আলোছায়া

আলোছায়া !! Part- 07

স্নিগ্ধ বিকেল। প্রকৃতি মনের সকল মাধুরি মিশিয়ে সেজেছে নিজের মনের মতো করে। আকাশের বুকে মেঘেরা খেলছে। কখনো তারা নীল আকাশের উপরে ভেসে বেড়াচ্ছে আবার কখনো আলতো করে সরে যাচ্ছে সেখান থেকে। পরিবশে অদ্ভুত সুন্দর এক মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়ে হালকা বাতাস ভেসে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। সেই বাতাসে মিশে রয়েছে মিষ্টি এক সুভাস। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বুক ভরে খানিকক্ষণ শ্বাস নিয়ে আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করলো উল্লাসী। তারপর হাতের কফির মগ নিয়ে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দেবার আশায় কয়েক কদম পিছিয়ে পড়লো সে। আজও ক্লাস করেনি সে। কোচিংএ ঢুকে অসহায় এক পরিবেশে পড়ে ফিরে এসেছে নিজ গৃহে। তবে এভাবে আর কতদিন? লোকটি কেনো এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছে? সে বুঝেও বুঝে উঠতে পারছে না তার কোনটি করা উচিৎ আর কোনটি নয়! কফির মগে চুমুক দিয়ে লম্বা একটি নিঃশ্বাস ছাড়লো উল্লাসী। টি-টেবিলের উপর থেকে ফোন উঠিয়ে ডায়েল করলো জ্যোতির নাম্বারে। অসহায় এই মুহূর্তে কেনো যেনো বারেবারে তাকেই শুধু মনে পড়ছে তার!
“তোমার শরীরের কী অবস্থা?”
“চলছে মোটামুটি।”
“খাওয়াদাওয়া ঠিক ভাবে করতে পারছো?”
“হু..”
“আর বাবু? ও কতদিন পর আসবে?”
ফোনের ওপাশ থেকে একদন্ড থেমে জ্যোতি বললো,
“কিছুক্ষণের মাথায় তুমি একই প্রশ্ন দুইবার করেছো উল্লাসী। তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও যা বলতে দ্বিধা কাজ করছে তোমার? তবে আমি বলবো নিঃসংকোচে তুমি বলতে পারো। এতটা স্পেস আমি তোমায় একয় বছরে অবশ্যই দিয়েছি!”
“হ্যাঁ..”
“তবে এত কীসের জড়তা?”
উল্লাসীর দিক থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছাড়লো জ্যোতি। খানিকটা নড়েচড়ে বসে দৃঢ় গলায় বললো,
“তুমি একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখবে আমাদের আলাদা হবার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকলেও এক হবার পেছনের কারণ ছিল একটি। আমাদের মেয়ে, মৌমি। তাই বলে যে আমরা আমরা মনের বিরুদ্ধে সংসার করছি তেমনটা নয়। আমি আমার ভুলগুলো শুধরোচ্ছি, মাজহার তার ভুল গুলো শুধরোচ্ছে। হয়তো এই ভুলগুলো আমরা আজীবনই শুধরোতে থাকবো। তারপরও আমরা ভালো আছি। কেনো জানো? আমি যেমন ওকে দিচ্ছি তেমনটা পাচ্ছিও। ও আমায় নিয়ে ভাবছে.. আমাকে ভালো রাখতে প্রতিটি কদম দেখে শুনে ফেলছে। একটি সম্পর্কে যে জিনিস না থাকলে চলেইনা সেটি হলো গুরুত্ব.. একে অপরকে দেয়া গুরুত্ব। আই সেই সুত্রটি ধরেই কিন্তু আমরা এগোচ্ছি।”
এই একই কথা তো জাভেদ ভাইও তাকে বলেছিল। তবে কি আসলেই লোকটি খারাপ চায়না তার? বুকের ভেতটা কেঁপে কেঁপে উঠতেই ঢোক চেপে কফির মগ টেবিলে রাখলো উল্লাসী। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রেলিঙের দিকে পা বাড়িয়ে বললো,
“তোমার কী মনে হয়? তোমার কাছ থেকে বড় ভাই কোনো কথা গোপন করলে সেটা কোন ক্যাটাগরিতে পড়বে? গুরুত্ব দেয়ায় নাকি গুরুত্বহীনতায়?”
“তার আগে আমি বলে নেই গোপন করা শব্দটি নিয়ে দুটো কথা। আগে এই গোপন শব্দটি নিয়ে আমার এলার্জি ছিল.. তবে আজকাল সে এলার্জিটা কমেছে। এখন আমি আমি এই গোপন শব্দটির নতুন এক নাম আবিষ্কার করেছি।”
“নতুন নাম?”
“গোপনীয়তার অপর নাম যত্ন। সিক্রেট ইকুয়েল টু কেয়ার!”
“কীভাবে?”
“তোমার দিকটা বিবেচনা করে সে যদি তোমার কাছে একটি কথা লুকোয় তবে তাকে তো আমি তোমার প্রতি যত্নবানই বলবো তাই না?”
মাথা নেড়ে অশান্ত গলায় উল্লাসী বললো,
“আমার দিক বিবেচনায় হোক বা না হোক! স্ত্রী হিসেবে আমি কি সবটা জানার অধিকার রাখি না?”
“অবশ্যই রাখো.. তবে একটা মজার ঘটনা শুনবে? তোমাদের ওখান থেকে আসার সময় মাজহার আমার জন্য একটি শাড়ি নিয়ে এসেছে। তবে সে সেটা আমাকে এখনো দেয়ায়নি। গোপন করেছে। হয়তো রাতে জানাবে বলে প্রহর গুনছে।”
“আমাকে উনি কখনোই এমন সারপ্রাইজ দেয় না জানো?”
বিষন্ন মনে উল্লাসী জবাব দিতেই ভ্রু কোঁচকালো জ্যোতি।
“মেসবাহর কথা বলছো?”
“হ্যাঁ.. আর কে আছে আমার? অথচ সেও বোঝে না আমায়। বোঝে না আমি কখন কী চাই তার কাছ থেকে।”
উদ্বিগ্ন হলো জ্যোতি। উল্লাসীকে আস্বস্ত করার চেষ্টায় বললো,
“মেসবাহ আগে থেকেই এন্ট্রোভার্ট স্বভাবের মানুষ। সেই সাথে সারাদিনের ব্যস্ততা তো রয়েছেই।”
“কিন্তু আগে গম্ভীর হলেও কথাবার্তায় রসকষ ছিল। এখন নেই..”
“তাহলে তো খারাপ.. আমি কি কিছু বলবো ওকে?”
একমুহূর্ত ভেবে উল্লাসী বললো,
“না.. থাক। এমনিতেই কাল থেকে রেগে আছে আমার উপরে।”
“তবে তুমি তোমার ক্ষোভগুলো ওর কাছে প্রকাশ করো। খুলে বলো ওকে.. তারপর দেখো মেসবাহর দিক থেকে কোনো এফর্ট পাও কিনা! তোমাদের মাঝে বয়সের পার্থক্যটা অনেক। যেখানে আমরা দুজনেই পূর্ণবয়স্ক হয়েও ভুল করে ফেলেছিলাম.. সেখানে তোমাদের সম্পর্কটি আরও জটিল। সময় দাও এর পেছনে। তবে চুপ করে থেকো না। সকলেই যে তোমার নীরবতার অর্থ বুঝবে তেমন নয়!”
