আলোছায়া !! Part- 10
সন্ধ্যায় আকাশের রঙ বদলায় নানান ভঙ্গিমায়। কখনো কখনো সূর্য অস্ত হবার সাথেসাথে আকাশে ভেসে উঠে জ্বলজ্বল করা রশ্নিচিহ্ন আবার কখনোবা ঘন আঁধারে ছেয়ে যায় চারিদিক। মাগরিবের নামাজ শেষে মৈত্রীকে নিয়ে ছাদে উঠে মুন্নি সরকার সেই দৃশ্য প্রত্যহ অবলোকন করলেও হঠাৎ আসা ফোন কলে আজ সে কাজে ব্যাঘাত ঘটলো। জায়নামাজ ছেড়ে উঠে ফোন রিসিভ করে সে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল এক মেয়েলী কণ্ঠস্বর।
“ভালো আছেন? শরীর ভালো তো আপনার?”
ভ্রু কোঁচকালেন মুন্নি সরকার।
“ঠিক আছি.. কে আপনি?”
“আপনি আমায় চিনবেন না। আমি পিংকি রহমান।”
“পিংকি? তো আপনি আমায় কীভাবে চিনলেন?”
“আপনার দুঃসম্পর্কের বোন উল্লাসী আছে না? উল্লাসীর কাছ থেকেই।”
মুন্নি সরকার ভ্রুজোড়া আরও খানিকটা কোঁচকাতেই ওপাশ থেকে পিংকি রহমান বললেন,
“শুনলাম আপনি আপনার ছেলের জন্য পাত্রী দেখছেন?”
“আমার ছেলে?”
“হ্যাঁ.. আপনার ছেলে। উল্লাসী বললো..”
“কী বলেন এসব? উল্লাসী কেনো এই কথা বলবে! তাছাড়া আমার কণ্ঠ শুনে আপনার এতই বুড়ো মনে হয় যে ছেলের বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজবো?”
মুন্নি সরকারের ঝাঁজালো স্বরে দিশেহারা হয়ে পড়লেন পিংকি রহমান। উল্লাসী তাকে রাত আটটার পর কল দিতে বলেছিল। তবে অতি উৎসাহের বসে সময় পেরুবার আগেই কল দিয়ে বসেছে সে! এনিয়েই কি নারাজ হয়েছেন মহিলাটি? নাকি তার মনমেজাজ ভালো নেই? তবে কি ভুল করে ফেললেন তিনি? ঢোক গিললেন পিংকি রহমান। গলার স্বরে কোমলতার আভাস ফুটিয়ে বললো,
“আপনার কি মনমেজাজ ভালো নেই? খালু কি আশেপাশে কোথাও নেই? থাকলে দিন.. তার সাথেই কথা বলি।”
“মানে? কার খালু? কোন খালু?”
“ইয়ে মানে আপনার স্বামী..”
বিস্ময়ের শিখরে পৌঁছে গেলেন মুন্নি সরকার। কিছুক্ষণ নীরব থেকে সে তীক্ষ্ণ সুরে বললেন,
“ইয়ার্কি করেন আমার সাথে? বয়স কত আপনার? আপনি আমারে খালা বানান? বয়স কতো আপনার?”
“জ্বি? আমি তো থার্টি এইটে পা দিলাম।”
“ওরে আমার ভ্যাবাকান্দী! আটত্রিশ বছরের বুড়ি হয়ে তুমি আমায় খালা ডাকো? বাঁদরামির জায়গা পাওনা? একবার এসো আমার কাছে। পিটিয়ে তোমার পাছা লাল না করে দিলে আমার নাম মুন্নি সরকার নয়!”
রাগে গজগজ করতে করতে ফোনের লাইন কেটে দিলেন মুন্নি সরকার। মহিলাটির সাহস দেখে রীতিমতো অবাক সে। তার বয়সই বা কত হলো? এর মাঝেই আটত্রিশ বছরের একজন মহিলা তাকে খালা বানিয়ে দিচ্ছে? আর হাসানকে খালু? অদ্ভুত! সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন মুন্নি সরকার। মৈত্রীকে খুঁজতে পাশের ঘরের দিকে এগুতেই আবারও বেজে উঠলো তার ফোনের রিংটোন।
থেমে দাঁড়িয়ে একমুহূর্ত ভাবলেন তিনি। তারপর আবারও সোফায় এসে আরাম করে বসে কল রিসিভ করে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“কী চান? চাইছেন টা কী আপনি?”
