আলোছায়া

আলোছায়া !! Part- 05

মৌমি বদলে গেছে। এখন আর আগের মতো দাপিয়ে বেড়ায় না সে। ঝুড়ি খুলে বসেনা একগাদা আজগুবি প্রশ্নের। এখন আর তীব্র রোদে বিড়ালের পিছুপিছু সে ছোটে না। বয়স বেড়েছে তার। চলাফেরায় এসেছে গাম্ভীর্য। তার দিকে একদৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চোখ সরিয়ে নিল উল্লাসী। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচি ঠিক করে আঁচলে সেফটিপিন লাগানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সে এগিয়ে গেল জানালার ধারে বসে উদাসীন দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকা মৌমির কাছে।
“পিনটা একটু লাগিয়ে দাও মা।”
দৃষ্টিভঙ্গ হতেই খানিকটা কেঁপে উঠলো মৌমি। নজর ঘুরিয়ে উল্লাসীর দিকে চেয়ে ম্লান হাসলো সে।
“একটু ধীরে.. হ্যাঁ ব্লাউজের ভেতর দিয়ে লাগাবে।”
সেফটিপিন লাগিয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো মৌমি। আবারও জানালার ধারে গা লাগিয়ে বসে শুন্য দৃষ্টিতে তাকালো পিচঢালা পথের দিকে।
“মন খারাপ?”
প্রশ্ন করলো উল্লাসী। তবে মৌমির দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে খানিকটা হতাশ হলো। মেয়েটির মাঝের চাঞ্চল্যতা কমলেও এতটা গম্ভীর তো ছিল না সে। তবে কি খারাপ কিছু ঘটেছে তার সঙ্গে? মনে একগাদা প্রশ্ন বাসা বাঁধলেও ড্রয়িংরুম থেকে ডাক পড়ায় উল্লাসী ছুটলো সেদিকে। গ্রাম থেকে তার শশুর এবং ভাসুর এসেছেন। সঙ্গে এসেছে মৌমিও। তবে শাশুড়ীর কোমড়ের ব্যথা এবং বড় জা সাত মাসের গর্ভবতী হওয়ায় কোনো মহিলা সঙ্গে না আসায় বিয়ের সকল দায়দায়িত্ব এসে পড়েছে তার ঘাড়ে। অবশ্য এনিয়ে সামান্যও বিব্রত নয় সে। বরং কোমরে আঁচল বেঁধে একহাতে সামাল দিচ্ছে সবটা।
পুষ্পদের বাড়িটা কিছুটা ব্যাতিক্রম ধরনের। বেশ কয়েক কোঠা জায়গাজুড়ে নিয়ে করা বড়সড় এই বাড়িটি দোতলা। ডুপ্লেক্স বাড়িটির ড্রয়িংরুমের শেষ মাথায় বিশাল একটি ছাঁদ। যার দরজা খুললেই মনে হয় গ্রামের বাড়ির মতো পাকা একটি উঠান। যেখানে ২০/৩০ টি স্টীলের হাফ ড্রামে লাগানো রয়েছে নানান ফুলগাছ। আর বড়বড় কিছু ড্রামে লাগানো আম, কাঠাল, লিচুসহ কয়েক জাতের ফল গাছ। মনোরম সেই পরিবেশের বড়সড় একটি টেবিল পেতে টেবিল ফ্যান সেট করে দুপুরের খাবারের ঝামেলা সেখানে চুকিয়ে বিকেল গড়াতেই আংটিবদলের কাজ সেরে নিল দুই পরিবার। সবশেষে বিকেলের চায়ের আড্ডায় সকলে মেতে উঠতেই পুষ্পর ভাবি সকলের সামনে প্রস্তাব দিল দুজনকে নিজেদের মতো করে খানিকটা সময় কাটাতে দেয়ার। সে প্রস্তাবে কারো কোনো আপত্তি না থাকায় তাদের পাঠানো হলো পুষ্পর ঘরে।
“এই যে এপাশের সব বই গুলো আমার প্রাক্তনের দেয়া.. দেখলেন কতগুলো? জানেন? এতবই কিভাবে বাসর রাতে পোড়াবো তা নিয়ে আমি বেশ চিন্তিত থাকি!”
ম্লান হাসলো মুবিন। চেয়ারে বসে বই রাখার তাকের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বস্তায় ভরে রাখবেন.. যেখানেই বাসর হোক না কেনো সাথে করে নিয়ে যাবো।”
“সাহায্য করবেন তো?”
“অবশ্যই…”
হাসি ফুটলো পুষ্পর চোখেমুখেও। একটি বই হাতে নিয়ে নিজের বিছানায় আরাম করে বসে সে বললো,
“যাক! একটা ঝামেলা থেকে তো বাঁচলাম! তা আপনি বই পড়েন না?”
