গল্প: দাওয়াত

গল্প : দাওয়াত !! Part- 2

সেখান থেকে বের হয়ে আমি ছোট দুলাভাইয়ের বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি আপা বাসায় নেই, মার্কেটে নাকি গিয়েছেন। দুলাভাই গিটারের তার খুলে কি যেন করছেন। আমাকে দেখে উচ্ছসিত কন্ঠে বললেন, কি শালাবাবু, আজকাল যে আর তেমন দেখা পাওয়া যায় না। সারাদিন বউ এর আঁচল ধরে বসে থাকো বুঝি? আচ্ছা তুমি বস আমি আসছি। এ বলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন।
আমার এই দুলাভাইটা দিলখোলা মানুষ। ওনার সাথে কথা বলতে ও চলতে আমার খুব ভালো লাগে। উনি একটি ব্যান্ড দলের সদস্য। সেখানে গিটার বাজান। ওনার মাথায় কালার করা বাবরি চুল, হাতে বালা এবং এক কানে দুল পরা। বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি, কিন্তু চাল চলন কুরি বছরের যুবকের মত। এই বেশ ভুষার জন্য আমাদের মুরুব্বি টাইপ আত্বীয় স্বজন তাকে পছন্দ করেন না।
কিছুক্ষন পর তিনি প্লেটে করে বাদাম নিয়ে আমার সামনে রাখতে রাখতে বললেন, চা এর পানি বসিয়ে আসলাম। তা কি মনে করে?
আমি ওনাকে দাওয়াতের কথা বললাম।
তিনি খুশি হয়ে বললেন, ভালোই হলো, অনেকদিন কোন দাওয়াত খাই না।
আমি বললাম, দাওয়াতে কি কি আইটেম থাকবে তা তো জিজ্ঞেস করলেন না?
তিনি বললেন, জিজ্ঞেস করার কি আছে? কিছু একটা তো খাওয়াবে, খালি মুখে তো আর দিবে না।
আমি বললাম, মেঝ দুলাভাই বললেন পোলাও রোষ্ট এবং বড় দুলাভাই বললেন কাচ্চি কাবাব না হলে যাবেন না। আপনিও বলতে পারেন ফ্রাইড রাইস ও চিকেন ফ্রাই না হলে যাবেন না।
তিনি বললেন, ওনারা হলেন জ্ঞানী লোক, সে জন্য খাবার ছাড়া অন্য চিন্তা মাথায় আসে না। অনুষ্ঠানে সবাই একসাথে হবো, আনন্দ করবো এটাই আসল ব্যাপার, খাবারটা কোন গুরত্বপূর্ন বিষয় নয়। তুমি তোমার মত আয়োজন কর। যার ভালো লাগে আসবে, যার ভালো লাগবে না, সে আসবে না।
কিছুক্ষন পর তিনি চা এনে আমার হাতে দিয়ে বললেন, তুমি অনুষ্ঠানে গানের ব্যাবস্থা রাখতে পারো। সবাই মজা পাবে। আমি ছোট একটা দল পাঠিয়ে দিব।
আমি বললাম, ভাই আমার বাজেট কম। খরচ দিতে পারবো না।
তিনি বললেন, আমি তোমার জন্য ভালো ডিসকাউন্ট করে দিব।
আমি বললাম, অফিসের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা উঠিয়ে অনুষ্ঠান করছি। অনুষ্ঠানের বাজেট আর ওই টাকা প্রায় সমান সমান।
তিনি বললেন, কেউ যখন কারো বাড়িতে যায়, শুধু খেতেই যায় না। কিছুটা বিনোদনও পেতেও যায়। এজন্য দেখবে কুলখানিতে ভালো খাবার খেয়েও মানুষের মন খারাপ থাকে আর জন্মদিন শুধু কেক খেয়েও মানুষ আনন্দ করে। তোমার অনুষ্টানে যখন ব্যান্ড এর দল গান গাইবে, তখন দেখবে অনুষ্ঠানের পরিবেশই অন্যরকম হয়ে যাবে। বাচ্চারা এমনকি বড়রাও অনেক মজা পাবে।
আমি বললাম, আপনার কথা ঠিক আছে, কিন্তু আমার কাছে টাকা নেই।
তিনি বললেন, আচ্ছা টাকার চিন্তা তোমাকে এখন করতে হবে না। আমি আমার দল নিয়ে চলে যাবো। তুমি বেতন পেয়ে এক মাসে বা দুই মাসে টাকা দিয়ে দিও।
আমি বললাম, তা না হয় দিলাম। কিন্তু আর একটি সমস্যা আছে।
তিনি বললেন, কি সমস্যা?
অনুষ্ঠানে মুরুব্বী শ্রেনীর যারা থাকবে তাদের মধ্যে অনেকে গানের আয়োজন দেখলে রাগ করতে পারেন।
তিনি বললেন, আরে আমরা কি মুরুব্বীদের সামনে গান গাইবো নাকি। ওনারা চলে গেলে তখন আনন্দ করবো।
তারপর আমি ছোট চাচার বাসায় গেলাম। আমার বাবার এক ভাই তিন বোন। বাবা মারা গেছেন, এখন ওনাকে আমরা পরিবারের মুরুব্বী হিসেবে জানি। আমাদের পরিবারের যে কোন সমস্যা বা বিচার শালিসে ওনাকে ডাকি।
আমি সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলাম তিনি ওজু করে এসেছেন, নামাজ পড়বেন। কেউ নামাজ পড়লে তার পেছনে বসে থাকা যায় না, নিজেকে চোর চোর মনে হয়। আমিও ওজু করে আসলাম নামাজ পড়ার জন্য।
নামাজ শেষে তিনি মুনাজাত ধরলেন, সবার জন্য দোয়া করলেন। বাবার জন্য দোয়া করতে গিয়ে ওনার চোখ দিয়ে পানি বের হতে লাগলো। সাদা দাড়ি ভিজে গেলো।
মুনাজাত শেষে বললেন, ছোট বেলায় দেখছি মা সারা বছর অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে থাকতো। ভাইজানই আমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন, খাইয়ে দিতেন, সারাদিন কোলে কোলে রাখতেন। ছোট বেলায় মার কাছে থাকতাম না, ভাইজানের কাছেই থাকতাম। ছোট মুরগির বাচ্চা যেমন সারাদিন মা মুরগির পেছনে পেছনে ঘুরে, তেমনি আমিও সারাদিন ভাইজান এর পেছনে পেছনে ঘুরতাম। ইদানিং ভাইজানকে ঘন ঘন স্বপন দেখছি, আমাকে ডাকছেন। আমাকে ছাড়া নাকি তার ভালো লাগে না।
তারপর তিনি বললেন, মনটা কেমন যেন অশান্ত হয়ে আছে। ভাইজানের কবরটা একটু জেয়ারত করতে পারলে মনটা শান্ত হতো। শরীরটা খুব অসুস্থ, এখন আর দুরে কোথাও যাওয়ার জন্য সাহস পাইনা, শরীরে কুলোয় না।
আমি বললাম, আপনি একটু সুস্থ হোন আমি অফিস থেকে দুই দিন ছুটি নিয়ে আপনাকে গ্রামে নিয়ে যাব।
তারপর, আমি ওনাকে দাওয়াতের কথা বললাম।
তিনি চোখ মুছে বললেন, মসজিদের ইমাম সাহেবকেও দাওয়াত করিও। তিনি এসে দোয়া করে দিয়ে যাবেন।
কিছুক্ষন চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ওই ডিসকো দুলাভাইকে দাওয়াত করেছো?
আমি মাথা নাড়লাম।
তিনি বললেন তার তো বিদাতি কাজ কারবার। ঢোল বাদ্য ছাড়া কোথাও যেতে পারে না। মানুষ একটা বয়সে শয়তানি করে তারপর ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এই লোকটাকে দেখলাম আর ভালো হলোনা। যত দিন যাচ্ছে তার নাফরমানি যেন বেড়েই যাচ্ছে।
তারপর তিনি কিছুক্ষন দম ছেড়ে বললেন, অনুষ্টানে তাকে নিয়ে নাচা নাচি করলে আমাকে যেতে বলো না। আমি দাদুভাইকে দুর থেকে দোয়া করে দিব।
এরপর আমি বড় ফুপুর বাসায় গেলাম। এই বাসায় আসিনা অনেক দিন। শেষ কবে এসেছিলাম মনে নেই। ফুপু আমাকে দেখেই কেঁদে ফেললেন।
বললেন, বাবা মা না থাকলে মেয়েদের বাপের বাড়ি থাকেনা, পরের বাড়ি হয়ে যায়। মাঝে সাজে আসতে তো পারিস! বাবার বাড়ির কাউকে দেখলে কি যে শান্তি লাগে!
ফুপুর কান্না দেখে খুব খারাপ লাগলো। নিজেকে অপরাধি মনে হতে লাগলো। তিনি তো আমার কাছে টাকা পয়সা কোন কিছু চান না, শুধু চান মাঝে মাঝে যেন এসে উনাকে দেখে যাই। তাতো আর কঠিন কোন কাজ নয়।
আমি ফুফুকে দাওয়াতের কথা বললাম।
শুনে তিনি খুশি হলেন। কান্না জড়ানো কন্ঠে বললেন, ফুফুরা এখন তোদের আপন কেউ নয়, পর হয়ে গেছি। তা আমরা কি পরের মত প্যন্ডেল থেকে দাওয়াত খেয়ে চলে আসবো, নাকি দুইদিন আগে নাইওর নিয়ে যাবি। ভাইজান বেঁচে থাকলে তো এক সপ্তাহ আগে আমাদেরকে নিয়ে যেতন।
আমি বললাম, তুমি একসপ্তাহ আগে বা যখন মন চায় চলে এসো।
সবাইকে দাওয়াত করে দিন শেষে বাসায় ফিরলাম। মনটা খুবই অশান্ত হয়ে আছে। মনে হচ্ছে বিরাট সমস্যায় পড়তে যাচ্ছি, অনুষ্ঠানের দিন অনেক ঝামেলা হবে।
খাবার মেন্যু নিয়ে বড় দুলাভাই বা মেঝ দুলাভাই ঝামেলা করবেন। যে কোন একজন রাগ করে চলে যাবেন।
যদি গানের ব্যাপেরে ছোট দুলাভাইকে না করি, তাহলে তিনি অপমানিত বোধ করবেন এবং দাওয়াতে আসবেন না।
যদি গানের আয়োজন করি তাহলে চাচা রাগ করবেন এবং বিভিন্ন সময়ে এই নিয়ে কথা শুনাবেন। তাছাড়াও আত্বীয় স্বজনের কাছে আমার অবাধ্যতার কথা বলে বেড়াবেন।
তিন ফুফুকেই দাওয়াত দিয়ে বলে আসছি একসপ্তাহ আগে আসার জন্য। কারন, একজনকে যদি নাইওর আনি এবং বাকি দুজনকে যদি না আনি তাহলে তারা রাগ করে ঝামেলা করতে পারেন। তাছাড়া ফুফুদেরকে নাইওর আনা মানে শুধু খাওয়ালেই হবে না, কিছু জামা কাপড় কিনে দিতে হবে।
আমি সামান্য বেতনে বেসরকারী প্রতিষ্টানে চাকুরী করি। আমার স্বল্প বাজেটের মধ্যে এতকিছু কিভাবে করবো? এছাড়াও আমি ছোট দুই কামরা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি। তিন ফুফু যদি তাদের পরিবার নিয়ে একসপ্তাহ বা দুইদিন আগে চলে আসেন তাহলে আমি এতগুলো লোককে কোথায় রাখবো আর কিভাবে মেহমানদারি করবো? তাছাড়া স্ত্রীও ব্যাপারটাকে কিভাবে নিবে, মেনে নিবে কিনা? অনুষ্ঠান করাটা মনে হচ্ছে বিড়াট চ্যলেঞ্জের বিষয় হয়ে দাড়াচ্ছে।
(চলবে)