তবু মনে রেখো

তবু মনে রেখো !! Part- 07

ঘুম ভাঙতেই শিমুলের মনে হলো তার উপর কিছু ভারী জিনিস রাখা হয়েছে। এমনেও বেচারির শেষ রাতে ঘুম এসেছে। ইফতির সাথে প্রথম বেড শেয়ার করছে। খুব অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে রাত কাটায় শিমুল। শেষমেশ শেষরাতে সব চিন্তা ভাবনার জ্বলাঞ্জলি দিয়ে ঘুমের সাগরে পাড়ি জমায়। চোখ খুলতেই ফিল করতে লাগলো কিছু ভারী জিনিস তার বুক আর পেটের উপর রয়েছে। বেশকিছুক্ষন পর বুঝতে পারলো ভারী জিনিসগুলো আর কিছুই না, পাশে শুয়ে থাকা বাপ-মেয়ে। ছোটজন তার পুরো শরীরটাই তার উপর দিয়ে রাখছে, আর বড়জন তার দানবের মত পা তার পেটের উপর দিয়ে রাখছেন। ছোটটাকে পুরো বড়টার মিনিএচ্যার লাগতেছে। একই রকম ভাবে ঘুমিয়ে আছে দুজন,শোয়ার ভঙ্গি একই এবং সেটা খুবই বাজে। ছোট টাকে ঠিক মতো শুইয়ে, বড়জন পা গুলো সরাতে লাগলো শিমুল। ইফতির পা খুব সাবধানে সরিয়ে, ফ্রেশ হয়ে নামায পড়ে নিলো শিমুল, আজ তার হাসপাতালে যেতে হবে। তাই সব কাজ সেরে রেডি হতে হবে। তাই রান্নাঘরে যেয়ে নাস্তা বানাতে শুরু করে। আফসানা বেগম উঠে গেছেন। বউ শাশুড়ীর খুব মিলেছে সকালে নাস্তা বানাতে বানাতে কড়া করে এক কাপ চা খাবে তারা। সব প্রায় শেষ তখন কেউ এসে আচল ধরে টান দেয় শিমুলের। পেছনে ফিরে দেখে অথৈ উঠে গেছে। অথৈকে হাত মুখ ধুইয়ে খাওয়িয়ে দেয় শিমুল।
– বাবু, মামুনি আজকে হসপিটালে যাব। তোমাকে দাদুমনির কাছে থাকতে হবে। ঠিক আছে?
– তুমি নিবা না?
– না বাবু ওখানে সুই আছে, তোমাকে যদি লাগিয়ে দেয় তখন কি হবে? তুমি দাদুমনির কাছে থাকবা ঠিক আছে?
– আচ্ছা।
– সোনা মা আমার।

অথৈ ইঞ্জেকশন ভয় পায়, তাই মামুনি যা বললো সব কিছুতে হ্যা বলে দিলো সে। অথৈকে সখিনার কাছে দিয়ে রুমে চলে এলো শিমুল। রেডি হতে হবে, ৯.৩০ টায় রিপোর্টিং।
মহারাজ এখনো ঘুমোচ্ছে। কিছুক্ষন হালকাভাবে ডেকেও লাভ হলো না, মহারাজ গভীর ঘুমে। শিমুল তাই ব্যার্থ চেষ্টা না করে ওয়াশরুমে চলে গেলো। পানির ঝাপটা মুখে পড়ায় ইফতির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। পিটপিট করে চোখ খুলেই দেখতে পেলো একজন নারী আকাশী রঙের শাড়ি পড়ে তার ভেজা চুল গুলো মুছছে। এতো স্নিগ্ধ লাগতে যেন বর্ষায় ভেজা কোনো অপরাজিতা ফুল। খুব ইচ্ছে করছে ফুলটাকে ছুয়ে দিতে।
– উঠে গেছেন, ফ্রেশ হয়ে নিন। বাবা চলে এসেছেন বোধহয় ডাইনিং রুমে।