“আপনি আমার কথা পুরোটা না শুনেই কল কেনো কেঁটে দিলেন? ম্যানার জানেন না নাকি?”
“না জানলেই বা কী? আপনার মতো আটত্রিশ বছরের শিশুর কাছ থেকে শিখতে হবে?”
“আপনি তো যথেষ্ট বেয়াদব এক মহিলা! নিজে কি আঠারো বছরের ছুড়ি যে খালা বলে ডাকলে জাত যাবে?”
পিংকি রহমানের ঝাঁজালো কথায় বিরক্তে চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন মুন্নি সরকার। মনে মনে কয়েকটি গালি গুছিয়ে নিতে তার অতীতে উঁকি দিতেই পিংকি রহমান বললেন,
“হয়তো উল্লাসী নামের মেয়েটি আমায় ভুল নাম্বার দিয়েছে। মেয়েটি যথেষ্ট বেয়াদব ছিল! তবে কথা হলো, তাহলে আপনি ওকে চিনলেন কীভাবে?”
অতীতের স্মৃতিচারণে না প্রবেশ করে মুন্নি সরকার বললেন,
“এখন একটা যুক্তিসঙ্গত কথা বলেছেন! সত্যিই কি উল্লাসী আপনাকে আমার নাম্বার দিয়েছে?”
“তাছাড়া? আমি শুধুশুধু মিথ্যা কেনো বলবো?”
“এই এই.. শুনুন শুনুন! আমার এক ভাই আছে। যার বিয়ের জন্যই পাত্রী দেখছি। উল্লাসী আমার ভাইয়ের কথা বলেনিতো?
একদন্ড ভাবতেই মুন্নি সরকারের চোখমুখ চিকচিক করে উঠলো। অতি উৎসাহের সাথে প্রশ্নখানা করতেই পিংকি রহমান বললেন,
“আপনার ভাই? ডাক্তার তো?”
পিংকি রহমানের কথার শেষটা শোনার আগেই মৈত্রী দৌঁড়ে এসে মুন্নি সরকারকে জড়িয়ে ধরতেই হাত থেকে পড়ে গেল তার ফোন। প্রায় সাথেসাথেই চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। মৈত্রীকে সরিয়ে দ্রুত ফোন তুলে কানে নিয়ে তিনি বললেন,
“হ্যালো! হ্যাঁ। আমার ভাই।”
ওপাশ থেকে পিংকি রহমান গদগদ হয়ে বললেন,
“আমার একটা বোন আছে বুঝেছেন? জার্মানি থেকে পিএইচডি করে এসেছে। ফিজিক্সে ঢাকা ভার্সিটি থেকে এমএস কমপ্লিট করে জার্মানি গিয়েছিল। ওখান থেকে ফিরেছে বছর দুয়েক আগে।”
খুশি হলেন মুন্নি সরকার। উল্লাসী তাকে নিয়ে এত ভাবে? এত ভালো এক বিয়ের প্রস্তাব এনে দিল উল্লাসী? তাও কিনা মেয়ে লন্ডন থেকে পিএইচডি করে এসেছে? যেখানে তার ভাই বেকার, ভবঘুরে হয়ে জীবন কাটাচ্ছে? বিশ্বাস করতে সামান্য কষ্ট হলেও পুরো বিষয়টি নিয়ে খুশিতে উল্লাসে ফেটে পড়ার উপক্রম হলো তার।
“উল্লাসী আমার দুঃসম্পর্কের বোন হলেও আমি সবসময়ই ওকে নিজের ছোট বোনের নজরে দেখেছি। যতটা পারি আমি ওর জন্য করেছি। আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে যখন এখানে এসেছিল উল্লাসী বিশ্বাস করুন আমি ভাবিনি ও আমার আত্মার আত্মা হয়ে যাবে।”
আবেগঘন এক পরিবেশ সৃষ্টি হতেই ঠোঁট বাঁকালেন পিংকি রহমান। তবে কথায় তৃপ্তি এনে বললেন,
“হ্যাঁ.. মেয়েটা ভারী মিষ্টি।”
“এতটুকু মেয়ে হয়ে তার উপর কত দায়িত্ব! তবুও সবটা কত সুন্দর ভাবে সামলাচ্ছে ভেবে মাঝেমাঝে গর্বে বুকটা ফুলে উঠে আমার।”
“তাই তো.. মেয়েটা অনেক ভালো। ঠিক বলেছেন! মাঝেমাঝে আমারও বুক ফুলে উঠে।”
চোখের কোণা মুছে ফেললেন মুন্নি সরকার। তারপর আবারও প্রসঙ্গে ফিরতে বললেন,
“আপনার বোনকে উল্লাসী দেখেছে?”
