সাঁঝের প্রেম

সাঁঝের প্রেম !! Part- 20

সায়েমের সাথে তুর্নার বিয়ের কথা এনাউন্সমেন্ট হওয়ার পর তুর্না আর সায়েম দুজনেরই কোনো মাথা ব্যাথা নেই বিয়ে নিয়ে। সায়েমের যে তুর্নাকে ভালো লাগেনা তা না কিন্তু বিয়ে এত তারাতারি হচ্ছে দেখে সায়েম আপসেট। তুর্না আর সায়েমের সামনে যায়নি। নিশি আর মাহবুব সম্পূর্ণ প্রিপেয়ার্ড বিয়ের জন্য। বিয়ের ডেট এখনো ফাইনাল হয়নি। বাড়ির সবাই আয়োজন জমাচ্ছে একটু একটু করে।

পাঁচমাস পর,,,,

নিশির চলাফেরা করতে ভীষণ কষ্ট হয় এখন। মাহবুব ট্রান্সফার নিয়ে ঢাকায় পোস্টিং হয়ে গেছে তিন মাস হলো। মাঝে মাঝে মাহবুব একটু অসুস্থ হয়ে যায় কিন্তু আবার সেড়ে যায়। তুর্না এখন নিশিকে খুব আদর যত্ন করে। তুর্না আর সায়েমের বিয়ে আর একমাস পর। সায়েম অনার্স ফাইনাল ইয়ারে উঠলেই ওদের বিয়ে। সবাই মিলে একসাথে থাকে আর সারাক্ষণ সায়েম বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখে। মাহবুব ইদানীং নিশিকে চোখে হারায়, অনেক ভালবাসে নিশিকে।

এক শুক্রবার সকালে,

মাহবুব রেডি হয়ে বের হচ্ছে আর নিশি বিছানায় বসে জুস খাচ্ছে।

-সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছো? (নিশি)
-আর বলো না! ফ্রেন্ড সার্কেলের গেট টুগেদার আছে। হঠাৎ করেই সব এরেঞ্জ করে কল করলো আমায়। এখন যেতেই হবে। (নিশির সামনে বসে মাহবুব)
-শুক্রবারটা সময় পাও সেইটাও আমার জন্যে না? (মাহবুবের হাত ধরে নিশি)
-পাগলি! আমার সারা জীবন ই তো তোমার জন্য। একটা দিন না হয় সবাইকে দিলাম! (নিশির কপালে চুমু দিয়ে মাহবুব)
-সাবধানে যাও আর সাবধানে তারাতারি বাড়িতে এসো।
-ওকেহ ডিয়ার। তুমি জুস খাওয়া শেষ করে ব্রেকফাস্ট কর এরপর ওষুধ খাও। আমি তুর্নাকে বলে যাচ্ছি।
-খেয়ে নিব আমি। (মাহবুবের বুকে মাথা রেখে নিশি)
-কি হলো? আজকে কি বেশি কষ্ট হচ্ছে? (নিশির মাথায় হাত বুলিয়ে মাহবুব)
-না তবে কেন যেন তোমায় ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।
-বিকেলেই চলে আসব। একটু একা থাকতে পারবেনা?
-হুহ যাও তুমি।
-তুমি না হাসলে যাই কি করে?
-হিহিহি। হেসেছি,যাও।
-পাগলি! আসছি আমি।
-ঘড়ি নিয়ে যাও।
-থ্যাংক ইউ।

নিশির কপালে চুমু দিয়ে মাহবুব ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ড্রইংরুমে সবাইকে বাই বলে মাহবুব বের হতে যাবে তখন ছোট মা বলে,

-মাহবুব খেয়ে বের হও।
-ছোট মা খাব না এখন। রাতে আমার জন্য চিংড়ি ভুনা কর। এসে খাব। (মাহবুব)
-এখন কি কিছুই খাবা না?
-নাহ। দেরি হচ্ছে আমার। আসছি।
-আল্লাহ হাফেজ।

মাহবুব বের হয়ে চলে যায় কিন্তু কেনো যেনো নিশির অনেক অস্বস্তি হচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে মাহবুবকে যদি আটকাতে পারতো! আধা ঘণ্টা পর নিশি মাহবুবকে ফোন করে মনের শান্তির জন্য। মাহবুব ফোন রিসিভ করে বলে ও রাস্তায় আছে, ফেস্ট এ যাচ্ছে। নিশি তখন শান্তি পেলো এরপর ওষুধ দিয়ে গেলো তুর্না নিশিকে। সায়েম ছোট মায়ের পায়ের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে।

-সায়েম আব্বু তোর কি কিছু হয়েছে? চুপচাপ কেন এমন? (ছোট মা)
-মনটা ভাল নেই আম্মু। কেনো যেনো একদমই ভালো লাগছেনা। (সায়েম)
-কেনো? কিছু কি হয়েছে?
-না তেমন কিছুই না।

সায়েম ওর আম্মুর সাথে দুপুরে কথা বলছিলো আর ঠিক তখন নিশির ফোনে কল এলো। নিশি ঘুমাচ্ছিলো তাই তুর্না মাহবুবের নাম্বার দেখে ফোনটা রিসিভ করলো।

-হ্যা ভাইয়া বলো। (তুর্না)
-নিশি কি আপনি? (কোনো এক লোক)
-না আমি তুর্না। আপনি কে?
-আমি এলিফ্যান্ট রোড থেকে বলছিলাম। এই ফোনের মালিক একটু আগে রাস্তায় এক্সিডেন্ট করেছে অনেক বাজে ভাবে। ওনাকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। লাস্ট নাম্বার এইটা দেখলাম তাই ফোন করলাম। হলি কেয়ার হসপিটালে উনি ভর্তি।
-কিহ?

তুর্না ওতটুকু বলার পরেই সোফার উপর বসে পরে। তুর্নার হাত পা অসার আর ঠান্ডা হয়ে আসছে। তুর্না এক ঝটকায় উঠে ছোট মা’র ঘরে যায়। গিয়ে দেখে সায়েম ওইখানে শুয়ে আছে। তুর্নাকে কাঁদতে দেখে সায়েম উঠে বসলো। সায়েম কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তুর্না বলল,

-আন্টি ভাইয়া রোড এক্সিডেন্ট করেছে। ভাইয়া হসপিটালাইজড! (তুর্না কাঁদতে কাঁদতে বলছে)
-কিই? এই মেয়ে মাথা ঠিক আছে তোমার? (দাঁড়িয়ে গিয়ে সায়েম)
-প্লিজ হলি কেয়ার হসপিটালে চলুন। আন্টি আপনি থাকেন। আপু ঘুমাচ্ছে, আপুকে দেখবেন। তারাতারি আসুন।

সায়েম টি শার্ট, ট্রাউজার আর স্যান্ডেল পরেই দৌড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করার টাইম নেই। সায়েম ওর বাইক নিয়ে তুর্নাকে সাথে নিয়েই দ্রুত হাসপাতালে যায়। সায়েম টোটালি ম্যাড হয়ে গেছে। হাসপাতালে বাইক পার্ক না করেই মাঝখানে বাইক রেখে দ্রুত দৌড়াচ্ছে সায়েম। রিসিপশনে গিয়ে শুনে সাত মিনিট আগে মাহবুব মারা গেছে। এইটা শোনার পর সায়েম আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। তিনজন লোক অর্থাৎ যারা মাহবুবকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলো তারা সায়েমকে এসে ধরে। তুর্না ওই জায়গাতেই সেন্সলেস হয়ে যায়। সায়েম দৌড়ে ওটিতে গিয়ে দেখে মাহবুবের ধূসর রঙের শার্ট টা রক্ত দিয়ে মাখা আর মাথায় ব্যান্ডেজ করা। মাহবুব ঘুমাচ্ছে আর এইটাই ওর শেষ ঘুম। ও আর জাগবেনা ঘুম থেকে! সায়েম মাহবুবকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলে,

-ওই ভাইয়া, ভাইয়া তুমি এইভাবে শুয়ে আছো কেনো? ওই ভাইয়া উঠছো না কেনো? আমার কি হবে ভাইয়া? ভাইয়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া! (সায়েম চিৎকার করে কাঁদছে)

সায়েমের ফোন বেজেই চলছে কিন্তু ধরবে কে? ছোট মা বারবার ফোন দিচ্ছে। আব্বু বারবার ফোন দিচ্ছে। সায়েমের আব্বু হসপিটালে চলে আসে কিছুক্ষণ পরেই। এসে নিজের চোখের সামনে সন্তানের লাশটা দেখে তিনি ঠায় চেয়ে রইলেন। কিছু বলার ক্ষমতা আর শক্তি দুটোই তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। সায়েমের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো মাহবুব, নিশির আদর্শ স্বামী ছিলো মাহবুব। সায়েম হাউমাউ করে কাঁদছে। তুর্না চুপচাপ বসে আছে। তুর্না শুধু ভাবছে বোনকে গিয়ে কি বলবে ও? মাহবুব কেনো নিশিকে কিছু বলে গেলো না? সায়েমের আব্বু ছোট মা কে শুধু বলে,

-আমার সব শেষ শেইলি। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।
-কি হয়েছে সায়েমের আব্বু? মাহবুব কেমন আছে? (উত্তেজিত হয়ে ছোট মা)
-আমার মাহবুব এই দুনিয়ায় আর নাই শেইলি। (বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন মাহবুবের বাবা)

ছোট মা এর চিৎকারে নিশির ঘুম ভাঙে। নিশি বিছানা ছেড়ে উঠে আসে ছোট মায়ের ঘরে। ছোট মা কাঁদছে। নিশি জিজ্ঞেস করে,

-ছোট মা কি হয়েছে? কাঁদছেন কেনো? (নিশি)

নিশির কথা শুনে ছোট মা নিশির মুখের দিকে তাঁকিয়ে ছিলেন। ঠিক তখনি তিনতলার ভাড়াটিয়া দৌড়ে আসে ঘরে।

-ভাবি আপনার বড় ছেলে মাহবুব নাকি মারা গেছে? (ঘামতে ঘামতে একজন মহিলা)
-এইসব কি বলছেন আপনি? (ঠান্ডা মাথায় নিশি)
-নিশি মাহবুবের লাশ নাকি বাসায় নিয়ে আসছে। তুমি জানো না কিছু? (মহিলা)
-ছোট মা উনি এসব কি বলছে? ওনাকে থামতে বলুন। আমার মাহবুব ফ্রেন্ডদের সাথে গেছে। ও একটু পরেই আসবে। (নিশি)
-বউমা তুমি শান্ত হও। বসো এখানে। (ছোট মা)
-ছোট মা আমার ফোনটা দিন, আমার ফোনটা দিন ছোট মা। আমি ওকে ফোন করব। (নিশি উত্তেজিত)
-দাঁড়াও দিচ্ছি।

ছোট মা কিছুতেই কান্না আটকাতে পারছেন না। নিশিকে ফোন এনে দিলে নিশি মাহবুবকে ফোন করে। কিন্তু ফোন তো কেউ ধরেনা। ফোন আউট অফ রিচ বলে কেন?

-এই মা আমার মাহবুবের ফোন তো বন্ধ থাকেনা কোনোদিন। বন্ধ বলছে কেন ওর ফোন? (নিশি এইবার কাঁদছে) কি হয়েছে বলো আমাকে? ওই আন্টিটা কি বলছে এসব? (নিশি ওর আম্মুকে বলছে)

তুর্না আর সায়েম দুজনেই একেবারে ভেঙে পরেছে। মাহবুবের বাবা যেন হাঁটতে ভুলে গেছে। ডক্টর লাশ টা এম্বুলেন্সে করে বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে। নিশি তখনো কল্পনাও করেনি মাহবুব আর নেই। এক ঘণ্টা পর যখন বাড়ির নিচে এম্বুলেন্স এর আওয়াজ পেলো নিশি তখন বারান্দায় গেলো। নিজের ভারী শরীর নিয়ে চলতে ভীষণ কষ্ট হয় ওর। এতক্ষণ ও শুধু মাহবুবকে ফোন করেই যাচ্ছিলো। বারান্দায় গিয়ে যখন দেখলো সায়েম, তুর্না আর আব্বু মিলে কাঁদছে তখন নিশির কাছে সব স্পষ্ট হয়ে গেলো। নিশির হাত থেকে ফোন পরে গেলো। এক মুহুর্তের জন্য নিশির পুরো পৃথিবী থেমে গেলো। আস্তে করে নিশি আহ শব্দ করে মাটিতে লুটিয়ে পরলো। সায়েম দ্রুত ঘরে এসে ছোট মা কে জিজ্ঞেস করে,

-আম্মু ভাবি কই? ভাবি ঠিক আছে তো? (সায়েম তখনো কাঁদছে)
-নিশি বারান্দার দিকে গেলো। সায়েম, মাহবুব কই? (ছোট মা ও কাঁদছে)
-বারান্দায় গেছে মানে? আম্মু ভাবি অসুস্থ।

সায়েম কথা বলতে বলতেই বারান্দায় যায়। গিয়ে দেখে নিশি বারান্দায় পরে গোঙাচ্ছে। সায়েম আম্মু আম্মু বলে চিৎকার করে আর নিশিকে কষ্ট করে কোলে তুলে আম্মুর ঘরে নিয়ে যায়। তুর্না তখন নিশির সামনে এসে বসে।

-আমি জানতাম এমন কিছুই হবে। আমার আপু ও বাঁচবেনা। (চিৎকার করে তুর্না)
– তুর্না চুপ কর। ফালতু কথা এখন একদম বলবেনা। ডক্টর ডাকো তারাতারি। (নিশির হাত ঘষে সায়েম)

এখন কে কোনদিকে যাবে? সায়েমের ভেতর সব দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। মাহবুবের লাশটাকে বাসার নিচে রাখে ওয়ার্ড বয় রা। এম্বুলেন্স চলে যাওয়ার পর মাহবুবকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যায় নিশি। সায়েম জানে এখন নিশিকে নিচে নিয়ে যাওয়া মানে আজকে নিশিকেও হারানো। এত কষ্ট সইবে কি করে সবাই? তুর্না আর নিশির আম্মু নিশিকে সামলাচ্ছে। সায়েম উপরে নিচে দৌড়াদৌড়ি করছে শুধু। সায়েমের বন্ধুরা মাহবুবকে গোসল করানোর ব্যবস্থা করে। সায়েম কাফনের কাপড় কেনার জন্য এক বন্ধুকে টাকা দেয়। কিন্তু নিশিকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছেনা।

-আপু, এমন কর না আপু। তোমার যে ক্ষতি হয়ে যাবে আপু। ভাইয়ার হায়াৎ ছিলো না তাই ভাইয়া আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। এই সত্যিটা কি তুমি, আমি পাল্টাতে পারব? (কাঁদতে কাঁদতে তুর্না)

চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *