শালুক ফুলের লাজ নাই !! Part- 13
সকাল থেকেই ঝলমলে রোদ।গাছের পাতায় সূর্যের আলো পড়তেই কেমন চকচক করছে সোনার মতো। শালুকদের বাড়িতে আজ রান্নার আয়োজন হচ্ছে বাবুর্চি দিয়ে।
আজকে আফিফার এনগেজমেন্ট।
দুই দিনেই আফিফার চেহারা অন্যরকম হয়ে গেছে।কেমন মলিন হাসছে আফিফা।শালুকের ভীষণ কষ্ট হলো আফিফার জন্য।এতো ভালোবাসলো কেনো আফিফা জহির ভাইকে!
পরক্ষণেই শালুকের মনে হলো সে কি আদনান কে ভালোবাসে নি?তাহলে তার কেনো এমন হয় নি অবস্থা?
সে কেনো পারে নি আফিফা আপার মতো আদনান ভাইয়ের মুখোমুখি হতে?বরং ধ্রুব ভাই বুঝিয়ে বলার পর থেকে শালুকের মাথা থেকেই বের হয়ে গেছে আদনানের ব্যাপারটা।
তবে শালুকের কি এটা ভালোবাসা ছিলো না?
মাথার মধ্যে শালুকের এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে লাগলো। কাকে জিজ্ঞেস করবে এই প্রশ্নের জবাব সে?
নিকটাত্মীয় কয়েকজনকে দাওয়াত করা হলো এনগেজমেন্টে।দুপুরের দিকে পাত্রপক্ষ এলো। আফিফাকে সাজাতে বসলো শাপলা শালুক আশা দিবা নয়না মিলে।আফিফার বিবর্ণমুখ কিছুতেই উজ্জ্বল হলো না এতো সাজের পরেও।
শালুকের বুক কাঁপতে থাকে। আফিফা আপা সুখী হবে তো!
শালুক সাজতে বসে থেমে গেলো। কেনো জানি সাজতে ইচ্ছে করছে না।সেদিন ধ্রুব ভাই বলেছিলো সাজলে ওকে নাকি জংলীদের মতো লাগে।তাকে যে সজারুর মতো লাগে তা তো শালুক বলে নি।
নিজেই হেসে ফেললো শালুক নিজের মিথ্যে কথায়।ধ্রুব ভাইকে কখনোই সজারুর মতো লাগে না। শ্যাম বর্ণের মায়াবী চেহারার মানুষটাকে দেখলেই অন্যদের থেকে আলাদা মনে হয়।
পাঞ্জাবী পরে,টুপি মাথায় দিয়ে যখন মসজিদ থেকে আসে,ধ্রব ভাইকে মনে হয় পৃথিবীর শুদ্ধতম পুরুষ।
শত্রুর ও সাধ্য নেই ধ্রুব ভাইকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করার।মাঝেমাঝে শালুকের ভীষণ গর্ব হয় যখন ক্লাসে স্যারেরা ধ্রুবকে উদাহরণ হিসেবে দেখায়।শালুকের ইচ্ছে করে চিৎকার করে সবাইকে বলতে, “সে আমার ধ্রুব ভাই, আমার দেখা সেরা পুরুষ, শুদ্ধতম পুরুষ সে।”
যদিও কখনো ধ্রুবর সামনে এসব স্বীকার করে না কিন্তু ধ্রুবর মন খারাপ হলেই শালুকের এসব মনে পড়তে থাকে।
সাজলো না শালুক।সুতি একটা জামা গায়ে দিয়ে একটা কালো রঙের হিজাব পরে নিলো। বাগানে স্টেজ করা হয়েছে,বসার ব্যবস্থা ও বাগানে করা হয়েছে।
সকাল থেকে শালুক আর সেদিকে যায় নি।কিন্তু এখন সবাই মিলে নিচে গিয়ে অবাক হলো।
সবকিছু কেমন যেনো বেখাপ্পা লাগছে।সুন্দর করে সাজানো হয় নি কিছুই।
আফিফাকে নিয়ে আসা হলে আফিফার ও মন খারাপ হয়ে গেলো।
একে তো তার মনে ভীষণ কষ্ট তার উপর এমন মরা মরা সাজ দেখে মন আরো খারাপ হয়ে গেলো। কোনোমতে প্যান্ডেল করে চেয়ার টেবিল বসিয়ে দেওয়া হয়েছে যেনো।
আশা এই প্রথম বাংলাদেশের বিয়ে দেখছে।সে নিজেও অবাক।এদের এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান এভাবে করা হয়!
কোনো ডেকোরেশন নেই,কেমন কেমন যেনো।
আফিফাকে সেই কথা জিজ্ঞেস করতেই আফিফা মন খারাপ করে বললো, “আমার কপাল খারাপ আশা।একে তো বিয়ে হচ্ছে যাকে আমার অপছন্দ তার সাথে।তার উপর ধ্রুব ও নেই।আজ যদি ধ্রুব থাকতো তাহলে দেখতে সব কিছু ম্যাজিক করে চেঞ্জ করে ফেলতো।আমার এমনই পোড়া কপাল যে এরকম সময়ে ধ্রুব ও চলে গেলো। ”
সমবয়সী হওয়ায় আফিফা ধ্রুবকে নাম ধরেই বলে।
আশা বুদ্ধি করে সবকিছুর ছবি তুলে ধ্রুবকে পাঠালো।সেই সাথে শালুকের ছবিও।
তারপর আদনানকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এভাবে এনগেজমেন্ট হচ্ছে কেনো?তুমি বড় ভাই আছো কেনো তাহলে? এসব সাজানোর রেসপনসেবলিটি তোমার না?”
আদনান বিরক্ত হলো। কবে আশাকে বিয়ে করতে পারবে তার মাথায় সেই চিন্তা এসব নিয়ে ভাবার সময় কই তার?
তাছাড়া এসব কিছু আদনান বুঝে ও না ভালো। সে এসব কাজকর্মের সময় পিছুটান দেয়।
আশা ধ্রুবকে কল দিয়ে বললো, “ধ্রুব,আফিফার ভীষণ মন খারাপ। ওর বিয়েটা একেবারে যাচ্ছেতাইভাবে হচ্ছে। ”
ধ্রুব জবাব দিলো না। কি বলবে সে?তার নিজের ও কি খারাপ লাগছে না?কিন্তু কি করার আছে তার এখন?
পাত্রপক্ষের কয়েকটি ছেলে আশাকে দেখে কথা বলার জন্য উৎসুক হয়ে গেলো। আশা সবার সাথে হাই হ্যালো করলো। কয়েকজনের সাথে সেলফি তুললো। দূর থেকে এসব দেখে আদনানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। বিড়বিড় করে আশাকে ক্যারেক্টারলেস বলে গালি দিয়ে সবার সামনে থেকে টেনে নিয়ে গেলো নিজের রুমে।
আশা অবাক হলো আদনানের এই ব্যবহারে। তবুও কিছু বললো না। সে দেখতে চায় আদনান কি করে!পুরোটা সময় আদনান আশাকে নিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে বসে রইলো।
মেহমানদের খাবার সময় আরেক ঝামেলা হলো। পাত্রপক্ষ খাবার আগে কনেপক্ষের দাওয়াত করা মেহমানেরা খেতে বসে গেলো। এই নিয়ে পাত্রপক্ষ রেগে আগুন হয়ে গেলো। নুরুল ইসলাম সাহেব সবাইকে কোনোমতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠান্ডা করলেন।এরমধ্যে অনেকে অনেক কথা বলে ফেললো।
আদিবা বেগম বিপদ টের পেয়ে ধ্রুবকে কল দিলেন।এই দুই দিন ধ্রুব যদিও বাড়ির কারো কল রিসিভ করে নি আশা ছাড়া তবে এই মুহূর্তে বড় চাচীর কল রিসিভ না করে পারলো না।
আদিবা বেগম ধ্রুব কল রিসিভ করতেই হঠাৎ করেই ইমোশনাল হয়ে গেলেন।না চাইতেই কান্না চলে এলো তার। কান্নাজড়িত স্বরে ধ্রুবকে বললেন,”বাবা তুই কই?এদিকে তো মান সম্মান সব শেষ হয়ে যাচ্ছে আমার। তোর পায়ে পরি বাবা তাড়াতাড়ি বাড়িতে আয়।তোর বোনের বিয়েটা নয়তো ঝামেলাহীনভাবে হবে না।তোর বড় ভাই গাধা কোথায় গিয়ে বসে আছে। এদিকে পাত্রপক্ষ রাগারাগি করছে তাদের আগেই আমাদের দিকের মেহমান খেতে বসে গেছে বলে। ”
“আমি আসছি” বলে ধ্রুব দৌড়ে বাসা থেকে বের হলো। ধ্রুব উঠেছে তার এক বন্ধুর বাড়িতে।পরনের কুঁচকানো শার্ট, প্যান্ট পরেই ধ্রুব দৌড়ে এলো। রাস্তায় এসে একটা রিকশা পেয়ে লাফিয়ে উঠে বললো,”চাচা,তালুকদার বাড়ি চলেন।”
মোটরচালিত রিকশায় বাড়ি আসতে ধ্রুবর ১৫ মিনিট লাগলো।
পাত্রপক্ষ খেতে বসলো কিন্তু দেখা গেলো খাবার সার্ভ করার সময় মেয়েপক্ষের কেউ নেই।
বাবুর্চিদের লোকেরা তো আর বেড়ে দিবে না,তাদের কাজ টেবিলে খাবার পৌঁছে দেওয়া খাবার শেষ হয়ে গেলে।তাদের কাজ হচ্ছে ঢিমেতালে।
এদিকে মেয়ের বাবা,চাচা,দাদাকে বসতে হলো ছেলের চাচা,বোনের জামাই,মামা,ফুফাদের সাথে। তারা উঠে কিছু করতেও পারছেন না।ওদিকে আদিব,আকিফ,জাবির,দিব্য ছোট মানুষ। কাকে কোন আইটেম এগিয়ে দিবে তারা কিছু বুঝতে পারছে না।দেখা যায় সবাই মিলে এক টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে অন্য টেবিলগুলোতে কেউ নেই। এই টেবিল থেকে একজন বলছে এখানে মাংস নেই তো ওই টেবিল থেকে বলছে কাচ্চি নেই।
কারো টেবিলে বোরহানি নেই।
আদনানও নেই এখানে।সব কেমন বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে। মেয়ে পক্ষের মেহমান যারা ছিলো তারা খেয়ে দেয়ে ঘরে গিয়ে বসে আরাম করছে।লজ্জায় শালুকের দাদার মাথা নিচু হয়ে গেলো।
শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে ধ্রুব খাসির মাংসের বাটি নিয়ে এগিয়ে এলো যেই টেবিলে পাত্রপক্ষের মামা চাচা দুলাভাইসহ প্রধান অভিভাবকেরা বসেছে।
সবার প্লেটে খাসির মাংস বেড়ে দিলো,ডেকোরেটরের লোকদের ডেকে কড়া গলায় হুকুম দিলো সবাই একটা একটা করে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য।যা শেষ হবে তা যেনো দ্রুত নিয়ে আসে।
পাত্রের দুলাভাইদের প্লেটে ডাবল রোস্ট তুলে দিয়ে হালকা হাসিমশকরা করার সাথে সাথে নিজের ভাই সবাইকে ডেকে বললো সবাই যেনো একটা একটা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে কার প্লেটে কি লাগবে সেসব তুলে দেয়।ঠিকভাবে কাজ করতে পারলে সবাইকে আগামীকাল ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হবে।
পূর্ণ উদ্যমে সবাই কাজে লেগে গেলো এবার।ধ্রুবর কড়া কথায় ডেকোরেটরের লোকেরাও হাত লাগিয়ে কাজ করতে লাগলো।
ধ্রুবর দাদার মুখের কালো ছায়া সরে গেলো নিমিষেই। ধ্রুব ভোজবাজির মতো এই কাউকে রোস্ট তুলে দিচ্ছ এতো কারো জন্য কাচ্চি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কারো প্লেটে মাংস শেষ তো নিজ হাতে বেড়ে দিচ্ছে।
কারো বাচ্চা কান্না করছে তো আবার তাকে কাঁধে বসিয়ে সবার জন্য বোরহানির জগ নিয়ে ছুটছে।
কাজের মধ্যে সবার সাথে সমানতালে কথা ও বলে যাচ্ছে।
আগামী শুক্রবার বিয়ের তারিখ ধার্য করা হলো ৫ লক্ষ টাকা দেনমোহরে।
পাত্রপক্ষ খাবার পর শালুকেরা বাসার সবাই আসলো খেতে।ধ্রুবকে দেখে শালুক চমকে গেলো। ধ্রুব ভাই বাড়িতে এসেছে!
কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে শালুকের।আফিফা অনেক আগেই ধ্রুবকে দেখেছে কিন্তু পাত্রের বোনেরা সাথে থাকায় কথা বলতে পারে নি। সবাই ঘরে বিশ্রাম নিতে যাওয়ায় আফিফা দৌড়ে এসে ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।
কে জানে কেনো,ধ্রুবর ও চোখ ভিজে উঠলো। আফিফা কাঁদতে কাঁদতে বললো, “ধ্রুব তুই কথা দে,তুই আমার বিয়ের সবগুলো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবি।তুই না থাকলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে।”
ধ্রুব হাসলো আফিফার কথায়।তারপর কথা দিলো বিয়ের সব অনুষ্ঠানে ধ্রুব অবশ্যই হাজির থাকবে।
খেতে এসে আদনান শুনলো এই কথা।ধ্রুবকে দেখে আশা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমি ভীষণ অবাক হয়েছি তোমাকে দেখে ধ্রুব।এতোক্ষণ সব অসম্পূর্ণ ছিলো যেনো তুমি না থাকায়।”
ধ্রুব মুচকি হেসে সন্তর্পণে আশাকে সরিয়ে দিলো।
আদনানের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। তারপর হুট করেই মাথায় একটা প্ল্যান চলে এলো আশার কাছ থেকে ধ্রুবকে দূরে সরাবার।নিজের বুদ্ধিতে আদনান নিজেই অবাক হলো এতো দারুণ প্ল্যান কিভাবে এলো তার মাথায়!
খুঁজে পাতিল থেকে মুরগির লেগ পিস এনে ধ্রুব শালুকের পাতে দিয়ে বললো, “মন খারাপ করে রেখেছিস কেনো?তোর লেগ পিস লাগবে আমি তা ভুলি নি।চারটা লেগ পিস রেখেছি তোর জন্য।”
মেহমান বিদায় নেয়ার পর ধ্রুব ও চলে গেলো না খেয়ে।শত বলেও কেউ তাকে খাওয়াতে পারলো না।
রাতে শালুক আফিফাকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপা,কেউ যদি কাউকে ভালোবাসে,তবে কি তার পাশে অন্য কোনো মেয়েকে সহ্য করতে পারে? ”
আফিফা হাসলো।বড় করুণ সেই হাসি।তারপর বললো, “না রে শালুক,সেটা ভালোবাসা কিছুতেই নয়।ভালোবাসা হলে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার অধিকার আদায় করে নিতো। তাকে না দেখলে বুক চিনচিন করতো।অভিমানে চোখে জল আসতো।ভালোবাসার মানুষের কষ্টে নিজের কলিজা ছিড়ে যাবার মতো ব্যথা হয়।তার মুখে হাসি না থাকলে নিজের দুনিয়া অন্ধকার মনে হয়। নিজের সব আনন্দ হারিয়ে যায়।যেমন আমার হতো জহির ভাইয়ের জন্য।”
শালুক ভয়ংকরভাবে চমকালো এসব শুনে। তবে সে কাকে ভালোবেসেছে?
কোনটা ভালোবাসা কোনটা মোহ সে কি বুঝে নি?
না-কি কখনো ভালো বাসে নি!
চলবে….
রাজিয়া রহমান