অন্ধবাড়ি

অন্ধবাড়ি !! Part- 05 ( শেষ পর্ব)

#অন্ধবাড়ি ( শেষ পর্ব)

রুপসা কালো গ্লাসে ঘেরা একটি প্রাইভেট কারের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাড়িতে উঠবে কিনা বুঝতে পারছে না। সে পেছোন ফিরে তাঁকালো। রাইসা পতিতালয়ের মেইন গেটের সামনে ছলছল চোখে তাঁকিয়ে আছে। রুপসাকে ইশারা করে সে বললো তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসতে। হাতে সময় অনেক কম। যেকোনো সময় যে কেউ এদিকে চলে আসতে পারে। রুপসাকে দেখে ফেলতে পারে! তখন সে এই কারাগারে আজীবনের জন্য বন্দি হয়ে যাবে। রুপসা গাড়ির দরজা খুলে শেষ বারের মতো পতিতালয়ের দিকে তাঁকালো। সস্তা বাল্ব জ্বলছে জায়গায় জায়গায়। হলুদ কমলাটে রঙের আলো বেরুচ্ছে। সেই আলোয় এই পুরো জায়গাটাকে জীবন্ত মৃত্যুপুরী বলে মনে হচ্ছে। এখানকার প্রতিটি মেয়ে যেনো একেকটি মৃত আত্মা। তাদের শরীর আছে। শরীরের ভেতর রক্ত মাংসে গড়া একটি হৃদপিন্ড আছে। কিন্তু মন বলে কিছু নেই। অনুভূতি বলে কিছু নেই। দুচোখে কোনো স্বপ্ন নেই, আশা নেই, জীবনে কোনো ভালোবাসাও নেই! এরা মানসিক ভাবে মৃত। এদের মোনাজাতে কখনো পরিবার উঠে আসে না। ভালোবাসার মানুষটির নামও উচ্চারণ হয় না। এরা সৃষ্টিকর্তার কাছে সর্বস্ব শরীরের মৃত্যু কামনা করে।

রুপসা আকাশের দিকে তাঁকালো। আকাশে চাঁদ নেই। লক্ষাধিক তারা মিটমিট করে জ্বলছে। আজ কি অমাবস্যা? মনে তো হয় না। তাহলে আকাশে চাঁদ নেই কেনো? পরিবেশ এত থমথমে কেনো? রুপসার মুক্তিতে কি তারা খুশি নয়? হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া শুরু হলো। সেই ঝড়ো হাওয়ায় ভেসে আসছে মৃত্যুর গন্ধ। ভেসে আসছে শত তরুণীর আর্তনাদ। সম্মান হারানোর আর্তনাদ। না আর এক মুহুর্তও এখানে থাকবে না রুপসা। মুক্তির স্বাদ যে একবার পায় সে পরাধিনতার মাঝে বাঁচতে চায় না। গাড়ির দরজা লাগিয়ে দিলো রুপসা। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাইসা তাঁকিয়ে দেখছে রুপসার ফিরে যাওয়া। এই গাড়ি তাকে নিয়ে যাচ্ছে তার নিজ গন্তব্যে। যেখানে মেয়েটা এক নতুন জীবন গড়ে নিবে। ভয়ার্ত সেই চোখদুটিতে থাকবে অজস্র স্বপ্ন!

