তোমারই আছি আমি

তোমারই আছি আমি !! Part- 06

রাত বারোটা। সারা তার নিজের রুমে ড্রিমলাইটের আলোর নিচে তার সবচেয়ে কাছের বেস্ট ফ্রেন্ড, তার প্রিয় ডায়েরীটা খুলে বসেছে। খুঁজে খুঁজে ডায়েরীর একদম শেষ পাতাটা বের করল শেষবারের মতো আকাশকে চিঠি লেখার জন্য। আজ রাতের চিঠিটা আকাশের জন্য তার লেখা শেষ চিঠি। এরপর সে আর কোনদিন চিঠি লিখবেনা আকাশকে। সারার সামনে পাঁচপাতা ঘুমের ওষুধ, পানির গ্লাস। চিঠিটা লিখেই সে সুইসাইড করবে। তাই মৃত্যুর আগে প্রিয় মানুষটিকে শেষবারের মতো কিছু কথা বলতে চায়। কিন্তু লিখতেই পারছে না; লেখার আগেই চোখের নোনা পানিতে ডায়েরীর সাদা সাদা পাতাগুলো ভিজেনেয়ে একাকার হচ্ছে। সারার খুবই বিরক্তি লাগছে, এই চিঠিটা লিখতে দেরি হচ্ছে বলেই তার সুইসাইডের সময় পিছিয়ে যাচ্ছে। বেঁচে থাকার সময়টা আরও কিছুক্ষণ বাড়ছে। কিন্তু সারা তো আর চায়না বেঁচে থাকতে। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর থেকে সে মুক্তি চায়।
সারা আকাশের জন্য লেখা চিঠিটা লেখার শেষেই ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলল। সে চায়না এই চিঠিতে কি লেখা আছে তা কেউ জানুক। এই চিঠিটা পড়ে কেউ আকাশকে তার মৃত্যুর জন্য দোষী করুক। আকাশের কোন দোষ থাকলেও সেটা শুধু সারা জানবে; শুধুই সারা। পৃথিবীর কারো সামনে সে আকাশকে দোষী হতে দেবে না।
সারা ওষুধগুলো খোসা থেকে একটার পর একটা ছাড়িয়ে নিয়ে পানির গ্লাসটা হাতে তুলল। “আর মাত্র কিছুক্ষণ আকাশভাইয়া, আর কয়েকটা মুহূর্ত অপেক্ষা করো। তারপর আমার ঘিন্না মুখটা আর দেখতে হবে না। কাল থেকে আর কষ্ট করে আমাকে ঠকানোর জন্য মিথ্যে ভালবাসার অভিনয়েরো দরকার হবে না; তুমি যাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসো ভালো থেকো তার সঙ্গে। আমি তো সারাজীবন এটাই চেয়েছি তুমি ভালো থাকো।”
সারা ওষুধসহ পানির গ্লাসটা ধীরে ধীরে মুখের কাছে এগোল।
সেই মুহুর্তেই পাশের রুমে সারার ভাই সায়ানের ফোন বেজে উঠল। মাঝরাতে কাচা ঘুম ভাঙায় যে ফোন করেছে তাকে শালা, মজুর, কু* বলে আদর করলেও আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠল। ফারিহা মেয়েটার রাত-বিরাতে আননোন নাম্বার থেকে কল করার অভ‍্যাস। এজন্য-ই সায়ান সারারাত না ঘুমিয়ে জেগে থাকে। মেয়েটা আননোন নাম্বার থেকে কল দিয়ে অন‍্য মানুষের গলা নকল করে কথা বলে। এমন একটা ভাব করে সায়ান যেন চিনতেই পারছে না। পরেরদিন দেখা হলেই চোখমুখ লাল করে বলে,,,,,মেয়েরা রাতের বেলা কল দিলে মজা লাগে, না? সারারাত জেগে সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে আলাপ তো ভালোই করেন। তাহলে শুনেন, কালকে রাতে আপনারে কোন সুন্দরী ফোন দেয় নাই, এই আমি ফারিহা দিছিলাম। আপনের আসল চেহারা আমার দেখা হইয়া গেছে। ক‍্যারেক্টারলেস পাবলিক যত্তসব।” অবুঝ মেয়েটা বোঝেও না তার রাগ-রাগ লালমুখটা দেখতে আর এই কথাগুলো শুনতেই সায়ান প্রতিদিন ইচ্ছা করে এক-ই ভুল করে।
কিন্ত ফোনটা তুলতেই অপর পাশ থেকে পুরুষকন্ঠ বলে উঠল, “তোমার বোনের রুমে যাও। সে সুইসাইডের চেষ্টা করছে। প্লিজ সায়ান, গো ফাস্ট।” লোকটা এত অস্থিরভাবে কথাগুলো বলল যেন এই মুহূর্তে তার দমটা নেওয়ারো সময় নেই ।
সায়ান: ভাইরে ভাই কে আপনে? মাঝরাইতে ফাজলামি করার আর বিষয় পান না?