মাথা নেড়ে মুবিন বললো,
“না.. তবে চৈতালি পড়তো।”
“চৈতালি? সে কে?”
বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে উঠলো মুবিনের। নিজের কথায় বেশ হতাশ হলেও নিজেকে সামলে লম্বা একটি দম ছেড়ে বললো,
“আমার বোন অনার বান্ধবী ছিল।”
“অনা? আমি প্রচুর কষ্ট পেয়েছিলাম অনার সাথে ঘটা ট্রাজেডি শুনে। ওসবের সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের কি শাস্তি হয়েছে?”
“শাস্তি? এর মাঝেই জামিনে বেরিয়ে বিয়েশাদীও করে নিয়েছে ছেলেটি!”
তাচ্ছিল্যের সুরে বললো মুবিন।
চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে পুষ্প বললো,
“আমি বুঝি না এদের কাছে মেয়ে দেয় কারা?”
“বাস্তবতা বড়ই নির্মম!”
“তবে অসুন্দর নয়.. আজ আইনের দ্বারা শাস্তি হয়নি, তবে কাল যে প্রকৃতি দ্বারাও হবে না তা আমরা কী করে বলি বলুন?”
বুকচিরে গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রসঙ্গ পালটাতে মুবিন বললো,
“আপনি মাস্টার্স কোত্থেকে কমপ্লিট করতে চান?”
“আপাতত কিছু ভাবছি না.. তবে আমি চাই আপনি আমার জীবনের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে আমার পাশে থাকুন। আপনি আমার হাতে হাত রাখুন.. আমার পায়ে পা মিলিয়ে চলুন। আমার কাঁধে হাত রেখে বলুন তুমি এগিয়ে যাও আমি তোমার পাশে আছি।”
মেঝের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এই প্রথম পুষ্পর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো মুবিন। শ্যামল বরণ মেয়েটি। চোখে টেনে দিয়েছে মোটা করে কালো কাজল। জাম রঙের একটি জামদানী শাড়ি পরে চুলগুলোয় করে রেখেছে হাতখোঁপা। কোমল ঠোঁটটি রাঙিয়েছে হালকা খয়েরী রঙের লিপস্টিকে। থুতনির কোণায় কালো তিলের উপস্থিতিতে কত স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটিকে! যেনো উড়ন্ত কোনো প্রজাপতি হাপিয়ে উঠে এখনি বসবে তার চুলের খোপায়। অদ্ভুত সুন্দর তুমি পুষ্প.. পুষ্প নামটি যেনো বিশেষ যত্নে তৈরি করা হয়েছে তোমার জন্যই! মনে মনে আওড়ালো মুবিন।
মুবিনকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঢোক চেপে মেঝেতে নজর দিল পুষ্প। বুকের ভেতরটায় তার তুফান শুরু হয়েছে। শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় পৌঁছে দিচ্ছে সেই ঝড়ের আভাস। এভাবে কেনো তাকিয়ে আছেন লোকটি? তাকে কেনো বিব্রতকর একটি পরিস্থিতিতে ফেলতে উঠে পড়ে লেগেছে? গভীর কিছু নিঃশ্বাস ফেলে নড়েচড়ে বসলো পুষ্প। পরিবেশ স্বাভাবিক করতে হালকা কেশে বললো,
“এসব কেমন নীতি? আমায় আংটি আপনি না পরিয়ে উল্লাসী ভাবি কেনো পড়িয়ে দিল? আর আপনাকেই বা আমি না পরিয়ে বাবা কেনো পড়িয়ে দিল? জানেন আমার ইচ্ছে কী ছিল?”
“জানি.. আপনার ইচ্ছেগুলো বেশ প্রাণবন্ত!”
কোমল স্বরে কথাটি বলে নিজের হাতের আংটি খুলে মুবিন তা বাড়িয়ে দিল পুষ্পর দিকে।
অবাক হলেও খুব সাবধানে নিজের হাতের আংটি খুলে ফেললো পুষ্প৷ তারপর হাত মুবিনের দিকে বাড়িয়ে ধরতেই মুবিন স্পর্শ করলো তার হাত। সময় নিয়ে নিজের হাতে পুষ্পকে আংটি পড়িয়ে তার কাজল কালো গভীর চোখের সাগরে ডুবে গিয়ে তার হাতে ঠোঁট ছোয়ালো মুবিন।
“এই তোমরা কী করছো? ওমা! তুমি ছোটো চাচির হাত খাচ্ছো কেনো? দাঁড়াও, আমি সবাইকে বলে আসছি।”
মৈত্রী চেঁচিয়ে উঠতেই ঘটনার আকস্মিকতায় পুষ্পর হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মুবিন। দ্রুত পায়ে মৈত্রীর পিছনে পা বাড়াতেই এক দৌড়ে মৈত্রী ঢুকে পড়লো ড্রয়িংরুমে।
“এখন? বলে দেবে?”
আতংকিত গলায় বললো পুষ্প।
জবাবে মাথা চুলকে ম্লান হাসলো মুবিন।
“ওমা.. শুনো শুনো। ছোট চাচ্চু ছোট চাচ্চির হাত খাচ্ছে..”
চায়ের আড্ডায় উপস্থিত সকলে একমুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে পড়লেও মাঝ থেকে হেসে উঠলেন শেখ আলাউদ্দীন। নাতনিকে নিজের কাছে টেনে নাকে আদর দিতেই খিলখিল করে হেসে উঠলো মৈত্রী।
একমুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেলেও পরমুহূর্তেই আড়চোখে উল্লাসী তাকালো মৌমির দিকে। মেয়েটি সেসময় ছোট ছিল.. হঠাৎ তাদের ঘরে ঢুকে খবরদারী করে বলেছিল, এই তোমরা কী করছো আমাকে ফেলে? ও মেজো বাবা, তুমি ছোট আম্মুর চুল খাচ্ছো কেনো? চুল কী খাওয়ার জিনিস? অতীতের স্মৃতিচারণ করতেই হেসে উঠলো উল্লাসী। পাশে হাসিমুখে বসে থাকা মেসবাহর পেটে গুতো মেরে ফিসফিস করে বললো,
“এখন আমি চুলে গন্ধরাজ বেলিফুল লাগাই.. তারপরও আর খাননা কেনো চুল?”
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হলেও ঘেমে নেয়ে উঠায় গোসল সেরে নিল উল্লাসী। ভেজা চুলগুলো টাউয়ালে মুছে তা বেলকনিতে মেলে দিতে গিয়েই নজরে পড়লো গুমসুম মেরে বসে থাকা মৌমিকে।
“মন খারাপ?”
উল্লাসীর ডাকে খানিকটা আঁতকে উঠে পিছিয়ে পড়লো মৌমি। নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় ভাঙা গলায় বললো,
“না তো..”
“তাহলে এত চুপচাপ কেনো? কী হয়েছে? আমায় বলবে না?”
চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিল মৌমি। তারপর সুপ্ত গলায় বললো,
“চমকের বাবা মারা গেছে..”
“চমক কে? তোমার বন্ধু?”
“না..”
“তবে?”
“চৈতালি ফুপুর ছেলে…”
পুরো শরীরে যেন কাঁটা দিয়ে উঠলো উল্লাসীর। বিস্মিত হয়ে সে বললো,
“চৈতালি আপার স্বামী মারা গেছেন? মানে সবুজ স্যার মারা গেছেন? বলো কী! কবে কীভাবে মারা গেলেন?”
“বাসের নিচে চাপা পড়ে.. আমি সবাইকে লুকিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম ছোট আম্মু। মুখের যে কী বিশ্রী অবস্থা! আমি দু’রাত ঘুমাতে পারিনি..”
মৌমিকে বুকে চেপে ধরলো উল্লাসী। লম্বা একটি দম ছেড়ে আতংকিত গলায় বললো,
“কবে মারা গেছেন উনি?”
“ওই শুক্রবারে..”
“সাতদিন হয়ে গেল! অথচ আমাদের কেউ জানায়নি?”
“মেজো বাবা তো জানে.. বাবা মেজো বাবাকে জানিয়ে পরামর্শ করছিল ছোট চাচ্চুকে জানাবে কিনা!”
“তারপর?”
“তারপর দাদা ঠিক করলেন জানানোর দরকার নেই। আমি একটা বাজে কাজ করে ফেলেছি ছোট আম্মু।”
পূর্বসুরেই উল্লাসী বললো,
“কী বাজে কাজ?”
“লুকিয়ে লুকিয়ে বাবা আর আম্মুর কথা শুনে নিয়েছি। ছোট চাচ্চু চৈতালি ফুপুকে ভালোবাসে তাইনা?”
সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলো উল্লাসী।
মৌমি বললো,
“তাহলে চাচ্চুকে কিছু জানায়নি কেনো ওরা? তুমি জানো চৈতালি ফুপু কেমন করে মেঝেতে গড়িয়ে গড়িয়ে কাঁদছিল?”
চোখজোড়া ছলছলে হয়ে উঠলো উল্লাসীর। মৌমিকে বুকে চেপে ধরে সে শান্ত গলায় বললো,
“তোমার দাদু যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেহেতু তাতে আমাদের সম্মান দেখানো উচিৎ।”
“তবে ছোট চাচ্চুকে কিছুই বলবো না?”
“না..”
কোথাও একটা আশার আলো ফুটলেও তা নিমেষে আঁধারে পরিণত হতেই মুখ ছোট করে ফেললো মৌমি৷ ক’দিন যাবৎ কিছুই ভালোলাগছে না তার। বারবার চোখের সামনে ভেসে আসছে চৈতালির আর্তনাদের দৃশ্য।
(চলবে)