আলোছায়া

আলোছায়া !! Part- 13

পড়ন্ত বিকেলে এক ফালি আলোক রেখা শরীরে পড়ায় বেশ শান্তি অনুভব হলো সিকান্দার মির্জার। হাতে থাকা পত্রিকা টেবিলে রেখে তিনি হাত বাড়ালেন চায়ের কাপের দিকে। একটি কাক আর্তস্বরে চিৎকার করে যাচ্ছে। পাশের আমগাছের একটি মরা ডালে বসে চুপসে রয়েছে তার হৃষ্টপুষ্ট শরীর। সেদিকে চেয়ে বেশ ব্যথিত মনে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন তিনি। সন্ধ্যায় সুহার জন্য ডাক্তারের কাছে এপয়েন্টমেন্ট নেয়া হয়েছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আজকালের মাঝেই অপারেশনের জন্য একটা ডেইটও দিয়ে দেবে। তবে মাঝে এসে বাধ সাধলো উল্লাসী। তার সমস্যার বিহিত না করে সুহাকে নিয়ে ভাবা কতটা যৌক্তিক হবে তা ভেবে চিন্তিত মুখে তিনি মরা ডালটি থেকে নজর সরিয়ে নিতেই চিলেকোঠার ঘর পেড়িয়ে ছাদে প্রবেশ করলো উল্লাসী। চোখমুখে একরাশ হতাশা নিয়ে সে সিকান্দার মির্জার সম্মুখে বসতেই গলা খাঁকরে উঠলেন তিনি।
“তুমি রাগারাগি করে এসেছো?”
সিকান্দার মির্জার প্রশ্নে নড়েচড়ে বসে ওড়নায় আঙ্গুল প্যাচানো শুরু করলো উল্লাসী। বুকের ভেতরটা কাঁপছে তার। নানাজানের গলার স্বর মোটেও সুবিধার লাগছে না।
“কী হলো? তুমি রাগারাগি করে এখানে এসেছো?”
“না.. উনি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন।”
“বের করে দেবার কারণ?”
“আমি কিছুই করিনি।”
কপাল কোঁচকালেন সিকান্দার মির্জা। গলার স্বরের রুক্ষতা আরও খানিকটা এনে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“আমি মেসবাহকে কল দিলেই কিন্তু সবটা বেরিয়ে আসবে উল্লাসী। তুমি চাইছো আমি তোমাকে অবিশ্বাস করে মেসবাহকে কল করি?”
ঘাড় নাড়ালো উল্লাসী। মেঝের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
“আমি কোচিংয়ে সবাইকে বলেছিলাম আমি অবিবাহিত।”
“আর?”
“আর উনি আমার দুঃসম্পর্কের ভাই। তবে নানাজান আমি আমার কাজের জন্য ক্ষমাও চেয়েছি। কিন্তু উনি আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে, আমার বেড়ে উঠা নিয়ে অনেক কথা শুনিয়েছে।”
“কী কথা শুনিয়েছে?”
“আমি নাকি অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে এসেছি। উনি না থাকলে আমি আজ কখনোই এই অবস্থানে আসতে পারতাম না। নানাজান, আপনিই বলুন উনি কি এটা বলার অধিকার রাখে?”
“কেনো রাখবে না? তাছাড়া মেসবাহ ভুল কি বলেছে? তুমি কি তোমার অতীত ভুলে গেছো? মেমোরি লস হয়েছে তোমার?”
সিকান্দার মির্জার প্রশ্নে অবাক চোখে উল্লাসী তাকালো তার দিকে। নানাজানের মনে হচ্ছে উনি ভুল কিছু বলেননি? অথচ উনি যে কতটা ছোট মনমানসিকতার কথা বলে ফেলেছে সেদিকে তার দৃষ্টিই নেই!
“আই ট্রাস্ট মেসবাহ অভার ইউ.. তাছাড়া আমি মনে করি তোমার এখন ফিরে যাওয়া উচিৎ। গাড়ি এখনো নিচে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের স্থানে ফিরে যাও।”
ফুঁপিয়ে উঠলো উল্লাসী।
“উনি আমায় বের করে দিয়েছে নানাজান!”
“আর তুমি খুব ভালো কাজ করেছো? আমি আগেও বলেছি আমি খুব বাস্তববাদী একজন মানুষ। আমার চিন্তাধারা, কাজ সবটাই বাস্তবতাকে ঘিরে। আমার লোক চিনতে বেশি একটা সময় লাগেনা। মেসবাহকে আমি চিনি জানি..”
শেষ বারের মতো চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাপ টেবিলে নামিয়ে রাখলেন সিকান্দার মির্জা। জলভর্তি চোখে তার দিকে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে তাকিয়ে থাকা উল্লাসীর দিকে চেয়ে গলার স্বর কোমল করলেন তিনি।
“খুব সহজেই তো আজকের এই জায়গায় আসিনি আমি। দুনিয়াদারী দেখে, মানুষকে চিনে তবেই আমি আজ এই অবস্থানে এসেছি। আর তুমিও এখন আর দুধের বাচ্চা নও উল্লাসী। তোমার মাথায় রাখতে হবে তোমার উপর অনেক দায়দায়িত্ব রয়েছে।”
“নানাজান আপনার কি মনে হয় আমি আমার দায়দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করিনা?”
উল্লাসীর পাল্টা প্রশ্নে একমুহূর্ত ভেবে সিকান্দার মির্জা বললেন,
“অবশ্যই করো।”
“কিন্তু উনার তা মনে হয়না। উনি আমায় স্বাধীন ভাবে চলতে দেয়না নানাজান।”
“স্বাধীনতা লাগবেই বা কেনো? স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করে খাচ্ছো.. খাও। বাস্তবতা বড়ই নির্মম। সেদিকে চোখ বুলাও উল্লাসী।”
গাল বেয়ে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি পড়তেই তা মুছে নিল উল্লাসী। বুঝে আসছে না তার। নানাজান এমন ধরনের কথা কীভাবে বলতে পারলেন?
“একজন মানুষ কতোটা অবুঝ হলে এতো সুখ শান্তির পরও স্বাধীনতা খোঁজে উল্লাসী? তাছাড়া আমার জানামতে মেসবাহ তোমায় যথেষ্ট স্বাধীনতা দেয়। যা তুমি অন্য আর দশটা বিবাহিত মেয়ের ক্ষেত্রে খুঁজে পাবে কিনা তাতেও বেশ সন্দেহ রয়েছে!”
বললেন সিকান্দার মির্জা।
জবাবে অস্থিরতা নিয়ে উল্লাসী বললো,
“আপনি আমার কষ্টটা বুঝতে পারছেন না। আমি ওখানে যাবোনা নানাজান।”
“দেন গেট আউট ফ্রম মাই হাউজ। তুমি ইতিমধ্যে আমাকে যথেষ্ট হতাশ করে ফেলেছো। না তোমার মাঝে মেয়ের জন্য কোনো কষ্ট দেখতে পাচ্ছি আর না নিজের কাজ নিয়ে অনুতাপ!”
বিরক্ত মুখে সিকান্দার মির্জা উঠে দাঁড়াতেই আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো উল্লাসী।
“আমার মৈত্রীর জন্য কষ্ট হচ্ছে।”
“তবে দ্রুত বাড়ি ফিরে যাও। আমি কাল সকালে গিয়ে মেসবাহর সাথে কথা বলে আসবো।”
“তাহলে আমিও কাল যাই।”
“আর মৈত্রী? মেয়েটা একটা রাত মা ছাড়া কাটাবে? তুমি কী করে ভুলে যাচ্ছো তুমি তোমার মার মতো এখনো পরলোকগমন করোনি। জীবিত রয়েছো..”
ঢোক চেপে আবারও চোখ মুছলো উল্লাসী। বুকের ভেতরে চলা সকল কষ্ট চেপে স্বাভাবিক সুরে বললো,
“ঠিকাছে.. আপনি যখন চাইছেন আমি উনার সামনে ছোট হয় তখন আমি ফিরে যাবো।”
বাংলাদেশে দিন দুয়েক হলো ফিরলেও শরীর খানিকটা ঝিমিয়ে পড়ায় বাড়িতেই বিশ্রামে ছিল ইভানা। তবে সময়ের সাথেসাথে শরীর সুস্থ হয়ে উঠায় সন্ধ্যায় বেড়িয়ে পড়লো সে মেসবাহর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে। শুক্রবার এসময় মেসবাহর বাড়িতেই থাকার কথা। সাথে উল্লাসী আর ওদের মেয়েটাকেও দেখা হয়ে যাবে। সব ভেবে উৎফুল্ল মনে ইভানা বাসা থেকে বেরুলেও মেসবাহর ফ্ল্যাটের দরজা খোলা পেয়ে খানিকটা অবাক হলো। কপাল কুঁচকে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে সে উল্লাসীকে ডেকে উঠলেও আশপাশ থেকে এল না কোনো সাড়াশব্দ।
দাঁড়িয়ে পড়লো ইভানা। রান্নাঘরের দিকে চেয়ে আবারও উল্লাসীকে ডেকে উঠতেই শোবার ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ এল এক বাচ্চার৷ মৈত্রীর আওয়াজ নয়তো? সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠে সেদিকে পা বাড়িয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই আঁতকে উঠলো ইভানা। নজরে এল তার মোটাসোটা করে এক মহিলা একটা মগের সাহায্যে পানি ঢেলে যাচ্ছে মেসবাহর মাথায়।
“হোয়াট হ্যাপেন? কী হয়েছে ওর? এই মেসবাহ?”
দৌড়ে ইভানা বিছানার দিকে এগুতেই কপাল কোঁচকালেন মুন্নি সরকার। হাতের মগ রেখে তিনি তীক্ষ্ণ সুরে বললো,
“তুমি?”
“ইভানা.. ওর ফ্রেন্ড। কী হয়েছে ওর?”
“জানি না.. হাসান তো গেলো ডাক্তার ডাকতে। ডাক্তার না আসলে কী করে বলি!”
আবারও বালতি থেকে পানি উঠানোর জন্য হাত বাড়ালেন মুন্নি সরকার। বিরক্ত সুরে মেসবাহর মাথা হাতড়াতে হাতড়াতে বললেন,
“উল্লাসীটাও না! মেয়েটার জন্য কোথাও শান্তি নেই। এই মৈত্রী পানিতে হাত দিচ্ছিস কেন বারবার? ওকে ধরো তো।”
উদ্বিগ্ন মুখে মৈত্রীর দিকে তাকালেও সাথেসাথেই নজর সরিয়ে নিল ইভানা। অশান্ত গলায় মুন্নি সরকারের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি ওকে ধরুন। আমাকে দেখতে দিন। দেখি সরুন।”
মেসবাহর কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা বুঝতে ব্যর্থ হওয়ায় তার বুকে পরম যত্নে হাত রাখলো ইভানা। গলায় ব্যাকুলতা ফুটিয়ে বললো,
“কী হয়েছে তোর? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?”
পাশ থেকে চোখমুখ কুঁচকে মুন্নি সরকার বললেন,
“প্রেশার বেড়েছে বোধহয়? রাগারাগি করে উল্লাসী বেরিয়ে গেছে না!”
“কোথায় বেরিয়ে গেছে? হাউ ইরিসপন্সিবল সি ইজ! আচ্ছা ওর ব্যাগটা কোথায় বলতে পারবেন? বা স্ফিগমোম্যানোমিটার?”
জবাবে মেসবাহ হাতের ইশারা করতেই সেদিকে দৌড়ে এগুলো ইভানা। বুকের ভেতরটা তার ক্রমাগত কেঁপে যাচ্ছে। মন উঠছে কেঁদেকেঁদে। এই পৃথিবীতে নানান ধরনের কষ্ট রয়েছে। তাদের মাঝে ভয়ানক এক কষ্ট হচ্ছে ভালোবাসার মানুষটির পাওয়া পীড়া। যে পীড়া শুধু দেখে যেতে হয়, সহ্য করে যেতে হয়। তবে কখনোই নিজের মাঝে ধারণ করা যায় না।
(চলবে)