00

দহন !! Part- 02

শংকর তান্ত্রিকের মৃত্যু গ্রামবাসীকে ভয়ের সাগরে ডুবিয়ে দেয়। শংকর তান্ত্রিক তার জীবনকালে অনেক মানুষকে ভুতপ্রেতের হাত থেকে রক্ষা করিয়েছেন। তার নামের অনেক সুনাম এলাকায় এবং এলাকার বাহিরেও। তাই এত বড় তান্ত্রিকের মৃত্যু গ্রামবাসীকে আতঙ্কিত করেছে। কিন্তু তান্ত্রিকের শেষ কথাটি গ্রামবাসীকে মহা দুশ্চিন্তায় ফলে দিল। কোনো দুরাত্মা এসেছে যে খুব শক্তিশালী। সে এই গ্রামটিকে ধ্বংস করতেই এসেছে। তান্ত্রিক বলেছিলেন এটা এই গ্রামবাসীদের পাপের ফল। কিন্তু কি এমন পাপ গ্রামবাসীরা করলো যার মাশুল এত ভয়ানকভাবে দিতে হচ্ছে তাদেরকে। গ্রামের লোকজন বড্ড ভয়ে আছেন। দিনের পর দিন কোনো না কোনো মেয়ের খুব নির্মম অবস্থা হচ্ছে। পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ।

গ্রামের এমন ভয়াবহ অবস্থায় ফেরেস্তা হয়ে আসেন রহমান সাহেব। গ্রামে রহমান সাহেবের সম্মান অনেক। উনি এই গ্রামের মসজিদের ইমাম। উনি যখন গ্রামের এমন পরিস্থিতির কথা জানতে পারলেন তখন অন্যদের মতো উনিও ভয় পেলেন। এর আগে এমন কোনো ঘটনা ঘটে যেতে দেখেননি বা শুনেননি। তাই একদিন গ্রামবাসীদের নিয়ে একটা বৈঠকের আয়োজন করলেন উনি। গ্রামের সবাই উপস্থিত হলেন বৈঠকে। গ্রামবাসীরা যথেষ্ট মানেন উনাকে। বৈঠক থেকে একজন ইমাম সাহেব কে সব ঘটনা বিস্তারিত জানিয়ে বলল,
ইমাম সাহেব, সবকিছুই তো আপনি জানেন। এই গ্রামের উপর কার যে কুদৃষ্টি পড়ল তা কেউ জানেনা। মেয়েরা তাদের অজান্তেই মা হয়ে মারা যাচ্ছে। এমনকি তাদের বাবা-মাকেও ছাড়ছেনা সেই দুরাত্মাটা। আপনি তো আলেম মানুষ, জ্ঞানী ব্যক্তি। এই সমস্যার সমাধানের কোনো পথ দেখান আমাদেরকে…

গ্রামবাসীরা সবাই একত্রে অনুরোধের আওয়াজ তুলল। ইমাম সাহেব সবাইকে প্রথমে শান্ত করলেন তারপর বললেন,
আমিও খুব আহত হয়েছি এই ঘটনাটির পর থেকে। কখনো ভাবিনি আমাদের এই গ্রামের উপর এমনভাবে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার উপর সর্বদা বিশ্বাস রাখতে হয়। উনিই তো সবকিছু করেন। উনি নিশ্চয়ই এর কোনো উপায় রেখেছেন। আমি একজন পীর সাহেবকে চিনি। উনি খুব বিজ্ঞ এবং দক্ষ মানুষ। অনেক কিছু জানেন উনি। হয়তো উনি আমাদেরকে এই বিপদ থেকে বের করতে পারবেন। যদি আপনারা সবাই বলেন তাহলে কালই আমি এই গ্রামের পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানাবো। উনি হয়তো নিরাশ করবেননা। আপনারা কি সবাই একমত?

মৃত্যু যখন সামনে, মানুষ তখন বাঁচার জন্য ছটফট করে উঠে। গ্রামের সবাই ইমাম সাহেবের মতে মত জানালেন। ইমাম সাহেব উনাদেরকে বললেন,
কিন্তু পীর সাহেবকে পাওয়াটা সহজ না। ফোন যোগে উনার সাথে যোগাযোগ করা অসম্ভব। উনি এসব ব্যবহার করেননা। তবে হ্যাঁ, কয়েকজন মিলে উনার গ্রামে গেলে উনি আমাদেরকে ফিরিয়ে দিবেননা। তাই আমার সাথে কাল কয়েকজনকে পীর সাহেবের গ্রামে যেতে হবে। আপনারা কে কে যাবেন?

