেয় না,,আমি একটু সাজুগুজু করে বাইরে গেলে কেমন মারে আমাকে,,,ছেলেদের সঙ্গে কোনো কথাই বলতে দেয় না,,,আমার বান্ধবীরা কত ছেলেদের থেকে প্রপোজ পায়,,,আর আমি? ওনার কারনে ভয়ে কেউ আমার সঙ্গে কথাই বলে না। ওনার ওপর খুব রাগ ওঠে। আমি কোথায় যাব কি করব কার সঙ্গে মিশব এইসব নিয়ে ওনার মাথাব্যথা কিসের জন্য? আমার মা-বাবা আছে, ভাই আছে তারা কিছু বলে না- উনি আমাকে সবকিছুতে বাধা দেওয়ার কে? আসলে ওনাকে আমার খুব ভয় করে। তাই এই কথাগুলো বলতে পারি না। ওনার ভয়েই তো তোমাকে এতদিন মনের কথা বলতে পারি নি। যদি তোমার ক্ষতি করতে চায়! আমার খুব ভয় করত তাই।
কথাগুলো শুনে আমি মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না। সারাকে ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিয়ে চলে আসলাম।
হ‍্যা, সারাকে আমি ভালবাসি। সারা আমার হৃৎপিন্ড। কিন্তু আমার আকাশভাইয়া চাইলে আমি হৃৎপিন্ড-ও দিয়ে দিতে পারি। আমার জীবনে আকাশভাইয়ার চেয়ে বড় কেউ না। তার স্থান সবার উপরে। আমি কিছুতেই পারব না নিজের সুখের জন্য তাকে একবিন্দু-ও কষ্ট দিতে। সারা কি বোঝে না আকাশভাইয়া ওকে কি পরিমাণ ভালবাসে? আকাশভাইয়ার মতো ভালোবাসা ও কার কাছে পাবে? না, আমাকে সারার
থেকে দূরে সরে থাকতে হবে। সারা অনেক ছোট; ওর মনটাও বাচ্চাদের মতো অবুঝ। আবেগে পড়ে কথাগুলো বলছে।
২৪-০২-২০১২
আমি আর পারছি না। সারার পাগলামি দিন দিন বেড়েই চলেছে। দুপুরবেলা ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ করে খেয়াল করি বুকের ওপর কিছু একটার অস্তিত্ব। ঘুম ভাঙতেই পুরো শরীরে ভারী কিছু অনুভব করলাম। তাকিয়ে দেখি সারা আমার ওপর শুয়ে গেন্জি তুলে বুকের ভেতরে ঢুকে রয়েছে।
: সারা সর্ কি হচ্ছে এইসব? প্লিজ।
: উহু,,,সরব না। আমার বান্ধবীরা সবাই ওদের বয়ফ্রেন্ডের বুকে মাথা দেয়। শুধু আমিই পারি না। আমি কেন বাদ থাকব,,হুম?
: সারা,,শুরু করেছিস টা কি?
: ভালোবাসা শুরু করেছি।
বলেই সারা আমাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল।
: সারা ছাড়্। তুই যদি আমাকে না ছাড়িস আমি সব আকাশভাইয়াকে বলে দেব। তুই জানিস আকাশভাইয়া এই কথাগুলো শুনলে এক্ষুনি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।
: না। আমি আর কখনো তোমার বুকে শোবনা। আমি তো ভুলেই গেছিলাম লোকটার কথা।
বলেই সারা ধড়মড়িয়ে আমার ওপর থেকে সরে গেল।
বলল, এই লোকটার জন্য আমার কোথাও শান্তি নেই। ভালবাসার মানুষটার বুকে থেকেও শান্তি পাই না। সেইখানেও ওর ভয়। ধুর্।
সারা রাগ করে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছি। মেয়েটার কি আকাশভাইয়ার কথা একবারো মনে হচ্ছে না? ও কি বোঝে না আকাশভাইয়া ওকে কতটা ভালবাসে।
দিনে দিনে সারার অত‍্যাচার বাড়তে লাগল। আমাকে রং নাম্বার থেকে ফোন করা, ফোন কেটে দিলে কান্নাকাটি করা, আকাশভাইয়া বাসায় না থাকলে আমার রুমে এসে জড়িয়ে ধরা, মাঝে মাঝে জোর করে যখন ওর কোমল ঠোঁটজোড়া গালে মিলিয়ে দিত আমি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারতাম না। অনেক কষ্টে শক্ত রাখতাম নিজের মনকে। আমাকে আকাশভাইয়ার
কথা ভাবতে হবে। এই মেয়েটা আকাশভাইয়ার জীবন-মরন পুরো দুনিয়া। এটা সারা না বুঝুক আমি তো বুঝি।
এভাবেই চলতে লাগল দিন। অবশেষে সারাকে নিজের থেকে দূরে রাখতে আমি একটা কাজ করতে বাধ্য হলাম।
চলবে