ঝরা ফুলের বাসর

ঝরা ফুলের বাসর !! Part- 22

হৃদের বাড়ন করা স্বত্বেও আপুর রুমে গিয়েছিলাম আমি।আপুর সাথে কথা বলেছিলাম আর এটা দেখে হৃদ প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলো। আমার সাথে ঝগড়া করে মাঝ রাতে হোস্টেলে রেখে গিয়েছে আমায়।আর

বলেছে পরীক্ষার আগে বাড়িতে যেন না যাই আমি।আমি ওকে কতবার ফোন করেছি ধরেই নি।অনেক হয়েছে আর না ও যখন যা চাইবে তাই শুনতে হবে নাকি?
আমার কথা শুনে মিনি, নিশি আর প্রিয়াও হৃদের হয়ে বলল।ওদেরও মনে হয় হৃদ ঠিক আর আমি ভুল।ওরাও পছন্দ করে না আমার আপুকে।কাউকে বুঝিয়ে লাভ নেই।কাল হসপিটালে গিয়ে মেঘ স্যারের সাথে কথা বলতে হবে আমার।স্যারকে বোঝাতে হবে আপু আর আগের মতোন নেই।ঠিক মতোন খাই না।নিজের যত্ন নেয় না।দেখলে খুব মায়া হয় আপুকে।জীবনের দীর্ঘ সময় আপুর সামনে পরে আছে।এভাবে আপুকে আমি কস্ট পেয়ে শেষ হয়ে যেতে দিতে পারি না।স্যারকে বলব আপনি যদি সত্যি আমার আপুকে ভালোবেসে থাকেন তাহলে আর একটা সুযোগ দিন।
সকাল আটটা,,, জানালার পর্দা সড়িয়ে দেখতে পেলাম গাড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে হোস্টেলের সামনে দাড়িয়ে আছে হৃদ।আশ্চর্য আজ ও আমায় একটাবার ফোনও দেয় নি।অন্যদিন তো ঘড়ির কাটায় পাঁচটা বাজতে না বাজতে ফোন করতে শুরু করে।আমার ঘুম থেকে উঠে নিচে যেতে হয়ে যায় ছয়টা।দুই ঘন্টা ওর সাথে সময় কাটিয়ে আটটার পরে হসপিটালে ঢুকি।আজ যেমন লেট করে এসেছে তেমন যাবোই না ওর সঙ্গে।আমি নিচে নেমে ওকে দেখেও না দেখার ভাব করে পাশ কেটে চলে এলাম বড় রাস্তার মোড়ে।ইজিবাইক ডেকে উঠে পরলাম আমি।ঠিক তখনই ইজিবাইক থামিয়ে আমাকে টেনে নামালো হৃদ।রাস্তার উপর ওর এমন ব্যাবহারে আমার ইচ্ছে করে ওকে গোবর পানিতে চুবাই।আমি রেগে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,

—সমস্যা কি তোমার? কেন এসেছো আমার কাছে?
হৃদের বুকে ধাক্কা দিয়ে ঘুরে আসতে লাগলাম আমি। হৃদ একটানে আমাকে জোড়িয়ে ধরে বলল,
—তুই তো জানিস আমাকে।আমি রাগ করলে তোর সাথে কথা বলি না।যতোক্ষণ না তুই আমার সাথে কথা বলিস।আর তোর থেকে দূরেও থাকতে পারি না।
আমি হৃদের পিঠে হাত রেখে ওকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।তারপর বললাম,
-কাল ওভাবে ঝগড়া করলে কেন? তোমার চিন্তায় সারারাত ঘুম হয়নি আমার।
হৃদ ঠেলে আমায় সরিয়ে দিয়ে বলল,
-নূরকে আমার ভালো লাগে না।ও যেই অপরাধ গুলো করেছে শুধু মাত্র তোকে কস্ট দেওয়ার জন্য। আমার খুব চিন্তা হয়। আমি চাই না তুই আর কখনো ওর আসেপাশে থাকিস।
আমি বুঝতে পারলাম হৃদকে বুঝিয়ে লাভ নেই।ওর চোখে এখনও আপু খুব খারাপ। নিচের দিকে তাকিয়ে নড়ম গলায় বললাম,
-হসপিটালে চলো।
দুপুরে লাঞ্চ করছিলাম হৃদের চেম্বারে। এমন সময় মেঘ স্যার নক না করেই ঢুকে পরে হৃদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-ফুলের সাথে আমার একটা জরুরী কথা আছে হৃদ।
আমি আর হৃদ কি অবস্থায় ছিলাম সেদিকে স্যারের খেয়াল নেই। নিজের কথাটা শেষ করেই আনমনা হয়ে চেম্বার থেকে বেড়িয়ে গেলো মেঘ স্যার।স্যারের চলে যাওয়ার পর হৃদের কোলের উপর থেকে নেমে দাড়ালাম আমি।ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
-স্যারের কি হলো বলো তো? আমি কি কোনো ভুল করলাম? কিন্তু আজ তো আমার ডিউটি ছিলো না তাহলে?
হৃদের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে এসে ভয়ে ভয়ে স্যারের চেম্বারে ঢুকলাম। দেখলাম সব জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে নিচে পরে আছে।আর স্যার চেয়ারে বসা।চোখদুটো লাল হয়ে আছে।আমাকে দেখে উঠে এসে আমার সামনে দাড়ালেন।মুখের সামনে একটা খাম ধরে বললেন,
-এই ছিলো তোমার আপুর মনে? এই ওর ভালোবাসা? একটাবার আমার কথা ভাবলো না? আমিতো ওকে একটা সুযোগ দিতে চেয়েছিলাম। চিঠি লিখেছে আমি নাকি ওকে অপমান করেছি।ওর ভালোবাসা বুঝি নি।তাই আমার আগেই ও আমাকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে।ডিভোর্স দেবে আমাকে।ডিভোর্স!
এটুকু বলেই স্যার কেঁদে উঠলেন।দু’হাত জোড় করে আমার সামনে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে পরে বললেন,

-আমি মরে যাবো ফুল কিন্তু নূরকে ডিভোর্স দিতে পারবো না।হ্যাঁ মানছি অনেক অন্যায় করেছে নূর।কিন্তু আমি চাই নি ওকে অপমান করতে।সেদিন যা কিছু করেছি বাবার কথা রাখতে।আমি যদি ওকে হসপিটাল থেকে বের না করতাম তাহলে বাবা ওকে পুলিশে দিতো।কোনো উপায় ছিলো না আমার কাছে।নূর চলে যাওয়ার পর থেকে এমন একটা মুহূর্ত নেই ওকে আমি মনে করি নি।প্রত্যেকটা দিন, প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমি চেয়েছি নূর শুধু একটাবার আমাকে ডাকুক।একটাবার ফোন করুক।আমি সব ছেড়ে ওর কাছে চলে যেতাম।কিন্তু একবারের জন্যও নূর আমার খোঁজ রাখেনি।তাহলে এতে আমার কি দোষ ছিলো?
আমি স্যারকে ধরে উঠিয়ে চেয়ারে নিয়ে গিয়ে বসালাম।স্যারকে বললাম,
-কাল আমি বাড়িতে গিয়েছিলাম।আমার আপুও ভালো নেই স্যার।কাকিমণি ছাড়া ওখানে কেউ আপুর সাথে ভালো ব্যাবহার করে না।আপুকে দেখলে মনে হয় যেন খুব অসুস্থ। ঠিক মতোন খাই না।নিজের যত্নও নেই না।সাদা ছাড়া অন্য কোনো রংয়ের পোশাক পড়ে না।ডাক্তারি পড়ার সময়ে আপুকে জন্মদিনে মজা করে আপনি একটা সাদা শাড়ি দিয়েছিলেন তাই না? ওটাই পরে থাকে।কাল আপু বলেছে আমাকে আপনাকে খুব মিস করছে।কিছু বলতে চাচ্ছিলো আপু হৃদের জন্য শুনতে পারিনি।তবে আমার বিশ্বাস আপু আপনাকে নিয়ে সুখে থাকতে চাই।এই ডিভোর্স পেপার হয়তো আপনার উপর অভিমান করে পাঠিয়েছে।আমি বলছি স্যার আপনি একটাবার আপুর সামনে গিয়ে দাড়ান।নিজে প্রশ্ন করুন।আপুর চোখের ভাষা পরে বুঝুন কি চাই।
স্যারকে কথাগুলো বলে চেম্বার থেকে বেড়িয়ে আসলাম আমি।এমন সময় কাকিমণির ফোন আসলো।রিসিভ করলে বলল,
—ফুল তুই তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে আয়।নূর কেমন যেন করছে।হৃদকে ফোন দিয়েছি ও নূরের নাম শুনেই কেটে দিয়েছে।বলতে পারিনি হৃদকে।তুই হৃদকে সাথে করে নিয়েই আসিস।