“না না.. ও তো আমার ননদের সাথে পড়ে। ও দেখেনি পাপিয়াকে। এটা কি আপনার নাম্বার? এই নাম্বারে হোয়াটসঅ্যাপ খোলা আছে?”
“হ্যাঁ.. আছে তো।”
তবে যে উল্লাসী এই নাম্বারটি তার খালাখালুর নাম্বার বলে দিল! প্রশ্নটি মনে উঁকি দিলেও তাকে বের করলেন না পিংকি রহমান। ফোনে ইয়ারফোনের প্ল্যাক লাগিয়ে সে গ্যালারিতে পাপিয়ার ছবি খুঁজতে খুঁজতে বললো,
“আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাপিয়ার ছবি সেন্ড করে দিলাম.. দেখুন।”
“অপেক্ষা করুন..”
তড়িঘড়ি করে নেট অন করে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকতেই মুন্নি সরকারের মনে বেজে উঠলো তার ভায়োলিনের সুর। সত্যিই উল্লাসী তাকে নিয়ে এত ভাবে?
“মেয়ে তো বেশ রূপবতী। নাম যেনো কী বললেন ওর?”
“পাপিয়া..”
“বাহ! কত সুন্দর নাম!”
“আলহামদুলিল্লাহ.. তবে কি আমরা সব পাঁকা ভেবে নেবো?”
তৃপ্ত মনে বললেন পিংকি রহমান।
উত্তরে মৃদু হাসলেন মুন্নি সরকার।
“আপনারা ছেলে দেখবেন না?”
“দেখাদেখির কী আছে? তাছাড়া রুমা তো দেখেছেই। ওর তো আপনার ভাইকে খুব ভালো লেগেছে। যেমন লম্বাচওড়া তেমন তার ফিটনেস। দেখতে নাকি পুরো নায়ক নায়ক।”
রুমা দেখেছে? কোথায় দেখলো? পরমুহূর্তেই নিজের ভাইয়ের প্রশংসা শুনে আত্মা শান্তি হয়ে গেলো মুন্নি সরকারের। সে পূর্বসুরেই বললো,
“ডান.. ডান। আসুন তবে কাল। সব ঠিকঠাক থাকলে না হয় কালই আংটি বদল করে রাখবো।”
কোচিং সেরে বাসায় ফিরে মেসবাহকে দেখে অবাক হলো উল্লাসী। এসময় তো লোকটির থাকার কথা নয়। তবে লোকটি বাসায় যে! পুরো ফ্ল্যাটে হন্য হয়ে কিছু একটা খোঁজার জন্য পা চালাতেই ভ্রু কোঁচকালো মেসবাহ।
“কী খুঁজছো তুমি?”
পা না থামিয়েই উল্লাসী বললো,
“আপনি আজ এখন বাসায় কেনো? করিম খালা কই? এই করিম খালা?”
“তাকে এখন কই পাবে? এই উল্লাসী..”
মেসবাহ হাত ধরে বাঁধা দিতেই থেমে গেলো উল্লাসী। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে রেখে ক্লান্ত স্বরে বললো,
“এক গ্লাস পানি খাবো।”
উল্লাসীকে বিছানায় বসিয়ে মেসবাহ এল ডাইনিংয়ে। জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে সে উল্লাসীর হাতে দিতেই ঢকঢক করে পুরো পানি শেষ করে ফেললো উল্লাসী। এমন কি হতে পারে পিংকি ভাবি মুন্নি ভাবিকে এর মাঝেই কল করেছিল? আর মুন্নি ভাবি সবটা উনাকে খুলে বলেছেন? বুকের ভেতরটা আঁতকে উঠতেই ক্ষীণ স্বরে সে বললো,
“আপনি এখন বাসায় কেনো?”
“কেনো? আমায় দেখে তুমি খুশি হও নি?”
“অবশ্যই খুশি হয়েছি..”
“তবে মুখে তো তার উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি না!”