: আমি কে সেটা তোমার না জানলেও চলবে। তোমার হাতে আর পাঁচ সেকেন্ড সময় আছে; বোনের সুইসাইড আটকাও। আজ রাত ও যেন না জেগে থাকে। ওকে বুঝিয়ে স্লিপিং পিল দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে আসো। যাও। মাইন্ড ইট তোমার দেরির কারণে সারার কিছু হয়ে গেলে শুধু বোনকেই হারাবে না- আমি তোমার লাইফটাই শেষ করে দেব।”
কেন যেন সায়ানের মনে হলো বিষয়টা সিরিয়াস। আচ্ছা, একবার সারার রুমে গিয়ে দেখলেই হয়।
সারার রুম পর্যন্ত মনে মনে দোয়া পড়তে পড়তে গেল যেন ফোনের লোকটা যা বলছে সব মিথ্যা হয়। সারার রুমের দরজা হালকা ঠেলা দিতেই সায়ান নিজের চোখে যা দেখল তাতে তার পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম।
স্লিপিং পিলসগুলো মুখে দিয়ে পানির গ্লাসটা এগোচ্ছিল সারা। হঠাৎ থাপ্পড়ে মুখ থেকে সবগুলো ওষুধ পড়ে গেল। তাকিয়ে দেখল ভাইয়া সামনে দাঁড়ানো। তারপর সায়ানের একের পর একটা থাপ্পড় পড়তে লাগল সারার গালে।
সারা: ভাইয়া…
সায়ান: ভাইয়া ডাকবি না আমাকে। আমি কেউ না তোর। এই কাজটা যখন করছিলি তখন ভাইয়ের মুখ মনে পড়ল না? আচ্ছা ভাইকে নাহয় ভালবাসিস না, আম্মু-আব্বুর কথাও মনে পড়ে নাই? আমরা কেউই না তোর?
সায়ানের রাগে রক্তলাল হওয়া চোখের থেকে বড় বড় ফোটা চোখের পানি বেয়ে পড়ল। সারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার ভাইটার দিকে। ভাইয়াকে আগে কখনোই কাঁদতে দেখে নি।
সারা সায়ানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। বোনের কান্নায় সায়ানের বুক ভেঙে যাচ্ছে। বোনটাকে বুকের মধ্যে নিয়ে কপালে গালে অসংখ্য চুমু দিল।
“এত অপদার্থ ভাই আমি। আমি আমার বোনের কোন খেয়ালই রাখি নি। একটুও আগলে রাখতে পারি নি। আমার এত ছোট্ট বোনটার মনের মধ্যে কেন এত কষ্ট থাকবে? সারা আমি আর তোকে কোন কষ্ট পেতে দেব না বোনুটা আমার‍।”
সায়ান অনেক্ষন সারার কাছে থাকল। তারপর ফোনের লোকটার কথামতোই ঘুমের ওষুধ দিয়ে সারাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। ভাইয়ের কষ্ট পাওয়া দেখে সারা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। এটা কি করতে যাচ্ছিল সে? যে মানুষগুলো তাকে এত ভালবাসে তাদের বিনা দোষে শাস্তি দিচ্ছিল? কার জন্য? যে তাকে কোনদিনই ভালবাসেনি বরং বারবার মিথ্যা অভিনয় দিয়ে ঠকিয়েছ। আর সারার প্রচন্ড ভালবাসার বিনিময়ে শুধু অপমান ফেরত দিয়েছে। ভাইয়ের কোলে মাথা রেখে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল আকাশকে সে এবার একেবারে ভুলে যাবে।
সায়ান সারা ঘুমিয়ে পড়লে ওর মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে আস্তে আস্তে বালিশে রাখে। নিজের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখে লোকটা এখনো ফোন কাটে নি।
ফোনটা হাতে নিয়ে সায়ান সারার ঘরের বারান্দায় দাঁড়াল। যা ভেবেছিল তাই। তাদের বাসার সামনে ঠিক সারার ঘরের নিচে একটা নেভি ব্লু গাড়ি পার্ক করা। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল ওর।।
: সারারাত না ঘুমিয়ে আমার বোনের দারোয়ানগিরি করা লাগবে না শালা আকাইশ‍্যা। আমার বোনকে দেখার জন্য তার ঘরে সি.সি ক‍্যামেরা না লাগিয়ে তাকে বরং নিজের ঘরে নিয়ে যান। যাতে চব্বিশ ঘন্টা সামনে থেকে দেখতে পারেন।
: সায়ান,,,থ‍্যাংক ইউ দোস্ত। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম রে। পুতুলকে ঘুমের ওষুধগুলো হাতে দেখে আমার মাথা কাজ করছিল না।যদি পুতুলের কিছু হয়ে যেত… আসলে আজকের কথাগুলো ওর খুব মনে লেগেছে। অনেক কষ্ট পেয়েছে আমার পুতুলটা।
: কেন এগুলো করছিস আকাশ? নিজেও তুই পুড়ছিস,,,আমার ছোট্ট বোনটাকেও পোড়াচ্ছিস। তোর কারনে ও মরতে যাচ্ছিল। আকাশ রে যাকে এতটা ভালবাসিস,,,পারিস না তার একটা ভুলকে ক্ষমা করে দিতে? বিশ্বাস কর্,,সারা তখন ছোট ছিল ভুলে একটা ভুল কাজ করে ফেলেছে কিন্তু আজো ও তোকেই ভালবাসে। এতখানি কষ্ট আর দিস না তোকে। ওকে কষ্ট দিয়ে তুইও তো ভালো নেই। বরং সারার চেয়ে বেশি কষ্ট তুই পাচ্ছিস।
: সায়ান কিছু কিছু ভুলের ক্ষমা হয় না।
:আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না রে আকাশ আমার বোন ঐরকম কিছু করেছে।
: প্লিজ সায়ান। এই টপিকে আর যেতে চাচ্ছি না।
: আচ্ছা বাদ দিলাম,,,,এখানেই থাকবি নাকি সারারাত
: থাকব না মানে? একটুও বিশ্বাস করি না তোমার বোনকে। আবার যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে?
: আচ্ছা থাক তুই,,,,আমার আবার মিথ্যা-ফোনের সময় হয়ে গেল।।
:মিথ্যা-ফোন? সেইটা আবার কি?
: বলবনি আরেকদিন।
ঘুমে নিস্তব্ধ এই শহরে একা একা রাত জাগে আকাশ।ভিডিওতে সারার ঘুমন্ত মুখের ওপর হাত বোলায়। ল‍্যাপটপটা কাছে টেনে সারার মুখের জায়গাটায় চুমু খায়।
পরেরদিন ভার্সিটিতে সারা অনেক বড় একটা বিপদের সম্মুখীন হলো
চলবে