জ্যোতির কথার যৌক্তিকতা খুঁজতে জাভেদের লেখা চিরকুটের কথাগুলো স্মরণ হতেই তার কথা জ্যোতিকে জানাবে কিনা তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলো উল্লাসী। জ্যোতি তাকে প্রায়সময়ই ভালো পরামর্শ দেয়। যা তাকে জীবনটা দেখার ধরনে প্রায়সময়ই পরিবর্তন আনে। আবার মাঝেমাঝে তার মতোই বুঝদার হবার চেষ্টায় সে অনুসরণের চেষ্টাও করে। তাহলে তাকে সবটা খুলে বললে সমস্যা কোথায়? সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠে জাভেদের কথা জ্যোতিকে জানানোর পায়তারা করতেই বন্ধ হয়ে গেলো তার ফোন।
ফোন চার্জে লাগিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই উল্লাসীর কানে এলো কলিংবেলের শব্দ। সেদিকে এগিয়ে দরজা খুলতেই লাফিয়ে ভেতরে ঢুকলো মৈত্রী। মুন্নি সরকার বললেন,
“যদিওবা তোর শোনার আগ্রহ নেই জানি। তারপরও বলছি। শীতল ভাই আমাদের এখানেই থাকছে।”
“এখানে থাকছে বলতে?”
“এখানে থাকছে বলতে এখানেই থাকছে। নেশাটা এবার ছাড়িয়েই দিবরে উল্লাসী। তারপর দেখিস আমাত ভাইয়ের কেমন বউ আনি ঘরে! যারা আমার অবলা ভাইকে নিয়ে মুখ কুঁচকেছে তাদের মুখে গোবর না লেপ্টে দিলে আমার নাম মুন্নি সরকার নয়।”
“আলহামদুলিল্লাহ.. শুকুর আলহামদুলিল্লাহ৷ মনে করে মিষ্টির এক প্যাকেট পাঠিয়ে দেবে কিন্তু।”
“সবসময় ঢং না? এসেছিস সেই কখন! মেয়েকে নিয়ে যাসনি কেনো শুনি?”
“ও বাড়িতে ঢুকলেই আমার কাজ বাড়ে.. এই যে দেখো গিয়ে ড্রয়িংরুমে রাজ্যের খেলনাপাতি নিয়ে বসেছে! এসব গোছাবে কে শুনি?”
“তুই.. মা হয়েছিস কোন কাজ করতে?”
“তোমার যে আরও কথা! সারাদিন কত্ত কাজ থাকে আমার! নামমাত্র কাজের লোক রেখেছেন উনি! আসে আর খায়.. আমার কাজের সময় বাতের বিষে নাকি তার পা’ই উঠেনা। আর যেই মৈত্রীর বাবা কিছু বলে ওমনি লাফিয়ে লাফিয়ে সেই কাজ সারে।”
“বলিস কী! রঙঢঙ কেমনরে?”
“রঙঢঙ বলতে?”
“বুকে কাপড় রাখে? নাকি মেসবাহর সামনে..”
মুন্নি সরকারকে থামিয়ে দিয়ে ভ্রু কুঁচকে উল্লাসী বললো,
“ছি! ছি! ওসব কী বলো! মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?”
“এখন সব হয়রে ময়না। দেখে শুনে রাখ.. আমার এক চাচাতো বোনের স্বামী ওদের বাসার কাজের মেয়ের সাথেই পরকিয়ায় জড়িয়েছিল। পরে তো মেয়েটার পেটে নাকি বাচ্চাও এসেছিল।”
ঢোক গিললো উল্লাসী। স্মরণ করার চেষ্টা করলো করিমুন্নেসা নামের মহিলাটি কি ঠিকঠাক ভাবে বুকে কাপড় রাখে মেসবাহর সামনে? আর মেসবাহ? উনিই বা কোন নজরে দেখে মহিলাটিকে?
“কী একটা যে অবস্থা! বোন আমার বিষটিষ খাবার হুমকি দিয়ে অস্থির! এখনকার পুরুষ মানুষদের উপর কোনো ভরসা আছে নাকি! সারাদিন এরা যৌনতা নিয়ে ভাবে। আর আশেপাশে যাদের দেখে তাদের দিকেই লোভী দৃষ্টিতে তাকায়। ভালোমানুষ ছিল আমাদের বাপ দাদার আমলের মানুষ। আহা.. তাদের নজর ছিল সবসময় মাটির দিকে! ভাবলেই গর্বে বুকটা ভরে যায়। দরজাটা লাগিয়ে দে.. যাচ্ছি আমি।”
মুন্নি সরকার নিজের ফ্ল্যাটের দিকে পা বাড়াতেই দরজা আটকে মৈত্রীর পাশে এসে বসলো উল্লাসী৷ কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম। বুকের ভেতরটা অস্থিরতায় ভরে উঠেছে। মেসবাহ কেনো তার সঙ্গে রাগ দেখিয়ে এতটা সময় থাকতে পারছে? তবে কি করিমুন্নেসাই জড়িত এতে কোনোভাবে? পরক্ষণেই নিজের ভাবনাকে বেশ নীচ মনে হলো উল্লাসীর। মাথায় চলা উদ্ভট এই ভাবনা কাটাতেই সে মৈত্রীকে বললো,
“ওই বিচ্ছু রশ্নিটা আর কি কিছু বলেছে?”