ম্লান হাসলো উল্লাসী। মেসবাহর দিকে তাকিয়ে তার হাত আঁকড়ে ধরতেই চেঁচিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো মৈত্রী।
“আমি রেডি.. আমি রেডি।”
রোযার ঈদের কেনা লাল রঙের জামাটি পরেছে মৈত্রী। মাথায় করেছে দু’ঝুটি। তাকে এক নজর দেখে উল্লাসী মেসবাহর দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাতেই সে বললো,
“ফ্রেশ হবে না এমনি বেরোবে?”
“বেরোবো? কোথায়?”
“ঘুরবো আজ.. পুরো ঢাকায় ঘুরবো।”
উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। মেয়ের কাছে গিয়ে তাকে কোলে নিয়ে তার কপালে চুমু দিয়ে হাসতে হাসতে বললো,
“মেয়ে আমার মেয়ে নয় যেন পরী! এই পৃথিবীতে থাকিস কেনো তুই? তোর কাজ হলো আকাশে উড়ে উড়ে বেরানো।”
বাবার কথার তালে আহ্লাদী সুরে মৈত্রী বললো,
“তোমরাই তো! তোমাদের কারণেই তো আমি কোথাও যেতে পারিনা। উফ! আমার যে কত কত কাজ!”
“দেখেছো আমার মেয়েটার কত কাজ? মার চেয়ে তো আমার মেয়েটাই বেশি কাজ করে। তাই না বাবা?”
বাবা-মেয়ের খুনসুটি দেখে হেসে উঠলো উল্লাসী। খানিকক্ষণ আগে মুহূর্তেই ভয়ে চুপসে পড়লেও নিমেষেই সে ভুলে গেলো বিকেলের ঘটনা। ভুলে গেলো গোঁফওয়ালা ভাবিকে শায়েস্তা করতে ভুড়িওয়ালা ভাবির নাম্বার দেবার কাহিনী। কয়েক কদম এগুলো সে। মেয়ের গাল টিপে চুমু দিতেই উল্লাসীর হাত ধরে মেসবাহ টেনে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রাতের ঢাকা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে।
রাত ধীরেধীরে গভীর হচ্ছে। চারিপাশে নেমে আসছে ঘন আঁধার। আগুনে পুড়ছে নিকোটিন। সেই সাথে পুড়ছে মুবিনের মন। মন বলতে কি কিছু আছে তার? থাকলে একবার হলেও কি চৈতালির কষ্ট অনুভব করতে পারতো না সে? বুকচিরে গভীর এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসতেই চোখজোড়া বুজলো মুবিন। আজ হঠাৎ করেই চৈতালিকে খুব করে মনে পড়ছে তার। কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরটা। এতটা কষ্ট শেষ কবে অনুভব করেছিল সে? চৈতালিকে হারানোর কষ্ট তো দিনকেদিন বেশ ফিকে হয়ে পড়ছিল। পরিবর্তে যায়গা করে নিচ্ছিলো পুষ্পকে নিয়ে তার মনে একরাশ ভালোলাগা। তবে আজ কেনো পুরাতন সেই আঘাতে আবারও খোঁচা দিয়ে ব্যথিত করে তুললো চৈতালি? চোখ মেলে সিগারেট হাত থেকে ফেলে দিল মুবিন। বালিশের দুপাশ খুঁজে ফোন হাতে নিয়ে কনটাক্টস লিস্টে গিয়ে বের করলো চৈতালির নাম্বার। নাম্বারটা সে নিয়েছিল তার বড় ভাবির ফোন থেকে। এরপর থেকেই সে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেছে চৈতালিকে একটাবার ফোন দেবার। সুন্দর স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে তার খোঁজ খবর নেবার। তবে পেরে উঠেনি সে। সাহস হয়ে উঠেনি ক্ষণিকের জন্যও! আবারও চোখজোড়া বুজে গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুবিন। সেদিনও এসেছিল চৈতালি। গা ঢাকা ছিল তার নীল রঙের একটি ওড়নার আবরণে। মুখে ছিল মিষ্টি হাসির রেখা.. তবে চোখের নিচের কালচে দাগ তাচ্ছিল্যের সুরে বারবার বলছিল, মিথ্যা হাসির অভিনয় আর কত চৈতালি?
কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে সে ভাত ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। হঠাৎ দরজার পাল্লাটা শব্দ করে উঠে চিকন এক মেয়েলী কন্ঠস্বর কানে আসলো তার।
“আসবো?”
কাঁথা থেকে মাথা বের না করেই সে বললো,
“কে?”
“গলার স্বর টাও ভুলে গেলে?”
প্রায় সাথেসাথেই হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো মুবিন। চৈতালির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“তুমি এখানে?”
“বাপের বাড়িতে এসেছিলাম.. তোমার বড় ভাবি আমাকে দেখতে গিয়ে সাথে করে নিয়ে এলো। আজকাল তোমাদের আমার উপর বড্ড ভালোবাসা পাচ্ছে কেনো বলতো?”
বলতে বলতেই চৈতালি এসে বসলো খাটের এক কোণায়।
“ধরেছে নাকি নতুন করে কাওকে মনে?”
প্রশ্ন করলো চৈতালি।
তবে তার সে প্রশ্নেরও জবাব দিল না মুবিন। বুকের ভেতরটা তখনও কাঁপছে তার। ইচ্ছে করছে সকল বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে উঠে তার চৈতালিকে বুকের ভেতরটায় ঠেসে ধরতে।
দুজনের মাঝের দীর্ঘসময়ের নীরবতা কাটিয়ে উঠে মুবিন বললো,
“তুমি ভালো আছো?”
“এই প্রশ্ন করে কী শুনতে চাও? আমি ভালো নেই? আমি তোমার জন্য এখনো কষ্ট পাই? না.. আমি কারো জন্য কোনো কষ্ট পাইনা। আমি ভালো আছি। খুব ভালো আছি।”
তাচ্ছিল্যের সুরে চৈতালি জবাব দিতেই ম্লান হাসার চেষ্টা করে মুবিন বললো,
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি৷ ক’মাস চলছে তোমার?”
“আটমাস..”
“ছেলে হবে না মেয়ে? কিছু জানতে পেরেছো?”
“না.. তবে আমি চাইনা আমার ছেলে হোক।”
“কেনো?”
“ছেলেরা খুব বেশি নিষ্ঠুর হয়.. খুব। আমি চাইনা আমার ছেলে কখনো কোনো মেয়ের মন ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিক।”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে প্রসঙ্গ টানতে মুবিন বললো,
“তাহলে মেয়ে চাও?”
“না.. মেয়েও চাই না। মেয়ে মানের একবুক দুঃখের সাগর। মেয়ে মানেই লাঞ্ছনা সহ্য করা নীরবে চলা। মায়ের মতো এত সহ্যশক্তি যদি ওর না থাকে? তবে?”
মুবিনের দিকে তাকালো চৈতালি। তবে তার দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে সে গম্ভীর স্বরে বললো,
“আমি চাই-ই না ও এই দুনিয়ায় আসুক.. আমি কি খুব কঠিন একটা কথা বলে ফেললাম?”
“তা তো বলেছোই।”
উত্তর করলো মুবিন।
চৈতালি ম্লান হেসে বললো,
“মনে পড়ে আমাকে?”
“এসব কথা থাক..”
“থাকবে কেনো? বললে কি আমার মতো তুমিও বেহায়া হয়ে যাবে?”
একমুহূর্ত নীরব থেকে মুবিন বললো,
“পড়ে..”
“আজও ভালোবাসো আমায়?”
“বাসি..”
দুজনের বুকচিরে গভীর কিছু নিঃশ্বাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়তেই চৈতালির গাল বেয়ে টপাটপ গড়িয়ে পড়লো কয়েকফোঁটা জল।
“তুমি জানো আমি ভালো নেই? আমার একেকটি দিন কতটা কষ্টে কাটে? একেকটা রাত আমি কতটা ছটফট করে পাড় করি?”
“সবুজ লোকটি ভালো..”
“তো আমি কী করবো মুবিন? আমার মনের চাওয়া, আমার মতামতের কোথাও কি মূল্য নেই? মা বলে সবুজ ভালো, ধৈর্য ধরে থাক। বাবা বলে সবুজ ভালো, যা বলে অক্ষরে অক্ষরে সেটাই পালন করবি। এ বলে এটা ও বলে ওটা.. আর আজ তুমিও বললে! কিন্তু আমার মন? তার কী হবে? আমি যে তাকে মন থেকে কখনো স্বামী হিসেবেই মেনে নিতে পারিনা তার কী হবে মুবিন?”
ভাঙ্গা গলায় মুবিন বললো,
“চেষ্টা করো..”
“কত চেষ্টা করবো? কতভাবে মনকে বোঝাবো? তোমার মনে হয় এই দুই বছরে কম চেষ্টা করেছি আমি? আমি পারিনা.. লোকটি আমার কাছে আসলে আমার পুরো শরীর ঘিনঘিন করে… পরপর লাগে। আমি কখনোই মন থেকে উনাকে কাছে টেনে নিতে পারিনা। এ কেমন অসহনীয় অবস্থায় তুমি আমায় ফেলেছিলে মুবিন? আমি কোনোদিক তাকিয়েও এর কোনো সমাধান খুঁজে পাইনা। মনকে বুঝাই.. উনিই তোর সব। উনাকে কেনো মন থেকে মেনে নিতে পারছিস না? কিন্তু বেহায়া এই মন আমার কী বলে জানো? ভালোবাসা তো একবারই হয়। বারবার হয় মোহ।”
মেঝেতে বসে পড়লো চৈতালি। জোরে কিছু নিঃশ্বাস ছেড়ে মুবিনের পা ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে।
“কী হয় আবারও সবটা আগের মতো করে নিলে? কী হয় আবারও আমরা একসাথে হলে?”
ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল মুবিন। চৈতালির হাত সরানোর চেষ্টায় মেঝেতে বসে পড়লো সে।
“ছাড়ো চৈতালি। এটা হবার না।”
“কেনো হবার না? তুমি আমাকে চাও না? তুমি আমাকে ভালোবাসো না?”
“বাসি.. তবে এটা করলে সবুজ ভাইয়ের প্রতি অন্যায় করা হবে।”
“আর আমি? সবাই কেনো ওই লোকটাকে নিয়েই ভাবে? আমি কি মানুষ না? আমার কি অনুভূতি নেই? আমি আর কত সহ্য করবো? আমার প্রতি সবাই অন্যায় করেনি?”
“অবুঝের মতো কথা বলো না চৈতালি।”
“হ্যাঁ, আমিই তো অবুঝ। আমিই খারাপ। আমিই বেহায়া। এজন্যই তো বারেবারে হেনস্তা হবার পরও তোমার কাছেই ফিরে আসি। আমি এতটা বেহায়া কেনো মুবিন?”
দু’হাতের বাঁধনে চৈতালি আঁকড়ে ধরে বুকে টেনে নিল মুবিন। তার ভালোবাসায় চাদরে সিক্ত হওয়া অশান্ত চৈতালিকে শান্ত করার চেষ্টায় মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে সে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল তার চুলের মাঝে।
“কী করেছিলে আমায় তুমি? কী যাদু করেছিলে? আমি কেনো ভুলতে পারিনা তোমায়? কেনো সবুজকে তোমার জায়গায় বসাতে পারিনা? আমি ধীরেধীরে এভাবেই শেষ হয়ে যাবো মুবিন.. আমার কষ্ট কেউ কখনো বুঝতেই পারবে না।”
“সব ঠিক হয়ে যাবে.. চুপ। একদম চুপ।”
চৈতালিকে শান্ত করার চেষ্টায় মুবিন এতটায় মগ্ন হয়ে পড়েছিল যে আশেপাশের কিছুই নজরে ছিল না তার। তবে খানিকটা সময় কাটতেই হঠাৎ করে তার চোখ দরজার দিকে পড়তেই পুরো শরীর শক্ত হয়ে এল। গলা শুকিয়ে কাঠ হবার উপক্রম হতেই ওপাশ থেকে মোরশেদা বেগম এগিয়ে এসে ছাড়িয়ে নিলেন চৈতালিকে তার বুকের ভেতর থেকে। কঠিন স্বরে তার উদ্দেশ্যে বললেন,
“বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘুরছো অথচ নষ্টামি করছো বেশ্যাদের মতো। সবুজ মাস্টার জানে এসব? নাকি ঢাক ঢোল পিটিয়ে জানাতে হবে? আর কখনো যদি আমার ছেলের আশেপাশে তোমাকে দেখেছি চৈতালি, তো ভালো হবে না।”
সেদিন মা সবটা জানার পরই তিনি পুরো পরিবারকে জানিয়ে দিয়েছিল তাদের প্রণয়ের বিষয়টি। সাথে করে দিয়েছিল তাকে নিঃস্ব। ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে সেদিন চৈতালি বেরিয়ে গিয়েছিল তাদের বাড়ি ছেড়ে। এক বুক কষ্ট আর লাঞ্ছনা নিয়ে সে আর কখনোই ফিরে আসেনি তার দুয়ারে।
(চলবে)