গ্রামবাসীদের মধ্যে থেকে পাঁচজন প্রস্তুত হলেন ইমাম সাহেবের সাথে যেতে। ইমাম সাহেব আবারো আশ্বাস দিয়ে বললেন,
আপনারা আপনাদের সৃষ্টিকর্তার উপর আস্থা রাখেন। মালিক সব ঠিক করে দিবেন ইনশাআল্লাহ…

পরদিন ইমাম সাহেব এবং গ্রামের পাঁচজন লোক মিলে পীর সাহেবের কাছে গেলেন। পীর সাহেবের ঘর দেখে সবাই বেশ অবাক। গ্রামের সবকটি ঘরই দেখতে বেশ সুন্দর এবং উন্নত। কিন্তু পীর সাহেবের ঘর সেই আগের ঘরগুলোর মতোই বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি। ইমাম সাহেব অবশ্য আগে দুয়েকবার প্রয়োজনে এখানে এসেছেন তাই উনার কাছে সব পরিচিত।

ইমাম সাহেবের সাথে পাঁচজন লোককে দেখে পীর সাহেব তাদের বসতে বললেন। পীর সাহেব ইমাম সাহেবকে তো চেনেন কিন্তু এই পাঁচজনকে চেনেন না। কিন্তু একবারও তাদের পরিচয় জানতে চাননি বা এমন আচরণ করেননি যে উনারা পীর সাহেবের অপরিচিত কেউ। গ্রামবাসীরাও এটা নিয়ে ভাবেননি বা অবাক হোননি। কিন্তু গ্রামবাসীরা তখন খুব অবাক হোন যখন পীর সাহেব বললেন,
তোমরা ভাবছো গ্রামের ঘরগুলো এত সুন্দর কিন্তু পীর সাহেবের ঘর কেন এমন বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি। আমার তো ঘর পরিবার সব পরম করুণাময় আল্লাহ কে নিয়েই। উনাকে ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। উনিই হলেন সবার বাবা-মা। আপনাদের চেহারায় ভেসে উঠা ভয়ের জলছাপ আমি দেখতে পারছি। এই ভয় ই আপনাদেরকে এখানে এতদূর টেনে নিয়ে এসেছে।

পীর সাহেবের কথা শুনে লোকগুলো একদম হতভম্ব হয়ে গেলো। পীর সাহেবের তো এসব জানার কথা না। কেউ তো উনাকে জানায় নি। পীর সাহেব গ্রাম থেকে আসা লোকজনদের চেহারায় বিস্ময়ের চিহ্ন দেখে একটু মুচকি হেসে বললেন,
অবাক হবেন না। আল্লাহ আমাকে উনার অশেষ মেহেরবানি করে কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন। আপনারা কেন এসেছেন তা আমি জানি।

ইমাম সাহেব জানেন পীর সাহেবের ক্ষমতা তাই উনি অবাক হলেন না মোটেও। সরাসরি সমস্যার কথা তুলে ধরলেন।

– পীর সাহেব, গ্রামের উপর আসা বিপদের খবর তো আপনি জানেনই। আমরা কেউ ই এই সমস্যার উৎপত্তি কিভাবে হল আর সমাধান কিভাবে তা বুঝতে পারছিনা তাই আপনার নিকট শরণাপন্ন হয়েছি। আপনিই পারেন আমাদেরকে এখন এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে।

জ্ঞানী ব্যক্তিরা বিপদে অস্থির হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেননা। পীর সাহেব এর প্রমাণ দিলেন। পীর সাহেব মধুর গলায়, চেহারায় একটু হাসি এনে বললেন ,
সব আল্লাহর কাছে ইমাম সাহেব। আমরা করার কেউ না সব উনিই করেন। আপনারা যতটা সহজ ভাবে নিয়েছেন বিষয়টাকে, আসলে বিষয়টা ততটাই জটিল এবং বিপজ্জনক। ভাবছেন কোনো ভুত পিশাচের কাজ এটা? ঠিকই ভাবছেন। কিন্তু এটা এতটাই শক্তিশালী দুরাত্মা যে এর সাথে লড়াই করা সহজ কথা না।

