তোমারই আছি আমি

তোমারই আছি আমি !! Part- 18

কবুল বলার সময় মেধা কিছুতেই মুখ খুলছিল না বরং তার কাঁপাকাপির পরিমাণ উত্তরোত্তর হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যেন একরাশ ভয় আতঙ্ক তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। মেধার এধরনের আচরণ সবাইকে বেশ অবাক করে তুলল।
“মেধা,,বল্ কবুল। কবুল বলা ছাড়া বিয়ে হয় না।”
“ঐ মেধা তোর হয়েছে টা কি একটু বলবি। পার্লার থেকে সেজেগুজে আসার পর থেকে তোকে দেখছি একদম চুপচাপ; শব্দ-ই বের করছিস না মুখ দিয়ে। আর মাথায় এরকম একটা কি ঝাপটা দিয়ে রেখেছিস- তুই যে মানুষ ওড়নাই পড়তে চাস না সে নিজের বিয়ের দিন মুখে পর্দা লাগিয়ে বসে আছিস- দিস ইজ নট ফেয়ার মেধা। আর এইরকম লজ্জা কেন পাচ্ছিস? কম অন মেধা,,,বিয়ে হচ্ছে বলে লজ্জা পাওয়ার মতো স্টুপিডিটিতে তোকে মানায় না। ইউ আর নট লাইক দ‍্যাট।”
“এই মেধার কি হয়েছে বল্ তো। আসলেও এটা মেধা তো? নাকি আমাদের আকাশভাই অন‍্য কাউকে বিয়ে করার জন্য তুলে এনেছে?”
এইসব কথায় আশেপাশের সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলেও ঘোমটার ভেতরে থাকা বৌ ভয়ে কুকড়ে বারংবার কাঁপতে লাগল।
“জাস্ট সাট আপ।” উপস্থিত সবার দিকে ভয়ানক রাগী দৃষ্টিতে তাকায় আকাশ। “ওকে আর কেউ কোনো কথা বলবে না। বিয়ে দেখতে এসেছ,,,চুপচাপ বিয়ে দেখো। ওকে নিয়ে ভাবার দরকার নেই। সেটা আমার কাজ।”
বলেই নিজের বসার জায়গা ছেড়ে মেধার চেয়ারের কাছে গেল আকাশ। মেধার সামনে হাটু মুড়ে বসে ওর কোলের ওপর রাখা হাতদুটোর ওপর নিজের দুই হাত রাখল।
“বলো,,কবুল। কি হলো বলো?” ভীষণ মায়াজড়ানো কন্ঠে মেধাকে বলল আকাশ।
মেধার দিক থেকে কোন শব্দ নেই। না, শব্দ নেই বললে ভুল। শব্দ আছে,,প্রচণ্ড জোরে জোরে শ্বাস টানার শব্দ।
আকাশ মেধার হাতদুটো নিজের মুঠোর ভেতর নিল। তাতে মেধা যেন বেশ ভালোভাবেই নড়ে উঠল। যেন আকাশের স্পর্শ তাকে এক ভয়াবহ আতঙ্কের মুখোমুখি করে তুলছে।
আকাশ মেধার হাতদুটোকে মুঠোয় আকড়ে ধরে খুব শান্ত ধীরকন্ঠে বলল, বলো,,কবুল বলে দাও। একবার এই শব্দটা উচ্চারণ করলে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাব। পৃথিবীর কোন শক্তির সাধ‍্য থাকবে না আমাদের বিচ্ছিন্ন করার। তুমি চাও না আমরা সারাজীবন এক থাকি,,বলো চাও না? আমি কিন্তু আমার জীবনের আর একটি মুহুর্ত তুমিহীন কাটাব না। বুঝতে পারছ কি বলছি আমি।
ঘোমটার আড়াল থেকে মেধা একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। পরস্পর পরস্পরের চোখের দিকে।
আকাশ মেধার মাথায় হাত রাখে,,,কেন ভয় পাচ্ছ? আমি আছি তো। কথা দিচ্ছি তোমার স্বামী তোমার অধিকার তোমার হাতে তুলেই ছাড়বে। একবিন্দু অসম্মান হতে দেবে না তোমার ।কোনো ভয় নেই,,,হুম।
মেধাকে কাছে টেনে সবার সামনেই ওর ঘোমটা আবৃত কপালে চুমু খায়।
তারপর আবার মেধার পায়ের কাছে বসে ওর হাতে হাত রেখে বলে,এবার তো অন্তত বলো। তোমাকে আমার করে পাওয়ার পূর্নতা দাও আমায়।
“ক-ক-বুল”
কোনমতে কাঁপতে কাঁপতে বলে মেধা। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় মেধার মাথার ওড়না সরে যায়। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে স্নিগ্ধ-মায়াবী একটি বৌ-বৌ মুখ। কিন্তু কথা হলো মুখটা মেধার নয়।
