সে কি জানে

সে কি জানে ! Part- 21

মনে ভর করেছে একরাশ স্তব্ধতা।। আর কানে বাজছে রেয়ানের সেই “ভালোবাসি” কথাটা।।সাথে রয়েছে আকাশ থেকে বৃষ্টির এক এক বিন্দুর নিচে পরার শব্দ।।বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি আমি।।বারান্দা থেকে আজ এক অন্যরকম মনোরম দৃশ্য দেখতে পারছি আমি।।অন্যরকম এক অনুভূতি!!হলুদের অনুষ্টান শেষ হতে প্রায় অনেক দেড়ি হয়ে যায়।।রেয়ান খুব কৌশলে আমাদের তাদের বাসায় থাকার জন্য বাধ্য করে ফেলেন।।তাছাড়া রেয়ানের মা-বাবা,,দিধা অনেক করে বলছিলো আমায়।।যেন থেকে যাই আজ রাত-টা।।তাই আমিও আর মানা করি নি।।কিন্তু কোথায় যেন একটা অস্বস্থি কিংবা বাঁধা রয়েই গেছে।।তবুও ভালো লাগছে।। বাইরের মৃদু মৃদু বাতাস প্রাণ-টা জুড়িয়ে দিচ্ছে আমার।।আপাতত এ পরিবেশটা উপভোগ করতে চাই আমি।।হঠাৎ গান গাওয়ার শব্দ আমার কানে এসে বারি খায়।।পাশে তাকাতেই দেখি আমার ঠিক বাম পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন রেয়ান।।হাতে তার গিটার!!উনার গানের গলা খুব অদ্ভুদ।।পাশাপাশি সুন্দরও।।আবছা আলোয় বুঝতে পারছি উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন আর গান গাইছেন।।এ যেন তার পক্ষ থেকে আমার জন্য এক টুকরো ভালোবাসা……
🍁খোলা জানালা দখিনের বাতাসে🍁
🍁ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে🍁
🍁কখন তুমি এসে হেসে বলে দাও🍁
🍁আছি তোমার পাশে🍁
🍁বহুদূর পথ ভীষণ আঁকাবাঁকা🍁
🍁চলতে ভীষণ ভয়🍁
🍁তুমি এসে বলে দাও আছি আমি পাশে🍁
🍁কোরো না কিছুতেই ভয়🍁
🍁কখনো ভাবি নি চলে যাবে তুমি🍁
🍁আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে🍁
🍁কখনো বুঝি নি ফিরে আসবে না🍁
🍁আমার পৃথিবী রাঙিয়ে🍁

