ও আমায় ভালোবাসেনি- সিজন ২ – Part- 17 (Last-Part)
___
— তানভীর আমি খুন করে ফেলেছি ।
— কিইহ্? কি বলছিস তুই আপু?
— হ..হ্যাঁ । র..রাইদ কে খুন করেছি আমি ।
— তোর মাথা ঠিক আছে? কি বলছিস এসব! কই তুই?
— আমি বাসায় । প্লিজ তুই আয় ভাইয়া আমার ভয় লাগছে ।
— আমি এক্ষুণি আসছি তুই দরজা বন্ধ করে বসে থাক কেউ আসলে খুলবি না ।
ফোন কেটে ,
রাফনিদের জন্য কেনা ঔষধ গুলো কেবিনে রেখে ওর মা আর শ্বাশুড়িকে রাফনিদের পাশে থাকতে বলে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো তানভীর ।
হসপিটাল থেকে বেশি দূরে নয় বাসাটা । বাইকে আধ ঘন্টার মধ্যে চলে আসলো তানভীর ।
কোনো রকমে বাইক টা রেখে জলদি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলো এবং নিজের কাছে এক্সট্রা চাবি দিয়ে মেইন ডোর খুলে ভেতরে ঢুকলো ।
জানালা দরজা সব বন্ধ গুমোট অন্ধকারে বসে আছে মিথিলা ।
তানভীর এদিকে ওদিকে চোখ ঘুরিয়ে ওকে খুঁজলো তারপর ধীর কন্ঠে ডাকলো_
— আপু তুই কোথায়? আপু?
ভাইয়ের গলার স্বর পেয়ে ঘর থেকে ছুটে আসলো মিথিলা ।
তানভীরের বুকে পড়ে হু হু করে কাঁদতে থাকলো অনবরত আর কম্পিত কন্ঠে অনেকটা ফিসফিসিয়ে বলতে থাকলো_
— আমি ওকে খুন করেছি , আমাকে পুলিশে দিয়ে দে ভাইয়া । আমি ওকে খুন করেছি ।
তানভীর বোনের অবস্থা বুঝতে পেরে ওকে দু হাতে আগলে নিয়ে সোফায় বসালো ।
— তুই বস একটু ঠান্ডা হ আমি পানি নিয়ে আসি তোর জন্য তারপর বাকি কথা শুনছি ।
ফ্রীজ থেকে পানির বোতল বের করে এনে মিথিলার পাশে বসলো তানভীর । ও এখনো একটা কথাই রিপিট করে যাচ্ছে । তানভীর কিছুই বুঝতে পারছে না হঠাৎ কি হলো!
মাথায় হাত রেখে আশ্বস্ত করলো কিচ্ছু হবে না , একটু শান্ত হয়ে পানিটা খেয়ে নিতে ।
তানভীরের কথা মত মিথিলা দু এক বার পানিতে চুমুক দিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো ।
ও একটু শান্ত হতেই তানভীর জিজ্ঞেস করলো_
— কি হয়েছে ? আমাকে খুলে বল পুরোটা ।
— আমি রাইদ কে খুন করে দিয়েছি ভাইয়া ওর ফার্ম হাউজে আজ ভোর বেলা ।
— কিন্তু কেনো? আর মারলি কীভাবে?
— পয়জন দিয়েছিলাম ওর চা’য়ের সাথে মিশিয়ে ।
— পয়জন! সেটা কোথায় পেলি তুই? আর মারলি কেনো তাকে?
— ও একটা খুনি । ও বাবা আর শব্দকে খুন করেছে ভাইয়া ।
— হোয়াট? শব্দ ভাই কে রাইদ ভাই খুন করেছে? কে বললো তোকে?
— আমি নিজের চোখে দেখেছি ।
বিয়ের দিনের ঘটনা থেকে শুরু করে এ যাবৎ সবটা খুলে বললো মিথিলা তানভীর কে ।
সব শুনে তানভীর আশ্চর্য্য হয়ে বসে থাকলো । ধাতস্থ করতে থাকলো নিজেকে ।
— তোর কাছে ভিডিও ক্লিপস গুলো আছে?