পীর সাহেবের কাছে এসে, উনার অলৌকিক ক্ষমতা দেখে লোকদের মনে একটা আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু পরক্ষণে এমন বাক্য শুনে প্রদীপ প্রায় নিভু নিভু অবস্থায়। লোকগুলোর মনের এমন অবস্থা পীর সাহেব আন্দাজ করে নিলেন। বললেন,
আগেই বলেছি সবকিছুর মালিক আল্লাহতালা। তাই উনার উপর ভরসা রাখুন। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আপনাদের গ্রামের মানুষদেরকে রক্ষা করার।

ইমাম সাহেব মনযোগ দিয়ে শুনছিলেন উনার কথাগুলো। কিন্তু এই অভিশাপ কেন উনার গ্রামকে গ্রাস করছে সেটা জানার খুব ইচ্ছে জাগলো ইমাম সাহেবের মনে। উনি পীর সাহেব কে বললেন,
ঠিক বলেছেন পীর সাহেব। আল্লাহ-ই সবকিছুর মালিক। কিন্তু পীর সাহেব আমাদের গ্রামে এরকম তো আগে কখনোই ঘটেনি। তাহলে এখন এমনটা কেন হচ্ছে? কেন গ্রামের মেয়েরা হুট করে এভাবে সন্তান জন্ম দিচ্ছে?

পীর সাহেব নিশ্চুপ বসে রইলেন। কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
এটা গ্রামবাসীদেরই পাপের ফল!

লোকজনেরা পীর সাহেবের কথায় ভীষণ অবাক। কোন পাপের কথা বলছেন পীর সাহেব? মনে সবার একই প্রশ্ন। সেই পাঁচজন লোক এবার একসাথে জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
বাবা, কোন পাপ?

-ঠিক ২০ বছর আগে আপনারা কয়েকজন মুরুব্বিরা মিলে একটা বিচার করে দিয়েছিলেন আপনাদেরই গ্রামের একটা মেয়ের। মেয়েটার সাথে জোরপূর্বক অপকর্ম করা হয়েছিল। করেছিল আপনাদেরই গ্রামের প্রভাবশালী বাপের কয়েকজন ছেলেরা। মনে আছে? বিচারকদের মধ্যে থেকে একজন ব্যক্তি এখানে এসেছেন।

পাঁচজন লোকের মধ্য থেকে একজন বলল,
আমি ছিলাম বিচারক।

– আপনার নাম রবিন?

লোকটা যথেষ্ট অবাক হলো। কেননা রবিন তারই নাম। কিন্তু এতক্ষণে সে পীর সাহেবের ক্ষমতা আন্দাজ করতে পেরেছে তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
হুম আমিই রবিন। বিচারে সেদিন আমিও রায় দিয়েছিলাম।

– জানি। ঘটনাটা পুরোপুরি ই আমি জানি। তবুও আমি আপনার মুখে শুনতে চাই সম্পূর্ণ ঘটনা। একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলবেন কি হয়েছিল।

রবিন বলতে শুরু করলো সেই অতীতের ঘটনাটুকু পীর সাহেবের কাছে।
মেয়েটার বাবার নাম ছিল রতন আর মায়ের নাম ছিল সুমা। তার একটাই মেয়ে ছিল ঊর্মি । দেখতে খুব সুন্দর এবং বিয়ের উপযুক্ত। বাবা-মা ছিলেন নেহাৎ গরীব। সমাজে ছিল তারা নিচু জাতি। তো একদিন সেই মেয়ে ও তার বাবা-মা কাঁদতে কাঁদতে গ্রামের প্রধানদের কাছে অর্থাৎ আমাদের কাছে নালিশ নিয়ে আসলো৷ আমরা ১০ জনের একটা কমিটি ছিলাম। বিচার-আচার আমরাই সমাধান করতাম। তো মেয়েটার ভাষ্যমতে তার সাথে ৬ জন ছেলে মিলে নাকি তার ধর্ষণ করেছিল। আবার সেই ৬ জন ছেলের মধ্যে একটা ছেলে নাকি তাকে ভালোবাসতো যার সন্তান তার গর্ভে ছিল। আপনি হয়তো এটাও জানেন যে ছেলেগুলোর বাবা-মা কে ছিলো!

পীর সাহেব মাথা নাড়লেন।

– মেয়েটার দেহের কাপড় চোপড় ছেড়া ছিল। প্রায় প্রায় অর্ধনগ্ন ছিল মেয়েটা। তো আমাদের মাঝে থেকে একজন একটা চাদর দিল তাকে তার দেহটা ঢাকার জন্য। মেয়ের বাবা তখন কাঁদতে কাঁদতে বলল, চাদর দিয়ে শরীর টা তো ঢাইকা দিবেন কিন্তু আমার ইজ্জত টা কি ফিরত আসব। আপনারা আমারে সঠিক বিচার কইরা দেন। ঐ ছেলেগুলারে শাস্তি দেন! তার বাবা মা কেঁদে কেঁদে পুরো এলাকা ভাসিয়ে দিচ্ছিল। পরেরদিন আমরা ছেলেগুলোকে বিচারে আসার জন্য বলি। মেয়েটা যে ছেলের নাম নিয়েছিল তাদেরকেই ডেকে আনা হয়। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় মেয়েটা যা কিছু বলছে তা কি সত্য। তখন ৬ জন ছেলের মধ্যে থেকে সুজয় যা বলল তা ছিল এমন,
আমরা এই বিষয়ে কিচ্ছু জানিনা কিন্তু আমি মেয়েটাকে পছন্দ করতাম। কিন্তু একদিন আমি শুনতে পাই যে মেয়েটার সম্পর্ক ছিল কোনো এক ছেলের সাথে। আর ঐ ছেলেটারই বাচ্চা তার পেটে। কিন্তু এখন নাকি ছেলেটা অস্বীকার করে বলছে সে এই মেয়েকে বিয়ে করবেনা। তাই ঊর্মি এবং তার বাবা-মা আমাকে ফাঁসানোর জন্য, তার মেয়ের বিয়ে যেন আমার সাথে দিতে পারে এজন্য এই ষড়যন্ত্র আঁটছেন।

কথাগুলো শুনবার পর আমরা ঊর্মির বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করলাম। তারা বলল,
আমরা বিন্দুমাত্রও মিথ্যে বলছেনা। আমরা যদি সুজয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতাম তাহলে এতজন ছেলের উপর দোষারোপ কেন করতাম বলেন?

তখনই সুজয় দাঁড়িয়ে বলল,
তোরা নিচু জাতির হলে কি হয়েছে, বুদ্ধিতে আমাদের থেকে দুই কদম এগিয়ে। তোরা তোদের কথাকে জোর দেয়ার জন্য আমাদের কে ফাঁসাচ্ছিস।

রতন আর সুমা কাঁদতে কাঁদতে ভাসিয়ে দিচ্ছিল। আমরা ঊর্মি কে ধমক দিলাম, ভয় দেখালাম কিন্তু সেও একই কথা বলছিল। আমরা কোনো সিদ্ধান্তে পোঁছাতে পারছিলামনা। তারপর আমরা সেই ছেলেদেরকে জিজ্ঞেস করি যে মেয়েটা যে সময়ে তার ধর্ষণ করার কথা বলেছে ঐ সময় তারা কোথায় ছিল। ছেলেরা সবাই একই সাথে থাকে। তারা পরস্পর বন্ধু। তারা সবাই বলল কোন এক হোটেলে তারা আড্ডা দিচ্ছিলো তখন। আমরা তারপর হোটেলের মালিক কে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। সেও তাদের পক্ষেই মত দিল। কিন্তু মেয়েটা হোটেলের মালিক কেও মিথ্যে বলছে বলে দোষারোপ করল। কিন্তু মিথ্যে বলে তো তার কোনো ফায়দা হওয়ার কথা না তাহলে সে মিথ্যা কেন বলবে। কিন্তু ঊর্মি নামের মেয়েটার লাভ ছিল মিথ্যে বলে। সে যাকে নিজের গর্ভের সন্তানের বাবা বলে দাবী করেছিল সে ছিল এলাকার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর ছেলে। তার বউ হতে পারলে সে রানির মত থাকতো। তাই সেই হোটেল মালিকের কথানুযায়ী আমরা মেয়েটাকে কঠোর শাস্তি প্রদান করি। মেয়েটা তার মা বাবার সাথে আত্মহত্যা করে মারা যায়।

পীর সাহেব মনযোগ দিয়ে শুনছিলেন কথাগুলো। একটু মুচকি হেসে পীর সাহেব ইমামের দিকে মুখ করে বললেন,
শুনছেন ইমাম সাহেব?

ইমাম সাহেব ১০ কি ১২ বছর হবে এখানে ইমামের কাজ করছেন। আগে অন্য একজায়গায় ছিলেন। ইমাম সাহেব বললেন,
জ্বি। কিন্তু আপনার রহস্যময়ী হাসিনর পেছনের কারণ টা বুঝতে পারিনি।

পীর সাহেব আরেকটু হাসলেন। তারপর রবিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
রবিন সাহেব, আমি আগেই বলেছিলাম আমি সব জানি। আপনি যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন কিন্তু অসম্পূর্ণ বলেছেন।

কথাটাা শুনেই রবিনের মুখ বেঁকে গেল। পীর সাহেব বললেন,
আমি সম্পূর্ণ করছি ঘটনাটা। যে ছেলেগুলোর উপর ঊর্মি দোষারোপ করেছিলো তাদের বাবারা মিলে বিচারের আগের দিন আপনাদেরকে ১ লক্ষ টাকা নগদ দিয়েছিল এবং বলেছিল যেভাবেই হোক তাদের ছেলেদের উপর যেন কোনো দোষ না আসে। বাস্তবে ছেলেরা ঠিকই মেয়েটার সাথে কুকর্ম করেছিল। কিন্তু আজও গ্রামের মানুষেরা জানেনা যে আপনারা টাকার জন্য ঈমান বিক্রি করে দিয়েছিলেন। একটা মেয়ে কখনো নিজের ইজ্জত নিয়ে এত লোকের সামনে মিথ্যে, বানোয়াট দোষারোপ করতে আসবেনা। আজ সেই মেয়েটাই তার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে এসেছে।

রবিন মাথা নত করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। তখন ইমাম সাহেব পীর সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,
কিন্তু পীর সাহেব, গ্রামের সবাইকে কেন মেয়েটা মেরে ফেলতে চায়? দোষ তো এই ১০ জন গ্রাম প্রধানরা করেছেন!

– বিচার শেষে মেয়েটাকে গ্রামের লোকজন অনেক মারধর করেন। মেয়েটার সাথে পেটের বাচ্চাটাও তখন আঘাত পেয়ে পেটের ভেতরেই মারা যায়। তাই গ্রামের প্রতিটা মানুষ তার নজরে শত্রু, বেইমান।

– কিন্তু পীর সাহেব সেই মেয়েগুলোর তো কোনো দোষ নেই যারা এসবের শিকার হচ্ছেন!

– দোষ তো ঊর্মিরও ছিলনা। কিন্তু তাকেও তো অন্যায়ের শিকার হতে হয়েছে। ঊর্মির সাথে যখন এসব ঘটে তখন সে মাত্র ১৬ বছরের ছিল। তাই সে প্রতিটি ১৬ বছরের মেয়েকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে যেভাবে সে নিজে পেয়েছে। যে সাতজন এই কয়েকদিনে এভাবে মারা গেছে তাদের মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন পাঁচজন গ্রাম প্রধানের মেয়ে।

পীর সাহেব এবার রবিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
তোমার মেয়েও তো এবার ১৬ বছরে প্রবেশ করেছে নাকি!

রবিন কথাটা শুনেই ভয় পেয়ে যায়। তার মেয়েও এবার ১৬ তে পা দিয়েছে। রবিন ভয়ে পীর সাহেবের পায়ে গিয়ে পড়ে আকুতি মিনতি করে বলে,
পীর সাহেব আমাকে মাফ করে দেন। আমি লোভের বশে এতবড় পাপ করে ফেলেছি। কিন্তু আমার মেয়ের তো কোনো দোষ নেই। তাকে বাঁচান পীর সাহেব।

পীর সাহেব বললেন,
ক্ষমা করার মালিক ঈশ্বর। উনার কাছে ক্ষমা চাও। আমাকে আল্লাহ এসব ক্ষমতা দিয়েছেন মানবসেবার জন্য। কিন্তু কোনো পাপীকে বাঁচানোর জন্য নয়, পাক মানুষের রক্ষা করার জন্য। আপনি ঠিকই বলেছেন আপনার মেয়ের কোনো দোষ নেই। আমি সেইসব নিরপরাধ মেয়েদের কে বাঁচানোর জন্যই আপনাদের গ্রামে যাবো। জানিনা পারব কিনা, কিন্তু আমৃত্যু চেষ্টা করব। এতে আমার মৃত্যুও হতে পারে। কারণ আপনাদের সীমাহীন অন্যায়-অত্যাচারের কারণে তার আত্মা খুবই ক্রুদ্ধ যার কারণে সে অধিক শক্তিশালীও। তবুও বলছি সৃষ্টিকর্তার উপর আস্থা রাখুন। উনি সব ঠিক করে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন।

পরেরদিন পীর সাহেব ইমাম সাহেবের সাথে গ্রামে চলে আসলেন। ইমাম সাহেব এবং উনার সাথে যাওয়া লোকেরা পীর সাহেবের সাথে হওয়া সব কথপোকথন বিস্তারিত জানালেন। সবাই সবকিছু জেনে পীর সাহেবের ক্ষমতা কতটুকু তা বুঝতে পারলেন। গ্রামের লোকজনদের মনে একটা আশার প্রদীপ জ্বলে উঠলো। সবাই পীর সাহেবের উপর ভরসা করে আছেন।

এদিকে রবিনের জন্য একটা দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিল। গ্রামে আসতেই সে জানতে পারলো সকালে তার মেয়ের ঠিক একইভাবে পেটে ব্যথা উঠেছে। সে ব্যথা সহ্য করতে না পেরে বার দুয়েক অজ্ঞান হয়ে যায়। রবিন খবরটা পেয়ে একদম দিশেহারা হয়ে যায়। সে সবকিছু ভুলে তার মেয়েকে দেখার জন্য দৌড়ে যায় ঘরে। পীর সাহেবও পেছনে পেছনে যান ইমাম সাহেবকে সাথে নিয়ে।

রবিন বাবুর মেয়ে রাত্রি যখন পীর সাহেবকে দেখলো তখন সে ভয়ে কাঁপতে লাগলো। যেন সে ভুত দেখে ফেলেছে। রাত্রি ভয়ে দূরে সরে যেতে লাগলো। পীর সাহেব রবিনকে বললেন মেয়েকে ধরতে। কিন্তু রবিন একা তার মেয়েকে সামাল দিতে পারছিলেন না। মেয়েটার দেহে তখন এতই শক্তি ছিল যে সে তার বাবাকে ধাক্কা দিয়ে দুরে ফেলে দিচ্ছিল। পীর সাহেব সাথে থাকা চারজন লোককে বললেন মেয়েটিকে ধরে রাখার জন্য। তারা মিলে মেয়েটিকে কোনোভাবে সামাল দিল। পীর সাহেব রাত্রির পেটে হাত বুলিয়ে দিলেন। ধীরে ধীরে রাত্রির পেট ব্যথার উপশম হল। রবিন বাবু পীর সাহেবের কাছে অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জানালেন। কিন্তু তবুও রবিনের মনে ভয়ের মেঘ গর্জন করছে। সে পীর সাহেব কে জিজ্ঞেস করলো,
পীর সাহেব আমার মেয়ে তো ঠিক হয়ে গেছে? তাকে তো আর সেই আত্মা টা মেরে ফেলবে না?

পীর সাহেব বললেন,
ঠিক হয়নি রবিন সাহেব। আমি শুধু তার পেটের ব্যথাটাকে কমাতে পেরেছি। তার গর্ভে সেই সন্তানটা চলে এসেছে।

রবিন অসম্ভব ভয় পেয়ে যায়। তাহলে তার মেয়েও অন্যদের মতোই মারা যাবে? প্রশ্নের ঢেউ উঠছে রবিনের মনে। পীর সাহেবকে রবিন জিজ্ঞেস করলো,
তাহলে আমার মেয়েকে বাচানোর কি কোনো উপায় নেই পীর সাহেব?

