আলোছায়া

আলোছায়া !! Part- 04

দু’কাপ চা হাতে ড্রয়িংরুমে এসে মুন্নি সরকারের পাশে বসলো উল্লাসী। এককাপ মুন্নি সরকারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে তাকালো দেয়াল ঘড়ির দিকে। আটটা বেজে দশ মিনিট। অর্থাৎ আর কিছুক্ষণের মাঝেই চলে আসবে মেসবাহ। তারপর সে জাভেদকে নিয়ে একেএকে সবটা খুলে বলবে তাকে। সবশুনে হয়তো খানিকক্ষণ নীরব থাকবে মেসবাহ। তারপর গম্ভীরমুখে বলবে, ওসবে পাত্তা দেয়ার দরকার নেই। তুমি তোমার কাজটা মন দিয়ে করে যাও। যেমনটা এর আগেও একবার বলেছিল সে..
তখন চলছিলো জানুয়ারি মাস.. চারিদিকে স্কুল কলেজ নিয়ে চলছিলো ভর্তির আমেজ। উল্লাসীর আরেক বছর গ্যাপ পড়ে যাবে ভেবে মৈত্রী মাস চারেক না হতেই মেসবাহ তাকে ভর্তি করিয়ে দিল নতুন স্কুলে। আর তখনই বাঁধলো বিপত্তি! দিন দুয়েক মেয়েটিকে রেখে ক্লাস করলেও তিনদিনের মাথায় মেসবাহকে কিছু না জানিয়েই মেয়েকে নিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হলো উল্লাসী। তাছাড়া আর কীইবা করবে! দুদিনে ছোট্ট মেয়েটা যে মাকে না পেয়ে প্রচুর কেঁদেছে তা স্কুল থেকে ফেরার পর মুন্নি সরকার জানিয়েছিল তাকে। তবে বিপত্তি সৃষ্টি হলো সেদিন থেকেই। খুললো নানান প্রশ্নের ফুলঝুরি। যেখানে সহমর্মিতা দেখিয়ে একদুটো প্রশ্ন থাকলেও প্রায় প্রশ্নেই ছিল অশ্লীলতার ছোয়া। তোমার স্বামী কি তোমার সাথে প্রথম রাতেই শুয়েছিল? ইশ! কী রোমান্টিক ব্যাপার.. কী কী করেছিলে তোমরা সেই রাতে? কোথায় কোথায় আদর করেছিল উনি তোমায়? বাচ্চা হবার পরও কি আগের মতো করেই আদর করে? কতদিন পর থেকে আদর করা শুরু করেছে? একজন তো সকল লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে প্রশ্ন করে বসলো, তোমার সিজার হয়েছে? কীভাবে কেটেছিল পেট? একটু জামাটা উঠিয়ে দেখাবে?
আসলে দোষ তাদের নয়.. দোষ বয়সের। এই বয়সের মেয়েদের নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি ঝোক থাকে। ভারী আগ্রহ এবং একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তারা সেসব শুনে ভেসে বেড়াতে ভালোবাসে অনুভূতির অথৈ সাগরে। অবশ্য এবিষয়টি উল্লাসী নিজে অনুধাবন করেনি। বরং সবটা জানার পর এই কথাগুলো বলেছিল মেসবাহ। খানিকটা সময় নিয়ে নীরবতা কাটিয়ে উঠে সে তাকে বুঝিয়েছিল নিজের পড়াশোনায় মনোযোগী হতে। তবে দিনের পর দিন স্কুলের মেয়েদের অত্যাচার বৃদ্ধি পাওয়ায় উল্লাসী শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে আর যাবেনা স্কুলে। পরীক্ষা দেবার হলে যাবে, নয়তো নয়! সেই থেকেই শুরু হলো তার জীবনের নতুন অধ্যায়। স্কুল পেড়িয়ে কলেজে উঠলেও সে আর মারায়নি ক্লাসের ছায়া। তাই না তার কোনো ভালো বান্ধবী হয়েছে আর না পেয়েছে নিজের সুখদুঃখ ভাগাভাগি করার মতো সমবয়স্কা কাউকে। অবশ্য এনিয়ে তার নেই কোনো আক্ষেপ…
তবে দীর্ঘদিন পর আবারও একই ঝামেলা বাঁধলো মেসবাহর স্বপ্ন পূরণ করতে মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে। ভর্তির কাজে কোচিং কর্তৃপক্ষ মেসবাহর পরিচয় জানলেও তাদের ক্লাসের কেউই জানেনা তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে। তার নতুন বান্ধবী রুমা, এমন কী আগ বাড়িয়ে তার সাথে ভাব জমাতে আসা সুমনও নয়! সুমন তাদের ব্যাচের বেশ ভালো একজন ছাত্র। আর ভালো ছাত্রছাত্রীরা অবশ্যই বাল্যবিবাহ নিয়ে খারাপ মনোভাব রাখে। সাথে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্নের হাত থেকে নিস্তার তো রয়েছেই! তাই সব ভেবেই চুপচাপ রয়েছিল সে। তবে মাঝ থেকে হঠাৎ সুমন কীভাবে জেনে গেলো সবটা? মনে চলা উল্লাসীর প্রশ্নত্তরের পালা শেষ না হতেই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পাশ থেকে মুন্নি সরকার বললেন,
“ভাইরে ভাই! বিশ্বাস করবি না.. সে আকাশ পাতাল তফাৎ!”
দাঁতে নখ খোঁচাতে খোঁচাতে উল্লাসী বললো,
“কার?”
“শীতলের জন্য যে মেয়ে দেখে এলাম সেই মেয়ে ট্যারা.. অথচ ফেইসবুকের ছবিতে বোঝার উপায়ই নেই মেয়ে ট্যারা!”
“বলো কী!”
“হ্যাঁ.. তোর ভাই এটা নিয়ে দেখিস আমাকে কত কথা শোনায়! আমি বুঝি না কী সমস্যা ওর আমার ভাইকে নিয়ে!”
“সমস্যা তোমার ভাইকে নিয়ে নয়.. তোমার ভাইয়ের কর্মকান্ড নিয়ে। তুমি শীতল ভাইকে কিছু বলো না কেনো?”
“আমি কীভাবে কী বলবো? তাছাড়া শীতল ভাইয়া আমার দুই বছরের বড়। ছোট হয়ে আমি কী করে তার উপর কথা বলি?”
উদ্বিগ্নতার সাথে উল্লাসী বললো,
“তো হাসান ভাইও তো তোমার চেয়ে বড়। তবে তার মুখের উপরে তুমি কেনো কথা বলো?”
“হাসান আর শীতল এক হলো নাকি? তোর চিন্তাভাবনা এখনো আগের মতোই রয়ে গেছে! মাথায় তো ঘিলু না গবর নিয়ে ঘুরিস!”
“গবর? এই শহরে কোথায় পাবো গবর যে তা মাথায় নিয়ে ঘুরবো! গ্রামে থাকলে না হয় একটা কথা ছিল!”
নিজের মাথা নিজে চাপড়ালেন মুন্নি সরকার। তারপর চায়ের কাপ রেখে মুখে ভেংচি কেটে বললেন,
“তুই হয়তো ন্যাকা সাজিস নয়তো তুই আসলে ন্যাকাবোকা! ন্যাকাশ্যরি, ন্যাকা দ্যা ডন, ফকিরের শহররের ন্যাকা। যাচ্ছি আমি..”
মুন্নি সরকারের উঠে সদর দরজার দিকে এগুতেই তার যাত্রাপথের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো উল্লাসী। চায়ের কাপ হাত থেকে রেখে বই খুলে তাতে চোখ ডোবাতেই বেজে উঠলো তার ফোনের রিংটোন।
স্ক্রিনে সুমনের নাম দেখে ভাবলো উল্লাসী। তবে ওপাশ থেকে সুমনের একেরপর এক কল আসায় প্রথমে কল ধরার সিদ্ধান্ত না নিলেও পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত পালটে কল ধরলো সে।
“তুমি ওভাবে চলে কেনো গেলে?”
ফোনের ওপাশ থেকে আক্ষেপ নিয়ে বললো সুমন।
উল্লাসী একমুহূর্ত ভেবে স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“আমার অসুস্থ লাগছিল।”
“অসুস্থ লাগলেই ওভাবে চলে যাবে? আমাকেও কিছু বলবে না?”
জবাব দিল না উল্লাসী। সুমন বললো,
“পরের ক্লাসগুলোর নোটস আমি তোমায় হোয়াটসঅ্যাপ করে দিয়েছি। দেখে নিও।”
“থ্যাংকস..”
“মোস্ট ওয়েলকাম। একটা প্রশ্ন করি?”
“হু..”
“তোমাকে নিয়ে আজ ক্লাসে কথা হচ্ছিলো.. তখনই দিতি তুললো তোমাকে প্রায়দিনই যে দিতে আসে তাকে নিয়ে কথা..”
বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠলো উল্লাসীর। মেসবাহকে তবে সবাই দেখে ফেলেছে?
“তখনই রুমা বললো ওই লোকটি তোমার দূরসম্পর্কের ভাই। উনাদের বাসায় থেকেই নাকি তুমি কোচিং করছো?”
রুমাকে তো সে নিজে থেকে কিছু বলেনি। তবে রুমা কি নিজের মতো করে ভেবে নিয়েছে? একমুহূর্ত ভাবলো উল্লাসী। তারপর ক্ষীণ স্বরে বললো,
“হ্যাঁ.. রুমা ঠিক বলেছে।”
“আমিও তো সেটাই বলি। সবাই আসলে তোমাকে নিয়ে জেলাস.. তুমি দেখতে যেমন পড়াশোনাতেও আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি অলরাউন্ডার বলে সবাই তোমায় হিংসা করে। নিজেকে ধরে রেখো উল্লাসী। কখনোই ওদের কাছে নিজেকে ছোট হতে দিও না।”
আরও খানিকক্ষণ সুমনের সাথে কথা বলে ফোন কেটে সোফায় শুয়ে পড়লো উল্লাসী। নিজের মনকে শান্ত করতে বারবার আওড়াতে লাগলো মেসবাহর নাম। মেসবাহও তো তাকে দুঃসম্পর্কের বোন বানিয়েছিল! তবে সে বানালে সমস্যা কোথায়? তাছাড়া ক্লাসই হবে আর দুটো মাস। যে দিনগুলো দেখতে দেখতে খুব দ্রুতই কেটে যাবে। তবে কেনো সেসব নিয়ে এত ভাবছে সে? কিছুই হবে না.. কিচ্ছু নয়!
“দরজা খোলা কেনো? আর আমার বাবা কই? বাবা?”
হঠাৎ মেসবাহর কন্ঠ কানে আসতেই উঠে বসলো উল্লাসী। ঢোক চেপে নিজেকে বুঝ দিয়ে শান্ত গলায় বললো,
“মুন্নি ভাবি মাত্রই গেল। তাই আর দরজা লাগানো হয়নি।”
“যখনই যাক দরজা লাগিয়ে রাখবে। তোমার এই বদঅভ্যাসটির এবার পরিবর্তন করা দরকার।”
“ঠিকাছে করবো.. আপনার হাতে এতসব কী? বাজার করার ডেইট তো এখনো আসেনি!”
মেসবাহ বাজারের ব্যাগ হাতে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,
“কাল গ্রাম থেকে সবাই আসছে.. পুষ্পকে আংটি পড়িয়ে বিয়ের ডেইট ঠিক করে যাবে।”
“আমায় তো আগে কিছু জানালেন না!”
“এইতো জানালাম.. তোমার কাল কোচিংয়ে না গেলে চলবে না?”
বুকচিরে বেরিয়ে আসা গভীর এক নিঃশ্বাস ফেলে সোফা ছেড়ে উঠে পড়লো উল্লাসী। রান্নাঘরে এসে খানিকটা ক্ষোভ নিয়ে বললো,
“চলবে.. আপনি যান। ফ্রেশ হয়ে নিন.. আমি ঠিকঠাক করছি।”
একগাদা জড়তা, রাগ, ক্ষোভ নিয়ে ঘুমোতে এলেও ঘুমের দেখা মিললো না উল্লাসীর। বুকের ভেতরটা তার ছটফট করছে। মাথার ভেতরটা ব্যথায় ভরে উঠেছে। তার করা কাজটি কি ঠিক হলো? মেসবাহ জানলে কি কষ্ট পাবে? চোখ মেলে মেসবাহর দিকে তাকালো উল্লাসী। মেয়েকে বুকে নিয়ে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে মেসবাহ। মনোযোগ তার বইয়ের দিকে থাকলেও মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে পরম যত্নে। একদন্ড ভেবে উঠে বসলো উল্লাসী। আলতো করে মৈত্রীর হাত ধরে তাকে কোনার দিকটায় সরানোর চেষ্টা করতেই চেঁচিয়ে উঠলো সে।
“আমি মাঝে শোবো.. আমি মাঝে শোবো। আমি ওদিকটায় শোবো না।”
ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল উল্লাসী। হতভম্ব হয়ে বললো,
“তুই ঘুমাসনি?”
চোখ কচলাতে কচলাতে মাথা নাড়লো মৈত্রী।
“উহু.. উহু!”
হেসে ফেললো মেসবাহ। বই রেখে মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে জোরে চেপে ধরলো নিজের বুকে।
“এখন খুব কেলানো হচ্ছে? আর আগে একদুদিনের জন্য সুহা এলেই পাগল হয়ে যেতেন।”
“এখন তো এক মেয়ের বাবা আমি! ধীরেধীরে বুড়ো হয়ে যাচ্ছি.. বুড়োদের পাগলামি করলে চলে? বাবা, বলেন তো! চলে পাগলামি?”
মৈত্রী কিছু না বললেও কপাল কোঁচকালো উল্লাসী।
“কচু হচ্ছে! থরথরে বুড়া হয়েছেন? নিজের যখন মন চায় তখন আপনার যৌবন ঢেলে ঢেলে পড়ে। আর আমি চাইলেই তখন বুড়োমো ঢেলে ঢেলে পড়ে?”
হেসে উঠলো মেসবাহ।
“মৈত্রী কিন্তু জেগে!”
“তাতে কী? নাচবো আমি? দ্রুত ঘুম পাড়ান এই বাদরটাকে। আমি যাচ্ছি ওই রুমে।”
পাশের ঘরে এসে অস্থিরমনে খানিকক্ষণ পায়চারী করলো উল্লাসী। তবে মেসবাহর দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে শুয়ে পড়লো। নানান জিনিস নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে করতে সে ঘুমের ঘোরে তলিয়ে পড়েছিল। তবে হঠাৎ ঘাড়ে কিছু গরম নিঃশ্বাস পড়াতে তন্দ্রা কেটে গেল তার। বুকের ভেতরটা হয়ে উঠলো শীতল।
“একটু সরুন!”
ঘুমকাতুরে কন্ঠে উল্লাসী বলে উঠতেই মেসবাহ হালকা করলো নিজের শরীর। সাথেসাথেই সোজা হলো উল্লাসী। আধো আলো আধো অন্ধকারে মেসবাহর মুখের প্রতিচ্ছবি দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল তার। ঠোঁট বাড়িয়ে দিল সে তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি ওঠা ধারালো গালে।
সময় নিয়ে উল্লাসীর কামিজের নিচে হাত ঢুকিয়ে তার কানে চুমু দিল মেসবাহ। ধীর স্বরে বললো,
“রাগ হয়েছে না অভিমান?”
“জানি না.. আপনি কেনো বলতে পারলেন না আমি কোন রঙের জামা পরে বেরিয়েছিলাম?”
“বলতাম.. তবে মাঝে কুফা পেশেন্ট এসে পড়লো না!”
“মিথ্যা.. আপনি পারতেনই না!”
উল্লাসীর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মেসবাহ বললো,
“পারলে কী হতো? আর না পারলে কী?”
“পারলে বুঝতাম আপনি আমায় ভালোবাসেন.. আর পারেননি জন্য বুঝলাম আপনি আমায় ভালোবাসেন না!”
হেসে উঠলো মেসবাহ।
“কে বলেছে এসব?”
“জানি না। ভালো লাগেনা আমার। কিচ্ছু ভালো লাগেনা।”
“তাই? তা কী করলে ভালোলাগবে আপনার?”
কথা শেষ না হতেই উল্লাসীর পেটে মেসবাহ খুব সুক্ষ্ম ভাবে হাত বুলিয়ে দিতেই খিলখিল করে হেসে উঠলো উল্লাসী।
“সুড়সুড়ি দেবেন না.. বলছি দেবেন না।”
মেসবাহর হাত দুটো সরানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দুজনের মাঝের অবশিষ্ট দুরত্বটুকুও উল্লাসী ঘুচিয়ে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ধীরেধীরে সময়ের গতির সাথে মেসবাহর দেয়া আদরের ঢেউগুলোকে পরম সুখে চোখজোড়া বুজে উপভোগ করতে লাগলো সে…
(চলবে)