আলোছায়া

আলোছায়া !! Part- 21

সকালের তীব্র রোদের ঝলকানি চোখমুখে এসে লাগায় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো উল্লাসীর। মোচড়ে উঠে সে ওপর পাশ ফিরতেই চারপাশ থেকে আসা খিচুড়ির ঘ্রাণ নাকে এসে লাগায় পেটের ভেতরটা পাক দিয়ে উঠলো। ইচ্ছে হলো তার সকল কারবার চুকিয়ে দ্রুত এক থালা খিচুড়ি নিয়ে বসার। তবে গতদিনের কথা স্মরণ হতেই নিজেকে গুটিয়ে নিল উল্লাসী। আড়মোড়া ভেঙে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হাই তুলে বিছানা ছাড়ার পায়তারা করতেই বুকের ভেতরটা উঠলো ধুকপুক করে।
উশখুশ মনে মেসবাহর ফোন ঘেটে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো উল্লাসী। জাভেদ স্যার তবে এখনো কিছু পাঠায়নি মেসবাহর ফোনে। কিন্তু পরবর্তীতেও যে পাঠাবে না তেমনটিও নয়। তাছাড়া লোকটি যতটা জঘন্য, তাতে প্যাচ লাগিয়ে বিষয়টিকে এক থেকে দশে নেয়া তার পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। আর তার সঙ্গে মেসবাহর যা নিয়ে মন কষাকষি চলছে তাতে এর মাঝে জাভেদের সাথে তার কথা বলার বিষয়টি নিশ্চয় মেসবাহ ভালো চোখে দেখবে না। যেমনটি সেও দেখতে পারছেনা ইভানার ব্যাপারটি। সেক্ষেত্রে মেসবাহর চোখে তাকে চরিত্রহীনা হতে দু’দন্ডও লাগবে না। ভেবে ঢোক গিললো উল্লাসী। ওয়াশরুম থেকে মেসবাহর বেরুনোর আওয়াজ পেয়ে ফোন রেখে মৈত্রীর দিকে এগুতে এগুতে মনকে শক্ত করলো সে। যা হবার হবে, জাভেদ যা করার করবে। তার তো উদ্দেশ্য বাজে ছিল না, সে তো পরপুরুষে আসক্ত হয়ে তার স্বামীর গায়ে হাত তোলেনি৷ বরং লোকটির সাথে যতক্ষণ তার কথা হয়েছে তার স্বামীকে নিয়েই হয়েছে। তবে কেনো ওসব ভেবে বারবার ঘাবড়ে পড়ছে সে?
ঘাড় শক্ত করে মেয়ের পাশে এসে বসলো উল্লাসী। তার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে ডেকে উঠতেই মৈত্রী ধুপ করে উঠে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
“গুড মর্নিং মা…”
ভ্রু কোঁচকালো উল্লাসী।
“তুই জাগা ছিলি?”
“হ্যাঁ.. আমি জেগে জেগে দেখছিলাম তুমি বাবার ফোন চেক করছিলে না?”
মাথা মুছতে মুছতে মৈত্রীর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। উল্লাসীর সন্দেহবাতিক নিয়ে তার কাছে নেই কোনো চিকিৎসা। থাকলে খুব দ্রুত একটি ডোস দিয়ে দেয়া যেত!
উল্লাসীর কথা বিবেচনায় রেখেই সকালের নাস্তায় খিচুড়ি করার নির্দেশনা দিয়েছিল মেসবাহ। তবে উল্লাসীর ফোন ঘাটার বিষয়টি চরমভাবে মন মেজাজ খারাপ করায় চুপচাপ খাবার টেবিলে বসে পড়লো সে। থালায় ধোঁয়া উঠা খিচুড়ি নিয়ে ঠান্ডা করার চেষ্টায় চামচ দিয়ে নাড়তে শুরু করলো। সিকান্দার মির্জা গতকাল তার উদ্দেশ্যে যা বলে গেছেন তা যুক্তিযুক্ত। তবে বিপরীতে যে তর্ক করার মতো যুক্তি নেই তেমন নয়। উল্লাসী বিশ বছরের একজন বিবাহিতা মেয়ে। যার আশপাশটা চেনাজানার জন্য তার স্বামী যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা করে দিলেও উল্লাসী নিজ থেকে সেসব সুযোগ নিতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি। তবে উল্লাসীর সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশে তার স্বামীর দোষটা কোথায়?
“বাবা.. মা বলেছে আজ থেকে মা আমাকে আনতে যাবে।”
ডাইনিংয়ে মৈত্রী এবং উল্লাসীর প্রবেশে বুকভর্তি জমানো দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো মেসবাহ। মেয়ের দিকে চেয়ে ম্লান হেসে খিচুড়ি মুখে তুলে বললো,
“ঠিকাছে যাবে..”
“আর রশ্নির মাকেও আচ্ছামতো…”
মৈত্রীর কথা শেষ না হতেই তার মুখ ঠেসে ধরলো উল্লাসী। মেয়েটি বয়সের তুলনায় বেশি পকপক করে। নয়তো তার ফোন ঘাটার ব্যাপারটি মেসবাহর সামনে বলার কোনো প্রয়োজন ছিল কি? ভ্রু কুঁচকে বেশ বিরক্ত ভঙ্গিতে মৈত্রীর খাবার বাটিতে ঢেলে তার মুখে পুড়ে দিতেই ওপাশ থেকে মেসবাহ বললো,
“তোমার স্কুলে যাবার কোনো দরকার নেই।”
“আপনি কে আমাকে নিষেধ করার? আমি অবশ্যই যাবো..”
তাতিয়ে উঠলো উল্লাসী।
মেসবাহ শীতল কন্ঠে বললো,
“তুমি যাবে না। যখন প্রয়োজন ছিল তখন যখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়েছো তাহলে এখন যখন এক্সাম দরজার সামনে তখন নিশ্চয় পড়াশোনা হেলাফেলায় ফেলে রাখা উচিৎ নয়। তুমি যাবে না.. আর না রশ্নির মা’য়ের সঙ্গে কোনো রকমের বাজে কথা বলবে। সবাই ইভানা নয় যে তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে!”
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো মেসবাহ। উল্লাসীর কথা উপেক্ষা করে মেয়েকে নিচে নামার নির্দেশ দিয়ে সে হন্য পায়ে এগুলো সদর দরজার দিকে। তাদের সম্পর্কটি দিনকে দিন জটিল হয়ে পড়ছে.. বেশ জটিল!
মৈত্রীকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে হাসপাতালে ঢুকতে না ঢুকতেই চেম্বারে ইভানাকে দেখে বেশ অবাক হলো মেসবাহ। হাতের ব্রিফকেসটি রেখে কপাল কুঁচকে সে চেয়ারে বসতেই মৃদু হাসলো ইভানা।
“রেগুলার চেকঅাপের জন্য এলাম.. ভয় পাস না।”
“ভয় কেনো পাবো? তুই বাঘ, ভাল্লুক না সিংহ? আর বাঘ হলেই বা কী! যে বাঘের সাথে সংসার করেও এখনও বেঁচে আছি তাকে বাঘ সিংহের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।”
“পিচ্চি মেয়েটাকে বাঘ বানিয়ে দিলি?”
“যদি বলিস সিংহ বানিয়ে দেই! তা এত সকালে ঘুম ছাড়লো তোর?”
“ছাড়লো আর কই? চা দিতে বল..”
রফিক মিঞাকে ডেকে দু’কাপ চা দিতে বলে ইভানার দিকে ভালোভাবে তাকালো মেসবাহ। মেয়েটির গলার নিচে স্কার্ফে ঢাকা থাকলেও হাতের ব্যান্ডেজটি বদলে ফেলেছে সে। চেহারার মলিনতাও কেটে সেখানে প্রবেশ করেছে একরাশ আরামপ্রদতা।
“তোর মনে আছে কাল লিমনের বার্থডে?”
উৎসুকভাব নিয়ে ইভানা প্রশ্নটি করতেই ঘাড় নাড়ালো মেসবাহ।
“মনেই ছিল না..”
“জানতাম.. আমি এজন্যই এসেছি। ভাবলাম এবার তিনজন যেহেতু একসাথে আছিই তাহলে চল না ভালোভাবে সেলিব্রেট করি দিনটাকে।”
“বলছিস?”
উদ্বিগ্ন স্বরে বললো মেসবাহ।
উত্তরে ভ্রু কোঁচকালো ইভানা।
“বলছি মানে? তুই কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?”
“না..”
“তবে?”
এরইমাঝে চা এসে পড়ায় কাপ হাতে নিল ইভানা। খুব ধীরে ধোঁয়া উঠা চায়ে ফুঁ দিয়ে বললো,
“আমরা কিন্তু আমাদের প্লানে লিমনের ওয়াইফ, তোর ওয়াইফ সবাইকেই ইনক্লুড করতে পারি।”
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মেসবাহ বললো,
“দরকার নেই। উল্লাসী এসব বুঝবে না। বাজে রিয়েক্ট করে দেখবি দিনটাই নষ্ট করে দিচ্ছে। এর চেয়ে আমরা বরং অপর্না ভাবিকে এড করি।”
“কিছু হয়েছে কি উল্লাসীর সাথে?”
“না.. তুই একটু ওয়েট কর। আমি ভাবিকে কল করি।”
ইভানার সাথে তার সম্পর্কটি উল্লাসীর কাছে পরিষ্কার না হওয়া অব্দি আবারও দুজনকে একসাথে হতে দেয়ার প্রশ্নই উঠেনা। ভেবে ফোন হাতে নিয়ে অপর্নার নাম্বারে ডায়েল করলো মেসবাহ।
দুপুরের রোদে রাস্তায় যেখানে মানুষের উপস্থিতি মেলা বেশ কঠিন তখনই খাবার নিয়ে মুবিনের ব্যাংকের উদ্দেশ্যে বেরুলো পুষ্প। তবে ব্যাংকে মুবিনের অস্তিত্ব মিললো না কোথাও। রিসিপশনের এক মেয়ের কাছে মুবিনের অনুপস্থিতির বিষয়টি জানতে পেরে বেশ হতাশ হলো সে। লোকটি ফোন ধরছেনা, না করছে তার ম্যাসেজের কোনো রেসপন্স। লোকটি কি অসুস্থ? নাকি কোনো বিপদে পড়েছে? বুকের ভেতরটায় কু ডাকায় মুবিনের বাসায় যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দুঃসাধ্য বস্তুর মতো পেয়ে গেল তার দেখা।
“তুমি কেনো এখানে?”
চোখমুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে মুবিন প্রশ্নটি করতেই যেন জান ফিরে পেল পুষ্প। আশেপাশের লোকজনের উপস্থিতি ভুলে সে মুবিনের গালে স্পর্শ করে বললো,
“কোথায় ছিলেন? কিছু হয়েছে কি আপনার?”
সেপ্রশ্নের জবাব না দিয়ে পুষ্পর হাতের লাগানো ব্যান্ডেজের দিকে তাকালো মুবিন।
“হাতে কী হয়েছে?”
“পুড়ে গেছে.. আপনি কোথায় থেকে এলেন? আপনি কি দুপুরের খাবার খেয়ে এসেছেন?”
চমককে হাসপাতালে ভর্তি করার পর চৈতালিকে জোর করে সাথে নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে বেরুলেও পুষ্পর হাতের টিফিন বক্স দেখে তা চেপে গেল মুবিন। মাথা নেড়ে সে বললো,
“না.. এসো। পাশের রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি।”
পুষ্পর সম্মুখে বসে গম্ভীরমুখে মুবিন তাকালো তার চোখের নিচে পড়া কালচে দাগের দিকে। মেয়েটিকে কি খুব বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলছে সে?
“আপনি প্রচুর ঘেমে যাচ্ছেন.. একটু শান্ত হয়ে বসুন।”
পুষ্পর কথায় চিন্তারাজ্য ছেড়ে বেরিয়ে সোজা হয়ে বসলো মুবিন। শার্টের উপরের বোতামটি খুলে দিয়ে পুষ্পর হাতের দিকে নজর দিয়ে বললো,
“হাত কীভাবে পুড়লো?”
“তেল লেগে.. বেশি লাগেনি। অল্প সামান্য লেগেছে।”
“বেশি না কম তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তাছাড়া আমার জন্য তোমার খাবার করতে যেতে হবেই বা কেনো? খালা কি আমার জন্য রান্না করে যায় না? আমি কি না খেয়ে থাকি?”
মুবিনের হঠাৎ এমন রূপ দেখে হতবাক হলো পুষ্প। ঢোক চেপে সে মেঝের দিকে চেয়ে ভারী গলায় বললো,
“আপনি কি কোনো কারণে আমার উপর রেগে আছেন? আমি কি কিছু ভুল করেছি? কাল আপনার ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করানোর কথা থাকলেও শেষমুহুর্তে এসে না করে দিলেন। তারপর থেকে ফোন বন্ধ.. খোলা থাকলেও আমার ফোন পিক করেছিলেন না।”
নড়েচড়ে বসে শার্টের বোতাম লাগিয়ে নিল মুবিন। চৈতালির বিষয়টি বলার জন্য মুখ খুলেও সাহসে পেরে উঠলো না তার মন।
“স্যরি, আমার ব্যবহারে কষ্ট পেলে আমি দুঃখিত। আসলে আমি… আমি খুব প্রেশারে আছি পুষ্প।”
“কী সমস্যা? খুব ব্যক্তিগত না হলে শেয়ার করুন। দেখবেন হালকা লাগবে!”
“আমার খুব কাছের এক বন্ধুর ছেলের ডেঙ্গু হয়েছে। ওকে হাসপাতালে এডমিট করেই আমি এখানে এলাম। আমি আসলে..”
এলোমেলো সুরে মুবিন কথাগুলো বলতেই তার হাত আলতো করে চেপে ধরলো পুষ্প। তাকে আস্বস্ত করার চেষ্টায় বললো,
“চাপ নেবেন না.. আপনি চাপ নিলেই কি বাচ্চাটা সুস্থ হয়ে যাবে? আপনি বরং পারলে অফিস থেকে দুদিনের জন্য ছুটি নিন। আপনার বন্ধুর পাশে থাকুন। সেইসাথে নিজের মাইন্ডকেও রিফ্রেশ করুন। আপনি অসুস্থ হয়ে পড়লে আপনাকে দেখবে কে? আর ওই বাচ্চাটি? আপনার বন্ধু? তাদেরই বা সাহস দেবে কে?”
“হু..”
পরিস্থিতি ক্রমশ ভারী হয়ে পড়ায় মুবিনের হাত ছেড়ে নিজের কপালে নিজে চাপড়ালো পুষ্প। তারপর ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
“আমিও না! নিজেই আপনার এড়িয়ে যাওয়া সহ্য করতে না পারায় অস্থির হয়ে পড়েছিলাম.. যেখানে মানসিক চাপ একদমই নিতে পারিনা আমি যেখানে সেই আমিই দিচ্ছি আপনাকে পরামর্শ। হাস্যকর না?”
ঢোক গিললো মুবিন। প্রসঙ্গ বদলাতে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে নড়েচড়ে বসে বললো,
“কী খাবে বলো?”
টিফিন বক্স মুবিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে পুষ্প বললো,
“আপনার প্রিয় কাঠালের তরকারি। জানেন ভাবিও জানতো না এর রেসিপি। পরে ইউটিউব ঘেটেঘুটে তারপর করেছি। প্রথমবারের ভালো না হওয়ায় ভাইয়া ভাবিকে বলেছি এটা তোমাদের। তারপর আমি দ্বিতীয়বার করেছি আপনার জন্য। টেস্ট করে বলুন কেমন হয়েছে”
বুকের ভেতরটায় কামড়ে উঠলেও ঠোঁটে হাসির রেখা ফোটালো মুবিন। বক্সের ঢাকনা খুলে তরকারির সামান্য অংশ মুখে তুলে মাথা নেড়ে পুষ্পর দিকে তাকাতেই আবারও তার সেই ভুবন ভোলানো হাসি দিল সে। মেয়েটি যখন সবটা জানতে পারবে তখন কি এভাবেই মন খুলে হাসতে পারবে সে?
(চলবে)