– মরা-বাঁচা তো আল্লাহর হাতে। উনি যা চাইবেন তাই হবে। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো আপনার মেয়েকে এবং এই গ্রামটাকে বাঁচানোর।

– দয়া করে দ্রুত কোনো উপায় করুন পীর সাহেব।

রবিনের করুণ কণ্ঠ তার মনের অবস্থা বলে দিচ্ছিল। তার মেয়েকে সে কতটা ভালোবাসে সেটার প্রমাণ দিচ্ছিল। পীর সাহেব বললেন,
আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখুন।

তারপর পীর সাহেব রবিন কে বললেন গ্রামের সবাই কে একসাথে নিয়ে শ্মশানে যেতে। ইমাম সাহেব আর পীর সাহেব আগেই শ্মশানে চলে গেলেন। ইমাম সাহেব ভীষণ অবাক শ্মশানে যাওয়ার কথায়। তাই পীর সাহেবকে ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
পীর সাহেব, শ্মশানে কেন যাচ্ছেন?

পীর সাহেব মুচকি হেসে বললেন
সেখানে গেলেই সবকিছুর মূলটার দর্শন করতে পারবেন ইমাম সাহেব।

– মানে?

– মানে খুব সোজা। ঊর্মি কে যে জায়গায় কবর দেয়া হয়েছে সেখানে গেলে মন্ত্র শক্তির কারণে তাকে সহজে দেখতে পাবেন।

– এতে হবে কি?

– এতে আমরা তার সাথে কথা বলে তার এই ধ্বংসযজ্ঞের কারণ জানতে পারবো এবং সে কিভাবে এ গ্রাম ছেড়ে যাবে এটার উপায়ও বের করতে পারব।

সবাই শ্মশানে উপস্থিত হল। পীর সাহেব সবাইকে শ্মশানের বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন। পীর সাহেব রবিন বাবু, ইমাম সাহেব এবং আরো চার-পাঁচ জন লোককে নিয়ে শ্মশানের ভেতরে একটা কবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। ইমাম সাহেব পীর সাহেবকে কবরের পাশে দাঁড়াতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
পীর সাহেব, এই কবরের পাশে কেন দাঁড়ালেন?

– এটাই সেই মেয়েটার কবর যে এই সব ধ্বংসের মূল। আমি এখন মন্ত্রশক্তির সাহায্যে তাকে প্রকাশ্যে আসতে বাধ্য করবো। আপনারা সবাই চুপ করে থাকবেন। আর যখন সেই মেয়েটার সাথে আমি কথা বলবো আপনারা কেউ পালাবেননা আর চুপ করে থাকবেন।

সবাই সম্মতি জানালেন। পীর সাহেব চোখ বন্ধ করে মনে মনে মন্ত্র উচ্চারণ করছিলেনন। কিছুক্ষণ পর খুব জোরে বাতাস বইতে লাগলো। গাছপালা উপড়ে পড়ে যাবে মনে হচ্ছিল। গ্রামবাসীদের মনে ভীষণ ভয় জেগে উঠলো। পরক্ষণেই সবাই শ্মশানের ভেতরে আলো জ্বলে উঠতে দেখল। আলোটা সারা এলাকা এতটাই আলোকিত করে দিয়েছিল যেন মনে হচ্ছিল সূর্য উদিত হয়ে গেছে।

পীর সাহেব এবং সাথের মানুষজন দেখলো খুব ভয়ংকর একটা অবয়বের আবির্ভাব হয়েছে। প্রকাণ্ড দেহ তার। চোখগুলো লালচে। যেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কণ্ঠস্বর মর্মান্তিক। অবয়ব টা ঊর্মির অতৃপ্ত আত্মা ছিল। দহনের আগুন তার মনে জ্বলজ্বল করছিল। কর্কশ গলায় ঊর্মি পীর সাহেব কে বলল,
মৃত্যু তকেও ডেকে এনেছে এখানে তাইনা? মরতে যদি না চাস তাহলে চলে যা এখান থেকে। তোর এতটা সামর্থ্য নেই যে তুই এই পাপীর দলকে বাঁচাতে পারবি।

ভয়ংকর কণ্ঠ শুনে সারা গ্রাম হাহাকার করছিল। ভয়ে সবার হৃদয় কাঁপছিল। কিন্তু পীর সাহেবের চোখেমুখে কোনো ভয়ের ছাপ নেই। হাসিমাখা চেহারায় বললেন,
তুই মারার কে? মৃত্যুর মালিক তো উপরওয়ালা। যার উপর সেই আল্লাহর নজর আছে তার অনিষ্ট কেউ করতে পারে না। তুইও না…

ঊর্মির অতৃপ্ত আত্মা যেন রেগে যায়। কণ্ঠে যেন আগুন জ্বলে উঠলো। বলল,
কোথায় ছিলি তুই আর তোর আল্লাহ যখন আমার উপর, আমার বাবা-মায়ের উপর তারা অন্যায়-অত্যাচার করেছিল। তুইতো ধার্মিক মানুষ, পীর মানুষ তাহলে অন্যায়, অধর্ম করা মানুষদের বাঁচানোর জন্য কেন এসেছিস? তোর আল্লাহ কি এভাবে অন্যায়কারীদের রক্ষা করে?

– আল্লাহ পাক মানুষদের রক্ষা করেন আর পাপীদের শাস্তি দেন। আমি এসেছি সেইসব নির্দোষ মেয়েদের রক্ষা করার জন্য যাদের কোনো দোষ না থাকা স্বত্বেও তুই তাদেরকে কষ্ট দিচ্ছিস।

ঊর্মি বিকট ভাবে হাসতে হাসতে বলল,
হাহাহা, নির্দোষ? কেউ নির্দোষ না, সবাই দোষী। এই গ্রামের সবাই দোষী। আমি এই গ্রামকে ধ্বংস করে দিব।

– কেন? কি চাস তুই?

– আমি চাই আমার আর আমার বাবা-মায়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে। যে আগুনে আমি জ্বলেছি সে আগুনে তাদেরকে দহন হতে দেখতে চাই। তুই চলে যা এখান থেকে নইলে তুইও জ্বলে ছারখার হয়ে যাবি।

ঊর্মি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। অদৃশ্য হয়ে গেলো। জ্বলজ্বল করা অবয়বের গায়েব হয়ে যাওয়া ইমাম সাহেব পীর সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,
সে কি চলে গেছে পীর সাহেব?

পীর সাহেব গম্ভীর ভাবে বললেন,
না, সে যায়নি।

রবিন বাবু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
তাহলে কি সে কখনো যাবেনা পীর সাহেব?

– চিন্তা করবেন না। সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রাখেন। সবকিছু ঠিক হবে।

কিন্তু পীর সাহেবের চেহারায় কিসের যেন এক ছটফটানি ছিল। চোখেমুখে গাঢ় চিন্তার দাগ। উনি ইমাম সাহেবকে বললেন, উনার থাকার ব্যবস্থা এমন ঘরে করতে যেখানে কেউ থাকেনা। ইমাম সাহেব পীর সাহেবের কথানুযায়ী ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু গ্রামের মানুষের মনে ভয় হয়ে রয়ে গেল। পীর সাহেব আশ্বাস দিলেন গ্রামবাসীকে উপরওয়ালা সব ঠিক করে দিবেন।

পরদিন সকালে গ্রামবাসীরা ভীষণ বড় ধাক্কা খেল। পরদিন পীর সাহেবের বিভৎস লাশ পাওয়া গেল। দেহ থেকে মাথা আলাদা হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। সারা দেহে রক্ত লেপ্টে রয়েছে। চেহারায় বাজেভাবে চিরে ফেলা হয়েছে। ইমাম সাহেব ই প্রথম গ্রামবাসীকে পীর সাহেবের মৃত্যুর খবর দেন। পীর সাহেবের হাত থেকে একটা চিঠি পাওয়া যায় যেটা তিনি নিজেই মরার পূর্বে লিখেছেন। কিন্তু পীর সাহেবের মৃত্যুর খবর শুনে গ্রামের সবাই প্রায় প্রায় আশাহত হয়ে পড়ে! এদিকে চিঠিটা আরও অবাক করে দেয় গ্রামবাসীকে।

#চলবে…..

#বিঃদ্রঃ উক্ত গল্পে পীর সাহেব ও ইমাম সাহেবের চরিত্র দ্বারা কোনো ধর্মকে আঘাত করতে চাইনি। এইটা কাল্পনিক চরিত্র মাত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *