গল্প ¦ অঙ্ক টিচার— পর্বঃ- ৪
শারমিন আক্তার
—-আয়াত দড়জা খুলে দেখে তনয়া সিড়িতে উপর আধা শোয়া আর আধা বসা অবস্থায় পড়ে আছে। আয়াত প্রথমে ভাবলো তনয়া হয়তো দুষ্টমি করতেছে। কারন এ ধরনের দুষ্টমি তনয়া এর আগেও কয়েবার করেছিলো। তাই বললো——
আয়াতঃ তনয়া এবার আর আমাকে বোকা বানাতে পারবে না! ওঠো বলছি। তনয়া তনয়া ! তনয়া!
কয়েক বার ডাকদিলো কিন্তু তনয়ার কোন সাড়াশব্দ পেলো না। তাই গিয়ে তনয়ার কাঁধে রাখলো আর সাথে সাথে তনয়া মাটিতে গড়িয়ে পরলো।
আয়াত হতভম্ব হয়ে গেলো। কারন তনয়ার কপালে রক্ত। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখা দেয়ালেও খানিকটা রক্ত লেগে আছে। সিড়িতে অনেক পানি পরে আছে। মনে হয় তনয়া পানিতে স্লিপ করে পড়ে গেছে। মেয়েটা মাথা ফেটে গেছে। কি যে করি? আয়াত ভাবছে।
আয়াত তনয়াকে কোলে তুলবে কি তুলবে না তা নিয়ে অনেকটা অসস্তি বোধ করছে। তারপর ভাবলো ও সব পরে ভাববো আগে মেয়েটাকে ভিতরে নিয়ে যাই।
আয়াত তনয়াকে কোলে তুলে বললো আরে মেয়েটাকে দেখতে তো অনেক শুকনা কিন্তু ওজন কম করে হলেও ৪২ হবে।
আয়াত তনয়াকে নিয়ে ওর মায়ের রুমে শোয়ালো।
আয়াতের মাঃ আরে কি হয়েছে ওর?
আয়াতঃ মা মনে হয় সিড়ি দিয়ে স্লিপ করে পড়ে গেছে। দেখোনা মেয়েটার মাথা ফেটে গেছে।
আয়াতের মাঃ তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ফোন কর?
আয়াতঃ হ্যা মা করছি। কিন্তু তুমি ব্যাস্ত হয়ে নিজের শরীর খারাপ করো না।
আয়াত ডাক্তারকে ফোন করে তনয়ার মাথার রক্তটা মুছে কিছুটা এন্টিবায়োটিক ক্রিম লাগিয়ে দিলো যাতে তাৎক্ষনিক ভাবে রক্তটা থেমে যায়। তারপরে তনয়ার বাবা মাকে ফোন করে আসতে বললো।
তনয়া তখনো অজ্ঞান। তাদের ফোন করার পর। আয়াত তনয়ার চোখে মুখে পানির ঝাপসা দিলো।
তনয়া চোখ খুলে দেখে আয়াত আর আয়াতের মা ওর সামনে বসে আছে।
আয়াতঃ এই মেয়ে পড়ে গেলা কিভাবে?
তনয়াঃ রাগি চোখে তাকিয়ে কোন বেয়াক্কেল যেনো সিড়িতে পানি ফেলেছে?
আয়াতঃ হুম দেখেছি। কিন্তু কে সেটা জানি না?
তনয়াঃ তাহলে তাড়াতাড়ি জানেন! তার অবস্থা আমি বারোটা বাজাবো। মাথাটা পচন্ড ব্যাথা করতেছে।
আয়াতঃ আর কোথাও ব্যাথা পাইছো?
তনয়াঃ হ্যা। পায়ে খুব ব্যাথা করছে মনে হয় মচকে গেছে?
আয়াত তনয়ার পায়ে হাত দিয়ে পা টা দেখছে।
তনয়াঃ স্যার কি করছেন? প্লিজ পায়ে হাত দিবেন না। আপনি আমার শিক্ষক।
আয়াতঃ চুপ একদম চুপ। আয়াত তারপর দেখলো আসলেই তনয়ার ডান পায়ের উপরের পাতা অনেকটা ফুলে গেছে। আয়াত ভালো মত দেখছে আর (মনে মনে ভাবছে কোন মানুষের পা এত সুন্দর হতে পারে!)। তারপর বললো কপাল ভালো ভাঙেনি। তবে মচকে গেছে। ডাক্তার এখনি চলে আসবে।
কিছুক্ষন পর ডাক্তার আর তনয়ার বাবা মা একসাথে এলো।
ডাক্তার তনয়ার মাথায় ভালো করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। পায়ে লিকোপ্লাসটার পেচিয়ে দিয়ে বললো সপ্তাহ খানিক বেড রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। তারপর একটা ইনজেকসন বের করলো।
তনয়াঃ ডাক্তার ইনজেকসন কার জন্য?
ডাক্তারঃ কেন তোমার জন্য। পেইন কিলারের কাজ করবে আর সেফটিক হবে না।
তনয়াঃ নাাাাাাাাাাাআাাাাাাাাাাাা বলে একটা চিৎকার দিলো।
ওর চিৎকার শুনে সবাই কানে হাত দিলো। আর আয়াত তাড়াতাড়ি তনয়ার মুখটা চেপে ধরলো।
আয়াতঃ চুপ চুপ। কানের পোকা বের করে দিলো।
তনয়াঃ আমি একদম ইনজেকসর দিবো না। অতবড় সুচ আমার গায়ে ফোটাবে! নো চান্স।
আয়াতঃ ঠিক আছে দেয়ার দরকার নাই। আচ্ছা তনয়া একটা কথা বলো তো? তোমার তো অনেক রকমের ফুল গাছ ছিলো। এখন কি আছে নাকি?
তনয়াঃ স্যার আপনার মনে আছে?
আয়াতঃ কেন মনে থাকবে না? অনেক সুন্দর তোমার বাগানটা।
তনয়াঃ এখনতো আগের থেকেও বেশি ফুল আছে! জানেন স্যার বারো রকমের ক্যাকটাস গাছ আছে আমার!
আয়াতঃ আচ্ছা! তা আমাকে কিছু ফুল গাছ দিবা?
তনয়াঃ হ্যা অবশ্যই স্যার।
আয়াতঃ ডাক্তার হয়েছে ?
ডাক্তারঃ হাসতে হাসতে হ্যা।
তনয়া তাকিয়ে দেখে ডাক্তারের ইনজেকসন দেয়া শেষ। তনয়া বুঝলো আয়াত কেন ফুল গাছের প্রসঙ্গ তুলেছে?
তনয়াঃ ঠোট বাকিয়ে স্যার আপনি খু্ব বাজে।
আয়াতঃ মুচকি হেসে আমি জানি!
ডাক্তারঃ কয়েক দিনে ঠিক হয়ে যাবে। ঔষধ দিয়ে গেলাম। আর হ্যা দু তিন জ্বর থাকতে পারে।
তারপর তনয়ার বাবা মা আয়াতের বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে থাকে । আর আয়াত আর তনয়া অনেক কথা বললো। তনয়ার দুষ্টমি ভরা কথাগুলো শুনে আয়াত মুগ্ধ নয়নে তনয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। তনয়ার চোখে চোখ পড়লেই আবার চোখ সরিয়ে নিতো। এদিকে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো।
তনয়ার বাবাঃ আমাদের যে এখন উঠতে হবে?
আয়াতের বাবাঃ আরে থাক না আজকে।
তনয়া বাবাঃ নারে পড়ে একদিন। আজকে তনয়ার এ অবস্থা। তাই বাড়ি যাওয়াটাই বেটার। তাহলে আজকে উঠি।
তনয়ার মাঃ কিন্তু তনয়াতো হাটতে পারে না। ও তিনতলা থেকে কিভাবে নামবে?
আয়াতদের বাড়িটা তিনতালা। নিচের দুই তলা ভাড়া দেয়া। তিনতলায় ওরা থাকে। তাই তিনতালা ডুপ্লেক্স করা।
আয়াতের মাঃ সমস্যা নাই আয়াত নামিয়ে দিবে।
তনয়ার বাবা মা সবাই নিচের দিকে নামছে
সাথে আয়াতের বাবা মাও।
আয়াতঃ কি ম্যাডাম রেডি?
তনয়াঃ কিসের জন্য?
আয়াত কোন কথা না বলেই তনয়াকে কোলে তুলে নিলো। তনয়া হতভম্ব হয়ে গেলো। আর প্রথম বার আয়াতের স্পর্শ পেয়ে শিহরিতো হয়ে উঠলো। ওর শরীরের প্রত্যেকটি পশম দাড়িয়ে গেলো। কোন কথা যেনো মুখ থেকে বের হচ্ছে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে আছে।
আর আয়াত ওকে নিয়ে নিচে নামছে কিন্তু এক ধ্যানে তনয়ার দিকে তাকিয়ে দেখছে আর ভাবছে কি নিস্পাপ মুখ! আল্লাহ ঠিক কতটা যত্ন করে বানলে মানুষ এতটা সুন্দর আর মায়াবী হয়। তনয়া দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই মুচকি হেসে ফেললো।
আয়াতঃ তনয়া শোন।
তনয়া চোখ মেলে জ্বি
আয়াতঃ তোমার হাতটা আমার কাঁধে রাখলে ভালো হতো। তোমার যা ওজন! দুষ্টমি করে।
তনয়া রাগান্তিত চোখে আয়াতের দিকে তাকিয়ে হাতটা আয়াতের কাঁধে রাখলো। আর আয়াতের চোখের দিকে তাকাতেই অজানা এক আবেশে হারিয়ে গেলো ।
তনয়া মনে মনে বললো আরেকটা চান্স নেবো নাকি স্যারকে ভালোবাসার? সাথে চড়টার কথা মনে পড়লো। আর তনয়া হাতটা ওর বা গালে চলে গেলো।
আয়াত সেটা খেয়াল করে বললো—–
আয়াতঃ এই মেয়ে তুমি আমাকে দেখলে সবসময় গালে হাত দেও কেন?
তনয়াঃ এমন ভাব করছেন যেনো কিছু জানেন না? মুখে ভেংচি কেটে।
আয়াত তা দেখে হেসে দিলো।
তনয়া দেখলো ওরা নিচে নেমে প্রায় গাড়ির কাছে পৌছে গেলো। তনয়া বললো ইস তিনতালা না হয়ে দশ তালা হলে ভালো হতো।
তনয়াকে গাড়িতে পৌছে দিয়ে আয়াত মনে মনে কি যেনো ভেবে মুচকি হাসি দিলো।
তনয়ারা চলে গেলো। সেদিন রাতে তনয়া ভিষন জ্বর আসলো।
পরের দুদিন তনয়াকে ক্লাসে না দেখে আয়াত একে বারে অস্থির হয়ে গেছে। ফোনে অবশ্য খবর নিয়েছিলো। তাই ভাবলো আজ তনয়াকে দেখতে যাবে।
সেদিন বিকালে আয়াত আর আয়াতের মা তনয়াদের বাড়ি গেলো। প্রায় দুবছর পর আয়াত তনয়াদের বাড়ি আসলো। বাড়ির চারপাশে তাকিয়ে মনে মনে বলছে,— মেয়েটা সত্যি বলেছে। ওর ফুলের বাগানটা আগের থেকে অনেক বড় করেছে।
নিজে যেরকম ফুলের মত দেখতে তেমনি তার ফুলের শখ।
আয়াতকে দেখে তো তনয়ার মা খুব খুশি।
আয়াত তাকে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে বললো
আয়াতঃ আন্টি তনয়া কেমন আছে?
তনয়ার মাঃ আর বলো না দুদিন জ্বরের কারনে ছোট বাচ্চাদের মত জ্বালিয়েছে। আজ সারাদিনে কিছু খাওয়াতে পারিনি। দেখো এখনো ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে।
আয়াতঃ আন্টি কিছু মনে না করলে আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি?
তনয়ার মাঃ আরে এতে মনে করার কি আছে? এই নাও খাবার। তনয়া রুমেই আছে।
আয়াত আস্তে করে রুমে ডুকে দেখে তনয়া বাচ্চা মেয়েদের মত গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। আয়াত তনয়ার রুমের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। বাচ্চাদের মত সারা রুমে কার্টুন পিক টানানো। টম এন্ড জেরি থেকে শুরু করে রূপাঞ্জেল সবার পিক আছে।
আয়াত তনয়া দিকে তাকিয়ে ভাবছে। আসলেই দুদিনের জ্বরে মেয়েটা অনেকটা শুকিয়ে গেছে। চোখ দুটো বসে গেছে মুখটা শুষ্ক হয়ে গেছে। আর চুল গুলো এলোমেলো।
আয়াতঃ তনয়া! তনয়া!
তনয়া আয়াতের ডাক শুনে চোখ মেলে তাকালো। আয়াতকে দেখে যেনো তনয়ার চোখে মুখে খুশি ফুটে উঠলো।
তনয়াঃ স্যার আপনি? কেমন আছেন?
আয়াত তনয়াকে উঠে বসতে সাহায্য করে। তারপর বলে——
আয়াতঃ আমিতো ভালো বাট তুমি নিজের কি অবস্থা করেছো?
তনয়াঃ স্যার আমিতো ঠিক আছি।
আয়াতঃ হ্যা দেখেই বোঝা যাচ্ছে? কতটা ঠিক আছো! এবার খাবারটা খেয়ে নাও।
তনয়াঃ না। খাবার খেলেই আমার বমি পায়। আর খাবার গুলো খুব তেতো।
আয়াতঃ খাবার না খেলে আরো বেশি দিন অসুস্থ থাকবে!
তনয়াঃ থাক তবুও খাবো না।
আয়াতঃ হুম। তুমি কি দুদিন তোমার বাগানে গেছিলা?
তনয়াঃ নাতো? কেন?
আয়াতঃ আন্টি বললো তোমার অনেক গুলো গাছ চুরি হয়ে গেছে।
তনয়াঃ;কি?
আয়াতঃ তাইতো বলি? খেয়ে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে গাছের খেয়াল রাখো।
তনয়াঃ দিন তাড়াতাড়ি খাই। আমার গাছ। বলে মুখ ভার করে খাচ্ছে।
আয়াত সেটা দেখে মুখ টিপে টিপে হাসছে।
তারপর তনয়া আয়াতের মায়েন সাথে অনেকক্ষন গল্প করলো। কিছুক্ষন পর তারা চলে গেলেন।
তনয়ার সুস্থ হতে প্রায় দশদিন সময় লাগলো। এই দশদিন আয়াত ক্লাসে তেমন কোন মনোযোগ দিতে পারলো না। তনয়াকে খুব মিস করতো। কিন্তু কেন? সেটা সে নিজেও ভেবে পাচ্ছিলো না!
তনয়া এখন নিয়োমিত কলেজে আসে। দিন চলে যাচ্ছে। আর তনয়া আর আয়াতের সম্পর্কটা আগের থেকে অনেকটা কাছে এসেছে। খুব ভালো বন্ধুতাব হয়ে গেছে দুজনার। তারপর তনয়ার তনয়ার ১ম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হলো। আর পরীক্ষা খুব ভালোভাবে হয়ে গেলো ।
একদিন তনয়া বন্ধুদের সাথে একটি রেস্টুরেন্টে গেলো। সেখানে আয়াতের জিএফ লিমাকে দেখলো কার সাথে যেনো কথা বলছে——-?
চলবে———