শূন্যতায় অস্তিত্ব

শূন্যতায় অস্তিত্ব !! Part- 10

আমার মা তাহলে একদম ঠিক বলেছিল, যে একবার মন ভেঙে মজা পায় সে বারবার সেটা করতে পারে এবং সবার সাথে!
তারপরেও আবার অন্য রকম একটা ভাবনা থেকে রায়ান ভাইয়াকে বলে বসলাম,
___আপনি ওর সম্পর্কে ঠিকঠাক বলছেন তো?
আমার কথা শুনে উনি হা হয়ে গেলেন। বিমর্ষ চোখে বললেন,
___ আমাকে কি তোমার কোনো কারণে অবিশ্বাসী বলে মনে হয়? ওর সম্পর্কে মিথ্যে বললে আমার কোনো লাভ আছে? লিয়া আমি তোমাকে এখানে ওর সম্পর্কে জানা সত্যটা জানাতে চেয়েছিলাম, আর তুমি কিনা আমাকেই অবিশ্বাস করছো?
আমি থতমত করতে করতে বললাম,
___ আরে আরে শুনেন! আমি আপনাকে অবিশ্বাস করছি কোথায়? আমি বলতে চাচ্ছি দীপ্তি যা বলেছে আর আপনি যা জেনেছেন তা সঠিক কিনা? কেননা তিয়াস আমার সামনে বলেছিল দীপ্তি ওর জীবন, দীপ্তির জন্য সে সব করতে পারে!
___আচ্ছা দীপ্তির সাথে কথা বলতে চাও? এখন অবশ্য অফলাইনে সে। তুমি রাতে ফোন দিও, আমি নাম্বার দিচ্ছি।
আমি ফোনটা খুলে ওর নাম্বার নিলাম। তারপর আস্তে আস্তে বললাম,
___ আসলে আমার কথায় আপনি কিছু মনে করলে আমি দুঃখিত। এই রং মাখানো দুনিয়ায় সাদাকালোর তফাৎ বুঝা ভীষণ কঠিন জানেন তো? এরপর আবার মানুষের উপর ভরসা করাটা তো ভাবা-ই যায়না।

রায়ান ভাইয়া আমার দিকে মাথা নেড়ে নেড়ে বললো,
___ হুম হুম! বুঝতে পারছি। তোমার বিশ্বাস লুণ্ঠন হয়েছিল, আর তাই কারো প্রতি খুব সহজে বিশ্বাস জন্মায় না। এমনও হয় তুমি কারো অনূভুতিও বুঝতে পারোনা। ভীষণ কঠিন হয়ে গেছো তাইতো? আচ্ছা সময় হলে ঠিক বেঠিক স্পষ্ট হয়ে যাবে। সাথে মানুষও চিনে যাবে। এখন চলো এক কাপ কফি খাওয়া যাক। এই প্রথমবার ক্যাম্পাস ছাড়া অন্য কোথাও আমাদের দেখা।
আমি না সূচক ভঙ্গিতে বললাম,
___ আজ নয়৷ অন্যদিন খাবো। আচ্ছা আপনি আমার একটা উপকার করতে পারবেন?
সাথে সাথে উনার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বললেন,
___ কি উপকার বলো? আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।

___ আপনি কাল কি ব্যস্ত থাকবেন?
___ হ্যাঁ সকাল ১১ টা থেকে বিকাল পর্যন্ত ব্যস্ত থাকবো।
___ তাহলে চলবে। আপনি কাল সকালে আমার সাথে কোচিংয়ে যাবেন। মানে সেখানে আমাকে পৌঁছে দিবেন। তিয়াস কাল থেকে জয়েন করার কথা। আমি জানিনা আসবে কিনা, তবে আসলে যাতে দেখে তার চক্রান্ত ভেস্তে গেছে! এখন চলুন ফেরা যাক।
তিনি সানগ্লাসটা ঠিকঠাক করে, হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করতে করতে বললো,
___ আচ্ছা তুমিই তো ওকে আমার ব্যপারে এতোকিছু বললে! কেন বলেছো প্রীলিয়া?
আমি হাতব্যাগটার উপর হাতটা কাচুমাচু করে সামনে এগিয়ে বললাম,
___ এসব পরে বলবো। এখন চলেন, কাল দেখা হবে।
উনি হেসে ডানদিকে নিজের গন্তব্যে রওয়ানা দিলো, আমি বামদিকে নিজের গন্তব্যে!
বাসায় পৌঁছে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে বিছানার উপর ধপাস করে বসে পড়লাম। অতীত যা ছিল তা বর্তমানে কেন প্রভাব বিস্তার করছে? কেন তিয়াস আবার এমন করছে? সে আসলেই কি এতটা খারাপ,যতটা আমি জেনেছি? নাকি তার চেয়েও বেশি খারাপ? অসংখ্য মেয়ের সাথে প্রতারণা করে থাকলেও শেষ পর্যন্ত সে আমাকেই কেন চায়? আমাকে পাওয়ার পেছনে তার কেমন স্বার্থ জড়িয়ে আছে? আর সে যে শোধরায় নি সেটা আমি ওদের বাসায় অপমানিত হয়েই বুঝেছিলাম। কিন্তু সে আমাকে দেখে এতটা ভালো হয়ে যাওয়ার চেষ্টা কেন করছে?আমি কি করে সত্যিটা জানবো?
তিয়াস নিজের মুখে কখনোই পুরো সত্যিটা জানাবেনা। তাছাড়া তিয়াসে

র মধ্যে মিথ্যে বলার ভয়ানক অভ্যাস আছে। নাহলে কি করে রায়ান ভাইয়াকে আমার সম্পর্কে আজেবাজে কথা বললো?
ওর মুখ থেকে কিছু শুনতে চাইলে সে নিশ্চিত আবার নতুন ছল করবে!
কিন্তু আমার মাথায় বহু পূর্বে তিয়াসের একটা ভালো মানুষি কাজ মাথায় ঘুরপাক খায়। যেটা ছিল নুজহাতকে সা’দের পরিবারের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া।
তার কাছে ভালোবাসার মূল্য না থাকলে সে ওইদিন এটা কেন করেছিল?
আমি নিজের মাথা চাপড়ে নিজেকেই বললাম,
কিসের মেধাবী আমি? মানুষ পড়তে জানিনা। মানুষ চেনায় অজ্ঞতা নিয়ে আমি এতো দূর এসেও কি করতে পেরেছি?
না না বহুত পড়ালেখা শিখেছি। এবার থেকে ভিন্ন রকম শিক্ষা অর্জন করতে হবে। আর আমি এখন এমন একটা পর্যায়ে আছি, যেখানে কেউ আসুক কিংবা চলে যাক আমার হৃদয়ে বিঁধবেনা। তাই হাজার কোটি মানুষের ভীড়ে সঠিক বলতে কোনো শব্দ আছে কিনা সেটা খুঁজে বের করতে হবে!
পরেরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রান্না করে খেয়েদেয়ে তারপর রায়ান ভাইয়াকে থাকতে বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।
গিয়ে দেখলাম উনি রাস্তার মোড়ে আমার আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি এগিয়ে এসে তারপর উনার সাথে হাঁটা ধরলাম। কারো সাথে পায়ে পা মিলিয়ে একসাথে বহুদিন পরে হাঁটছি। কিছুক্ষণ গিয়ে কোচিংয়ের মোড়ে আসতেই যা ভেবেছিলাম তাই দেখলাম। তিয়াসকে দূরে দেখা যাচ্ছে।

আমি আস্তে আস্তে রায়ান ভাইয়ার আরেকটু কাছে ঘেঁষলাম। আরেকটু আগাতেই বামহাতে উনার হাতের আঙুলে ধরে পায়ের তাল ঠিক রেখেই এগুতে লাগলাম।
উনি হঠাৎ হাতে ধরাতে অবাক হলেন। নিচে হাতের দিকে তাকিয়ে উনিও হাতটা ধরলেন আর সরল একটা হাসিতে বললেন,
___প্রীলিয়া সেসময় তিয়াসের সাথে সত্যের মধ্যেই অভিনয় ছিল। কিন্তু এই সময় আমার সাথে এই অভিনয়টা কি সত্যি সত্যি মন থেকে হতে পারে না? আমি সত্যিকার..
মুখের কথা আটকে হাত ছেড়ে দিয়ে আমি চোখ ইশারা করে ফিসফিস করে বললাম,
___ এই এই দেখেন তিয়াস চলে যাচ্ছে। নিশ্চিত ওর কলিজায় আগুন ধরে গেছে!
উনি তাকিয়ে দেখলেন তিয়াস চলে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই বললেন না। আমি হাসিমুখে উনাকে ধন্যবাদ জানাতে জানাতে ক্লাসে প্রবেশ করলাম।
তিয়াস আর ভেতরে আসেনি। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে গতকাল ওর বলা মিথ্যে আমার কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। এসে কি জবাব দিবে সেটা ভেবেই হয়তো চলে গেছে।
সেদিনটা স্বাভাবিক চলে গেলো। এর মধ্যে আরো ৪-৫ দিন চলে গেলো। মাঝে মাঝে খেয়াল করি তিয়াস দূর থেকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কাছে আসার সাহস পায়না। এখন কোনো কথা আছে বলেও বাহানা করে না। আমি আশেপাশে দেখলেই না দেখার ভান করে নিজের মতো করে কাজ করে যাই।
রায়ান ভাইয়ার সাথেও কথা বলিনা। উনি ফোন দিলেও রিসিভ করিনা, যদিও করি তাহলে বিভিন্ন ব্যস্ততার অজুহাত দেখাই। সত্যি বলতে আমি চাইনা উনাকে কোনো রকম ভরসা দিতে। যদি কখনো এমন হয় আমি কথা রাখতে পারলাম না, তাহলে আমিও তো তিয়াসের মতো প্রতারকের খাতারে চলে যাবো। তার চেয়ে ভালো সময় হলে আপন করে নিবো, ভালো লাগা ভেতরেই থাকুক। প্রকাশ করার চেয়ে গোপন অনূভুতির তীব্রতা বেশি!
সেদিন ছিল ছুটির দিন। সারাদিন বাসাতেই বই নিয়ে বসে ছিলাম। এর মধ্যে বাবা মাকে বারবার ফোন করে পাগল করে দিচ্ছিলাম। প্রতিটা ছুটির দিনেই আমি একটু পর পর উনাদেরকে ফোন দেই। কেন জানি এতো কথা বলেও কথা বলতে শুধু ভালোই লাগে। ভাবছি খুব তারাতাড়ি উনাদেরকে আমার কাছে নিয়ে আসবো।
সন্ধ্যার পরেরদিকে আমি পড়ছিলাম, হঠাৎই নুজহাতের ফোন আসলো। আমি বই বন্ধ করে ফোন রিসিভ করে গলা ছেড়ে বললাম,
___ কিরে বাচ্চার মা, ভালো আছিস তো?

উত্তরে নুজহাতের ভাঙা গলা স্পষ্ট শুনতে পেলাম। নুজহাত কেঁদে কেঁদে বললো,
___সা’দ আরেকটা বিয়ে করে ফেলেছে লিয়া। বিয়ে নাকি আরো দেড় বছর আগেই করছে। আমি এতোদিনে জানতে পারছি!
আমি চমকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আতংকিত হয়ে বললাম,
___ কাকে বিয়ে করছে? আর তুই এখনো ওর বিরুদ্ধে মামলা করছিস না কেন? তোদের একটা বাচ্চা আছে, সে কি করে এরপর আরেকটা বিয়ে করে? আমি হলে খুন করে ফেলতাম!
নুজহাত নাক টেনে আস্তে আস্তে বললো,
___ তিয়াসের কথা মনে আছে তোর? যাকে একদিন খুশিতে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম! আজ আমি যদি সত্যিই হাতে প্রতিবাদের অস্ত্র তুলে নেই সবার আগে ওর গলাটা দেহ থেকে আলাদা করে দিবো। কারণ সে সবকিছু জানতো!
নুজহাতের কথা শুনে আমার সারা শরীর শিউরে ওঠলো। আমার গলা থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিলোনা। একটু থেমে থেকে আস্তে আস্তে বললাম,
___ তিয়াস?
নুজহাত জোর গলায় বললো,
___ হ্যাঁ তিয়াস! যা করেছে সব তিয়াস করেছে। চার বছর আগে আমাকে মানানোর ক্ষেত্রে সে-ই সেদিন রাজী করিয়েছিলো এই বলে যে, বিয়ে করেছিস যখন মেনে ফেল। তারপর বউ রেখে যাকে ভালো লাগে প্রেম করে বেড়াবি সমস্যা নেই। তিয়াস সেদিন শুধুমাত্র তোর কাছে ভালো হওয়ার জন্য ভালো মানুষের অভিনয় করছে। মনে আছে রাতে তুই সা’দের কুকীর্তির কথা শুনে তিয়াসকে ব্লক করে দিয়েছিলি?
আমি চুপ করে রইলাম। কিছু বলার ভাষা পাচ্ছিলাম না। নুজহাত আবার বললো,
___আমার দিকে সা’দের বাজে উস্কানিতেও তিয়াসের হাত আছে। এরপর ওর মনে বিষ ঢুকানোর মাধ্যমটাও তিয়াস। তোর সাথেও তো প্রতারণা করছে সে। তুই ওকে জীবনেও মাফ করবিনা লিয়া! সে শুধু তোর জীবন নিয়ে নয়, অনেক জীবন নিয়ে খেলা করেছে।
আমি নিথর হয়ে শুধু শুনেই যাচ্ছিলাম। তখন হঠাৎ করেই আমার মনে হলো সেদিন রায়ান ভাইয়ার থেকে দীপ্তির নাম্বার এনেও তাকে এখনো ফোন করে সত্যটা যাচাই করা হয়নি। তার মধ্যে আজকে এসব আমি কি শুনছি? তিয়াসকে নিয়ে আমার মধ্যে যে খারাপ ভাবনা ছিল, সে তার সীমান্তও অতক্রম করে ফেলেছে। অনেক বেশি অপরাধী সে!
চলবে…..