00

জীবনের গল্প !! Part- 02

আদনানের কাছ থেকে এমন কথা শুনে আমার ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো আমার ভিতরের হৃৎপিন্ডটাকে কেউ জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে ছেড়ে দিয়েছে। যাকে ভালোবাসলাম,বিশ্বাস করলাম,নিজের পৃথিবী ভেবে বিয়ে করলাম সেই মানুষটাই আজ আমাকে ছেড়ে যাওয়ার ভয় দেখাচ্ছে। আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছিলো না,তবুও নরম গলায় বললাম,
“আমি ডিভোর্সের ভয়ে নিজের স্বপ্ন গুলো ধ্বংস করতে পারবো না। তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে আমার স্বপ্ন পূরণের সঙ্গী হবে,সবসময় আমার পাশে থাকবে,যতোই বাঁধা আসুক না কেনো আমাকে কোনোদিন ছেড়ে যাবে না। কিন্তু আজ নগণ্য একটা কারণে আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছো। সত্যি বলতে কখনো ভাবিনি মাঝপথে এসে এভাবে সরে দাঁড়াতে চাইবে তুমি। আমি ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করতে পারবো না। তবে তুমি চাইলে আমার পড়ালেখার পেছনে যে টাকাটা খরঁচ করো সেটা বন্ধ করে দিতে পারো কিন্তু আমাকে ক্লাসে যাওয়া নিষেধ করো না। আমি যেভাবেই হোক নিজের পড়াশোনার টাকাটা জোগাড় করে নিবো।”
আমার কথা শুনে আদনান বলল,
“আমার মায়ের কথায় ঠিক। আসলেই তুমি বেয়াদব একটা মেয়ে। নিজের স্বামীর সাথে উঁচু গলায় কথা বলছো। তোমার কথা আমি মানি। তোমাকে একসময় আমি কথা দিয়েছিলাম বিয়ের পরেও আমি তোমাকে পড়ালেখা করাবো। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিটাও তোমাকে বুঝতে হবে। আমি যা বললাম সেটা না করলে আমি ভুলে যাবো তুমি আমার স্ত্রী। আমি কাল অফিসিয়াল কাজে একমাসের জন্য ঢাকার বাহিরে যাবো। তুমি কাল থেকে আর ভার্সিটি যাবে না এটাই আমার শেষ কথা। এতোগুলো মানুষের সুখের জন্য তুমি তোমার পড়ালেখাটা বিসর্জন দিতে পারবে না? আমাদের ভবিষ্যৎ সন্তানের কথা ভেবে অন্তত তুমি আমার কথা শুনবে।”
কথাগুলো বলেই আদনান বিছানায় শুয়ে পড়লো। আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো না। আমিও আর কিছু বললাম না। কারণ আমি জানি এখন যাই বলি না কেনো সেটা সে আমলে নিবে না। দুজন মানুষ এক বিছানায় ঘুমালেও দুজনের মাঝে অনেক দূরত্ব বিরাজ করছে আজ। জানি না দূরত্বটা সময়ের ব্যবধানে কোনো একসময় কমে যাবে নাকি আরও বেড়ে যাবে।

সকালে আদনান অফিসে যাওয়ার পরে আমি যখন ভার্সিটি যাওয়ার জন্য বের হলাম তখন আমার শাশুড়ি বলল,
“তোমাকে আদনান কিছু বলেনি? তোমাকে তো ভার্সিটি যেতে না বলেছে। তারপরেও কেনো যাচ্ছো?”
তখন আমি বললাম,
“ওটা এমনিতেই বলেছে।”
তখন আমার শাশুড়ি বলল,
“এমনি না। সত্য সত্যই বলেছে। আমিও বলছি তোমাকে আর পড়াশোনা করতে হবে না। কয়েকদিন পরে তো মা হবে। তাই ঘরের বাহিরে যাওয়ার দরকার নেই।”
আমি তাঁর কথা কানে নিলাম না। নিজের মতো করে বেরিয়ে গেলাম ভার্সিটির উদ্যেশ্য। এভাবে প্রায় একমাস চলল। এই একমাসে আমার শ্বশুর শাশুড়ি আমার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি এটা যেনো আমার বিশ্বাসই হয় না। একমাস পর যখন আদনান বাসায় আসলো তখন খুশিতে তাকে আমি জড়িয়ে ধরি। কারণ বিয়ের পর এই প্রথম তাঁর থেকে আমি এতোটা দিন দূরে ছিলাম। কিন্তু আদনান আমাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দিলো। ভাবলাম সে হয়তো আমার ওপর রাগ করেছে তাঁর কথা শুনিনি বলে। তাই তাঁর রাগ ভাঙানোর জন্য উঠে পড়ে লাগলাম। কিন্তু কোনো কিছুতেই তাঁর রাগ ভাঙাতে পারলাম না আমি।
আমার পৃথিবীটা উলটপালট করে দিয়ে আদনান যখন খুব নরম কণ্ঠে বলল,
“আমার অনেক খারাপ লেগেছে সিদ্ধান্তটা নিতে। অনেক কঠিন একটা সিদ্ধান্ত ছিলো অন্তত আমার জন্য। যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম তাকে একসময় ডিভোর্স দিতে হবে কখনো কল্পনা করিনি। কিন্তু অনেক ভেবে চিন্তে দেখেছি আমি। তুমি আমাকে সুখ দিতে পারবে না। যে মানুষটা আমার জন্য,আমার পরিবারের জন্য নিজের ছোট্ট একটা স্বপ্নকে বিসর্জন দিতে পারেনি সে মানুষটা ভবিষ্যতে আমাকে সুখ দিবে এটা আমার বিশ্বাস হয় না। তুমি যদি আমাকে ভালোবাসতে, আমার ভালো চাইতে,আমার পরিবারের ভালো চাইতে তাহলে এতো কিছুর পরেও তুমি তোমার লেখাপড়াটা কন্টিনিউ করতে চাইতে না। আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। আমি তোমার সাথে আর থাকতে চাই না।”

আমি যখন আদনানের মুখ থেকে কথাগুলো শুনলাম তখন কেনো জানি আমার ভিতরটাকে আমি বিশ্বাস করাতে পারলাম না এই কথাগুলো সত্য। আমার মনে হলো আদনান কখনোই এমন কিছু বলতে পারে না। এসব কিছু মিথ্যা। সামান্য একটা কারণে সে আমাকে এতো বড় শাস্তি দিতে পারে না। কিন্তু আদনান যখন পুনরায় বলল,
“আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্স পেপারটা রেডি করে তোমাকে জানাবো।”
তখন আমার মনে হলো আদনান সত্যি সত্যিই আমার সাথে আর এক ছাদের নিচে থাকতে চায় না। তখন নিজের অজান্তেই কাঁদতে থাকি আমি। আদনানকে অনুরোধ করি।
“তোমার সিদ্ধান্তটা বদলাও,চাইলেও তুমি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারো না। তুমি বলেছিলে সারাজীবন আমার পাশে থাকবে। আমার তোমাকে ছাড়া থাকতে অনেক কষ্ট হবে। আমি তোমার সাহসেই নিজের স্বপ্ন গুলো পূরণ করতে চাই। আমাদের সন্তানের কথাটা একবার ভাবো।”
তখন আদনান বলল,

“ওটা আমার সন্তান না। তোমার সন্তান। তুমি আমাকে খুব ভালো করেই চেনো আমি কেমন মানুষ। আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়াবো না। আমি তোমাকে কতো করে বলেছি তুমি আমার কথা শোনোনি। তোমার সম্পর্কে মা আমাকে অনেক কিছু বলতো কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু আজ বিশ্বাস না করে পারছি না। তুমি মাঝে মাঝেই ভার্সিটি থেকে রাত করে ফিরতে। আমাকে বলতে পারো সন্ধ্যার পরেও তোমার কিসের ক্লাস থাকতো? তোমার পেটের বাচ্চার বাপ আমি নাকি অন্য কেউ সত্যি করে বলতে পারবে? এটা নিয়ে তো আমার সন্দেহ হয়।”
আমি আদনানের কথাগুলো সহ্য করতে পারলাম না। বুকের ভিতর এক অসহ্য অসহনীয় যন্ত্রণা হতে লাগলো। নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা হতে লাগলো। নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে খারাপ মানুষ মনে হচ্ছিলো। যে মানুষটা এতোদিন পরেও নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছে বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি। আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। আদনানের গালে দুইটা চড় মেরে দেই। আর বলতে থাকি।

“খুব ভালো বলেছো। আমাকে একটা নষ্ট মেয়ে হিসেবে তোমার কাছে প্রতিস্থাপন করলে। আমি কি আসলেই এতোটা খারাপ? কারো সম্পর্ককে কিছু না জেনেই শুধুমাত্র সন্দেহ আর রাগের বশে এতোটা জঘন্য অপবাদ দিতে পারে কেউ জানতাম না। কিন্তু আজ তুমি আমাকে জানিয়ে দিলে। তুমি ডিভোর্স পেপারটা রেডি করো। আমি নিজেই তোমার কাছে আর থাকবো না। দরকার হলে নিজের দেহ বিক্রি করে নিজের সন্তানকে বড় করবো। তবুও তোমার মতো কাপুরুষের কাছে থাকবো না।”
পরের দিন রাগ করে আমি আমার বাবা মায়ের কাছে চলে যাই। আমি ভেবেছিলাম আমার স্বামী কোনো একসময় সবকিছু ভুলে যাবে। আবার আমাকে নিতে আসবে। কিন্তু সে আসে না। দিন যায়,মাস যায় সে আমাকে নিতে আসে না। কয়েক মাস পর আমি ছেলে সন্তানের মা হয়ে গেলাম। ভাবলাম এবার আর আদনান আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। সন্তানের মায়ায় হলেও অতীতের সব রাগ অভিমান ভুলে আমার আর আমার ছেলেকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবে। কিন্তু যখন আদনানদের বাড়িতে খবর পাঠানোর পরেও কেউ আমার ছেলেকে দেখতে আসলো না তখন মনে হলো আমাদের সম্পর্কটা আর কখনো জোড়া লাগবে না।
দেখতে দেখতে প্রায় একটা বছর কেটে গেলো। সেদিন যে রাগ করে চলে এসেছিলাম তারপরে আর কখনো আমার স্বামীর সাথে কোনো কথা হয়নি আমার। আমি যদি তাকে ফোন দিতাম তাহলে সে কখনো আমার ফোন ধরতো না। যদি মেসেজ করতাম সেটারও রিপ্লাই করতো না। আমি বুঝতে পারতাম সে আমাকে ইগনোর করে তবুও আমি তাঁর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতাম,কথা বলার চেষ্টা করতাম। শুধুমাত্র অামার সন্তানটার কথা ভেবে। কিন্তু তাঁর সাথে আমি কথা বলতে পারতাম না। সে কেনো আমার আর সন্তানকে দেখতে আসেনি সেটাও আমি জানি না। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো আমাদের ডিভোর্স হয়নি,আমাদের সম্পর্কটা সেই আগের মতোই আছে। তবুও কেনো আমার সাথে এমন হচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তর আমি অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। একবছর অপেক্ষা করার পরেও যখন আমার স্বামীর বাড়ি থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কেউ আসলো না কিংবা ডিভোর্স নামক শব্দটার মাধ্যমে আমাদের সম্পর্কটা ছিন্ন করার জন্যও কারও আগমন ঘটলো না। তখন আমি আমার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করা একেবারেই বাদ দিয়ে দিলাম। নিজের জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জীবন যুদ্ধে নেমে পড়লাম।
চলবে………….