আলোছায়া

আলোছায়া !! Part- 16

“ইভানা আপু কবে এসেছে?”
উল্লাসীর প্রশ্নে হাই তুলে তার চুলে হাত বুলিয়ে নিল মেসবাহ। ঘুমের ভাবটা কেটে গেছে তার। শরীরের ভেতরের অস্থিরতাটাও কমে এসেছে। শুধু রয়ে গেছে মাথায় ভারী ভাবটা। তাই চোখজোড়া বুজে রইলো সে। ধীর স্বরে থেমে থেমে বললো,
“জানা হয়নি।”
“জানেন না? তাহলে উনাকে কেনো ডাকলেন?”
“আমি তো ডাকিনি।”
“বললেই হলো! আপনি আগে বলুন আপনার শরীর খারাপ কেনো করেছিল? আমার বিরহে না?”
হেসে উঠলো মেসবাহ। উল্লাসীর মাথা থেকে হাত সরিয়ে পিঠে নিয়ে সজোরে চেপে ধরতেই ওপাশ থেকে উল্লাসী আবারও বললো,
“হাসছেন যে! আপনি বলুন কেন আপনার শরীর খারাপ করেছিল?”
ঠোঁটের কোণায় হাসি নিয়ে মেসবাহ বললো,
“ওইতো.. তোমার বিরহে।”
“ইশ! এভাবে বলতে লজ্জা করেনা?”
মেসবাহর বুকে খানিকক্ষণ মিশে থাকার পর তার গালে একটি চুমু দিয়ে উঠে বসলো উল্লাসী। আশেপাশে নজর বুলিয়ে পরণের ওড়না খুঁজে নিয়ে পরতে পরতে বললো,
“এখন কেমন লাগছে? একটু ভালোলাগছে কি?”
“লাগছে.. তবে ক্ষুধা পাচ্ছে।”
মাথা নেড়ে মেসবাহ জবাব দিতেই ক্ষোভে ফেটে পড়লো উল্লাসী। উঠে দাঁড়িয়ে সে চোখমুখ কুঁচকে বললো,
“শুধু ঔষধ খাইয়ে বুক, মাথা হাতালেই চলবে? ভাতটা যে খাওয়াতে হবে তার সে জ্ঞান নেই? অকর্মার ঢেঁকি একটা। আসুক আবার.. উনাকে বুদ্ধি বাড়ানোর জন্য ঢেঁকি শাক আমি খাওয়াবোই খাওয়াবো।”
সেকথার জবাব না দিয়ে মেসবাহ পাশ ফিরে শুতেই এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিল উল্লাসী। তারপর বিছানার উপরে পড়ে থাকা মেসবাহর বুকের লোমগুলো উঠাতে উঠাতে বললো,
“গরম ভাত বসিয়ে দেই?”
“দাও..”
“কী দিয়ে খাবেন? দুপুরে তো কিছু রান্না হয়নি।”
“কাল রাতের তরকারি থাকলে ওটাই গরম করে দাও।”
“না, না। ওসব কেনো খাবেন? মুন্নি ভাবির কাছ থেকে তরকারি আনছি।”
আবারও উল্লাসীর দিকে ফিরলো মেসবাহ। চোখমুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে বললো,
“না.. ওসব খাবো না। ভর্তা করে দাও। ডাল ভর্তা। কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে করবে।”
মেসবাহর আদেশ পাওয়ামাত্র রান্নাঘরে ঢুকে ভাতের চাল ধুয়ে রাইস কুকারে বসিয়ে দিয়ে ডাল চুলোয় সিদ্ধর জন্য বসিয়ে আবারও ঘরে ফিরে এল উল্লাসী। মেঝে ঝাড়ু দিয়ে ঘরের আলো নেভানোর পায়তারা করতেই ওপাশ থেকে মেসবাহ বললো,
“থাক.. আমি ওয়াশরুমে যাবো।”
“ধরবো?”
“এসো..”
ঝাড়ু রেখে মেসবাহর দিকে এগিয়ে এল উল্লাসী। তাকে ধরে ওয়াশরুমে পৌঁছে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে বললো,
“দরজা লাগাবেন না.. এভাবেই থাকুক।”
“চাপিয়ে তো দাও।”
“চাপাচাপিরও দরকার নেই। আপনি যা করার দ্রুত করুন।”
উল্লাসীর সঙ্গে না পেড়ে উঠে মেসবাহ দরজা হালকা চাপিয়ে দিতেই উল্লাসী এল ফোনের খোঁজে। পুরো বিছানায় তন্নতন্ন করে খুঁজে না পেয়ে টেবিলের দিকে নজর দিতেই অতি আকাঙ্খিত মেসবাহর ফোনটি দেখতে পেল সে। এগুলো সেদিকে। লক খুলে নোটিফিকেশন চেক করতেই তার দ্বিতীয় আকাঙ্খিত এসএমএসটিও গেল পেয়ে। মিনিট পাঁচেক আগেই এসএমএস করেছে ইভানা। দুটো এসএমএস। গোটাগোটা অক্ষরে ইংরেজিতে যাতে লেখা রয়েছে,
‘Are you awake?’
‘Are you Feeling better now? Then call me. It’s urgent.’
-Evana
পুরো শরীর নিশপিশ করে উঠলেও নিজেকে সামলে নিল উল্লাসী। বাথরুমের ভেতর থেকে মেসবাহর কাশির শব্দ শুনে দ্রুত এসএমএস দুটো ডিলিট করে সে আবারও দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই মেসবাহ বেরিয়ে এসে নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কী করেছো এসব?”
খুব মিষ্টি করে একটি হাসি দিয়ে মেসবাহর হাত আঁকড়ে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিল উল্লাসী। তারপর টাউয়েলের এক কোণা ভিজিয়ে এনে মেসবাহর বুক মুছে দিতে দিতে আদুরে গলায় বললো,
“গরম প্রচুর পড়েছে না?”
ভ্রু কোঁচকালো মেসবাহ।
উল্লাসী পূর্ব সুরেই বললো,
“এই গরমে আপনার মাথার চুল ছেটে ফেলা দরকার। নাড়ু মাথায় আপনাকে অসম্ভব সুন্দর লাগবে। বুঝছেন? একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগবে।”
“বুড়ো বয়সে বাচ্চা বাচ্চা লাগার কোনো দরকার আছে কি? তাছাড়া বুকে যা করেছো এটা কম না?”
মেসবাহ গম্ভীর স্বরে কথাখানা বলে উঠতেই ম্লান হাসলো উল্লাসী। তার পাশে বসে বেশ উচ্ছাসিত কন্ঠে বললো,
“জানেন ছোট বেলায় আমি প্রচুর জাম্বুর সিনেমা দেখতাম বিটিভিতে? ছোট সেই সুহা জাম্বুকে দেখলেই হেসে কুটিকুটি হতো.. আর আমি খুশিতে ফুলঝুরি! আর তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম! আমার একটা জাম্বুর মতো বর চাই-ই চাই।”
রাতের জন্য খালা ডিম ভাজি আর আলু ভর্তা করে রেখে গেলেও এতদিন পর আনিস আসায় চিন্তায় পড়ে গেল মুবিন। তাকে আর যাইহোক এসব দিয়ে খেতে দেয়া যায় না। তবে উপায়? আকাশকুসুম ভেবে হোটেলে যাবা তোরজোর করতেই হঠাৎ পুষ্পর আনা খাবারের কথা স্মরণ হলো তার। আজ দুপুরে আসার সময় সে সাথে করে এনেছিল গরুর মাংসের তারকারি। আর মেয়েটির হাতের রান্না অমৃত থেকে কোনো অংশেই কম নয়! ভাবামাত্রই ফ্রিজ থেকে সেই বাটিটা বের করলো মুবিন। সময় নিয়ে তা গরম করে টেবিলে খাবার গুছিয়ে নিতেই ডাইনিংয়ে এল আনিস। হাসিমুখে চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
“গরুর মাংস? দারুণ এক ঘ্রাণ বেরিয়েছে তো।”
কথার পিঠে হাসলো মুবিনও। চেয়ারে বসে প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে বললো,
“তুই তো কাল আছিস তাই না?”
“আছি.. তবে কাল রাতের বাসের টিকেট কেটেছি।”
স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়লো আনিস।
মুবিন বললো,
“তা যাত্রার উদ্দেশ্য কোথায়?”
“বড় আপার বাসা।”
“তাহলে তোকে কাল একজনের সাথে দেখা করাবো।”
“কার সাথে?”
“কালই দেখতে পাবি। দাঁড়া টাইমটা আগে ওকে জানিয়ে দেই।”
পুষ্পকে ম্যাসেজ করে টাইম জানিয়ে দিল মুবিন। তারপর তরকারির বাটি থেকে মাংসের পিচ তুলে আনিসের প্লেটে দিতে দিতে বললো,
“কবে এলি সৌদি থেকে?”
“মাস খানেক।”
“মাস খানেক? অথচ আমাকে একটা কলও করিসনি?”
ভাত মুখে পুড়তে পুড়তে আনিস বললো,
“নানান ঝামেলায় ছিলামরে বন্ধু।”
“কীসের এত ঝামেলা? আর তোর কাজেরই বা কী অবস্থা? চলে এলি কেন সৌদি থেকে?
“দেশের মাটি দেশের ঘ্রাণ.. পরের দেশে ওসব আছে নাকি! তবে শোন, একটা নতুন বুদ্ধি পেয়েছি।”
বেশ উল্লাসের সাথে আনিস জবাব দিলেও ভ্রু কোঁচকালো মুবিন।
“যা টাকা কড়ি ওই পরের দেশ থেকে এনেছিস, তা এখন নিজের দেশে ঢেলেঢুলে নষ্ট কর।”
“নষ্ট হবে না বন্ধু। এটা করলে বরং সেই লেভেলেই লাভ হবে।”
“তাই? তা কী এমন লাভের কাজ সেটি?
“মাছ চাষ করবো। তোর আব্বার সাথেও কথা হয়েছে। পুকুর লিস নেয়ার ব্যবস্থা চাচা বলেছেন করে দেবেন।”
আনিসের কথায় চোখমুখে অসন্তোষ ফুটিয়ে মুবিন বললো,
“তুই কি এসবে অভিজ্ঞ?”
“অভিজ্ঞ নই। তবে হতে কতক্ষণ?”
“হ্যাঁ.. শেষে হাঁস মুরগিরটার মতো আবারও লস খা।”
“না.. এবার ওসব হবে না। এবার আমার প্ল্যান একদম ফিটফাট। ওইবার আসলে দোষ ছিল ভাগ্যের। মুরগিগুলো অসুস্থ না হয়ে পড়লে লস কখনোই খেতাম না!”
আত্মতৃপ্তি নিয়ে বললো আনিস।
মুবিন জবাবে সামান্য ক্ষোভ নিয়ে বললো,
“আমি বুঝি না তুই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে এসব কেনো ধরলি! কী পাস এসবে?”
“শোন, যারা ব্যবসার চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘোরে তাদের এসব পড়ালেখা বা চাকরি টাকরিতে মন বসেনা।”
“এরা চায় বিল গেইটস মতো পয়সাওয়ালা হতে। তাই তো?”
হাসলো আনিস। ভাত চিবাতে চিবাতে বললো,
“রাখ তো.. আসল কথায় আসি।”
“আসল কথাটা আবার কোন ব্যবসা নিয়ে?”
মুবিন উপেক্ষিত গলায় কথাখানা বলতেই ওপাশ থেকে আনিস বললো,
“সবুজ ভাই তো মারা গেছে।”
“কোন সবুজ?”
“চৈতালির বর।”
একমুহূর্তের জন্য যেনো হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে এল মুবিনের। চোখমুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে সে রুদ্ধশ্বাস কন্ঠে বললো,
“সত্যি? কবে? কীভাবে?”
“আমি জানতাম তুই জানিস না। চাচার সাথে কথা বলেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম।”
খাওয়া বন্ধ করে সবুজের মৃত্যুর বর্ণনা করতে গিয়ে মুবিনকে সবটা বললো আনিস। তারপর জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে তা এক ঢোক পান করে মুবিনকে আস্বস্ত করার সুরে বললো,
“ঢাকায় আমার আসার কোনো প্ল্যান ছিল না। তবে আমার মনে হচ্ছিলো তোর সাথে কোথাও অন্যায় হচ্ছে। তোর যেখানে বিয়ের কথাবার্তা চলছে সেখানে নিষেধ করে দে। সময় নে.. চৈতালিকেও সময় দে। তোর কপালে হয়তো তোদের দুজনের মিলনটাই লেখা ছিল।”
“একটা মিনিট দে আমায়। আমি আসছি।”
ঘাড় নেড়ে ফোন পকেটে তুলে সিঙ্কে হাত ধুয়ে দ্রুত ছাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা হলো মুবিন। অদ্ভুত লাগছে তার। চারপাশটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। নিজেকে ভারহীন কোনো বস্তু মনে হচ্ছে। কিছুটা তুলোর মতো.. যাকে এক তুরিতেই উড়িয়ে নিতে সক্ষম মলিন বাতাস।
ছাদের রেলিংয়ে হাত রেখে খানিকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো মুবিন। বারবার তার কানে বাজছে আনিসের শেষ কথাটি। তোদের দুজনের মিলনটাই লেখা ছিল.. লেখা ছিল? সত্যিই লেখা ছিল? আদৌ কি তাই লেখা আছে? মনের ভেতরের গুমোট পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পকেট থেকে ফোন বের করলো মুবিন। তারপর দিকবিদিকশুন্য ভাবে কল করে বসলো চৈতালির নাম্বারে।
চারবার রিং হতেই ওপাশ থেকে চৈতালি কল রিসিভ করতেই গলার ভেতরটা ভারী হয়ে উঠলো মুবিনের। বুকের ভেতরটা উঠলো কষ্টে মুচড়ে। কাঁপা স্বরে কোনোমতে সে চৈতালির নাম নিতেই ওপাশ থেকে দীর্ঘক্ষণের নীরবতা ভেঙে মুখ খুললো চৈতালি।
“কতটা বেহায়া হলে ফিরিয়ে দেয়া মানুষটি প্রার্থনাতে থাকে জানি না। তবে এটুকু জানি আমি ভালো নেই। আমার ছেলেটাও ভালো নেই.. আমাদের নিয়ে যাবে তুমি?”
(চলবে)