ঝরা ফুলের বাসর

ঝরা ফুলের বাসর !! Part- 25

আমরা প্রিয়ার কাছে জানতে চাইলাম এসবের মানে কি? আর এখানে ও কি করছে? তখন প্রিয়া আমাদের বলল কিছুদিন হসপিটাল আর হোস্টেল থেকে দূরে থাকবে। আবির চৌধুরী ওকে মেঘ স্যারের সাথে বিয়ে দিতে চাই। আর আপু মেঘ স্যারের যোগ্য না।তাই ও আপুকে স্যারের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে এখানে এসেছে।
ওকে আমরা বোঝালাম ও বুঝলো না বরং আমাদের উপর রেগে গেলো।আমাকে বলল,

-নূর ম্যাম কত অপরাধ করেছে।কত অন্যায় করেছে তোর সাথে।তুই কি সবকিছু ভুলে গেলি ফুল? তোর কি মনে হয় মেঘ স্যারের যোগ্য উনি? আমি যা করছি ঠিক করছি।যাকে আমি ভালোবাসি সে এমন একটা জঘন্য মনের মানুষের সাথে ঘড় করুক সেটা আমি চাই না।শুধু তোরা কেন মেঘ স্যার নিজে এসেও যদি বলেন আমাকে চলে যেতে তখনও আমি এখান থেকে যাবো না।আবির চৌধুরী এনেছে আমায়।একমাত্র উনি চাইলেই এখান থেকে যাবো আমি।
কথাগুলো বলে আমাকে নিশিকে আর মিনিকে রুম থেকে বের করে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলো প্রিয়া।আপু প্রিয়ার সবগুলো কথা শুনেছে বাইরে থেকে। আপুর দিকে ঘুরে তাকাতেই আপু ছুটে নিজের রুমে গিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলো।আমরা এগিয়ে গিয়ে আপুকে ডাকলাম আপু খুললো না দরজা।মেঘ স্যার হসপিটাল থেকে এসে আপুকে ডাকার আওয়াজ পেয়ে ছুটে এসে দেখলো আমরা দরজার সামনে আপুকে ডাকছি।আপু ভেতরে তাই স্যার ভয় পেয়ে দরজাটা ভাঙতে চাইলো।তখন আপু এসে দরজাটা খুলে দিলো।আর স্যারকে বলল,

-আবির চৌধুরী এখনও আমায় ক্ষমা করেনি মেঘ।তোকে আমি আগেই বলেছিলাম আমাকে ভুলে যা।আমি সত্যি তোর যোগ্য না।কিন্তু তুই শুনলি না।আমি জানি আমার অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই।কিন্তু তাই বলে ওইটুকু একটা মেয়ে।যে কাল অবদি আমাকে ম্যাম বলে ডাকতো।দেখলে সালাম দিতো।সে এসে বলছে আমার স্বামীকে আমার থেকে কেড়ে নেবে।আর সেটা আবির চৌধুরীর কথায়।আমার ভুলের আর কত মাসুল দেবো আমি?
এটুকু বলে আপু আলমারি থেকে কাপড় বের করে লাগেজ গুছাতে লাগলো। স্যার বাঁধা দিতে আসলে বলল,
-প্লিজ মেঘ বাধাঁ দিস না আমায়।আমার একটা আত্নসম্মান বোধ আছে।যেখানে আমার সম্মান নেই সেখানে আমি থাকবো না।যেদিন আবির চৌধুরী আমাকে মেনে নিয়ে নিজে আমায় ফিরিয়ে আনবে সেদিন এবাড়িতে আসবো।
স্যারের বাঁধা দেওয়া স্বত্বেও আপু বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। আপুকে গাড়িতে উঠার পরও স্যার অনেক ডাকলো।আটকানোর চেস্টা করলো।আপু শুনলো না।এক প্রকার জেদ দেখিয়ে চলে গেলো। আপু যাওয়ার পর মিনি আর নিশি স্যারকে প্রিয়ার কথা বলল।স্যার এসে প্রিয়াকে ওর রুম থেকে টেনে এনে বাড়ির বাইরে ছুড়ে ফেলে দিলো।ঠিক তখনই আবির চৌধুরী এসে স্যারকে কথা শোনালো। প্রিয়াকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এসে বলল আপুকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করতে।স্যার তার বাবার কথা শুনে অনেক রেগে গেলো। আর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।ঠিক তখন প্রিয়া বলে ওঠলো,
-আমার জন্য আপনাদের মধ্যে এতো ঝামেলা হোক সেটা আমি চাই না।তার চেয়ে বরং আমিই আপনাদের জীবন থেকে সরে যায়। নূর ম্যামকে নিয়ে মেঘ স্যার সুখে থাকুক।

প্রিয়া আবির চৌধুরীকে চোখের ইশারাই বোঝায় একটু অভিনয় করতে।আবির চৌধুরী বুঝতে পারলে বলে,
-আপনি না গেলে নূর ম্যাম ফিরে আসবে না বলে গিয়েছে।চলুন আমি আর আপনি ম্যামের কাছে ক্ষমা চাইবো।বলব স্যারের জীবনে ফিরে আসতে।
আবির চৌধুরী সম্মতি জানালো।মেঘ স্যার তাদের সাথে যেতে চাইলো।প্রিয়া কৌশলে বলল,
-স্যার আপনার আসার দরকার নেই।আজ প্রথমবার আবির চৌধুরী মন থেকে মেনে নিয়ে তার পুত্রবধূকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।আপনি বরং ম্যামের জন্য বাড়িতে অপেক্ষা করুন। ম্যামের পছন্দ হয় এমন কোনো সারপ্রাইজ প্ল্যান করুন।
স্যারকে বুঝিয়ে আমাকে, নিশিকে আর মিনিকে হসপিটালের দায়িত্ব মনে করিয়ে দিয়ে প্রিয়া আর আবির চৌধুরী আপুকে আনতে গেলো।আমি আপুকে ফোন করে বললাম,
-প্রিয়া ওর ভুল বুঝতে পেরেছে।আর আবির চৌধুরী তোমাকে আনতে যাচ্ছে।
আপু খুব খুশি হলো।নিজের হাতে অনেক রান্না করলো শ্বশুরের জন্য। আবির চৌধুরী আর প্রিয়া এসে বসলে।আপু নিজের হাতে রান্না করা খাবারগুলো নিয়ে তাদের সামনে এসে দাড়াতেই আবির চৌধুরী উঠে দাড়িয়ে বলল,
-কত টাকা পেলে আমার ছেলেকে ছেড়ে দেবে তুমি।
কথাটা শুনতেই আপুর হাত থেকে খাবারের ট্রে’টা পরে গেলো।আবির চৌধুরী আবার বলল,
-তোমার মতো মেয়েতো নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারো।আমার অনুপস্থিতিতে মেঘের চেয়ারটাও কেড়ে নিয়েছো হসপিটালে।এখন বলো কত টাকা দিলে ওর জীবন থেকে সরে যাবে? আমি চাই না তোমার মতো এতো জঘন্য একটা মেয়ে আমার ছেলের জীবনে থাকুন।ওর জীবনটা ছারখার করে দিক।তাই বলো কত টাকা চাও?
পাশ থেকে প্রিয়া বলে ওঠলো,
-স্যার আপনি বরং একটা চেক দিন।না হলে নূর ম্যাম বিশ্বাস করবে না আপনি টাকা দিয়ে মেঘকে কিনবেন?
প্রিয়ার মুখে এমন কথা শুনে আপুর খুব খারাপ লাগলো।ছলছল চোখে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
-মেঘ স্যার থেকে এখন মেঘ হয়ে গেছে? মেঘের কাছে শুনেছিলাম প্রিয়া মেয়েটা খুব ভালো।আমি যখন ওর কাছে ছিলাম না তখন তুমিই আমার মেঘকে হাসাতে।ওকে শান্তনা দিতে।কিন্তু আজ বুঝছি এগুলো কেন করতে।লজ্জা করে না তোমার? মেঘ তোমাকে স্টুডেন্ট ভেবে শ্রদ্ধা করে আর তুমি ওর সংসার ভাংতে চাচ্ছো? বউ হতে চাচ্ছো ওর?

আবির চৌধুরী ঘুরে আপুর গালে মারলো এক চড়।আপুর মুখের সামনে আঙুল উঁচিয়ে বলল,
-প্রিয়া আমার হবু পুত্র বধূ।ওর সাথে এমন ব্যবহার করার যোগ্যতা তোমার নেই।আমিই ওকে কথা দিয়েছি মেঘের সাথে বিয়ে দেবো যখন তোমাকে মেঘ ধাক্কা মেরে হসপিটাল থেকে বের করে দিয়েছিলো।তাই ওকে মেঘের বিয়ে করতেই হবে।আর মেঘ যদি ওকে বিয়ে না করে তোমাকে নিয়ে সুখে থাকতে চাই তাহলে মেঘকে আমি তেজ্জ করবো।আমি ভুলে যাবো আমার কোনো ছেলে ছিলো।তোমার মতোন স্বার্থপর আর লোভী মেয়ে যদি আমার কাছ থেকে আমার ছেলেকে কেড়ে নিতে চাও তাহলে নিতে পারো।
একটা চেকে সিগনেচার করে টেবিলের উপরে চেকটা রেখে আপুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-চেকটাই ইচ্ছামতো এমাউন্ট বসিয়ে নিও।আর তার বদলে মেঘ।ভেবে দেখও সিদ্ধান্ত তোমার হাতে।
কথাটা বলে প্রিয়াকে নিয়ে বেড়িয়ে যান আবির চৌধুরী।উনারা চলে যাওয়ার পরই মাম্মাম আর কাকি মণি হৃদের সাথে বাড়িতে ফেরে।হৃদ কাকি মণিকে চেকাবের জন্য হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলো।মাম্মাম সাথে গিয়েছিলো।বাড়িতে এসে সবাইবআপুকে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে দেখলো।দেখলো নিচে খাবার পরে আছে।
মাম্মাম আপুর কাছে জানতে চাইলো কখন এসেছে আর খাবার কিভাবে নিচে পরেছে।একটার পর একটা প্রশ্ন করে চলেছে আপুকে মাম্মাম। আপু কোনো কথা না বলে উঠে নিজের রুমে চলে গেলো।

রাতে হোস্টেল যাবো বলে হসপিটালের সামনে দাড়িয়ে আছি।হৃদের কোনো খোঁজ নেই।ভেবেছিলাম ওর সাথে দেখা হলে সারাদিনের সব কথা একসাথে বলব কিন্তু ওর কোনো খবরই নেই।অপেক্ষা করতে করতে না পেরে ফোন করলাম।দুইবার রিং হয়ে পরেরবার রিসিভ করলো।তারপর যেটা জানতে পারলাম সেটা শুনে আমি ইজিবাইকে উঠে বাড়িতে চলে এলাম।এসে দেখলাম আপুর রুমের সামনে মেঘ স্যার আর মাম্মাম বসে কাঁদছে। মেঘ স্যারের হাতে একটা চিরকুট আর পেপার।আবির চৌধুরী কিছুটা দূরে মাথাটা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। আমি এগিয়ে এসে মেঘ স্যারের থেকে চিরকুট’ টা নিয়ে পরতে শুরু করলাম।তাতে লিখা আছে,
আমি জানিনা মানুষ দ্বিতীয়বার সুযোগ পাই কিনা।তবে আমি ভেবেছিলাম আমি খুব ভাগ্যবতী তাই মেঘের মতো কাউকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি।সত্যিই আবির চৌধুরী খুব ভালো।তাই আমাকে নিজের ছেলের পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিয়েছে।কিন্তু আমার মনে হয় না আমি মেঘের যোগ্য।তাই চলে যাচ্ছি।কোথায় যাচ্ছি সেটা বলতে পারলাম না।কারণ মেঘ আবার আমাকে ফিরিয়ে আনতে চাইবে।আমি চাই মেঘ ওর যোগ্য কাউকে বিয়ে করে তার সাথে সুখে থাকুক।আমি যেখানেই থাকবো সুখে থাকার চেস্টা করবো।ডিভোর্স পেপারে সিগনেচার করে রেখে দিয়েছি।মুক্তি দিলাম মেঘকে আমার জীবন থেকে। আর মাম্মাম। তোমাকে অনেক কস্ট দিয়েছি।এটা সত্যি আমার মতো একটা জঘন্য মেয়েকে গর্ভে ধরে অনেক বড় অপরাধ করেছো তুমি।তাই আমার অপরাধে মানুষের সামনে গিয়ে দাড়াতে লজ্জা হয় তোমার।কিন্তু আর কখনো সেটা হবে না।তুমি চেয়েছিলে এবাড়ি থেকে যেন চলে যায় আমি তাই চলে যাচ্ছি।

আমি উঠে আপুর রুমে এলাম।আপুকে খুব মনে পরছে।নিচে চোখ যেতে খাটের পায়ার কাছে একটা চেক দেখতে পেলাম। চেকটাই আবির চৌধুরীর সিগনেচার করা।এবার বুঝতে পেলাম কি ঘটতে পারে।নিশ্চয় আবির চৌধুরী আপুকে খুব অপমান করেছে।হৃদ আমার হাতে চেকটা দেখে কিছু জানতে চাইলে আজকের সব ঘটনা ওকে খুলে বললাম।চেকটা আমার হাত থেকে নিয়ে হৃদ রেখে আবির চৌধুরীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে চাইলো এমনটা কেন করেছে। আমি হৃদকে আটকালাম। হৃদকে বললাম,
-আপুই হয়তো চাইনি আবির চৌধুরীকে মেঘ স্যার ভুল বুঝুক।চাইলে অবশ্য চিঠিতে লিখে রেখে যেত।আমাদের এমন কিছু বলে বাবা ছেলের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরানোর দরকার নেই।আবির চৌধুরীর সাথে পরে আমরা দু’জন আলাদা ভাবে কথা বলবো।এখন আপুকে খুঁজে বের করতে হবে।
চলবে,,