.
গানটা শুনতে শুনতে এতটা গভীরে চলে গিয়েছিলাম যে রেয়ান কখন গান গাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন তা টেরই পাই নি।।যখন বুঝতে পারি তখন পাশে তাকাতেই দেখি রেয়ান নেই।।উনি তো এতক্ষন এখানেই ছিলেন।।এখন কোথায় গেলেন??হয়তো রুমে চলে গিয়েছেন!!কিন্তু আমার এখন রুমে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।।এ-ই মনোরম পরিবেশে থাকতে বড্ড ইচ্ছে করছে আমার।।তাই কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলাম এখানে।।পরক্ষনে কি ভেবে যেন রুমে ঢুকলাম।।রুমে ঢুকার ৩-৪ সেকেন্ড পরই হালকা করে দরজা ধাক্কানোর শব্দ পাই আমি।।রিহান ঘুমাচ্ছে এখন।।আর মা অন্যরুমে।।তাই ভেবেছিলাম হয়তো মা এসেছেন।।কিন্তু দরজা খুলতেই আমি অবাক!!রেয়ান দাঁড়িয়ে আছেন সামনে।।তার হাতে ২মগ কফি কিংবা চা!!আমাকে দেখেই উনি ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন…….
—” মরুভূমি!!ভিতরে আসতে দিবে না আমাকে।।আর কতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবো।। ”
—” এত রাতে আপনি এখানে কি করছেন??জানেন ক’টা বাজে।। ৪টা!! ”
—” তো?? ”
—” তো মানে কি??যান এখান থেকে।। ”
—” আমি যে এত কষ্ট করে কফি বানালাম।।ভেবেছিলাম দু’জনে বারান্দায় বসে কফি খাবো।।আর বৃষ্টি উপভোগ করব।।তাছাড়া রোমেঞ্চ তো আছেই।। “(চোখ টিপ মেরে)
—” যান তো এখান থেকে রেয়ান।।ঘুমাবো আমি।। ”
—” বলেই হলো নাকি?? ”
কথাটা বলতে বলতেই উনি আমাকে উপেক্ষা করে ঢুকে গেলেন রুমে।। রিহানের দিকে একবার তাকিয়ে ওর কাছে যান উনি।।কফির মগ পাশে থাকা টেবিলে রেখে দু’টো চুমু দিলেন রিহানের কপালে।। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন……
—” বাবার ছেলে না তুই।।ঘুম থেকে উঠবিনা একদম!!বাবা-মার রোমেঞ্চের ১২টা বাজাইস না কেমন।।যদি না উঠিস তাহলে বাবাই তোকে অনেক গুলো চকলেট দিবো।। ”
তার কথা শুনে প্রায় সাথে সাথেই আমি বলে উঠলাম”ঘুসখোর”।।কিন্তু আমার কথায় বিন্দু মাত্র পাত্তা দিলেন না উনি।।রিহানের কপালে আরও কয়েকটা চুমু এঁকে দিয়ে কফির মগ নিয়ে সোজা চলে গেলেন বারান্দায়।।আমি এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছি।।এ মানুষটা কখনও আমার কথা শুনে না।।এত জেদ কোথা থেকে আসে উনার??
আমার ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটিয়ে রেয়ান আমার হাত টেনে নিয়ে যান বারান্দায়।।পাশাপাশি দু’টো চেয়ারে বসে আছি আমরা।।আমার হাতে কফি।।কফির এক চুমুক খেতেই আমি অবাক।।এত ভালো কফি কি উনি বানিয়েছেন??বিশ্বাস তো হচ্ছে না আমার।।একবার জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়??না থাক!!নাকি করেই ভেলব।।ভেবেই পাশে তাকালাম আমি।।রেয়ান একধ্যানে কফি খাচ্ছেন।। তার দৃষ্টি সামনের দিকে।।কিছুটা হালকা সরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম……
—” কফিটা কি আপনি বানিয়েছেন?? ”
—” অবশ্যই।।কেন ভালো হয় নি?? ”

—” না দারুণ হয়েছে।।কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এটা আপনি বানিয়েছেন।। ”
—” কেন??কেন??কেন বিশ্বাস হচ্ছে না।। ”
—” না কিছু না।।তা কি কি বানাতে পারেন আপনি।। ”
—” আমাকে কি তোমার মতো ডামিস পেয়েছো।।আমি অনেক কিছু বানাতে পারি।।এ-ই ধরো কফি আর নুডুলস।।”
—” এ্যাঁ।।শুধু কফি আর নুডুলস বানাতে পারে তার আবার কত তেজ।।আমাকে ডামিস বলেন।।আপনি নিজে কি।।পুরুষ ডামিস।।”
—” আর ইউ লস্টেড??পুরুষ ডামিস আবার কি?? ”
—” কিছু না ”
বলেই ভেংচি কাটলাম আমি।।তা দেখে হেসে দিলেন রেয়ান।।তারপর দু’জনের মধ্যেই নিরবতা।।শুধু রয়েছে না বলা কিছু কথার নিশ্বাসের শব্দ।।প্রায় কিছুক্ষন এভাবে থাকার পর রেয়ান হঠাৎ-ই বলে উঠেন…..
—” মিরা তুমি না আজকে মেহেদী লাগিয়ে ছিলে।।তোমার হাতে আমার নাম আছে নিশ্চয়ই।।দাও তো তোমার হাত।।আমি আমার নাম খুঁজবো।। ”
—” মানে?? ”
—” মানে হাত-টা দাও।। ”
বলেই আমাকে আর দিতে দিলেন না।।নিজেই আমার হাত টেনে নিজের কোলে রাখলেন।।তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন আমার হাত।।যেন এটা বিজ্ঞানিদের একটা বিশেষ পর্যবেক্ষনের জিনিস।।এভাবে কতক্ষন নিজের নাম খুঁজার পর উনি করুন গলায় বললেন……
—” এ হাতে তো শুধু রিহানের নাম।।আমার নাম তো খুঁজে পাচ্ছি না।। ”
—” কারন আমার বাম হাতে রিহানের নাম লিখা আর ডান হাতে আপনার।।আর এখন আপনি আমার বাম হাত ধরে আছেন।। ”
—” ও এ-ই ব্যপার।।আচ্ছা দাও তোমার ডান হাত-টা দাও।। ”
বলেই ডান হাতটা এবার নিয়ে নিলেন উনি।।আগের মতোই খুঁজছেন নিজের নাম।।আর আমি!!আমি হাই তুলছি বারবার।।এসব দেখে আমার শুধু একটা কথাই মাথায় ঘুরছে।।আমি এখন ঘুমাবো।।১০মিনিটের জন্য হলেও ঘুমাবো!!

রাত এভাবেই শেষ হয়ে যায় আমাদের।।আমার হাতে নিজের নাম খুঁজে পেয়েছিলেন রেয়ান।।তার মুখ তখন উজ্জ্বল লাল বর্ণ ধারণ করে ছিল।।ছেলেরাও কি লজ্জা পায়।।নাকি এটা তার বেশি খুশি হওয়ার নমুনা!!ভোরে বেশ আড্ডা করি আমরা দু’জন।।কিন্তু আফসোস!! আমার ঘুমানোটা হলো না।।
.
সকাল হতেই সবাই লেগে যাই বিভিন্ন কাজে।।সবার থেকে বেশি কাজ করছিলেন রেয়ান।।কিন্তু এ-ই ব্যস্ততার মাঝেও আমার খেয়াল রাখতেন তিনি।।কতক্ষন পরপরই এসে আমাকে আর রিহানকে জ্যুস খাইয়ে দিয়ে যান,,,দুপুরে খাবারের সময় ভাত।।আর এমনিও টুকিটাকি খাবার খাইয়ে দেন।।আবার এমনিও আসেন।।আমরা কি করি তা দেখার জন্য।।এ-র মধ্যে মারও খেয়াল রেখেছেন উনি।।মার কখন কি প্রয়োজন সব এনে দিয়েছেন রেয়ান।।সবশেষে অনুষ্টানের সব কাজ শেষ হয় আমাদের।।বিকাল তখন ৫টা।।রেডি হতে চলে যাই সবাই।।আমি রুমে যাওয়ার সময় রেয়ান সামনে এসে দাঁড়ান আমার।।হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে বলেন……
—” তুমি তো এমনিতেই পেত্নী।।আরও পেত্নী সেজে আসিও কেমন?? ”
বলেই দৌঁড় দিলেন উনি।।যেন কত ভয় পান আমাকে!!আমি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।।মুখ থেকে শুধু এতটুকুই বলি”অসভ্য”।।রুমে এসে প্যাকেট খুলতেই দেখি একটা লাল রঙের শাড়ি।।শাড়ি-টাতে কাজ নেই তেমন।।কিন্তু তাও কেন যেন চোখে ধরার মতো।।রেয়ানের চয়েস আছে বটে!!ভেবেই মুচকি হাসলাম আমি।।
.
রাত ৮টার দিকে সবাই কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছালাম।।আমি,মা আর দিধা একগাড়িতে,,রেয়ান আর রিহান বাইকে।।আর অন্য সবাই অন্যান্য গাড়িতে।।এতটুকু সময়ে একবারও রেয়ানকে দেখলাম না আমি।।ভেবেছিলাম কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে দেখা করব উনার সাথে।।কিন্তু হলুদের মতো আজকেও গায়েব উনি।।বুঝতে পারছি না এভাবে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ান কেন উনি!!তার এসব আমার প্রচুর বিরক্তি লাগে।।প্রচুর!!
.
অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে।।এখন কাজী দিধার আর তুরানের বিয়ে পড়াবেন।।কিন্তু এখনও রেয়ানের খবর নেই।।আসলে তিনি গেলেন কোথায়।।এখন যে চিন্তা হচ্ছে আমার।।দেখতে দেখতে বিয়ে পড়ানোও শেষ হয়ে যায়।।এখন কান্না আসছে আমার।।উনার কি আমাকে মনে পড়ে না।।এতো সুন্দর করে উনার জন্য সাজলাম।।অথচ উনিই নেই!!
হঠাৎ কে যেন এসে আমার হাত শক্ত করে ধরে।।পাশে তাকাতেই দেখি রেয়ান।।উনি আমার দিকে বাঁকা হেসে বললেন…..
—” রেডি তো মরুভূমি ”
বলেই আমাকে টেনে দিধার পাশে বসালেন।।আমার পাশে উনি বসতে বসতে কাজী সাহেবকে বললেন…..
—” বিয়ে পড়ানো শুরু করা যাক তাহলে!! ”
.
.
.
.
#চলবে🍁