— হু আছে ।
— কোথায়?
— আমার রুমে দাঁড়া নিয়ে আসছি ।
মিথিলা দ্রুত পায়ে ঘরে চলে গেলো ।
এদিকে ও যাওয়া মাত্র কলিংবেল বেঁজে উঠল । তানভীর একটু ভয় পেয়ে গেলো পুলিশ এসেছে ভেবে।
দরজা খুলবে কি খুলবে না এমন সংশয় নিয়ে বসে থাকলো ।
ওপাশে দু’বার কলিংবেল বাজিয়ে একটু বিরতি নিলো আগন্তুক ।
তৃতীয় বার বাজাবে কি না এই ভাবতে ভাবতে দরজার এপাশ থেকে পুরুষালি গলায় প্রশ্ন ছোঁড়া হলো_
— কে?
আগন্তুক একটু ইতস্তত ভাবে উত্তর দিলো_
— জ্বী আমি রাজিন এহসান । একটু দরজা টা খোলা যাবে?
আগন্তুকের নম্র জবাব শুনে দরজা টা খুলে দিলো তানভীর৷
দরজার সামনে ফর্মাল পোশাক পরিহিত এক যুবক কে দেখে ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো তানভীরের ।
— আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?
— মরহুম মেজর নাদিমের বাসা না এটা?
— হ্যাঁ আপনি কে?
— আমি রাজিন এহসান উৎস মেজর শিহান এহসানের ছেলে । তুমি কি তানভীর?
— শিহান আঙ্কেলের ছেলে মানে! শিহান আঙ্কেলের তো একটাই ছেলে শব্দ এহসান । আপনার নাম তো আগে শুনিনি ।
— শব্দ এহসান । আই থিংক তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে আমার নাম শব্দ এহসান না রাজিন এহসান । আমি শিহান এহসানের ছেলে ।
— প্রুফ কি?
— স্যরি ভাইয়া সেই প্রুফ তো দিতে পারলাম না আপাতত । প্রুফ নিতে হলে আমার বাসায় যেতে হবে তবে হ্যাঁ আমিও আর্মিতে আছি । চাইলে আমার আইডি কার্ড চেইক করতে পারো ।
যুবকটি পকেট থেকে তার আইডি কার্ড বের করে দেখালো ।
তানভীর দেখলো ঠিক ছেলেটার নাম , প্রফেশন লেখা আছে আর আর্মির পোশাক পরা ছবিও ।
বিস্ময় কাটিয়ে ধীর গলায় বললো_
— স্যরি ভাইয়া ভেতরে আসুন । একটা মিসআন্ডার্স্ট্যান্ডিং হয়েছে ।
বাসার ভেতরে নিয়ে এসে সবটা খুলে বলা হলো তাকে শুধু খুনের ব্যাপারটা চেপে গেলো ।
সব শুনে একটা চাপা হাসি দিয়ে ছেলেটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো_
— একজন আর্মি অফিসারের যদি অকস্মাৎ মৃত্যু হয় তা’হলে তার তদন্ত কি হবে না? আর তার পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করবে না? যেখানে তোমাকে লাশ দেখতে দেয়া হয়নি , দাফন কাফনের সময় ছিলে না সে আদৌও মরে গেছে ইনফ্যাক্ট সে আসলেই অফিসার ছিলো না কি এই নিয়ে সংশয় হয়নি তোমার?
— আমরা আসলে..
— তুমি এই মাত্র বললে তুমি যখন ড্রাগস ছাড়তে চাইলে তখন সে তোমায় তার সাথে নিয়ে গিয়েছিল তার মানে তুমি শব্দ সাহেবের সাথেই থাকতে তা’হলে তাকে অফিসে যেতে দেখোনি?
— আমাকে তো রিহ্যাব সেন্টারে রেখে আসা হয়েছিল ভাইয়া ।
— তানভীর উনি কে?
মিথিলা কন্ঠ পেয়ে উৎস এবং তানভীর দু’জনেই তাকালো ।
তানভীর উঠে গিয়ে ওর হাত ধরে বললো_
— আপু ইনি শিহান আঙ্কেলের ছেলে ।
— মানে? আঙ্কেলের ছেলে তো শব্দ ।
— না আপু ও ছিলো একটা ফ্রড ছিলো ।
— ইনি আসল সেটা কে বলেছে?
— আমি ওনার আইডি কার্ড চেইক করেছি আপু। আর ওনাকে দেখে অবিশ্বাস করার কারণ নেই । ওনাকে সব খুলে বলেছি আমি ।
— তুই একটা অপরিচিত ছেলেকে কীভাবে সব বলতে পারিস? আমরা এই মুহুর্তে কাউকে ই বিশ্বাস করতে পারিনা ।
মাথায় হাত দিয়ে কেঁদে ফেললো মিথিলা ।
উৎস বেশ বিব্রত বোধ করছে । তবে এরা যে কোনো ঝামেলায় আছে তা বুঝতে ওর সমস্যা হয়নি ।
তানভীরও এখন বেকায়দায় পড়ে গেলো । অনুমানের ওপর ভিত্তি করে একটা অপরিচিত ছেলেকে কীভাবে সব বলে দিলো এখন কি হবে?
সমাধান অবশ্য উৎস ই দিলো । ফোন বের করে কতক্ষণ চাপাচাপি করে তানভীরের দিকে বাড়িয়ে দিলো ফোনটা ।
— এখানে আমার সব ইনফরমেশন আমার ফ্যামিলির সাথে ফটো এমনকি আমার ট্রেনিং চলাকালীন সময়ের কিছু ছবিও পাবে । ট্রেনিংয়ে ভালো পারফর্মেন্সের জন্য তোমার বাবা আমায় নিজ হাতে পুরষ্কার দিয়েছিলেন ।
তানভীর মিথিলার দিকে তাকালো , মিথিলা চোখের ইশারায় না বললেও তানভীর কি মনে করে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখতে থাকলো ।
ছেলেটার কথা অনুযায়ী ঠিক তার সকল ইনফরমেশন , ইউনিফর্মে বেশ কয়েকটা ছবি , ফ্যামিলি ফটো এমনকি নাদিম শেখের সাথে ছবিও দেখা গেলো । সব দেখে এটাই প্রমাণিত হয় ছেলেটাই শিহান এহসানের ছেলে ।
মিথিলা এটা শুনে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো ।
সে কতবড় ভুল করেছে , একটা ফ্রডের কথায় তার স্বামীকে সে খুন করেছে । এ যন্ত্রণা সে কাকে দেখাবে!
ওর বাঁধ ভাঙা চোখের পানি আর নিস্তেজ অবস্থা দেখে উৎস একটু ঘাবড়ে গেলো ।
তানভীর সহ ধরাধরি করে মিথি কে সোফায় বসিয়ে দেয়া হলো ।
তানভীর গ্লাসে পানি ঢেলে মিথির হাতে দিয়ে বললো_
— একটু শান্ত হ আপু ধৈর্য্য ধর ।
— কীভাবে শান্ত হবো ভাইয়া? মানুষটা ভালো হতে চেয়েছিলো । আমি তো তার প্রাণ টাই নিয়ে নিলাম ।
এবার চমকাবার পালা উৎসের । সে হতবাক হয়ে গেল ।
— আপনি কি কারো মার্ডার করেছেন?
— আসলে..
— হ্যাঁ করেছি । এই হাত দিয়ে আমার হাজবেন্ডের জন্য বানানো চা’য়ে বিষ মিশিয়ে দিয়েছি । আমার চোখের সামনে সে তড়পাতে তড়পাতে জীবন দিয়েছে ।
তানভীরের কিছু বলার আগেই বলে দিলো মিথিলা ।
উৎস একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রশ্ন করলো_
— ওনার ডেড বডি এখন কোথায়?
— ভাইয়া আগে আমার কথা শুনুন এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ঘটেছে ঐ ফ্রড শব্দ’র ইন্ধনে । তার মৃত্যুর পর দিন তার জুনিয়র অফিসার অন্তর আমাদের বাসায় আসে এবং আমার আপুকে বলে শব্দ’র মার্ডারার কে খুঁজতে হেল্প করতে । “visor” না কি যেন সংগঠনের বিরুদ্ধে একটা গোপন মিশন ছিলো তার । ধারণা করেছিল তারাই শব্দকে মেরেছে । সেই অন্তর নামক লোকটাই এতদিন আপুর সাথে যোগাযোগ করে প্রুফ কালেক্ট করার ইন্ধন যোগায় । শব্দের ব্যাপারে আপুর ইমোশন কাজ করতো তার মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে সে আপুর জন্য একটা লকেট রেখে যায়। সেই লকেটে ছিলো একটা বক্সের চাবি । বক্সটায় ছিলো সব প্রুফ ।
কালকেই আপু সেই প্রুফ উদ্ধার করে এবং যখন দেখে তার হাজবেন্ড ই সব কিছুর সাথে জড়িত এমনকি বাবা এবং বাগদত্তার খুনিও সে তখন আপুর মনে প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে ।
— ওয়েট আ মিনিট । তানভীর , শব্দ সাহেবকে কে খুন করা হলো রাস্তায় । সে মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে লকেট দিয়ে গেলো । ওরকম শুনশান রাস্তায় তাকে কে বা কাহারা খুন করলো এটা তোমরা জানবে কি করে?
— আমি ফুটেজ দেখেছি ।
— অদ্ভুত! কাউকে খুন করার মুহুর্তের ফুটেজ রেকর্ড করবে কে? আর সেটা শব্দ সাহেবের বাসায় মিস্ট্রি বক্সে পৌঁছে যাবে কীভাবে? ব্যাপারটা অদ্ভুত নয়?
— তাই তো । আপু তুই যে বললি তোর কাছে ফুটেজ গুলো আছে কোথায়?
আমার ঘরে ড্রেসিং টেবিলের ওপর । ওনার আসার শব্দ পেয়ে রেখে এসেছি ।
— ওকে আমি নিয়ে আসছি ।
তানভীর যাওয়ার পর উৎস জিজ্ঞেস করলো_
— আপনার হাজবেন্ডের লাশ কোথায়?
— ওর ফার্ম হাউজে ।
— লোকেশন?
— উত্তরা । *** ***
— খুন করার মুহুর্তে আপনি ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিলো?
— নাহ্ ।
— রাইদ খানের বডিগার্ড , পিএ তারা কোথায়?
— গার্ড ছিলো কিন্তু পিএ রফিক ভাই অন্য বাসায় ছিলো ।
— আপনি গার্ডদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এই বাসায় চলে এসেছেন?
— হ্যাঁ ।
— ওহ্ আই সি । এজন্য এখন পর্যন্ত কোনো কেইস ফাইল হয়নি ।
মিথিলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে ।
— ভাইয়া এই যে নিয়ে এসেছি ।
উৎস’র দিকে বক্স আর ল্যাপটপটা এগিয়ে দেয় তানভীর ।
চটপট সেটাতে পেনড্রাইভ কানেক্ট করে একে একে ভিডিও ফুটেজ গুলো দেখা হয় ।
দু’টো কম্পেয়ার করে উৎস হেসে বলে_
— শব্দ সাহেবের ভিডিও টা তো একটা সাজানো নাটক । ভালো করে লক্ষ করুন আপনার বাবা কে যখন শুট করা হচ্ছে তখন রাইদের হাতে একটা ব্রেসলেট ছিলো এবং বন্দুকটা “এম ১৯১১” কিন্তু শব্দকে শুট করার ভিডিওতে না তার হাতে ব্রেসলেট আছে আর না বন্দুকটা সেম । এখানে ব্যবহার করা হয়েছে “এসআইজি”
সবচাইতে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো রাইদ বা’ হাতি । ও বা হাতে প্রায় সব কাজ করে , প্রথম ভিডিওতেও বা হাতে ই বন্দুক ধরে রেখেছে ডান হাতে নয় ।
শব্দকে যে মেরেছে তার বন্দুকটা ডান হাতে ধরা ।
— রাইদ বা হাতি এটা আপনি কীভাবে জানলেন?
— রাইদ একজন উঠতি তারকা । তাকে নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নিউজ ছাপানো হয় ।
আমি কিন্তু তার সম্পর্কে ইনফরমেশন পেয়েছিলাম পেপারে ই ।
— দ্বিতীয় ভিডিওতে রাইদের মুখ দেখা যাচ্ছে..
— ভিডিও এডিটিংয়ের যুগে তো সবই সম্ভব ম্যাডাম ।
— ওহ্ মাই গড! এত্ত বড় নাটক ।
— এখন কি করবো ভাইয়া?
তানভীরের কথার জবাবে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে,
— আগে রাইদ খানের বাসায় যেতে হবে । চলুন?
— হ্যাঁ ভাইয়া প্লিজ আপনি এখন আপনার টিম কে জানাবেন না আই বেগ অফ ইউ ।
তানভীরের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় উৎস ।
মিথিলার ডিরেকশন অনুযায়ী ফার্ম হাউজে এসে দেখে গার্ডরা কেউ নেই এবং মেইন ডোর লকড ।
বেশ অবাক হয় ওরা । মিথি বলে_
— আমার মনে আছে বেরুবার মুহুর্তে আমি দরজা টা খুলে রেখে চলে এসেছিলাম । আসলে তাড়াহুড়ো অবস্থায় আমি লক করতে ভুলে গিয়েছিলাম ।
— তা’হলে এখন লকড কেনো? আপনি সত্যি বলছেন নাকি এখানে কেউ এসেছিলো?
— আমি সত্যি বলছি বিশ্বাস করুন । এরকম সেন্সিটিভ একটা বিষয় আমি বানিয়ে বলবো কেনো?
— তা’হলে ধারণা করতে হবে এখানে কেউ এসেছিলো । আপনি বলেছিলেন আপনারা শাহবাগে আরেকটা বাসায় থাকতেন? তাহলে সেখানে চলুন তো? আর আপনার ফোনটা কোথায়? রফিক সাহেবকে দরকার এই মুহুর্তে ।
— আমার ফোন তো বাসায় ফেলে এসেছি ।
— রফিক সাহেবের নাম্বার মনে আছে?
— নাহ্ ফোনে সেভ করা আছে ।
— আচ্ছা আগে শাহবাগে যাওয়া যাক তারপর না’হয় বাকি খোঁজ খবর নেয়া যাবে ।
— হ্যাঁ চলুন ।
আজ রাস্তায় তেমন জ্যাম না হওয়ায় উত্তরা থেকে শাহবাগ দেড় ঘন্টায় পৌঁছাতে পারলো ওরা ।
অবাক করা বিষয় এখানে এসে দেখা গেলো এই বাসাও বন্ধ এবং এখানে কোনো গার্ড নেই ।
উৎস ধারণা করলো মিথির যাওয়ার পর ফার্ম হাউজে কেউ এসেছিলো । হয়তোবা রাইদের লাশ সে সরিয়েছে অথবা রাইদ এখনো মারা যায়নি এবং সে স্বেচ্ছায় নিরুদ্দেশ হয়েছে?
শাহবাগে এসে রাইদ কে যখন পাওয়া গেলো না তখন হোপলেস হয়ে পড়লো মিথিলা । নিজেকেই মেরে ফেলতে মন চাইছে তার ।
তানভীরও বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে আসলে ।
রাইদ কে এখানে খুঁজে না পেয়ে তিনজন বাসায় ফেরত আসলো ।
মিথিলা অনবরত কান্নাকাটি করছিল । তার কান্নাকাটি দেখে উৎস একটু বিরক্ত হয়ে বললো_
— এখন কেঁদে লাভ আছে? আপনি বরং রফিক সাহেব কে কল দিয়ে খোঁজ নিন তো?
— হু নিচ্ছি ।
কান্না সামলে সে ঘরে চলে গেলো ফোন খুঁজতে ।
এলোমেলো ঘরে ফোন কোথায় রেখেছে কিচ্ছু মনে নেই । ধৈর্য্যও নেই ফোনটা খোঁজার । পরে তানভীর কে ডেকে দু’জন মিলে ফোনটা খুঁজে বের করা হলো কিন্তু ফোন সুইচড অফ৷
চার্জে কানেক্ট করে পাঁচ মিনিট পর সুইচড অন করলো মিথিলা ।
ততক্ষণে তানভীর বাইরে এসে উৎস’র সাথে কথা বলছে , তাকে রিকোয়েস্ট করছে এই ব্যাপারটা যাতে বাইরে না যায় । উৎস রাইদের খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত কিছু করতে পারবে না সরাসরি বলে দিলো ।
— তানু তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না রে ।
মিথিলা দূর্বল পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলে ।
উৎস, তানভীর দু’জনেই প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় ।
মিথিলা হাতের ফোনটা বাড়িয়ে দেয় ওদের দিকে ।
উৎস ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে একটা মেসেজ ওপেন করা ।
তা’তে লেখা, “মানুষ টা ভালো হতে চেয়েছিলো ম্যাডাম । তাকে একটা তো সুযোগ দিতেন? সুযোগের বদলে তার জীবনটাই কেড়ে নেয়ায় প্রচেষ্টা করলেন? ঠিকাছে আর কখনো সে আসবে না আপনার সামনে । চলে যাবো আমার স্যার কে নিয়ে আপনাদের দৃষ্টি সীমানার বাইরে । আপনারা ভালো থাকুন”
রফিক
মেসেজ টা দেখে উৎস বলে_
— তার মানে রাইদ খান বেঁচে আছেন? তাকে খুঁজে পাওয়ার আশা আছে ।
— সে যদি আসলেই বেঁচে থাকে তা’হলে কি আসবে আর আমার সামনে? আমি না বড্ড ভুল করে ফেলেছি । ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ কি সে আমাকে দেবে?
— আমি আমার সর্বস্ব চেষ্টা করবো তাকে খুঁজে বের করতে ।
— আপনি সাহায্য করবেন আমাদের? কিন্তু আমি যে এতবড় ক্রাইম করেছি আপনি আমাকে আ্যারেস্ট করবেন না?
— মিসেস খান আমি মূলত এসেছিলাম আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইতে এতটা দিন দেখা না করার জন্য আর এটা জানাতে যে বাবা’র দিয়ে যাওয়া কথা রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ আমি যখন নতুন চাকরি তে জয়েন করি তখন আমার এক বান্ধবীর সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয় এবং আমরা কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিই । এই দু বছর আগে সে আমার সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে । আর তাছাড়াও আপনি আমার চাইতে বয়সে অনেক ছোট হবেন ।
এখানে এসে এতগুলো সত্যের মুখোমুখি হবো তা আমি কল্পনাও করিনি ।
পাঁচ মিনিট আগেও আমি সংশয়ে ছিলাম পুরো ঘটনা টা আমি আমার টিম কে জানাবো কি না!
কিন্তু রফিক সাহেবের এই মেসেজ আর আপনার চোখের পানি আমাকে কোথায় যেন আটকাচ্ছে তবে হ্যাঁ শব্দ আর তার সহযোগীদের সম্পর্কে তদন্ত তো আমাকে করতেই হবে । আপনি ওর সাথে জড়িত সবার ইনফরমেশন আমায় দেবেন ।
— আর রাইদ?
— তাকে আগে খুঁজেই পাই!এতটুকু নিশ্চিত থাকুন এই ঘটনাগুলো আর কেউ ই জানতে পারবে না । তবে হ্যাঁ আপনি এতবড় তারকার বউ ছিলেন, সেফ থাকতে হলে আপনাকে কিন্তু পরিবার সহ লুকিয়ে থাকতে হবে ।
— ভাইয়া আপনি কি এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করবেন?
— করবো । আজ রাতে সবাই তৈরি হয়ে থাকবে । আজ থেকে নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে হবে তোমাদের সবাইকে ।
তানভীরের কাঁধে ভরসার হাত রাখে উৎস ।
ভগ্ন মনে একরাশ অপরাধবোধ নিয়ে মিথিলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে । কেবলই প্রার্থনা করতে থাকে রাইদ কে জলদি খু্ঁজে পাক ।
__
পরিশিষ্টঃ
মার্সিডিজ-বেঞ্জ ফ্যাশন উইক রাশিয়া, এটিকে বলা হয় রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের সবচেয়ে বড় ফ্যাশন ইভেন্ট । যেখানে নজর থাকে বিশ্বের বড় বড় সব ফ্যাশ ন আইকন দের । এ বছর এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এর ষোলোতম আসর । এবারে প্রথম ফ্যাশন উইকের আয়োজকেরা ইন্টারন্যাশনাল ইয়াং ফ্যাশন ডিজাইনার দের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রবর্তনের চেষ্টা করেছেন । তারা এমন ছয়জন ফ্যাশন ডিজাইনার দের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন যারা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক ফ্যাশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন ।
তাদের মধ্যে একজনের নাম হলো মিথিলা খান । পরিবার এবং উৎস নামক ভালো বন্ধুটির সহযোগিতা এবং অনুপ্রেরণায় সে তার স্বপ্ন পূরণের পথে।
আজ ইভেন্টের প্রথম দিন । খুব তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বেরুচ্ছে মিথিলা । গাড়িতে ওঠার মুহুর্তে কি মনে করে আবার ফেরত গেলো সে । মিতা, উৎস পেছন থেকে ডেকে উঠলে ও জবাব দিলো , “ঋগ্বেদিতা কে ছাড়া কি করে যাই মা?”
— আমি তো আগেই বললাম ওকে নিয়ে নে ।
মিথিলা ঘরে ঢুকে দেখে রাইদের ছবি হাতে নিয়ে ছয় বছরের ঋগ্বেদিতা নালিশ করছে মায়ের নামে,
— পাপা জানো? মাম্মা আজও আমাকে নেয়নি । পঁচা মাম্মা । তুমি আসলে বকা দিয়ে দেবেনা বলো?
— ঋদি আ’ম স্যরি বেবী । এই দেখো মাম্মা তোমায় নিতে এসেছে ।
ঋগ্বেদিতা ছোট ছোট চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে নাক মুখ কুঁচকে বললো_
— ঋদি মন খারাপ করেছে ।
— স্যরি বেটা । মাম্মার ভুল হয়ে গেছে । প্লিজ তুমি জলদি এসো? মাম্মার লেইট হয়ে যাচ্ছে , তুমি এসে বকা দিও।
— উঁহু ঋদি যাবেনা ।
— ঋদি না ভালো মেয়ে সে সব কথা শোনে রাইট? মাম্মার কথা এখন শোনো পরে ঘুরে এসে মাম্মাকে বকা দিয়ে দেবে কেমন?
রাফনিদ ঋদিকে কোলে নিয়ে বলে ।
ঋদি কিছুক্ষণ ভেবে বলে_
— ওকে ঋদি যাবে । ঋদির বাবাও যাবে । রাইদের ছবিটা বুকে চেপে ধরে থাকে ঋদি ।
মিথিলা হেসে ওকে কোলে নিয়ে বলে_
— ওকে । চলো ।
পুরো রাস্তায় খুব এক্সাইটেড থাকে ঋদি । বাবা’র ছবির সাথে কত কথা বলে ।
বাবা’র প্রতি ঋদির টান দেখে চোখ দিয়ে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে মিথিলার ।
গাড়ির জানালা দিয়ে উদাস চোখে তাকিয়ে মনে মনে বলে, “আর কতদিন অপেক্ষা করাবে রাইদ? তোমার মেয়েও যে তোমায় দেখার জন্য বসে থাকে । আচ্ছা তুমি কি জানো তোমার পুতুলের মত একটা মেয়ে আছে?”
__
ভেতরে বাচ্চা এলাউড না বলে মিতা ঋদিকে নিয়ে বাইরে দাঁড়ায় । উৎস বলে দিয়েছে কাছেই একটা পার্ক আছে সেখানে ঋদিকে নিয়ে ঘুরে আসতে ।
মিতা অবশ্য এখন ওখানেই যাবে ।
হাঁটতে হাঁটতে বাবা’র সাথে কি কথা হয়েছে সব নানুকে বলে ঋদি ।
তার হাত পা নেড়ে কথা বলা দেখে হাসে মিতা ।
পার্কের কাছে বেশ কয়েকটা বহুতল বিশিষ্ট বাড়ি ।
পার্কে ঢোকার মুহুর্তে আশেপাশে তাকাতেই ঋগ্বিদিতার হঠাৎ মনে হয় ও তার বাবা কে দেখলো গাড়িতে উঠতে ।
সাথে সাথে সে বাবা বলে চিৎকার করে ।
মিতা ওর হাত চেপে ধরে বলে_
— কি হলো মনি?
— নানুমনি ঐ দেখো বাবা ঐ গাড়িতে ।
মিতা ওর ইশারা অনুযায়ী তাকিয়ে দেখে একটা কালো রঙের গাড়ি বহুতল বিশিষ্ট বাড়িটার সামনে ।
ভুল ধারণা ভেবে ঋদি কে কোলে তুলে নিয়ে বলে_
— তোমার বাবা এখানে কোথায় থেকে আসবে মনি? সে তো বিদেশে থাকে ।
— না নানু আমি দেখেছি তো । এই যে ছবির বাবাকে দেখেছি ওখানে ।
সবসময় বাবার খেয়ালে ডুবে থাকে ঋদি তাই তার কথা কানে না নিয়ে পার্কের ভেতর ঢুকে যায় ।
ঋদি বারবার হাত পা ছুঁড়ে বলে সে তার বাবা কে দেখেছে ।
গাড়িতে বসে মনযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছে সে । তার পাশে বসে আছে খুব বিশ্বস্ত কর্মচারী একইসাথে বন্ধু ।
গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললো_
— স্যার ঋদি মামুনি আপনাকে চিনতে পেরেছে । আর অপেক্ষা নয় স্যার । মোমের পুতুলের ন্যায় বাচ্চাটাকে আর কষ্ট দেয়া ঠিক হবেনা । আজই তার সামনে উপস্থিত হবেন তার বাবা’র অধিকার নিয়ে ।
ল্যাপটপে কাজ বন্ধ করে কাতর দৃষ্টিতে তাকায় সে । তার দৃষ্টি বলে দিচ্ছে মেয়ের থেকে দূরে থেকে কতখানি কষ্টে আছে সে । তারসাথে একটাই আক্ষেপ _
— ও যে আমায় ভালোবাসেনি তা’হলে ওর সামনে যাই কি করে?
এর উত্তর দিতে পারেনা রফিক । সাতটা বছর কেটে গেছে জীবন থেকে । রাইদ হারিয়েছে তার বাকশক্তি । তা সত্বেও মিথিলার প্রতি তার ভালোবাসা কমেনি আর তাই তো সে সাত বছরে প্রতিটা মুহুর্তের খবর নিয়েছে ।
রফিক সব খবর দিলেও একটা খবর এখনও দেয়নি , মিথিও তার সর্বস্ব চেষ্টা করছে রাইদ কে খুঁজতে । সেও হয়তো ভালোবেসে ফেলেছে ।
মিথিলার ওপর রাগ থেকে রাইদ কে এতটুকু জানানো হয়নি তবে আজ ঋদিতা কে সামনে দেখে রফিকের মনটা নরম হয়েছে ।
আজ সব ভুল বোঝাবুঝি মেটাতে হবে । রাইদ কে ছাড়া যে ওরা অসম্পূর্ণ ।
_
sinin tasnim sara
বিঃদ্রঃ শেষটা কেমন লাগবে বুঝতে পারছি না । এটা একটা ফ্যান্টাসী গল্প ছিলো এবং আমার লেখা প্রথম ক্রাইম/সাসপেন্স গল্প । ডোন্ট জাজ প্লিজ ।
আর ফ্যাশন উইকের তথ্য গুগল থেকে নেয়া ।
ধন্যবাদ 🙂
বিঃ দ্রঃ ” লেখাঃ সিনিন তাসনিম সার ” লেখকের লেখা অন্য গল্প গুলো পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এক পলকে দেখে নিন সহজে গল্প খুঁজে পাওয়ার সুবিধার্থে দেওয়া হল