প্রেমাতাল

প্রেমাতাল——- পর্ব ৩

লেখা- মৌরি মরিয়ম
মুগ্ধ বলল,
-“মেঘের আরো কাছে নিয়ে যাব তোমাকে। হাত বাড়ালেই মেঘগুলো লুটিয়ে পড়বে তোমার গায়ে।”
তিতির একথা শুনে বলল,
-“কোথায়? ওহ শুনেছিলাম নিলগিরি তে নাকি মেঘ ছোঁয়া যায়। সত্যি কি?”
-“হুম তবে সেটা খুব সকালে। ৮/৯ টা পর্যন্ত। কিন্তু আমরা নিলগিরি পৌঁছাতে ১২/১ টা বেজে যাবে।”
-“ওহ!”
-“আমি অবশ্য বলছিলাম রুইলুই পাড়ার কথা।”
-“সেটা কোথায়? নামও তো শুনিনি।”
-“ওটা একটা মেঘের দেশ! সাজেকের একটা গ্রাম।”
-“সাজেক খাগড়াছড়ি তে না?”
-“না না খাগড়াছড়ি দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সাজেক রাঙামাটিতে।”
-“ও। রাঙামাটিতে হলে খাগড়াছড়ি দিয়ে কেন যেতে হবে?”
-“রাঙামাটি দিয়ে কোন রাস্তা এখনো তৈরী হয়নি।”
-“ওহ! কিন্তু ওখানে আপনি আমাকে কি করে নিয়ে যাবেন?”
প্রশ্নটা শুনে মুগ্ধ কোন উত্তর খুঁজে পেলনা। সত্যি তো, কেন বললো ও একথা! তিতিরও প্রশ্নটা করে বোকা হয়ে গেল। কিন্তু প্রশ্নটাতো এখন আর ফিরিয়ে নেয়া যাবেনা। মুগ্ধ বলল,
-“না মানে তুমি একবার যখন ট্রাভেলিং শুরু করে দিয়েছো, ট্রাভেলিং ছাড়া তুমি থাকতে পারবে না তাই টিওবি থেকে সাজেকে কোন ট্রিপে হয়তো তুমি যাবে আর আমি তো ওদের প্রায় সব ট্রিপেই থাকি। তখন আমি তোমাকে আলো ফুটতে না ফুটতেই ডেকে নিয়ে যাব সেই স্বর্গীয় যায়গায়।”
-“গুড আইডিয়া। টিওবি মানে অরিজিনাল টিওবি আই মিন সাফি ভাইদের টা না। অথরিটির কোন সাজেক ট্যুর হলে আমাকে জানাবেন প্লিজ! আমি যাব।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“হা হা হা, অরিজিনাল টিওবি!”
-“অবশ্য জিপ মিস করে খারাপ হয়নি। শাপে বর হয়েছে।”
-“কিরকম?”
তিতির কিছু বলার আগেই হাসু ডাক দিল,
-“মামা কহন যাইবেন?”
মুগ্ধ তিতিরকে বলল,
-“এই খেয়ালই ছিল না। চলো চলো.. দেরী হয়ে যাবে আমাদের।”
তিতির সিওএনজিতে উঠতে উঠতে বলল,
-“অনেস্টলি স্পিকিং মিলনছড়ি অনেক সুন্দর। যেতে ইচ্ছে করছে না।”
সিএনজি আবার চলতে শুরু করলো। মুগ্ধ বলল,
-“সামনে এরকম শত শত সুন্দর যায়গা পড়বে, যাকে বলে একেবারে ভিউ পয়েন্ট। সব যায়গায় নেমে ২ মিনিট করে থাকলেও ২ দিনের আগে থানচি যেতে পারবো না।”
-“তাহলে কি আমরা ওই শত শত যায়গার মধ্যে ৪/৫ টা যায়গায়ও নামব না?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“হ্যা তা নামব।”
কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ তিতিরকে ইশারা করে দেখালো,
-“ওইযে দেখতে পাচ্ছো রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছো ওদিকে গিয়ে পাহাড় কেটে কেটে সিড়ি তৈরী করা হয়েছে। সিড়ি দিয়ে উঠলেই ‘মিলনছড়ি হিলসাইড রিসোর্ট’ বেশ কয়েকটা কটেজ আছে ওদের। আমি থেকেছিলাম যে কটেজে সেটার নাম ছিল মুনিয়া। কটেজের বারান্দায় গিয়ে আমি তো স্পিচলেস হয়ে গিয়েছিলাম। কি যে সুন্দর! শুধু পাহাড় আর পাহাড়! সব গুলো কটেজ এর নাম পাখির নামে বুলবুলি, টুনটুনি, শ্যামা, চড়ুই, মুনিয়া। তিতির নেই অবশ্য।”
তিতির হেসে ফেলল। মুগ্ধ এবার বলল,
-“নাও এবার বলো জিপ মিস করে কিভাবে শাপে বর হলো?”
-“ও, হ্যা! দেখুন, একেকটা জিপে আমাদের ১৪ জন করে বসতে হত। ৭ জন ডানপাশে, ৭ জন বামপাশে। এতগুলো অচেনা মানুষ মুখোমুখি বসে থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো এদের বেশিরভাগ মানুষই অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলবে তবে সেটা নিজেদের মধ্যে। অন্যদের সাথে পরিচিত হবার কোন দরকার নেই যেন। বাসে আর রেস্টুরেন্ট গুলোতে যেমন হয়েছে। আর আমরা যারা একা একা এসেছি তারা বলদের মত বসে থাকবো। তার চেয়ে এটাই ভাল হয়েছে না? অন্তত ওদের হা হা হি হি থেকে উদ্ধার পাওয়া গেল।”
-“হা হা হা, ওয়েল সেইড.. ওয়েল সেইড।”
-“হুম!”
-“আসলে এসব ট্যুরে কেউ একা একা আসেনা। ফ্রেন্ডস, গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড, ফ্যামিলি এভাবেই আসে। তাই তারা অন্যদের সাথে পরিচিত হবার তাগিদ ফিল করেনা।”
-“কই আপনি তো একা এসেছেন। যদিও আপনার কাজিন আছে কিন্তু সে তো তার ফ্রেন্ড সার্কেলদের সাথেই ছিল পুরোটা সময়। সেই হিসেবে আপনিও একাই এসেছেন।”
-“আসলে আমি যেখানেই যাই একাই যাই। অন্যদের সাথে আমার মেলেনা। খুব হতাশ হই গ্রুপের মানুষদের কিছু কাজকারবার দেখে। এগুলো টিওবির ট্যুরেও থাকে। গ্রুপে গেলে এগুলো থেকে রেহাই নেই।”
-“যেমন? একটু ডিটেইলে বলুন না। আমার তো কোন অভিজ্ঞতা নেই।”
-“যেমন ধরো, এরা অনর্গল হইচই করতে থাকবে। কথা বলুক, কথা বলাতে তো আর কোন প্রব্লেম নেই। এই যেমন আমরাও তো কখন থেকে কথা বলছি। কিন্তু হইচই তো করছি না। হইচই করলে পাহাড়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়। পাহাড় হলো নিরব, নিস্তব্ধ। এখানে এসে নিস্তব্ধতা বজায় রাখা আবশ্যক। হইচই করে পাহাড়েরও যে একটা নিরব ভাষা আছে সেটা ওরা শুনতেই পারে না। বিরাট এক মিস করে ফেলে।”
তিতির দেখলো মুগ্ধ খুব সিরিয়াসলি কথা বলছে তাই ও সিরিয়াসলি বুঝতে চায় ব্যাপারটা। জিজ্ঞেস করলো,
-“সত্যি কি পাহাড়ের কোন ভাষা আছে? আপনি বুঝতে পারেন সে ভাষা?”
-“শুধু আমি কেন তুমিও বুঝতে পারবে। কোন এক পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনে দেখো তারা কি বলতে চায়। আমার মনে হয় তুমি বুঝতে পারবে।”
তিতির ট্রাই করবে, যদি সত্যি পাহড়ের কোন ভাষা থেকে থাকে তবে রা বুঝতে চায় তিতির। তারপর মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তারপর হতাশার বাকি কারনগুলো বলুন।”
-“সেকেন্ড কারন হলো ছবি। যেকোন যায়গায় গেলে তার স্মৃতি রাখার জন্য ছবি তোলে মানুষ। খুব ভাল কথা। কিন্তু আজকাল দেখি যাওয়ার পরই শুরু হয়ে যায় ফটোসেশন পর্ব। যতক্ষণ সময় থাকবে ততক্ষণই ছবি তুলতে থাকে, এই পোজে সেই পোজে। আমি অবাক হয়ে যাই। এন্ড তাদের জন্য আমি ডিস্টার্ব ফিল করি। আমার পাহাড়ের সাথে প্রেমে ওরা বিঘ্ন ঘটায়। আমার মোবাইলে দেখো.. আমি যত যায়গায় গিয়েছি তার সব যায়গার দুএকটা ছবি পাবে কিন্তু আমার নিজের কোন ছবি পাবেনা। আরে ভাই ছবি তো ঢাকায় বসেও তোলা যায়।”
তিতিরের হঠাৎ খেয়াল হতেই বলল,
-“আরে.. আমিও তো সারাদিন ছবি তুলতে থাকি কিন্তু বান্দরবান আসার পর থেকে একটা ছবিও তুলিনি। এত সৌন্দর্য দেখে সব ভুলে গেছি। মনেই পড়েনি ছবি তোলার কথা।”
-“কারন তুমি প্রকৃত ট্রাভেলার। আর ওরা ট্যুরিস্ট!”
-“আমি না ট্রাভেলার আর ট্যুরিস্টের ডিফারেন্সটা বুঝিনা।”
-“আচ্ছা, বুঝিয়ে বলছি। ট্যুরিস্টরা কোথাও যাওয়ার আগের ২/৩ মাস ধরে প্ল্যান করে, টাকা জমায়। রুম বুক করে। বিলাশবহুল হোটেলে থাকতে চায়। ভাল খেতে চায়। যেখানে যাওয়ার রাস্তা ভাল, সুযোগ সুবিধা ভাল সেখানে যায়। যেখানে যাবে সেটাকে ব্যাগরাউন্ডে রেখে ছবি তুলে তুলে পুরো সময়টা ব্যায় করবে। ছবির সংখ্যা হবে অগনিত। আর স্পেশালি চিপসের প্যাকেট, কলার খোসা, পানির বোতল ইত্যাদি ভ্রমন স্থানে ফেলে আসবে।”
তিতির হেসে বলল,
-“ওহ! আর ট্রাভেলার রা?”
-“ট্রাভেলার রা হলো, মন চাইলো কোথাও যেতে.. ইন্সট্যান্ট পকেট হাতড়ে দেখবে তার কাছে কত টাকা আছে? যদি ভাল টাকা পয়সা থাকে তাহলে যেখানে মন চায় চলে যেতে পারবে। কিন্তু যদি কম টাকা পয়সা পায় যেমন ধর, ৪ হাজার টাকা পায় তাহলে চলে যাবে সেন্ট মার্টিনস। যদি ৩০০০ টাকা পায় তাহলে ছোটখাটো পাহাড়ে চলে যাবে। ২০০০ পেলে যাবে কক্সবাজার। আর যদি ১০০০ পায় তাহলে সিলেট তো আছেই।”
-“মানে? সিলেট কিভাবে ১০০০ এ যাওয়া যাবে?”
-“আসলে সিলেটের জন্য ১০০০ অনেক বেশি। ট্রেনে করে চলে যাবে। ইকনমি ক্লাসে চড়ে বা স্ট্যান্ডিং টিকেটে। ৩০ টাকার রুমে থাকবে। ১০ টকার ভাত। ১০ টাকার সবজি ১০ টাকার ডাল। মোট ৩০ টাকায় খাওয়া কম্পলিট। তাছাড়া সিলেটে মাংস ভাতও খাওয়া যায় ৭০/৮০ টাকায়।”
-“সিরিয়াসলি? আপনি মজা করছেন না তো?”
-“মজা কেন করবো? ইটস ট্রু!”
-“খাওয়াটা নাহয় বুঝলাম কিন্তু ৩০ টাকায় থাকা যায় কিভাবে? ফ্লোরিং করে নাকি ডরমিটরি সিস্টেমে?”
-“পুরো একটা রুম ভাড়া ৩০ টাকা। রুমে টিভিও আছে। প্রব্লেম একটাই, একটু রিস্কি! মেয়েদের জন্য।”
-“ওহ! হুম আমাদের দেশের সব সুবিধা তো ছেলেদের জন্যই।”
-“মেয়েরা তোমার মত সাহসী হলে মেয়েদের আর কোন প্রব্লেম থাকবে না।”
-“মেয়েদের প্রব্লেমের শেষ নেই কোনো। শুধু সাহস দিয়ে কি হবে?”
-“তুমি কি মিন করছো ঠিক ধরতে পারছি না।”
-“মিন করছি যে মেয়েরা তো বন্দী। ভাইয়া রিকোয়েস্ট না করলে বাবা-মা কখনো আসতে দিতনা। আমি নাহয় ভাইয়ার কারনে যেতে পারছি। কিন্তু আমার মত অনেক মেয়েরা আছে যারা ইচ্ছা থাকা স্বত্তেও বনে জঙ্গলে যেতে পারেনা। কারন, ফ্যামিলি থেকে এসব যায়গায় কেউ যায়না। বয়স্করা এত কষ্ট করতে পারবে না তাই। আর মেয়েগুলোর ঘুরাঘুরিও কক্সবাজার, সেইন্ট মার্টিনস, সিলেট পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে।
-“ঠিক, কিন্তু আজকাল আস্তে আস্তে মেয়েরাও সুযোগ পাচ্ছে। আমি তো আমার বোনকে মাঝে মাঝে নিয়ে যাই গ্রুপে গেলে, ও যদি ফ্রি থাকে। ওর ফ্রেন্ডদের সাথেও যেতে দেয় ফ্যামিলি থেকে।”
-“হুম এখন দেয়। আমাকেও দেয়। কিন্তু যখন আমাদের বিয়েসাদি হবে তখন আর পারবো না।”
-“বাপরে! কোন যুগে পড়ে আছো? তোমাকে দেখলে কিন্তু মনে হয়না তোমার চিন্তাধারা এমন।”
-“যা সত্যি তাই বললাম। যাই হোক, বাদ দিন। আপনি বলুন, একা একা ঘুরেই যদি আপনার এত আনন্দ তাহলে গ্রুপে কেন যান?”
-“একা একা ঘুরে আনন্দ ঠিক আছে তবে মনের মত সঙ্গী হলে দোকলাও প্রব্লেম নেই। বরং ভাল, নিজের ফিলিং শেয়ার করা যায়। আর গ্রুপের কথা যদি বলো সেখানে এত মানুষ সবাই তো আর আমার মনের মত হবে না। আবার একধরনের দূরের আর এক্সপেনসিভ ট্যুর গুলোতে তো গ্রুপ ছাড়া উপায়ও নেই। একেক যায়গার ভাড়া কিরকম তা তো দেখলেই। এসব যায়গায় থাকা খাওয়ার খরচ খুবই কম কিন্তু ভাড়াতেই সব চলে যায়। থানচি থেকে যে নৌকায় যাব তার ভাড়াও প্রায় ৭/৮ হাজার টাকা। তাহলে বোঝো একা তো পোষায় না। আর খরচের ব্যাপারটা আমাকে চিন্তা করতেই হয় কারন, প্রতি মাসেই আমি কোথাও না কোথাও যাই। বৃহস্পতিবার অফিস করে রওনা হই, শুক্র,শনি ঘুরে শনিবার রাতে ব্যাক করে রবিবার থেকে আবার অফিস করি। এরকম প্রতি মাসে অন্তত একবার হয়। আর বড় রকমের ট্যুর বছরে ২/৩ বার।”
তিতিরের চোখগুলো বড় হয়ে গেল।
-“এত ঘুরাঘুরি করেন?”
-“ওই আর কি!”
-“আপনার না স্টাডি কম্পলিট হয়নি তাহলে জব করেন কিভাবে?”
-“ইভেনিং এ মাস্টার্স করছি, প্রাইভেটে।”
-“ওহ!”
হঠাৎ গাড়িটা ডানে মোড় নিতেই টাল সামলাতে না পেরে তিতির মুগ্ধর গায়ের উপড়ে গিয়ে পড়ল। তারপর হয়তো সিএনজি থেকেই পড়ে যেত কিন্তু মুগ্ধ তার আগেই তিতিরকে ধরে ফেলল। তারপর বলল,
-“শক্ত হয়ে বোসো। আমি সময়মত না ধরলে তো পড়ে যেতে।”
ওয়াইজংশন যেতেই মুগ্ধ গাড়ি থামাতে বলল। মুগ্ধ সিএনজি থেকে নেমে বলল,
-“তিতির নামো।”
তিতির নামল। তারপর বলল,
-“রাস্তার ব্যাপারটা দেখেছো?”
তিতির দেখলো এতক্ষণ ওরা একটা রাস্তায় এসেছে। সেই রাস্তাটাই এখানে এসে একটা বাম দিকে নিচে চলে গেছে, পাশে অনেকটা জমির মত কিছুটা সমতল। আরেকটা রাস্তা ডান দিকের বড় পাহাড় ঘেঁষে উপরে চলে গেছে। মোড়টাতে বেশ কয়েকটা দোকানপাট আছে। সব দোকানদার মহিলা। শুধু একটা কাঠের টেবিলে পেঁপে নিয়ে বসে আছে এক বুড়ো-বুড়ী। তিতির বলল,
-“বাহ, যায়গাটা তো বেশ সুন্দর। আচ্ছা, রাস্তাটা এরকম দোতলা টাইপ কেন?
-“দোতলা! ওয়াও.. কিন্তু তোমার এই মোড়টাকে ওয়াইশেপ বলে মনে হচ্ছে না?”
তিতিরের এবার খেয়াল হলো। বলল,
-“আসলেই ওয়াই শেপই তো।”
-“এজন্যই এই যায়গার নাম ওয়াইজংশন।”
-“ওহ!”
-“চা খাও তো?”
-“খুব! বা খেলেই বরং খারাপ লাগে।”
-“তাহলে এতক্ষণ বলোনি কেন?”
-“আমি ভাবিনি এখানে চা পাওয়া যাবে।”
-“আচ্ছা, চলো। চায়ের সাথে আর কি খাবে?”
-“আর কিছুনা। আচ্ছা আমরা কোন রাস্তাটা দিয়ে যাব?”
-“উপরে যেটা গেছে ওটা দিয়ে।”
-“ও। আর নিচের ওই রাস্তাটা দিয়ে কোথায় যায়?”
-“ঠিক নিচের না। এখানে নিচে তবে আস্তে আস্তে উপরে উঠে গেছে। ওটা দিয়ে বগালেক, কেওক্রাডং এসব যায়গায় যায়।”
-“ওহ!”
মুগ্ধ দোকানে বসে বলল,
-“আপু, তিনটা চা দিয়েন।”
তিতির দোকানদার মেয়েটার দিকে তাকালো। মেয়েটা খুব সুন্দর একটা স্কার্ট পড়া। চাকমা টাইপ চেহারা হলেও খুব সুন্দর। তিতিরের স্কিন খুব ভাল। নিজের স্কিন নিয়ে ওর কোনই আক্ষেপ নেই। কিন্তু এই মেয়েটাকে দেখে নিজের প্রতি আক্ষেপই হচ্ছে। ও ফিসফিস করে মুগ্ধকে বলল,
-“মেয়েটা তো ব্যাপক স্মার্ট! আর মারাত্মক সুন্দর।”
-“এই কুনজর দিও না। স্মার্ট হবে না কেন? পাহাড়ে থাকে বলে কি ওরা স্ট্যাইল জানেনা ভেবেছো? আর ওরা এত সুন্দর যায়গায় থাকে, ফ্রেশ ওয়েদার। ওরা তো সুন্দর হবেই। আর তুমি এভাবে বলছো কেন? তুমি কি ওর চেয়ে কম নাকি?”
তিতির লজ্জা পেল। মুগ্ধও অকওয়ারড ফিল করলো। কি বলে ফেলল! প্রসঙ্গ পালটাতে মুগ্ধ তারপর হাসুকে ডাক দিল,
-“এই মামা, এদিক আসো।”
হাসু আসতেই বলল,
-“তুমি ওই কোনার মধ্যে বইসা আছো ক্যান? নেও চা-বিস্কুট খাও।”
হাসু চা নিল। বিস্কুটও নিল।
মুগ্ধ চা খাওয়া শেষ করে তিতিরকে বলল,
-“মজা দেখবে এসো।”
তারপর পেঁপের দোকানের সামনে গেল। তিতিরও সাথে গেল। বুড়ো-বুড়ী ওদের দেখেই হেসে দিল। মুগ্ধ একটা পেঁপে হাতে নিয়ে বলল,
-“দাদা, এটা কত?”
বুড়ো বলল,
-“তিইত তাকা।”
মুগ্ধ আরেকটা পেঁপে নিয়ে বলল,
-“আর এটা?”
বুড়ো একটু ভেবে বলল,
-“এতা পঁয়তিত তাকার মোতন।”
-“মিষ্টি হবে?”
বুড়ো হেসে বলল,
-“মিত্তি হবে।”
-“কেটে দেয়া যাবে?”
-“হি, কেতে দেয়া দাবে।”
মুগ্ধ একটা পেঁপে এগিয়ে দিল,
-“এটা কেটে দেন। আর ওইটা এমনই দিয়ে দেন।”
বুড়ো খুব সুন্দর করে পেঁপেটা কাটলো তারপর ধুয়ে পলিথিনে ভরে দিল। মুগ্ধ সেটা হাতে নিয়ে টাকা দিয়ে তিতিরকে নিয়ে সিএনজিতে উঠলো। সিএনজি ছেড়ে দিল। মুগ্ধ বলল,
-“যে মজাটা দিতে চেয়েছিলাম সেটা কি পেয়েছো?”
-“হ্যা, ওরা কি সুন্দর করে কথা বলে!”
-“খুব মিষ্টি না? আমার তো পাহাড়ীদের কথা শুনলে শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে।”
তিতির বলল,
-“আপনার কি পেঁপে অনেক পছন্দ?”
মুগ্ধ বলল,
-“পেঁপে বান্দরবানের জাতীয় ফল। ঢাকায় সারাবছরে একটা পেঁপেও খাইনা। কিন্তু বান্দরবান এলে ডেইলি ২/৩ টা পেঁপে খাই। এত মিষ্টি পেঁপে আমি পৃথিবীর আর কোথাও খাইনি। একবার খেয়ে দেখো। ঢাকা গিয়ে আর পেঁপে খেতে ইচ্ছে করবে না।”
-“আচ্ছা পরে খাবো।”
-“আরে খাওনা। খুব মিষ্টি। তোমরা মেয়েরা এত ডায়েট করো কেন বলোতো?”
-“আমি ডায়েট করিনা। অনেক খাই, খেলেও আমি মোটা হইনা।”
-“তাহলে খাও।”
তিতির পেঁপে নিল। মুখে দিয়ে ওর মনে হলো চিনি মাখিয়ে দিয়েছে। মুগ্ধ পেঁপে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি মিষ্টি না?”
-“হুম, মিষ্টির জন্য মাথা ধরে যাচ্ছে। বাপরে! মনে হচ্ছে ১ কেজি চিনি মাখানো হয়েছে পেঁপেটাতে।”
মুগ্ধ হাসলো।
কোন মানুষ যে যেকোনো সিচুয়েশনে এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে পারে তা মুগ্ধ আগে জানতো না। আর ঘুমানোর পর যে কারো মুখটা এতটা মায়াবী লাগে তাও ও জানতো না। তিতির ঘুমাচ্ছে, হ্যা সিএনজিতেই ঘুমাচ্ছে। যাতে পড়ে না যায় তাই ওর সামনে দিয়ে হাত বাড়িয়ে সিএনজি ধরে রেখেছে মুগ্ধ। ওর খুব ভাল লাগছে। ওর চোখ দুটো তিতিরের বন্ধ চোক, নাক, ঠোঁট, গাল, নিঃশ্বাস আর কপালের উপর এসে পড়া চুলের উপর ঘুরপাক খাচ্ছে। এতো সত্যি ঘুমকুমারী!
তিতিরের ঘুম ভাঙতেই দেখলো মুগ্ধ গুনগুন করে গান গাইছে। ও বলল,
-“আপনি গান গাইতে পারেন?”
মুগ্ধ বেড়ী দিয়ে তিতিরকে আগলে রাখা হাতটা সরিয়ে নিল। তিতির আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসল। তিতিরের ঘুমে জড়ানো কন্ঠস্বরটা মুগ্ধর বুকে গিয়ে লাগলো। মুগ্ধ সত্যি এবার চিন্তায় পড়ে গেল। ও তিতিরের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে না তো? সর্বনাশ! তিতিরকে ভাল লেগেছে এটা ঠিক, কাল যখন বাসে ওর কাধে ঘুমিয়ে পড়েছিল তখন থেকেই। ভাল লাগাতে তো দোষ নেই। কিন্তু প্রেমের মত ভুল ও আর করবে না, খুব শিক্ষা হয়েছে। আর না। ও জানে ও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবে।
মুগ্ধ চুপ করে আছে দেখে তিতির আবার জিজ্ঞেস করল,
-“কি হলো বলুন না, আমি তো আপনাকে গুনগুন করতে শুনলাম।
-“গান কে না গাইতে পারে?”
-“আমি পারিনা। আচ্ছা, আপনি যখন গান গাইতে পারেন আমাকে একটা গান শোনান। গান আমি খুব পছন্দ করি।”
-“এখন?”
-“হুম, এখনই তো গাইছিলেন।”
-“আমি যদি গাইও সিএনজির শব্দে কিছু শুনতে পাবে না। তারচেয়ে থানচি পৌঁছে রাতে শোনাবো।”
-“আমাদের থানচি পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে?”
-“অলমোস্ট।”
-“ও।”
তারপর মুগ্ধ হেসে বলল,
-“তিতির, তুমি এই গুণটা কিভাবে রপ্ত করেছো একটু বলবে? আমি না রাতে ছাড়া ঘুমাতেই পারিনা। আমাকে টিউটোরিয়াল দাও। খুব দরকার।”
-“ওটা আমার জন্মগত গুণ, আর প্লিজ আমার ঘুম নিয়ে আমাকে লজ্জা দেবেন না।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আচ্ছা আচ্ছা সরি।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। সিএনজি চলেছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে। কয়েকটা ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে দেখা গেল বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। তারা ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধ বলল,
-“তুমি বলেছিলে সিলেট গিয়েছো, সিলেটের কোথায় গিয়েছো?”
-“মাধবকুন্ড, জাফলং, রাতারগুল আর সিটিতেই একটা চা বাগানে। আর মাজারে তো গিয়েছিই।”
-“সবাই এসব যায়গায়তেই যায়। আমিও প্রথম এসব যায়গাতেই গিয়েছিলাম। কিন্তু নেক্সট বার সিলেট গেলে বিছনাকান্দি মাস্ট যাবে।”
-“বিছনাকান্দি কোথায়? আর ওখানে কি আছে?”
-“বিছনাকান্দি সিলেটেই। তবে যাওয়ায় একটু প্রব্লেম আছে। প্রথমে লেগুনা কিংবা সিএনজিতে করে যেতে হবে। তারপর পায়ে হেঁটে। তারপর নৌকায়। কিন্তু এত কষ্ট করে যাওয়ার পর যায়গাটা দেখে সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। ওখানে আকাশ নীল, পাহাড় নীল। নদীর পানিও নীল। ইন্ডিয়ার একদম সীমান্তে। ইন্ডিয়ার একটা ঝড়নার পানি এসে ওই নদীটায় পড়ে। অনেকটা জাফলং এর মতই, পানির নিচে পাথর। তবে ডিফারেন্স হলো ওগুলো অনেক বড় বড় পাথর আর জাফলং এর পানি যেমন সবুজ, বিছনাকান্দির পানি নীল। শুধু যে নীল তাই নয় স্বচ্ছও। এত স্বচ্ছ পানি যে তুমি গলা সমান পানিতে নেমে গেলেও নিচে তাকিয়ে পায়ের পাতাটা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাবে। তা বলে একা একা নেমো না, স্রোত তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। পানির স্রোত এত বেশি যে অনবরত কলকল ধ্ধনি হতে থাকে। জাস্ট স্পিচলেস!!!”
-“ধুর, আপনি খুব খারাপ! খালি লোভ দেখান।”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির বাইরে তাকালো।
আরেকটু সামনে যেতেই তিতির বিমোহিত হয়ে গেল রাস্তার দুপাশের সৌন্দর্য দেখে। দুপাশের পাহাড়গুলোই রাস্তা থেকে অনেক নিচে। বাম পাশের পাহাড়গুলো দেখতে একরকম, ডান পাশের গুলো আবার আরেকরকম। রাস্তার ধারে ফুটে রয়েছে রঙ বেরঙের বুনোফুল আর অচেনা ছোট ছোট বুনোলতা। তিতিরকে সেদিকে তাকিয়ে তাকতে মুগ্ধ বলল,
-“সুন্দর না বুনোলতা গুলো?”
-“হুম।”
-“বলোতো কেমন লাগতো এগুলো না থাকলে?”
-“মানে?”
-“আসলে এগুলো তো আগাছা! এগুলো যদি নিয়মিত কেটে ক্লিন করে রাখা হতো তাহলে কেমন লাগতো?”
-“কি জানি! সেরকম তো আর দেখিনি কখনো। এইতো প্রথম দেখছি।”
-“ভাল লাগতো না। মেঘালয়ে এসব আগাছা নিয়মিত কেটে রাখা হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫০০০ ফিট উপরে কিন্তু সব পাকা রাস্তা। সব কিছু হাতের মুঠোয়। কিন্তু আমার ভাল লাগেনি। এই ২৮০০ ফিট উপরের সাধারণ বুনো সৌন্দর্যই আমার কাছে বেশি ভাল লাগে।”
-“ও।”
মুগ্ধ তিতিরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“যা ন্যাচারাল তা সব আমার ভাল লাগে।”
তিতিরের কেমন যেন লাগলো বুকের ভেতর। তিতির বুঝলো না!
দরজায় টোকা পড়ল। তারপর ভাবীর গলা পাওয়া গেল।,
-“তিতির, এই তিতির.. ওঠো, আজ না তোমার ৮:৩০ এ ক্লাস। এখনো যে উঠছো না? দেরী হয়ে যাবে তো বাবা।”
তিতির চোখ মুছে পানি খেয়ে গলাটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। তারপর বলল,
-“ভাবী আমি উঠেছি, তুমি যাও.. আমি আসছি।”
মুগ্ধর পাঠানো অডিওটা শুনতে শুনতে মনে পড়ে গিয়েছিল ওদের প্রথম পরিচয়ের সেই বান্দরবান ট্রিপের কথা। আজ ৫ বছর পরেও চোখে ভাসে সব। ওসব ভাবতে ভাবতে কখন যে রাত পার হয়ে সকাল হয়ে গিয়েছে ও টেরই পায়নি। ফ্রেশ হয়ে এসে চেঞ্জ করলো। ক্লাসে যেতে হবে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে চোখ পড়লো বাঁশের পেনহোল্ডার টার দিকে। এই পেনহোল্ডার টা ও নিলগিরিতে উল্টেপাল্টে দেখেছিল কিন্তু কেনেনি। ওর পছন্দ হয়েছিল বুঝে মুগ্ধ কখন যেন কিনে নিয়েছিল। অনেক পরে ঢাকায় আসার পর ওকে দিয়েছিল। জিনিসটাকে আজও খুব যত্নে রেখেছে ও। মুগ্ধর দেয়া প্রতিটা জিনিস, মুগ্ধর সাথে কাটানো প্রতিটা ছোট ছোট স্মৃতিগুলাওকে খুব যত্নে রেখেছে ও। শুধু মুগ্ধকেই রাখতে পারেনি!
সেদিন দুপুরের দিকে ওরা নিলগিরি পৌঁছেছিল। সিএনজি পার্কিং এ রেখে ওরা টিকেট কেটে ঢুকলো। তিতির মুগ্ধর ঠিক পাশে পাশে হাঁটছে না। একটু পিছন পিছন হাঁটছে। ছেলেদের পাশাপাশি হাঁটতে ওর অস্বস্তি হয়। তিতিরের যায়গাটা ভাল লাগলো না। সবার মুখে শুনেছে নিলগিরি সুন্দর নিলগিরি সুন্দর। কিন্তু এখানে এসে ওর কাছে মনে হচ্ছে কোনো ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াতে এসেছে। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াগুলো যেমন সুন্দর সাজানো গোছানো থাকে সেরকমই। ও জানে নিলগিরি আর্মিদের যায়গা তবু পাহাড়েও ক্যান্টনমেন্টের মত হবে ভাবেনি। এখানে ভালই ভীর। ওদের মতই অসংখ্য লোকজন এসেছে নিলগিরি দেখতে। প্রায় প্রত্যেকটা দলই মোবাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত। একজনের ছবি তোলা হচ্ছে তারপর পালাক্রমে সেটা দলের সবাইকে দেখানো হচ্ছে। সবাই আবার সেই ছবি এনালাইজ করছে। অথচ কোথায় এসেছে সেটা দেখছেই না! অল্প কয়েকজনকেই দেখা গেল ঘুরে ঘুরে দেখতে। মুগ্ধ ঠিকই বলেছিল।
ওরা পাথরের বানানো সিড়ি দিয়ে একটা কিনার ধরে উপরে উঠছিল। বাম পাশে একটু নিচুতেই খাবার আর পাহাড়ীদের হস্তশিল্পের দোকান। উঁচু পাহাড়টা ছিল ডান পাশে। উঠেই দেখতে পেল পাহাড়ের কিনারে কিনারে পাথর দিয়ে বেশ কয়েকটা চেয়ার টেবিলের মত বানানো। তার পাশে রেলিং দেয়া। পাহাড়ের উপরে চার পাঁচটা কটেজ দেখা যাচ্ছে। কটেজগুলো পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু যায়গার কিনারে কিনারে বানানো। মাঝখানে চারকোণা একটা যায়গায় টাইলস বসিয়ে ড্রইংরুমের মেঝের মত করা হয়েছে। বামপাশে দেখলো বান্দরবানের একটা ম্যাপ যেখানে সব ইম্পরট্যান্ট যায়গাগুলো চিহ্নিত করা আছে। এই একটা জিনিসই শুধু ওর ভাল লাগলো।
তিতির মুখে কিছু না বললেও মুগ্ধ বোধহয় ওর ভেতরকার রিয়াকশনটা বুঝতে পেরেছিল। মুগ্ধ বলল,
-“ভাল লাগছে না না? সব প্লাস্টিক সৌন্দর্য বলে মনে হচ্ছে?”
-“আসলে আমার আফসোস হচ্ছে, এত সুন্দর পাহাড়টাকে কেটে কেটে এরকম ইট পাথরের কটেজ বানানোর কি দরকার ছিল? আবার দেখুন না, ওই যায়গাটাকে পুরো ড্রইংরুম বানিয়ে ফেলেছে।”
মুগ্ধ হেসে ফেলল। তিতির বলল,
-“আপনি বলছিলেন না বুনোলতাগুলো কেটে ফেলায় মেঘালয়ের পাহাড়ী রাস্তাকে আপনার ভাল লাগেনি। আমারও তেমন। যদিও আমি আগে এখানে আসিনি তবু মনে হচ্ছে এগুলো না থেকে স্বাভাবিক একটা পাহাড় হলেই বেশি ভাল লাগতো। এই যায়গার জন্য মানুষের এত লাফালাফি! আমি তো হতাশ হলাম।”
-“তিতির চোখ বন্ধ করো।”
-“কেন?”
-“অপরিচিত হওয়া স্বত্তেও আমাকে এতটা বিশ্বাস করে আমার সাথে এতদূর আসতে পেরেছো, আর এখন একটু চোখ বন্ধ করতে পারবে না?”
তিতির মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে নিজের চোখ বন্ধ করল। মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরলো। তিতির চোখ খুলে ফেলল। মুগ্ধ তিতিরের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
-“এতক্ষণে ভয় পেয়ে হোক আর যাই হোক, তুমি অলরেডি আমার হাত ধরে ফেলেছো। আরেকবার ধরলে আশা করি কোন ক্ষতি হবে না। আর অনেস্টলি স্পিকিং আমার মনে কোন দোষ নেই।”
তিতির ওর ঠোঁটে সেই মিষ্টি হাসিটা বজায় রেখে নিজেই মুগ্ধর হাত ধরলো। তারপর চোখ বন্ধ করলো। মুগ্ধ তিতিরকে ধরে কোথাও একটা নিয়ে যাচ্ছিল। তিতির অজান্তেই হাঁটছিল যেদিকে মুগ্ধ ওকে হাঁটাচ্ছিল। তারপর এক যায়গায় থামলো। তিতিরের পেছনে দাঁড়ালো মুগ্ধ। তিতিরের হাতটা আরো শক্ত করে ধরে বলল,
-“এবার চোখ খোলো।”
তিতির চোখ খুলতেই দেখতে পেল, ওর সামনেই অনেক অনেক নিচে অনেক অনেক পাহাড়। কাছের গুলো বড়, দূরের গুলো ছোট। দূরে যেতে যেতে পাহাড়গুলো যেন একেকটা পিঁপড়ার সমান হয়ে গেল। এখন বুঝতে পারছে এতক্ষণ যে রাস্তা থেকে পাহাড় দেখছিল আর অবাক হচ্ছিল তা নিতান্তই কাছে ছিল। পাহাড়গুলো দেখে মনে হচ্ছে কেউ অনেকগুলো ট্রায়াঙ্গল একটার ওপর একটা এঁকেছে। তারপর সবুজ রং করে দিয়েছে। কোনোটা গাঢ় সবুজ, কোনোটা হালকা সবুজ। এ এক অদ্ভুত সবুজের খেলা। বান্দরবানের একমাত্র নদী সাঙ্গু সর্পিল গতিতে বয়ে চলেছে সেই পাহাড়ের বুক ছিঁড়ে। শেষ প্রান্তটা কোথায় যে শেষ হয়েছে তা বোঝার উপায় নেই। আস্তে আস্তে সব ঝাপসা হয়ে গেছে। তিতিরের চোখের সামনে যা ছিল তার এক-চতুর্থাংশে ছিল এই পাহাড়! বাকি তিন- চতুর্থাংশ ছিল আকাশ। ছোটবেলায় ছবি আঁকার সময় হালকা আকাশী কালারের আকাশের উপর যে গোল গোল সাদা সাদা বাবলসের মত মেঘ আঁকত ঠিক তেমন মেঘ ছিল সে আকাশে। এমন আকাশ আর এমন মেঘ ও কোনদিনও দেখেনি। এত এত বিশালতা আর এত এত স্বচ্ছতা যেন তিতিরের চোখ, মুখ, নাক, কান এমনকি ওর শরীরের প্রত্যেকটি লোমকূপ দিয়ে ঢুকে ওর ভেতরের সব ক্লান্তি, গ্লানি, দুক্ষ, কষ্ট, আক্ষেপ, অভিমান আর না পাওয়াগুলোকে ছেঁকে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। ও কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল, কিভাবে দাঁড়িয়ে ছিল তার কিছুই তখন ওর খেয়াল ছিলনা। একটা কথাও বলতে পারলো না কখন ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো তা ও নিজেও টের পেলনা। ঠোঁটে ছিল বিস্ময়ের হাসি। থরথর করে কাঁপছিল। মুগ্ধ দেখলো এ দৃশ্য, খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলো। মুগ্ধ বেশ লম্বা তাই তিতিরের পেছনে দাঁড়িয়েও নিচে তাকিয়ে ওর মুখ দেখতে কোন সমস্যা হলোনা। তিতির ভারসাম্য হারিয়ে ওর বুকের উপর ঢলে পড়েছে। মুগ্ধ দুই হাত দিয়ে তিতিরের দুই হাত ধরে নিজের বুকের সাথে ওর পিঠ ঢেকিয়ে ধরে রেখেছে ওকে।