ঘোমটা সরানোর পর নতুন বৌ দেখে শ্বাসরোধ হওয়ার দশা সকলের। অল্পকয়েক মুহুর্তেই বিয়েবাড়িতে ছড়িয়ে গেল বৌ বদলে গেছে, বৌ বদলে গেছে। আকাশ বিয়ে করতে এসেছিল মেধাকে। বিয়ে মেধার বাড়িতেই হয়েছে কিন্তু মেধার সঙ্গে নয়। অন‍্য একটা মেয়ের সঙ্গে। কে এই মেয়ে? এই মেয়ের সঙ্গে যদি আকাশের বিয়ে হয়ে থাকে তাহলে মেধা এখন কোথায়? আকাশ কেন এই মেয়েকে বিয়ে করল? তাহলে কি মেধাকে বিয়ে করাটা শুধুই পরিকল্পনা আকাশের আসল উদ্দেশ্য ছিল এই মেয়েটা। এইসব নানান প্রশ্ন করে লোকজনেরা খান ও হক পরিবারের সবাইকে তটস্থ করে তুলছে। লজ্জায় অপমানে মান-সম্মান মাটিতে মিশে যাচ্ছে তাদের।
—————————————————————————–
জুয়েল সাহেব সায়ানকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছে দিতে যাচ্ছেন। আজ সায়ানের কানাডা যাওয়ার দিন। দুই ঘন্টা পর ফ্লাইট। ট‍্যাক্সির খোলা জানালায় চোখ রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সায়ান। তবে তার মনোযোগ বাইরে প্রাকৃতিক দৃশ‍্যের প্রতি নয় তার সম্পূর্ণ মনোযোগ তার মোবাইলের স্ক্রিনের প্রতি। ফারিহা একটাও কল করছে না! এইটা মেয়ে না পাথর!! ধুর্ কি ভেবেছিল আর কি হচ্ছে। ভেবেছিল সায়ান বিদেশে চলে যাচ্ছে এই খবর পাওয়ামাত্র ফারিহা বাংলা ফিল্মের হিরোইন হয়ে “না,এ হতে পারে না’ বলে বালিশে মুখ ডুবিয়ে ভ‍্যা শুরু করবে। তারপর সায়ান যখন শেষবারের মতো বিদায় নিতে যাবে তখন কেঁদেকেটে বলবে প্লিজ সায়ানভাই যাবেন না। সায়ানভাই আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না।” আসলে সায়ানের এই বিদেশ যাওয়া পুরোই নাটক। ফারিহাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য কাজটা করেছিল সে। তার বিদেশে কোন চাকরি-টাকরি হয় নি। কিন্তু ফারিহাকে শিক্ষা দিতে গিয়ে এই মুহূর্তে সে নিজেই মাইনকার চিপায় ঢুকে গেছে। মনে হচ্ছে বাবা তাকে সত্যি সত্যিই কানাডার প্লেনে উঠিয়ে দিবে। “ও ফারিহা,,সেইভ মি। জাস্ট একটা কল দাও। একটা কল,,,যাতে আমি সবাইকে বলতে পারি তুমি আমার জন্য এতোই কান্নাকাটি করছ কান্নাকাটি করে তুমি হার্ট অ্যাটাক করেছ তাই আমি কানাডা যেতে পারছি না। আমি কানাডা চলে গেলে তোমাকে রাস্তায় পাহারা কে দেবে,, হুম। এত কষ্ট করে পাহারা দিয়ে রেখেছি আমার তিন হালি বাচ্চার মা বানাব বলে– আমি চলে গেলে তোমাকে যদি কেউ নিয়ে যায়!! তাহলে আমার তিন হালি সন্তান যে মা-হারা হয়ে যাবে। না না আমার বাচ্চাদের মা’কে আমি কাউকে নিতে দিব না। আমি কানাডা যাব না,,যাব না,, কিছুতেই যাব না।”
এমন সময় সায়ানের ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সায়ান খুশিতে আট নয় আট দুগুনে ষোলখানা হয়ে গেল। ফারিহা কল করেছে।
: দ‍্যাখো তিন হালি’র মা তোমাকে কাঁদতে হবে না। আমি বিদেশ-টিদেশ কোথাও যাচ্ছি না। আরে আমি তো এটা মজা করেছি তোমার সাথে। যাতে তুমি বুঝতে পারো আমি তোমার লাইফের একটা ইমপরট‍্যান্ট পার্ট। তুমি হয়তো নিজেও বুঝতে পারো না কিন্তু আমি না থাকলে তুমি আমাকে ঠিকই মিস করো। আমি তো তোমাকে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম। ইউ ফিল ফর মি।
: ধুর্ ছাতা আপনি কি ফাউ পেঁচাল ছাড়া কিচ্ছু পারেন না? আজ পর্যন্ত কোনদিন দেখেছেন আমি দরকার ছাড়া আপনাকে ফোন করি? আপনার বিদেশ টিদেশ সব যে ভাউ আমি খুব ভালো জানি। আপনি এত সহজে আমার লাইফটা জ্বালানো অফ করবেন এইটা আমি আশা করি না। বাই দ‍্য ওয়ে আপনি যেখানে আছেন যে অবস্থায় আছেন প্লিজ ব‍্যাক করেন। প্লিজ সদর থানায় চলে আসেন। মিসিং ডায়েরী করা লাগবে। আমি আন্টিকে নিয়ে এসেছি।
: মিসিং ডায়েরী? কার নামে? আর তোমার সাথে আম্মু কেন?
: সায়ানভাই আমি এতো ডিটেইল আপনাকে বলার সিচুয়েশন এ নাই। বাট সারাকে পাওয়া যাচ্ছে না। প্লিজ আসেন। প্লিজ।
: ও,,বোনটার আমার বিয়ে হয়ে গেল। ভাই হয়েও বোনের বিয়ের দাওয়াত পাইলাম না,,,বিরাট একটা আফসোস।
: অ্যা??কি বলছেন আপনি এসব ? ধুর্ এইসব পাগল-ছাগল কে ফোন করাই অপরাধ। আপনার। কাছে ফোন করার চেয়ে ডাইনোসরের কাছে ফোন করা ভালো।
ফারিহা রাগে গজগজ করে ফোন কেটে দিল।
—————————————————————————-
হক এবং খান পরিবারের সবার এই মুহূর্তে স্থির দৃষ্টি সামনে দাঁড়ানো নববিবাহিত দম্পতি আকাশ ও সারা। কারণ আজ সব মানুষের সামনে তাদের অপমানের পেছনে এরাই দায়ী।
বেবিন: আমি জানতাম এই মেয়েটা আমার পরিবারের পিছন ছাড়বে না। টাকা দেখেছে না,,টাকা,,,যেমন বাপ তার তেমন মেয়ে। বাপটা যেমন আমার বোনকে তুলে নিয়ে বিয়ে করেছিল এই মেয়ে তেমনভাবে আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছে। ওদের সবগুলোকে আমার হাড়-মাংস চেনা। আমি সব বুঝি। সব এই মেয়ের বাপের চক্রান্ত। আমাদের পরিবারের জামাই হয়ে তো আমাদের সম্পত্তি গ্রাস করতে পারে নি তাই মেয়েকে ব‍্যবসায় নামিয়েছে। ছিঃ ঘিন্না করে আমার বোন এইরকম নষ্ট একটা মেয়ের জন্ম দিয়েছে।
আশরাফ: আমি এত কথা জানতে চাই না। আমি তোমাদের সবার নামে পুলিশ কেইস করব। আমার মেয়ে কোথায়? তোমরা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য আমার মেয়েটাকে কি করেছ? আমার মেধার ক্ষতি হলে আমি কাউকে ছাড়ব না।
শিল্পী: এই মেয়ে,,বলো মেধা কোথায়? আমার মেয়ে কোথায়? এই চুপ থাকবা না। আমরা তোমার মুখ দেখার জন্য এতগুলো প্রশ্ন করছি না। উত্তর দাও নাহলে চিনো না আমাদের আমরা কি কি করতে পারি। তোমার কারণে আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেছে। আমরা তোমার পুরো পরিবারকে শেষ করে দেব।
শিল্পী সারা’কে দুই হাতে ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে কথাগুলো বলে। আশেপাশের সবাই সারাকে ঘিরে ধরেছে। নানান আজেবাজে কথা বলছে সারাকে। শিল্পী হঠাৎ “ঠাস” করে সারার গালে থাপ্পড় মারলেন। সারা একদম নির্বাক। তার মধ্যে কোন অনুভূতি কাজ করছে না। জগতের নিষ্ঠুরতা দেখতে দেখতে স্তব্ধ। আর আজ যা হচ্ছে তা তো তার পাওনা। কারন আবেগের বশে কিছুক্ষণ আগেই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা সে করেছে। আকাশকে বিয়ে করেছে। এই আকাশ একটু আগেই বলেছিল সে তার কোন অসম্মান হতে দেবে না। আর এখন আকাশের সামনে সারাকে যা ইচ্ছা করা হচ্ছে অথচ আকাশ নির্বাক। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সারা বুঝতে পারল তাকে বিয়ে করার পেছনে কোনো ভালবাসা নেই; অন‍্য উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু কি সেই উদ্দেশ্য?
সারাকে সবাই যা মন চায় বলছে নোংরা নোংরা কথা যা মুখেও আনা সম্ভব নয়। সারা অবাক হয়ে দেখছে সবাই দোষারোপ তাকেই করছে অথচ আকাশকে কেউ কিছুই বলছে না। একটা মেয়েকেই যেন সব দোষের ভাগীদার হতে হয়? অথচ সারা’ই জানে বিয়েটা কোন পরিস্থিতিতে সে বাধ‍্য হয়ে করেছে।
ফ্লাশব‍্যাক
ক্লাসের মাঝখানে ওয়াশরুমে যাচ্ছিল সারা। ওয়াশরুমের দিকের জায়গাটা বেশ নির্জন। সাধারণত কেউ আসে না। হঠাৎই কেউ পিছন থেকে সারার মুখ চেপে ধরে। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে সারা। আধো-জ্ঞান অবস্থায় হালকা টের পায় তার অচেতন শরীরটা কেউ কোলে তুলে তাকে শক্তভাবে শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
চলবে