আমি ছুটে হৃদের কাছে গেলাম। ওকে বললাম আপুর কথা।আমার সঙ্গে আসলেও সারাটা রাস্তা আমাকে বলে এসেছে অসুস্থতাও আপুর কোনো নাটক।
বাড়িতে এসে আমরা দু’জনে আপুর রুমে গেলাম।কাকিমণি বলল আপু একটু আগে স্বাভাবিক হয়েছে।এখন ঘুমোচ্ছে।হৃদ আমাকে বলল,
-বলেছিলাম না সবই নাটক? শুধু শুধু হসপিটালের পেশেন্ট ফেলে রেখে এর নাটক দেখতে এসেছি।
আসেপাশে তাকিয়ে দেখলাম মাম্মামও আপুর রুমে আসে নি।হৃদ চলে গেলো।আমি আর কাকিমণি আপুর পাশেই বসে আছি।এমন সময় আমার মনে হলো আপুর কি হতে পারে? কালতো আপু কাকিমণিকে বলল রিপোর্টে কিছুই ধরা পরেনি।আচ্ছা আপুর ওষুধ দেখলে তো বুঝবো।
কাকিমণিকে বললাম আপু কি ওষুধ খাই আমাকে একটু দেখাতে পারবে? কাকিমণি ওষুধের বক্স এনে আমার সামনে ধরে বলল এগুলো। আমি চোখ তুলে ওষুধের দিকে তাকালাম।ওষুধগুলো উল্টিয়ে নামগুলো দেখে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম।নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে আলমারি খুলে আপুর রিপোর্টটা দেখার পর নিস্তব্ধ হয়ে রইলাম।
খাবার টেবিলে বসে মাম্মাম হৃদকে বলছে,
-তোরা যে কেন আসতে গেলি।এসব নাটককে একদম প্রশয় দিই না আমি।বাড়িতে কত কাজ পরে আছে তাই নিয়ে ব্যস্ত।তো কি দেখলি সত্যি কি অসুস্থ নাকি অভিনয়?
কাকিমণির প্রশ্নের উত্তরে হৃদ বলল,

-আর বলো না তো কাকিমা।তোমরা একটু ফুলকে বোঝাও।ওকে বোঝাতে বোঝাতে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।ও ভুলে গিয়েছে নূর ওর সাথে কি কি করেছে।
হৃদ আর কাকিমণির কথাগুলো আমার কাকে আসলো।আমি আপুর রুম থেকে বেড়িয়ে বলে উঠলো,
-তোমরা ঠিকই বলো সবসময় আপু নাটকই করে।এখনতো প্রমাণও পেয়ে গেলাম।
আমার মুখে কথাটা শুনে মাম্মাম খুব খুশি হলো।জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে বললো,
-যাক বুঝেছো যখন তখন একটু দূরে থেকো ওর থেকে।
আমি এগিয়ে এসে আপুর রিপোর্টটা ছুড়ে টেবিলের উপরে হৃদ আর মাম্মামের সামনে ফেললাম। চিৎকার করে বললাম,
-আমার কথা পুরোটা শুনো তোমরা।আপু নাটক করেছে নিজের অসুস্থতা লুকিয়ে। আপু যানতো তোমরা কেউ বিশ্বাস করবে না।বলবে নাটক করছে তাই কাউকে বলে নি।হৃদ রিপোর্ট খোলো।আর বলো আমি আমার আপুর কাছে যেতে পারবো কিনা?
হৃদ রিপোর্ট খুলে দেখলো।আর মাথাটা নিচু করে নিলো।আমি হৃদকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
-তুমি না ডাক্তার? দিনের পর দিন তোমারই বাড়িতে এমন পর্যায়ে এসে পরেছে একটা পেশেন্ট তুমি খোঁজও নেও না।এখন বুঝছি মেঘ স্যারকে আপু ডিভোর্স পেপার কেন পাঠিয়ে ছিলো।

মাম্মাম ভয় ভয় দৃষ্টিতে হৃদের দিকে তাকালো।হৃদকে ঝাকিয়ে বলল,
-ফুল এসব কি বলছে হৃদ? কি হয়েছে আমার নূরের? নূর কি সত্যি অসুস্থ? রিপোর্টটা দেখে তুই চুপ হয়ে রইলি কেন উত্তর দে?
হৃদ চোখ তুলে কাকিমণির দিকে তাকিয়ে বলল,
-নূরের ব্লাড ক্যান্সার।

কথাটা শুনতেই মাম্মাম এক চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। হৃদ মাম্মামকে ধরে রুমে নিয়ে গেলো।আমি ঘুরে দাড়াতেই দরজার সামনে মেঘ স্যারকে দেখতে পেলাম। সবে বাড়িতে ঢুকেছে।আর এই কথাটা শুনে স্যার নিস্তব্ধ হয়ে আছে।নড়াচড়া করছে না।আমি এগিয়ে এসে স্যারকে ডাকলাম,
-ডা.মেঘ স্যার।
স্যার সঙ্গে সঙ্গে বসে পরলেন নিচে।চিৎকার করে কেঁদে উঠে বললেন,
-আমার নূর কোথায়?
-রুমে ঘুমোচ্ছে।
আমার মুখে কথাটা শুনে মেঘ স্যার ছুটে আপুর রুমে গেলেন।
চলবে,,,,,,