আফজাল হোসেন বারে বসে হুইস্কি খাচ্ছেন। তাকে আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখা যাচ্ছে। এমন সময় রাজু ফোন করে জানালো রাইসা এসেছে। আফজাল রাজুকে বললো রাইসাকে বারে পাঠিয়ে দিতে। মিনিট দশেকের মধ্যে রাইসা বারে প্রবেশ করলো। চোখ লাল। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেটে ছুঁড়ে গেছে। আফজাল সাহেব চোখ বড় বড় করে বললো,
” কি হয়েছে তোমার? একি অবস্থা?”
” আগামীকাল রুপসাকে পালাতে সাহায্য করেছি বলে আমাকে মেরেছে।”
” কি বলো! ধরা পড়লে কিভাবে?”
” সুরমা বলে দিয়েছে। রুপসাকে গাড়িতে উঠতে দেখে ফেলেছিলো। ভাগ্য ভালো আর একটু আগে দেখে নি। তাহলে মেয়েটাকে বাঁচাতে পারতাম না।”
” এখানে এলে কিভাবে? তোমাকে আসতে দিলো?”
রাইসা একগাল হেসে বললো,
” দিলো। আমাকে রেখে নিজের ব্যবসা নষ্ট করবে নাকি? তাই ইচ্ছেমতো মেরে নিজেদের শখ মিটিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।”
” তুমি সব বলে দিয়েছো নাকি?”
” আমার বলতে হয় নি। জরিনা আপা নিজেই বুঝতে পেরেছে।”
আফজাল সাহেব রাইসার কাছে এগিয়ে এসে বললো,
“তোমার কপাল দিয়েও তো রক্ত বেরুচ্ছে! চলো এন্টিসেপটিক লাগিয়ে দেই।”
রাইসা কিছু বললো না। আফজাল রাইসাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো। ড্রয়ার খুলে এন্টিসেপটিক বের করে রাইসার ক্ষতগুলো যত্ন করে মুছে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে এখন কোথায় থাকবে বলে ঠিক করেছো?”
রাইসা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“জানি না।”
আফজাল সাহেব মুচকি হেসে বললো,
“জানো রাইসা, মানুষ যখন বুঝতে পারে তার শেষ সময় উপস্থিত হয়েছে তখন তার নানাবিধ ইচ্ছে জাগে। নেশায় ডুবে থাকতে ইচ্ছা করে। আর পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর নেশা হলো নারীর নেশা। আমি আমার জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় নারীর নেশায় ডুবে ছিলাম। ডাইভার্সিটি পচ্ছন্দ করতাম। এক পর্যায়ে এসে জানতে পারলাম এইচ আই ভি পজিটিভ। তখন আসলে করার কিছুই ছিলো না। তবুও নেশা কি এত সহজে ছাড়া যায়? একদিন কোনো এক বিশেষ কাজে তোমাদের পতিতালয়ের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম এক রুপবতী তরূণী মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে সিল্কের শাড়ি! ব্লাউজের পরিবর্তে শুধুই আন্ডারগার্মেন্টস। এর পরেও কোনো পুরুষের নিজেকে সঠিক স্থানে ধরে রাখা বড্ড কঠিন হয়ে পরে। কি ভুল বলেছি?”
রাইসা হেসে বললো,
” না ভুল বলেন নি।”
আফজাল সাহেব ফার্স্ট এইড কিট ড্রয়ারে রেখে দিলেন। ঘরে এসি চলছে। পুরো ঘর হীমশীতল। রাইসার ঘুম পাচ্ছে। সারারাত ঘুম হয় নি। তার ওপর সারারাত তার ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। রাইসা কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই আফজাল বললেন,
” তুমি গতকাল একটা কথা বলেছিলে।”
রাইসা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কি কথা?”
” ছেলেরা বিছানায় সঙ্গী ছাড়া থাকতে পারে না।”
রাইসা চুপ করে ফ্লোরের দিকে তাঁকিয়ে রইলো।
আফজাল হোসেন হেসে বললেন,
“আমার হাতে সময় অনেক কম রাইসা। কিন্তু তোমার কিচ্ছু হবে না। আমি এমন কিছু করি নি যাতে আমার জন্য তুমিও এই অভিশাপ শরীরে বয়ে বেড়াও! তুমি বাঁচবে। আরো শত বছর বাঁচবে।”
রাইসার চোখ ভিজে উঠলো। আফজাল সাহেব বললেন,
“একজন পুরুষ তার শেষ সময় বিছানায় সঙ্গী ছাড়া থাকতে পারে কিন্তু একসাথে সূর্যাস্ত দেখার জন্য হলেও ভালো কোনো বন্ধুর খুব প্রয়োজন বোধ করে। তুমি আমার সেই বন্ধু হবে রাইসা?”
রাইসা বললো, “হবো।”
আফজাল সাহেব টেবিলের ওপর থেকে টিস্যু নিয়ে নিজের চোখ মুছলেন। কতদিন পর তার চোখে পানি এসেছে তিনি নিজেও জানেন না।

বাড়ির ছাদে নানাবিধ ফুলের গাছ। ঠান্ডা বাতাস। দূরে একটি ঘুড়ির সূতো ছিড়ে ভাসতে ভাসতে দিগন্তে মিলিয়ে গেলো। পশ্চিমে সূর্য হেলে পড়েছে। আফজাল হোসেন এবং রাইসা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকটি পাখি তাদের সামনে দিয়ে উড়ে গেলো। আফজাল হোসেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“কি সুন্দর! তাই না?”
রাইসা মাথা নাড়ালো। সূর্যটা অর্ধেক ডুবে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসবে চারিপাশে। তবে যেখানে অন্ধকার হয় সেখানেই নতুন প্রভার দেখা মিলে।

সমাপ্ত।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *