স্বীকৃতি

স্বীকৃতি !! Part- 16 (Last-Part)

উঠোনে রাখা দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে খুশবু। হঠাৎ তার চোখ গিয়ে আটকায় গেইটের দিকে। খুশির সাথে তার দিকে এগিয়ে আসছে আরহাম। তাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো খুশবু।
আরহাম তার সামনে এসে নিশ্চুপভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পরে খুশবু জিজ্ঞাসা করলো-
আপনি? খুশি বুঝি নিয়ে এসেছে? দরকার ছিলোনা। আমি সাইন করে পেপার পাঠিয়েই দিচ্ছিলাম।
-ফারাজ মৃত আমাকে জানাওনি কেনো?

 

 

প্রশ্নটি শুনে খুশির দিকে তাকালো খুশবু। খুশি ইশারায় বোঝালো, সে আরহামকে বলেছে এসব।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে খুশবু বললো-
আপনি ওর ব্যাপারে জানেন আমি জানতাম না।
-শুরুতেও কিছু বলোনি আমাকে।
-মা ওয়াদা করিয়েছিলো। তাই পারিনি।
-আমি শুরু থেকে সবটা শুনতে চাই খুশবু।
.
খুশি বললো-
বল আপু সব! এমন সুযোগ আর নাও আসতে পারে।

খুশির কথা শুনে খুশবু বলতে শুরু করলো-
আমার বিয়ের কথা বাসায় উঠলে ফারাজ ও আমার সম্পর্কের কথা জানাই আমি।
ফারাজ ও আমার সম্পর্ক টা বাসায় জানার পর মেনে নিতে চায়নি মা বাবা। তখন আমার অবস্থা ঠিক আফসানার মতোই। একটাই সমস্যা ছিলো। ফারাজ নিজেও ছাত্র। তার নিজেকে গড়তে অনেক সময় লাগবে। কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি আমাদের! ফারাজের পরিবারকেও অপমান সহ্য করতে হয়েছিলো। কিন্তু এক সময় বাবা সবটা মেনে নেন। ঠিক হয়, ফারাজের পড়াশোনা শেষ হবার পরে আমাদের বিয়ে হবে। ততদিনে এনগেজমেন্ট টা করে রাখা যায়। এনগেজমেন্ট এর দিন তারিখও ঠিক হয়। সব ঠিক হয়ে গেলেও ভাগ্য আমার সাথে ছিলোনা। হঠাৎ খবর আসে….

 

কথাটি বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো খুশবু।
খুশি বললো-
ফারাজ ভাইয়ার এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়। আপু মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে পড়েছিলো। তাই মা বাবা তার বিয়ে নিয়ে ভাবেন। স্বামীর ভালোবাসা পেয়ে যদি ফারাজ ভাই এর স্মৃতি ভুলে যেতে পারে, এই আশায়। আর তখনি আপনাদের বাসা থেকে আপুর জন্য বিয়ের প্রপোজাল আসে। সবাই রাজি হলেও আপু হয়নি। মা ইমোশনাল ব্লেকমেইল করে আপুকে রাজি করায়। আর ওয়াদা করায়, ফারাজ ভাইয়ার ব্যাপারে সে যেনো কাউকে শেয়ার না করে। কি দরকার! নতুন জীবনে অতিতের ছায়া পড়ার? যেখানে অতীতের মানুষটি বেঁচেও নেই।
.
খুশবুকে নিজের বুকে টেনে নিলো আরহাম। কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর কিছুটা শান্ত হলো খুশবু। আরহাম তাকে ছেড়ে বললো-
তাহলে তুমি যে ফারাজ কে দেখেছিলে আর ফোনে কথা….
-আমার মনে হয়েছিলো আমি তাকে দেখেছি। আর ফোনে কথা মানে? আপনি কি দেখেছেন আমি ফোন কানে নিয়ে কথা বলছি?
-না। তোমার হাতে ফোন দেখে আমি বারান্দার বাইরে চলে এসেছিলাম।
-কানে নিয়ে নয়, ফারাজের ছবি দেখে কথা বলেছিলাম আমি। আমার মনে হচ্ছিলো আমি আপনার মায়া জালে আটকে যাচ্ছি। কিন্তু আমি সেটা চাচ্ছিলাম না। দূর্বল হয়ে পড়ছিলাম আপনার প্রতি। আপনিও কষ্ট পাচ্ছিলেন। সব মিলিয়ে আমি হতাশ ছিলাম। আর এখন হতাশ থাকলেই ফারাজের ছবির সাথে কথা বলি। শুধু তাই নয় ওর বন্ধ নাম্বারে মেসেজ পাঠাই, ফোন করি। আর একটা কথা ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ফেলি, যদি ফারাজ একটাবার ফোনটা রিসিভ করতো!
.
খুশবর কথা শুনে আরহামের চোখেও পানি চলে এলো। ভালোবাসার মানুষকে হারানোর বেদনা কতোটা ভয়াবহ হতে পারে, এ কয়েকদিন খুশবুর অনুপস্থিতিতেই টের পেয়েছে সে।

খুশি চিন্তিত স্বরে বলে উঠলো-
তাহলে ভাইয়াকে মেসেজ গুলো কে পাঠিয়েছে?
.
খুশবু জিজ্ঞাসা করলো-
কিসের মেসেজ?
.
আরহাম সবটা খুলে বললো খুশবুকে। সব শুনে খুশবু বললো-
এসব কি তাহলে নীলয় করেছে! সে আগেও আমাকে পাওয়ার জন্য নোংরা চাল চেলেছিলো।
.
আরহাম বললো-
নীলয় কে?
-ফারাজের বন্ধু। আমি এখুনি ফোন দিচ্ছি ওকে।
.
পেছন থেকে অনন্ত বলে উঠলো-
তার আর দরকার নেই।
.
অনন্তের দিকে তাকালো সবাই।
মাথাটা নিচু করে অনন্ত বললো-
সব আমি করেছি।

 

 

অনন্তের কথা শুনে সকলেই বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেলো। খুশি তার পাশে এসে বললো-
তুমি করেছো মানে?
-হু আমি করেছি।
-কিন্তু কেনো?
-আমি খুশবুকে ভালোবাসতাম।
.
কথাটি শুনে খুশির পায়ের তলা থেকে যেনো মাটি সরে যাচ্ছে।
আরহাম রেগেমেগে বললো-
এসব তুমি কি বলছো অনন্ত?
-সত্যি বলছি। খুশবুর সাথে ফারাজের সম্পর্কের কথা জানতে পেরেই আমি উপলব্ধি করতে পারি, খুশবু চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে। এক সাথে বড় হয়েছি আমরা। ওর উপর শুধু আমার অধিকার। আমার নিজেরও গফ ছিলো। কিন্তু খুশবুর জন্য তার সাথে আমি ব্রেকাপ করি। বুঝতে পারি খুশবুই আমার ভালোবাসা।
তাকে সবটা জানাই আমি। সে আমাকে বোঝায়, ফারাজকে ছাড়া সে শূন্য। তাই নিজেকে সরিয়ে আনি আমি। যেদিন ফারাজ ও খুশবুর এনগেজমেন্ট এর তারিখ ঠিক হয়, সবার সম্মতি নিয়ে তারা ছাদে যায় আলাদা কথা বলতে। আমিও পিছু নিই তাদের। খুশবুকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলো ফারাজ। সে মুহুর্ত টা আমি ক্যামেরা বন্দী করি। আমার কোনো বাজে উদ্দেশ্য ছিলোনা। ছবিটা দেখে যেনো আমি বুঝতে পারি, এরা দুজনে দুজনের জন্যই তাই নিজের কাছে রাখার জন্য তুলেছি। সবই ঠিক ছিলো। এলোমেলো হলো ফারাজের মৃত্যুর পর। আমি খুশবুর কষ্ট সহ্য করতে পারতাম না। কখনো চাইনি এমন কিছু হোক। কিন্তু কিছুদিন কাটার পর মনে আশা পোষণ করি, এবার হয়তো খুশবু আমার হবে! আবারো আমি ওকে প্রপোজ করি। আমার আশায় পানি ফেলে খুশবু আমাকে জানালো, খুশি হয়তো ভালোবাসে আমাকে। তাই তার পক্ষে আমাকে নিয়ে ভাবা সম্ভব নয়। এর পরেই তার বিয়ে হয়ে যায়।
.
আরহাম বললো-
-তার মানে বিয়ের রাতেই ছবি তুমি পাঠিয়েছো ফারাজ সেজে?
-হ্যাঁ। কারণ আমি জানতাম সে ফারাজের কথা কাউকে জানায়নি। শুধু তাই নয়, বৃষ্টির দিনে খুশবু ঠিকই দেখেছে। কেউ একজন দাঁড়িয়ে ছিলো। তবে সে ফারাজ নয়। আমিই পেছনে ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। খুশির কাছে খুশবু এসেছে শুনে প্লানটা করি। আমাকে দেখে ফারাজ ভেবে পাগলামি করে খুশবু, এসব দেখে আমিই আপনাকে মেসেজ করি ওসব।
এসব করার একটাই কারণ, যাতে আপনি খুশবুকে ছেড়ে দেন। সমাজে ডিভোর্সী মেয়ের মূল্য খুব কম। তাই খুশবুও আর আমাকে রিজেক্ট করতো না। কিন্তু…
.
আরহাম বললো-
কি?
-এসব যেমন সত্য আরেকটি কথাও সত্য। আমি খুশিকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমার উপর যেনো কোনো সন্দেহ না আসে তাই আমি খুশির সাথে মিথ্যে সম্পর্ক গড়ি। ভেবেছিলাম খুশবুর ডিভোর্স হলেই কোনো কারণ দেখিয়ে খুশির সাথে ব্রেকাপ করে নিবো। কিন্তু আমি ধীরেধীরে প্রেমে পড়ি ওর।
খুশবুর প্রতি এসব আমার মায়া, রাগ নাকি জেদ জানিনা। কিন্তু খুশিকে ছাড়া আমি অচল এটা আমি জানি। আর তাই খুশির জন্যই সব আজ স্বীকার করলাম।
.
সবটা শুনে রাগ হলেও শেষের কথাটি শুনে মনে যেনো শান্তি পেলো খুশবু। অনন্ত তার ভুল বুঝতে পেরেছে এটাও কম কি!
.
কিন্তু খুশি সবটা মেনে নিতে পারেনি। অনন্তের ডান গালে কষিয়ে থাপ্পড় বসায় সে। কোনো কথা না বলে কাঁদতে কাঁদতেই বাসার দিকে চলে যায়।
খুশবু তার পিছু ছুটতে ছুটতে বললো-
খুশি দাঁড়া….

৩মাস পর….
বাসর ঘরে বসে আছে খুশি ও অনন্ত। হ্যাঁ তাদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু খুশিকে রাজি করাতে তিনটা মাস সময় লেগেছে অনন্তের। অবশ্য খুশি রাজি হবার পেছনে খুশবুর অবদানও কম নয়। তবে বাসার কেউই এই বিষয়ে কিছু জানেনা। খুশবু ও আরহামের বিষয়টাও সামলে নিয়েছে তারা।
.
-এভাবে ড্যাবড্যাব করে কি দেখছো?
.
খুশির প্রশ্নে ঘোর কাটলো অনন্তের। মৃদু হেসে বললো-
তোমাকে।
-কিছুদিন পর আবার অন্য কাউকে ভালোবাসবে নাতো?
-উহু খুশি! শুধুই খোটা দিবা?
-হু! ঘুম আসছে।
-বাসর রাতে ঘুম! তিন মাস অপেক্ষা করিয়েও শান্তি হয়নি তোমার।
-আরো তিনমাস করো।
.
চুপচাপ শুয়ে পড়লো অনন্ত। খুশি তার দিকে ঝুঁকে, ডান গালটায় নিজের ঠোঁটের ছোঁয়া বসিয়ে দিয়ে বললো-
কোনটা মজা? এটা নাকি সেদিনের থাপ্পড় টা?
.
খুশিকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে অনন্ত বললো-
অবশ্যই এইটা। এমন ভালোবাসা দিবো ওইটা আর কখনো দিবেনা।
.
.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে খুশবু। আরহাম শুরু থেকে তার অতীত সম্পর্কে জেনেও তাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলো। আসলেই ভাগ্যবতী সে। এসব ভেবে আনমনে হেসে চলেছে খুশবু। পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলো আরহাম।
আরহামের ছোঁয়া পেয়ে খুশবু মুচকি হেসে বললো-
রোমান্টিক মুড বুঝি তোমার?
-এমনিতে বউকে জড়িয়ে ধরা যায়না নাকি?
-হু যায়।
-এদিকে এসো।
.
বিছানার উপরে থাকা বড় বক্স গিফট পেপারে পেঁচানো দেখে খুশবু বললো-
আমার জন্য এটা?
-হু। তোমাকে দেয়া সেরা উপহার আমার।
.
খুশবু পেপার সরাতেই চমকে গেলো। এই সেই বক্স। যেখানে ফারাজের দেয়া প্রতিটা উপহার রয়েছে। বক্সটা বাড়িতে গেলেই খুলে দেখতো খুশবু। এই বক্সের মাঝেই যে ফারাজের সব স্মৃতি!
.
আরহামের দিকে ছলছলে নয়নে তাকালো খুশবু। আরহাম বললো-
ও বাড়ি গিয়ে আর এসব দেখতে হবেনা। এখন থেকে যখন ইচ্ছে দেখতে পারবে।
.
কথাটি বলেই বিছানার উপরে শুয়ে পড়লো আরহাম।
বক্সটি ড্রয়ারে রেখে বিছানায় আসলো খুশবু। আরহামের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো সে। এমন একটা জীবনসঙ্গীই যেকোনো মেয়েরই কাম্য।
মুচকি হেসে খুশবু বললো-
তুমি আমার জীবনে না এলে বুঝতামই না, দ্বিতীয়বারও ভালোবাসা যায়।
.
সমাপ্ত

👉বিঃ দ্রঃ ” লেখাঃ সাজি আফরোজ ” লেখকের লেখা অন্য গল্প গুলো পড়তে এখানে ক্লিক করুন…

👉আমাদের ফেসবুক পেজ