শিমুলের কথায় ঘোর কাটলো ইফতির। মুহূর্তেই মুড অফ হয়ে গেলো। এক মিনিট বসে না থেকে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে। শিমুল ততক্ষনে রুম গুছিয়ে ফেলেছে। মাথা মুছতে মুছতে বের হলে ইফতির সাথে শিমুলের ধাক্কা লাগে। শিমুল টাল সামলাতে না পেরে ইফতি কাঁধ আঁকড়ে ধরে। ইফতিও শিমুলের কোমড় ধরে ওকে পড়ার থেকে রক্ষা করে। ইফতির ছোয়া পেয়ে প্রথমে খানিকটা কেঁপে উঠে শিমুল। ইফতির ভেজা চুলের পানি শিমুলের মুখে পড়ছে। দুজন দুজনার চোখে যে কতক্ষণ হারিয়ে যায় তার কোনো হিসেব নেই।
– মাউনি,মাউনি। সকিনা পঁচা, আমাকে খেলে না।

বলেই অভিযোগের পুটরি নিয়ে হাজির অথৈ। তাড়াতাড়ি ইফতি শিমুলকে সোজা করে নিজের কাজে চলে যায়। শিমুল অথৈকে নিজে রুম থেকে বের হয়ে যায়। ইফতির নিজের মাথায় গাট্টা মারতে ইচ্ছে করছে। আজ তার কি হয়েছে। মনে মনে বলছে,
– এটা শিমুল,এটা শিমুল। এটা কোনো বিশ্বসুন্দরী না। ওর প্রতি এতো আকর্ষিত হওয়ার কিছু নাই। তুই ভুল দেখছিস, এটা একটা মোহ শুধু।

অপরদিকে শিমুলের মুখ লাল হয়ে আছে, কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া সময়টা তার বারবার মনে পড়ছে। শিমুলের এখন কড়া এক কাপ চা খেতে হবে। মাথা হ্যাং হয়ে যাবে নয়তো তার। শিমুলের চা খাওয়ার একটা বাতিক আছে। নাস্তা খাওয়ার পর, ইফতি, সিকান্দার সাহেব এবং শিমুল এক সাথে বেরিয়ে গেলো। শিমুলকে হসপিটালের সামনে ড্রপ করে ইফতি অফিসে রওনা দিলো। হসপিটালে রিপোর্ট করে ওয়ার্ডের দিকে যেতেই কেউ একজন ডেকে উঠলো,
– শিমুলফুল

পেছনে ফিরে তাকাতে লোকটি এসে তাকে এক রকম জড়িয়ে ধরলো। লোকটি আর কেউ নয়, শিমুলের স্কুল ফ্রেন্ড এবং তার কলিগ নিহাল। নিহাল বরাবরই শিমুলে খুব ভালো ফ্রেন্ড। যদিও শিমুল তাকে বন্ধুই ভাবে কিন্তু নিহাল তাকে বন্ধুর চেয়েও বেশি মনে করে।
– নিহাল ছাড়, মানুষ দেখছে।
– একসপ্তাহ কই ছিলি? আমি ছুটি থেকে আসার পর শুনলাম তুই নাকি ছুটি নিছিস।কই গেছিলি?
– কোথাও যাই নি, তোর সাথে জরুরি কিছু বলার আছে।
– বেশ তবে ক্যান্টিনে চল
– এখন ওয়ার্ডে যাবো, তোর ডিউটি কোথায়?
– আইসিউ তে।
– ওহ তাহলে আমি চেক করে তোকে ফোন দিবো নে, তুই ফ্রি থাকলে বলিস। অনেক কথা আছে।

নিহাল দাঁড়িয়ে শিমুলের যাওয়া দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটাকে এখন থেকে নয় স্কুল লাইফ থেকে ভালোবাসে, কিন্তু বলার সুযোগ,সাহস কিছুই হয় নি। এখন হসপিটালে ভালো চাকরি পেয়েছে, সে এখন স্ট্যাবলিসড হয়েছে। এখন ওকে তার মনের কথা বলাই যায়। আর শিমুলের ইনফার্টাইলিটিতে নিহালের কিছুই যায় আসে না। সে শুধু তার শিমুলফুলকে নিজের করে নিতে চায়। যদি শিমুল বাধ সাধে সরাসরি বলে দিবে তাকে, দরকার হলে এডাপ্ট করতেও রাজি নিহাল। কিন্তু নিহাল তো জানেই না তার শিমুলফুল এখন অন্য কারোর বউ, অন্য কারোর মা।

শিমুল দুপুরের দিকে ফ্রি হয়, সকাল থেকে প্রচুর রোগী দেখেছে সে। এখন তার মেয়ের খোঁজ নিতে হবে। আফসানা বেগমকে ফোন দিয়ে বেশ কিছুক্ষন কথা বললো শিমুল।
– ভালো হয়েছে তুমি ফোন করছো, তোমার মেয়ে খেতেই চাচ্ছে না
– মা, আপনাকে খুব জ্বালাচ্ছে না ও?? ওকে একটু ফোনটা দিবেন।
– আচ্ছা দিচ্ছি।

অথৈকে ফোন দিতেই তার কথার পুটরি খুললো,
– মাউনি, দাদুন মাত দেয়। আমি খাবো না।
– সোনা, দাদুমনিকে জ্বালিও না। খেয়ে ফেলো, তুমি না আমার সোনা বাচ্চা।
– তুমি আছবা না?
– আসবো সোনা, আমি কাজ করি যে। কাজ শেষে এসে পরবো। তারপর আমরা খেলবো। বলো আসার সময় কি আনবো মামুনি?
– চককেট, আসকিম, তিপস।
– আচ্ছা, মামুনি নিয়ে আসবো। তুমি ভালো বাচ্চার মতো মাছ খেয়ে ফেলো তো সোনা। যদি দাদুমনি বলে তুমি গুড বাচ্চা, তাহলে মামুনি সব নিয়ে আসবো। এবার তুমি দাদুমনিকে ফোন দাও।
– আচ্ছা

আফসানা বেগমের সাথে কথা বলে ফোন রেখে দেয় শিমুল। ফোন রাখতেই নিহাল হাজির। সে অনেকক্ষন আগেই এসেছিলো, কথা বলছিলো বলে ডিস্টার্ব করে নি।
– কি কথা হলো পুচকুর সাথে?
– হুম পুরো পাকা বুড়ি একটা। পুট পুট করে কথা বলতেই থাকে।
– ও এখন কোথায়? তোর কাছে নাকি ওদের বাসায়।
– তোকে জরুরি কথা বলার আছে, ফ্রি তুই? তাহলে ক্যান্টিনে যেতাম।
– হুম চল, মেলা খিদা লাগছে।
– তোর তো খুদা লাগবেই। সারাক্ষন খাই খাই, চল।
– হাহাহা, এখন কি করবো বল, একটা বউ থাকলে না হয় সে রান্না করে খাওয়াতো। তা তো নাই, এখন ক্যান্টিন ই ভরসা।
– করে ফেল না, মানা কে করছে। আন্টির ও বয়স হয়েছে।
– এবার বিয়েটা করেই ফেলবো। বউ পালার সামর্থ্য হয়ে গেছে।

বলেই তারা ক্যান্টিনের দিকে রওনা দিলো। খাবার নিয়ে বসতে না বসতেই ফোন বেজে উঠলো শিমুলের, ফোন বের করে ১০০ ভোল্টেজের একটা শক খেলো সে। জনাব ইফতি রহমান তাকে ফোন করেছে। নিহালের কাছ থেকে একটু দুরে দাঁড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করে শিমুল।
– হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুমুস সালাম, কি অবস্থা?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনার?
– হুম ভালো। কখন ছুটি হবে?
– ৫-৫.৩০ টার দিকেই ফ্রি হয়ে যাবো, শিফট শেষ হয়ে যাবে।
– আচ্ছা, রাখি।

বলেই ফোন রেখে দিলো মহারাজ। শিমুল বুঝতে পারছে না এই লোকের আজ হলোটা কি! টেবিলে যেয়ে দেখে নিহাল খেতে আরম্ভ করে দিয়েছে।
– কিরে একটু অপেক্ষা ও করলি না??
– তুই দেরি করছিলি, কে ফোন করেছিলো রে?
– ইফতি মহাশয়
– ও তোকে কেন ফোন করেছে?
– ওহ তোকে যেটা বলা হয় নি। আমার আর ইফতির বিয়ে হয়ে গেছে। এই সপ্তাহ এই জন্যই আমি ছুটি নিয়েছিলাম। ঘরোয়া ভাবেই বিয়েটা হয়েছে, আজ ৪ দিন হলো আমার বিবাহিত জীবনের।

শিমুলের কথা শুনে যেন মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে নিহালের। চোখ মুখে আঁধার ছেয়ে গেলো। যে মেয়েকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন বুনেছিলো সেই মেয়ে আজ অন্য কারোর বউ৷ তবে সে বড্ড দেরি করে ফেললো৷ সে তো ভেবেছিলো শিমুলকে এই সপ্তাহের মধ্যেই মনের কথা বলে দিবে, কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো।
– তুই আমার কথা শুনছিস তো?

শিমুলের কথায় বাস্তবে ফিরে আসে নিহাল। হৃদয়ে যেন কেউ ধারালো কোনো ছুরি নিয়ে আঘাত করে যাচ্ছে এতোটা কষ্ট হচ্ছে। তবু নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলো শিমুলকে,
– তুই কি হুজুকে মাতাল হয়ে বিয়েটা করলি?
– এমন কেনো মনে হচ্ছে তোর?
– আর কি মনে হবে? তুই বল? ইফতি তোকে মেনে নিবে কোনোদিন? বকুলের জায়গা তোকে দিবে ও??
– না দিবে না, সেই আশা আমি করি ও না। আমি পুচকুর জন্য বিয়েটা করেছি।
– পুচকুকে সামলে রাখার আরো ওয়ে ছিলো শিমুল।
– তুই হাইপার হচ্ছিস কেন?
– কেন হবো না, একটা সমঝতার সম্পর্কে তুই নিজেকে জড়িয়েছিস। সেখানে অপর ব্যক্তি তোকে তোর প্রাপ্য জায়গাটা দিবে না। এই সমঝতার সম্পর্ক কতোদিন বয়ে নিবি? এক মাস, এক বছর। হাপিয়ে যাবি।
– শান্ত হ। বুঝার ট্রাই কর।
– কি বুঝবো, কি বুঝবো বল। এতো বড় সিদ্ধান্ত একবার কি আমার সাথে পরামর্শ করা যেত না?
– যেত কিন্তু
– কিন্তু কি?
– তুই ব্যস্ত ছিলি, ছুটিতে ছিলি। তাই ডিস্টার্ব করি নি।
– বাহ, ডিস্টার্ব এটাই শোনা বাকি ছিলো। আর কোনোদিন কথা বলবি না তুই।
– নিহাল শোন। নিহাল

নিহাল এক মুহূর্ত দেরি না করে সেখান থেকে চলে গেলো। শিমুল ভাবছে হয়তো তাকে এই বিয়ের ব্যাপারটা না বলায় নিহাল রাগ করেছে। অপরদিকে নিহাল শত কষ্টেও নিজেকে সামলাতে পারছে না। কেন শিমুল তাকে একটা বার সুযোগ দিলো না, কেন সে এতো দেরি করলো। ৪ দিন আগে জানলে হয়তো এই বিয়েটা হতে দিতো না সে৷ দুপুরের পর থেকে নিহাল একবার ও শিমুলের সামনে যায় নি। শিমুল ও ঘাটে নি ভেবেছে হয়তো এক দুই দিন পর রাগ পরে যাবে। ছুটির সময় বের হতেই দেখলো ইফতি গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বেশ লাগছে ইফতি কে। ব্লু শার্ট,জিন্স,হাতে কালো ঘড়ি, শার্টের হাতা কনুই অবধি তোলা৷ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। শিমুল অবাক হলেও খুশি হয়েছে। হয়তো তাদের সম্পর্কটা নতুন রুপ নিচ্ছে। শুধু সমঝতাই কি এই সম্পর্কের ভিত্তি, নাকি এই সম্পর্কটাও আর পাঁচটা স্বাভাবিক সম্পর্কের মতো হতে পারবে!!!

চলবে