পুতুলের ঘর গোছাতে গোছাতে মৈত্রী মাথা নেড়ে বললো,
“হু..”
“কী বলেছে?”
“বলেছে তোমাকে পড়াশোনা শিখিয়ে ভুল করছে বাবা.. তুমি তো শেষমেশ বাবাকে ছেড়ে চলেই যাবে।”
মন মেজাজ অসম্ভব খারাপ হয়ে এল উল্লাসীর। চার্জ থেকে ফোন খুলে তা অন করে মেসবাহর নাম্বারে ডায়েল করে মেয়েকে শিখিয়ে দিল রশ্নির মায়ের নাম্বার চাওয়ার কিছু কৌশল।
“বাবা, রশ্নির আম্মুর নাম্বারটা ম্যাসেজ করে দাও। আমার কিছু নোটস দরকার ছিল। মা ওগুলো হোয়াটসঅ্যাপে নিয়ে নেবে।”
“আমি বাসায় এসে নিয়ে নেবো।”
“না, আমার এখনি দরকার।”
ফোনের অপরপ্রান্তে থেকে উদ্বিগ্ন স্বরে মেসবাহ বললো,
“মা কী করে?”
উল্লাসীর দিকে তাকালো মৈত্রী। ধীর স্বরে বলা কথাগুলোর অর্থ বোঝার জন্য খানিকটা সময় নিয়ে বললো,
“পড়ে.. আমি আর মা দুজনেই পড়ি।”
“গুড.. পড়তে থাকো। আমি ঘন্টাখানিকের মাঝেই আসবো। এসে তোমার কোন নোটস দরকার তা নিয়ে কথা হবে।”
“আহা! আমার এখনই লাগবে তো!”
“লাগবে না.. আমি এসে দেখবো বিষয়টি।”
ওপাশ থেকে মেসবাহ লাইন কেটে দিতেই ভ্রু কোঁচকালো উল্লাসী। মেসবাহ তাকে নাম্বারটা দিল না কেনো? তবে কি এখানেও কোনো গোলমাল রয়েছে? এমন কি হতে পারে রশ্নির মায়ের সঙ্গেই লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছে সে? চোখজোড়া বুজে লম্বা একটি দম ছাড়লো উল্লাসী। এ কেমন উদ্ভট উদ্ভট চিন্তা করছে সে? দীর্ঘদিন যাবৎ একটি গন্ডির মাঝে থাকার পর তার সীমানা আজ অসীম। নানান স্বভাবের মানুষদের সাথে যখন ওঠাবসা করছে তখন তাদের বলা কথাগুলোও কেনো গায়ে মাখছে সে? কেনো এই রঙ্গিন দুনিয়া করছে তার সঙ্গে তামাশা? বুকের ভেতরটা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠায় মেঝেতেই শরীর মেলে দিল উল্লাসী। লাইটের আলো থেকে নিস্তার পেতে ডান হাত চোখের উপরে রাখতেই পাশ থেকে ফোনে বেজে উঠলো ম্যাসেজ টোন।
‘আমি জানি তুমি রেশমি চুড়ি ভালোবাসো.. তবে তোমার উনি কখনোই তোমার সেই ভালোবাসার মূল্য দেয়নি। ঠিক বলছি তো? হ্যাঁ আমি সবসময়ই ঠিক বলি। তারপরও কেনো তোমার বিশ্বাস হয় না আমায় বলতো? আচ্ছা এককাজ করলে কেমন হয়? তুমি আমার দেয়া চুড়ি এবং টিপ পরে আজ তোমার উনার সামনে যাও। গ্যারান্টি দিয়ে বলছি উনি তোমার প্রতি এতটাই কেয়ারলেস যে এটাও জানার আগ্রহ দেখাবে না জিনিসগুলো তুমি পেলে কোত্থেকে!
-Jeved Via’
কোঁচকানো চোখে ম্যাসেজটি পড়ে চিন্তায় পড়ে গেলাও উল্লাসী। তাকে যে মেসবাহ কখনো সাজগোজের জন্য কোনো জিনিসপত্রই কিনে দেয়নি সেব্যাপারে তো জাভেদ ভাইয়ের জানার কথা নয়! এটা তো তার সংসারের কথা.. সম্পূর্ণই তার মনের গহীনের কথা। তবে কি তার মন পড়তে জাভেদ ভাই সক্ষম?
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বিধ্বস্ত শরীরে যখন বাড়ি ফিরলো মেসবাহ তখন রাত এগারটা। একটি ইমার্জেন্সি কেইস আসায় আটকে পড়তে হয়েছিল হাসপাতালে। সেসব মিটিয়ে যখন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল সে তখন শরীরে অবশিষ্ট ছিল না কোনো শক্তি। হাত ঘড়িতে সময় দেখে আবারও কলিংবেল চাপতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিল উল্লাসী। তার দিকে একটি ব্যাগ বাড়িয়ে দিয়ে মেসবাহ ভেতরে ঢুকতেই উল্লাসী বললো,
“এটায় কী?”
“পেয়ারা..”
পরশু রাতে পেয়ারা খেতে চেয়েছিল সে। তবে কি তার মান ভাঙাতেই পেয়ারা এনেছে মেসবাহ? খুশিমনে পলিথিন ব্যাগটি হাতে রান্নাঘরে ঢুকলো উল্লাসী। হাতের চুড়িগুলোর দিকে নজর দিয়ে জোরে হাত নাড়াতেই ঝনঝন করে বেজে উঠলো সেগুলো।
টেবিলে খাবার দিয়ে মেসবাহকে ডাকতেই সে এসে বসলো চেয়ারে। থালায় ভাত বেড়ে একেএকে সবক’টি পদের তরকারি নিতে নিতে উল্লাসীর উদ্দেশ্যে বললো,
“তুমি খেয়েছো?”
“হ্যাঁ.. মৈত্রীকে খাওয়ানোর সময় খেয়ে নিয়েছি।”
“ভালো করেছো।”
“আপনার জন্য ও জেদ করছিলো খুব। আজ এত দেরি করলেন কেনো?”
“ইমার্জেন্সিতে আটকে পড়েছিলাম!”
“অহ..”
নীরব হয়ে পড়লো চারপাশের পরিবেশ। মাঝেমাঝে উল্লাসীর হাত থেকে ভেসে আসা কাঁচের চুড়ির চুড়ির ঝনঝন শব্দ ছাড়া এলো না দ্বিতীয় কোনো শব্দ।
খাবার শেষে বেসিনে হাত ধুতে যেতেই উল্লাসীর চুড়ির আওয়াজ মেসবাহর কানে স্পষ্ট হয়ে উঠতেই ভ্রু কোঁচকালো মেসবাহ।
“ধীরে শব্দ করো.. মৈত্রী উঠে পড়বে তো!”
“কী ধীরে শব্দ করবো?”
সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মেসবাহ ঘরের দিকে এগুতেই ক্ষেপে চেঁচিয়ে উঠলো উল্লাসী।
“কী সমস্যা আপনার? আপনি এতটা কেয়ারলেস কী করে হতে পারলেন?”
ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল মেসবাহ। থেমে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে বললো,
“কী করেছি আমি?”
“না! আমি পাগল হয়ে যাবো। আর ভালো লাগে না আমার এসব! অসহ্য লাগে!”
“আরে! কী করলাম আমি!”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো উল্লাসী।
“আপনি কেনো এতটা কেয়ারলেস? কেনো আমায় ভালোবাসেননা? কেনো উনার কথাই বারবার সত্যি করে দেন?”
কান্নায় ভেঙ্গে পড়া উল্লাসীর কাছে এগিয়ে এসে তাকে নিয়ে চেয়ারে বসালো মেসবাহ। নিজে আরেকটি চেয়ার টেনে নিয়ে তার সম্মুখে বসে দূর্বল স্বরে বললো,
“আমি ভুল করেছি তোমায় জানায়নি। এখন থেকে আর এই ভুল করবো না। আশেপাশে যাই ঘটুক না কেনো সবটাই তোমায় জানাবো।”
নাক মুছে আবারও ফুঁপিয়ে উঠলো উল্লাসী।
“দরকার নেই আমার।”
“তবে আমার দরকার আছে।”
“আপনারও দরকার নেই.. আপনি অনেক কিছুই আমার কাছ থেকে লুকান। আজ তো রশ্নির মায়ের নাম্বারটাও দিলেন না! কেনো দিলেন না নাম্বার? নাম্বার দিলে সবকিছু আমি জেনে যাবো সেই ভয়ে?”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে মেসবাহ বললো,
“একটু ধীরে কথা বলি আমরা! মৈত্রী উঠে পড়বে।”
“বলবো না ধীরে কথা.. আপনি কেনো এতটা কেয়ারলেস? রশ্নির মায়ের নাম্বার কেনো দিলেন না? করিম খালা আপনার কাজগুলো কেনো নেচে নেচে করে?”
খানিকটা বিরক্ত হলো মেসবাহ। ভ্রু কুঁচকে শক্ত গলায় বললো,
“বারবার কী কেয়ারলেস কেয়ারলেস লাগিয়েছো উল্লাসী? মানলাম তো ভুল করেছি। সবটা ঠিকঠাক করতে আগ বাড়িয়ে কথাও বললাম। তারপরও কেনো তুমি বুঝতে চাইছো না কিছু? তারপর আবার রশ্নির মা, করিম খালা.. এসব কেমন বাজে কথা বলছো উল্লাসী?”
“তাই? আমিই বুঝতে চাইনা কিছু? আপনিই আগ বাড়িয়ে কথা বলেছেন? এমন ডাহামিথ্যা বলতে আপনার বাধে না?”
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো মেসবাহ।
“চুপ.. একদম চুপ। সবুজ তোমার আপন কেউ লাগে? তাহলে তার মৃত্যু নিয়ে তুমি নিজের সংসারে অশান্তি কেনো করছো? আর এখন কী করতে বলো আমায়? তোমার পা ধরবো? পা ধরে মাফ চাইবো সবুজের মৃত্যু নিয়ে তোমায় জানায়নি বলে? সারাটাদিন বাইরে থেকে খেটেখুটে আসার পরও তুমি বুঝতে চেষ্টা করো না আমিও তো মানুষ। আমারও তো শরীর বলে কিছু আছে! রাত নেই দিন নেই তুমি বাচ্চাদের মতো ব্যবহার করবে আর আমি বাচ্চা ভেবে তোমাকে আগলে রাখতে পারবো না? তখনই তোমার কথা শুরু হয়ে যাবে? এখন কী করবো আমি বলো?”
আর্তনাদ সুর আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল উল্লাসী।
“আপনি আমার সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলছেন? অথচ আপনি এটা খেয়াল করে একটা বারও দেখছেন না আমি চুড়ি পড়েছি। টিপ পড়েছি! কোথায় পেয়েছি আমি সেগুলো সেটা একবারও জানতে চাইছেন না! এতটা কেয়ারলেস কেনো আপনি?”
উল্লাসীর বলা কথার প্রসঙ্গ ধরতে না পারায় বিরক্তির সীমানা ছাড়িয়ে গেল মেসবাহর। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কী করবে ভেবে না পেয়ে নিজেকে শান্ত করতে সে পা বাড়ালো সদর দরজার দিকে।