আড়ালে ভালোবাসার সংসার

আড়ালে ভালোবাসার সংসার !! Part- 28

বিধান মন্ত্র মুগ্ধের মতো বিথীর পিছন পিছন হাঁটছে আর এক মনে বিথীকে দেখছে। বিথীকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিথী অনেক রেগে আছে কিন্তু বিধান সেই রাগের ধার ধারছে না সে তো আজ খুশিতে পাগল হওয়ার দশায়। বিথী যে তার ভালোবাসা বিন্দু পরিমাণ হলেও বুঝেছে এতেই তার মনের কোণে কোণে ভালোবাসার মুগ্ধকর রঙে রাঙিয়ে গিয়েছে।
বিথী বিধানকে ঘরে এনে ঠাসসস করে দরজা লাগালো এতে বিধান তার মনোমুগ্ধকর ভালোবাসার রঙিন ঘোর
থেকে বের হলো। বিথীর রাগী মুখের দিকে সে অবাক হয়ে তাকালো। বিথী সেদিকে তোয়াক্কা না করে টুস করে আলমারি থেকে সুতি শাড়ি বের করে টাস করে বাথরুমে গিয়ে গেট লাগিয়ে দিলো।
বিধানঃ মিস্টার বিধান চৌধুরী বউ আজ ভালো খেপছে ঝাঁটা দিয়ে মারতে পারে! সাবধান!
বিধান কথাটা জোরে জোরেই বলল যাতে বিথী কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং তার সাথে রেগে হলেও কথা বলে। কিন্তু বিথী বিধানের ভাবনায় এক বালতি পানি ফেলে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখায় না যেনো সে শোনেই নাই।
বিথীঃ নিশ্চুপ!
বিধানঃ ধুররর শালা! আরো বেশি করে রাগ দেখা বউয়ের উপর! এখন কি করবো আল্লাহ! ( মনে মনে)
বিথী বাথরুমে শাওয়ার নিচ্ছে আর বিধানের চৌদ্দ গোষ্ঠীর ষষ্ঠী পূজো দিচ্ছে।
বিথীঃ শালা তুই পাইছোসটা কি আমারে! মারবি, দূরে ঠেলে দিবি আবার আইসা আদর করবি! পুতুল পাইছোসরে উগান্ডার কুত্তা যে যখন যা মন চায় তা করবি……..আমার কোনো ফিলিংস নাই! পানির মতো সরল সোজা পাইছোস তো তাই যখন মন চায় কষ্ট দিয়া বরফ বানায় ফেলস আবার ভালোবাসা দিয়ে গলায় ফেলিস! আর চলবে না এই জুলুম!
বিথী বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখে বিধান খাটের উপর বসে নখ কামড়াচ্ছে আর কিসব ভাবছে। বিধানের চোখ বিথীর দিকে পড়তেই বিথী এমনভাবে তাকে উপেক্ষা করে বারান্দায় চলে গেলো যেনো রুমে সে ছাড়া ঘরে কেউ নেই। বিধান বিথীর পিছু পিছু বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই বিথী এমন ভঙ্গীমায় চুল মুছতে মুছতে গান গেতে লাগলো যেনো সে ছাড়া কেউ নেই।
বিথীঃ ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান,
ফাগুন হাওয়ায় করেছি যে দান,
ও আমার আপন হারা প্রাণ,
আমার বাধন ছাড়া প্রাণ……
বিধানঃ বিথী শুনছো!
বিথীঃ ইস মে তেরা ঘাটা
মেরা কুছ নেহি যাতা
জেয়াদা পেয়ার হো যাতা
তো মে সেহ নেহি পাতা……
বিধানঃ সোনা বউ আমার কথা বলো তো…..
বিথীঃ দেখতে দেখতে বর বর
কিন্তু বড্ড বরবর
ফেঁসে গেছি আমি অকালে……
বিধান বুঝতে পেরেছে বিথী তাকে ইচ্ছে করে উপেক্ষা করছে এবং তার উপর প্রচণ্ড পরিমাণে খেপে আছে। বিধান এখন নিজের কপাল চাপড়াতে বলল,
শুনেছি মেয়েরা রাগ করলে বরের সাথে ঝগড়া করে কিন্তু আমার বউ তো তাদের চেয়েও ফরওয়ার্ড সে গান গেয়ে গেয়ে ইগনোর করে যেনো আমি মিস্টার বাংলাদেশ হয়ে গেছি। (বিরক্তবোধ করে)
বিথীর বিধানের কথায় হাসি পেলেও ঠোঁট চেপে আটকালো।
বিথীঃ দেখ বজ্জাত কেমন মজা দেখাই। (মনে মনে)
,

,,
,
অন্যদিকে ছাদে সবাই নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশা নিরবতা ভেঙে মুখ খুলল।
আশাঃ দেখ নীল তোর উচিত হয়নি বিধানকে এমনভাবে বলার! বিধান বিথীর স্বামী……ওদের বোঝাপড়ায় তোর নাক গলানো বড্ড বেমানান তোকে সেটা বুঝতে হবে।
নীলাভ্রঃ নিশ্চুপ। ( মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে)
আয়ানঃ বউ থাক! রেগো না বেচারা বুঝতে পারেনি বিধান হঠাৎ চর মারায় নীলাভ্র হয়তো বুঝতে পারেনি উচিত অনুচিত
আশাঃ হুম।
নীলাভ্র আর দাঁড়ালো না ছাদের পিছনের দিকে চলে গেলো। তার পিছন পিছন দিপ্তও গেলো তবে যাওয়ার আগে আশাকে কিছুটা শাঁসিয়ে গেলো।
দিপ্তঃ আশাপু তোমার উচিত হয়নি। তুই তো জানিস বিথীকে নীল ভাই কতটা ভালোবাসে
ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট পেতে দেখলে এমন আচারণ করা অস্বাভাবিক কিছুই নয়! ( ক্ষুব্ধ হয়ে)
আশাঃ দেখ ছোট ছোটর মতো থাক! বেশি বুঝতে আসিস না। বিথীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে নীলের সেটা বুঝতে হবে……….পিছুটান রেখে অন্য আরেক মানুষের রঙে তাকে রঙিন হতে হবেই।
দিপ্তঃ কিন্তু তুমি এভাবে না বলে বুঝিয়েও বলতে পারতে। অবশ্য বলবেই বা কি করে তুমি কি বুঝবে মন ভাঙার কষ্ট তাহলে তো আর আনিফ ভাইকে ছাড়তে না! ( তাচ্ছিল্য করে)
আশাঃ দিপ্ত!
আয়ানঃ উফফফ! তোমরা আবার শুরু হয়ে যেয়ো না। দিপ্ত তুই নীলকে দেখ আর আরিশা তুমি বিথীকে নিয়ে আসো বুঝিয়ে।
আয়ানের কথায় আরিশা আয়াশাকে নিয়ে নিচে চলে গেলো…… দীপ্তও চলে গেলো নীলাভ্রের কাছে। আর আশা ছাদের রেলিং ঠেসে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগলো। আয়ান পাশে এসে দাঁড়াতেই আয়ানের বুকে মাথা এলিয়ে দিলো।
আশাঃ আয়ান আমি সত্যিই কি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম? আনিফের সাথে তো আম্মু-আব্বুই এঙ্গেজমেন্ট করিয়ে ছিলো কারণ তখনও বুঝে উঠতে পারি না তোমার প্রতি থাকা ‘আড়ালে ভালোবাসা’। কিন্তু এঙ্গেজমেন্টের পর তুমি যখন আমাকে উপেক্ষা করতে তখন কেমন জানি খালি খালি লাগতো এই বুকটায়। আমি তো চেয়েছি তিনটা জীবনকে বাঁচাতে।
আয়ানঃ হুমম সোনা! তুমি কি জানতে আনিফ তোমাকে ভালোবাসে তোমাদের তো সাধারণ এরেঞ্জমেরেজ ছিলো।
আশাঃ হুমম!
আয়ান আশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, পূর্ণতা পাক আড়ালে ভালোবাসাগুলো।
আশাও আয়ানের হাতের বাধনে পরম শান্তিতে আবদ্ধ হয়ে থাকলো যেনো এটাই তার জান্নাত।
,
,
,
দিপ্ত নীলাভ্রের কাছে যেয়ে দেখলো নীলাভ্র ফোনে কি জানি। হলুদ লাইটের আলোয় বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে সে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে। একটু কাছে যেয়ে দেখলো বিথীর দুই বছর আগের ছবি। আশাপুর হলুদে প্রথম শাড়ি পরিহিতা বিথীর শাড়ি সামলাতে চোখে-মুখে থাকা বিরক্তি বেশ ভালোই প্রকাশ পাচ্ছে ছবিতে। নীলাভ্র পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ফোনের স্ক্রিন অফ করে দিলো।
নীলাভ্রঃ কিরে তুই এখানে? (মলিন হেসে)
দিপ্তঃ ফোনটা অফ করে দিলেই কি সব লুকানো যায়!
নীলাভ্রঃ আমি আবার কি লুকাবো?
দিপ্তঃ তোর আড়ালের ভালোবাসাকে। বড্ড কষ্ট হয় না তোর বিধান-বিথীকে একসাথে দেখে?
নীলাভ্র দিপ্তের বয়সে বড় হলেও বেস্টফ্রেন্ডের মতোই তাই কখনো কখনো তুই বলেও ডাকে। বিশেষ করে যখন বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে যায়।
নীলাভ্রঃ নাহ কি যে বলিস! ( মুখ ঘুরিয়ে)
দিপ্তঃ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে একই কথা বলতে পারবি। ( তীক্ষ্ণা দৃষ্টিতে তাকিয়ে)
নীলাভ্রঃ দিপ্ত বড্ড কষ্ট হয়রে যখন বিথীকে বিধানের কাছে দেখি। যখন বিথীর উপর বিধান অধিকার দেখায় এই খানটায় না ছুড়ি লাগে বারংবার! ( নিজের বুকটা দেখিয়ে)
দিপ্তঃ কিভাবে সহ্য করবিরে এতো কষ্ট! বিথীকে ভুলে আবার নতুন করে শুরু কর না জীবনটা। ( দিপ্তও কেঁদে জড়িয়ে ধরে নীলকে। কারণ নীলের অশ্রুঝরা চোখ দেখে যে তারও বড্ড পুড়ছে ভিতরটা কারণ নীলের আড়ালে ভালোবাসার সাক্ষী দিপ্ত)
নীলাভ্রঃ এই আড়ালে ভালোবাসা মনগুলো না বড্ড একরোখারে একবার কারো প্রতি অন্যকাউকে মেনে নিতেই চায় না! ( কথাটা বলতে বলতেই চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো)
দিপ্তঃ দেখিস ভাই তোর জীবনেও একজন পরী আসবে যে তোকে নিজের রঙে রাঙিয়ে দিবে! তোর আড়ালের ভালোবাসা পূর্ণতা পায়নি তো কি হয়েছে তার ভালোবাসাকে সে পূর্ণতা দিবেই।
নীলাভ্র দিপ্তের কথাই মুচকি হাসলো। আর মনে মনে বলল, ‘দিপ্ত তুই বড্ড বোকা ভালোবাসা যে একবারই হয় বাকিগুলো তো মায়ার বন্ধন। মায়ায় আবদ্ধ হতে পারলেও ভালো তো আর বাসতে পারবো নারে’
দিপ্ত নীলাভ্রকে নিয়ে ছাদের সামনের পাশে গেলো। ততক্ষণে আশাও আয়ানের সহযোগিতায় নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেলেছে।
(বিঃদ্রঃ মানুষ ভাবতে পারে সত্য ভালোবাসাগুলো পূর্ণতা পায় সবসময়। কিন্তু তা নয় কিছু ভালোবাসা অন্য ভালোবাসার কাছে উপেক্ষিত হয়ে থেকে যায় এক অশ্রুসিক্ত ও বেদনাদায়ক স্মৃতি হয়ে। সব আড়ালা ভালবাস ও আড়ালে ভালোবাসার সংসারগুলো থেকে যায় অপূর্ণ। একই বাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মধ্যেই কেউ পেয়েছে পূর্ণতা আবার কেউ নিজেকে অপূর্ণতার বেড়াজালেই গ্রাস করছে)
,
,
,
অন্যদিকে বিধান এতোক্ষণ ধরে বিথীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু বিথী প্রতিটি প্রচেষ্টায় নিজ হাতে পানি ঢেলে দিচ্ছে। এবার বিধান অন্য পন্থা গ্রহণ করলো।
বিধানঃ বউ তোমার পেটের তিলটা কিন্তু সেই লাগছে দেখতে!
বিথী তাড়াতাড়ি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো খাট ঝাড়তে ঝাড়তে শাড়ি কখন যেনো পেট থেকে সরে গেছে। আর বিধান পেটের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে আছে। বিথী তাড়াতাড়ি শাড়ি ঠিক করে নিলো।
বিথীঃ কেউ যেনো বেশি ছেঁচরামি করার আগে হাতের ঝাড়ুটা দেখে! (রেগে লাল হয়ে)
বিধানঃ (ওরে সোনাপাখি জানতাম তুমি কথা বলবেই এই কথায়- মনে মনে) আরে বাবু তুমি পেট ঢাকলে কেনো আমরা আমরাই তো! তাইনা? ( চোখ টিপ দিয়ে)
বিথীঃ ধুররর! এই আপনি এতো নির্লজ্জ কেন বলেন তো? ( লজ্জা ও রাগ মিশ্রিত মুখে)
বিধামঃ আমার বউ এমন চেরির মতো দেখে! ( ঠোঁট কামড়ে)
বিথীঃ ধুরর! আপনার সাথে কথা বলাই বেকার।
বিধানঃ তাই বুঝি এতক্ষণ কথা না বলার বৃথা চেষ্টা করছিলে? ( দুষ্টু হেসে)
বিথী এবার বুঝতে পারে বিধান তার অভিমানের বরফকে লজ্জার উষ্মতায় গলিয়ে পানি পানি করে ফেলেছে।
বিথীঃ শয়তান ছেলে! কথা বলবি না আমার সাথে কথায় কথায় বকিস-মারিস আবার আদর দেখাতে আসিস! পুতুল পাইছোস! ( রেগে)
বিধান বিথীকে কোলে নিয়ে সোফায় বসে। বিথীর চুলগুলোকে একপাশে রেখে বিথীর নগ্ন পিঠে আলতো করে চুমু খেয়ে বিথীর চুলে নাক ডুবিয়ে দেয়। বিথী এতে কেপে উঠে ভালোবাসার ঘোরে ডুবে যায়
বিধানঃ জান তুমি তো জানো আমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারি না। তোমাকে পড়ে যেতো দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম………মনে হচ্ছিলো এই বুঝি হারিয়ে ফেললাম তোমায়। তাই বকাবকি করে ফেলছি। কি করবো বড্ড ভালোবাসি যে।
বিথীঃ এতো ভালোবাসেন আমায়! ( ঘোরে)
বিধানঃ হুমমমম!
বিথীঃ আমিও বড্ড……

চলবে,,,,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *