সাঁঝের প্রেম

সাঁঝের প্রেম !! Part- 25

নিশি অনেক ভেবে চিন্তে সায়েমকে প্রশ্ন করলো,

-মাইসারাকে তখন ভুলে যাবা না তো?
-তোমার কি সেইটাই মনে হলো নিশি? (একটু ব্যথিত হয়ে সায়েম)
-মাইসারা তো তোমার নিজের মেয়ে না সায়েম। তো কেনো তুমি নিজের সন্তানের থেকে মাইসারাকে প্রায়োরিটি বেশি দিবা?
-আমার নিজের মেয়ের থেকেও বেশি মাইসারা। ও আমার ভাইয়ার মেয়ে। ভাইয়ার রক্ত মিশে আছে ওর শরীরে। আর জানো ভাইয়া কে? এই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে আপনজন যে ছিল সে। উলটাপালটা কথা বলো না নিশি। মাইসারার জায়গা সবার উপরে।
-দ্যাটস ইট। (সায়েমের পায়ের উপর নিজের পা ছড়িয়ে দিয়ে নিশি)

মাইসারা বিছানায় ঘুমাচ্ছে আর সায়েম, নিশি বারান্দায় বসে কত রংবাহারি আলোচনা করছে! নিশি বাইরে যায়না প্রয়োজন ছাড়া। নিশিকে সায়েম বলল,

-কালকে অফিসে যাব না আমি। চলো না একটু ঘুরে আসি কোথা থেকে! একদম ই বোর হয়ে গেছি বাসায়।
-কোথায় যাবা?
-তুমিই বলো কোথায় যাবা?
-সমুদ্র দেখতে যাব।
-সেইটা তো একদিনের বিষয় নয়। তবুও তুমি যখন বলেছো তো যাব। মাইসারাও বড় হয়েছে। কক্সবাজার যাব খুব শীঘ্রই।
-সায়েম?
-বলো।
-তোমার জীবনটা আমি নষ্ট করে দিলাম তাইনা? (সায়েমের চোখের দিকে তাঁকিয়ে নিশি)
-কেনো এই কথা বললা? (সায়েম ও নিশির দিকে তাঁকালো)
-বিয়ে করা, বাচ্চা সমেত একটা মেয়েকে তোমার বিয়ে করতে হলো। তোমার শখ, আহ্লাদ সব মাটিচাপা দিতে হলো, তোমার স্বপ্ন গুলো কাঁচের মতো এক ঝড়েই ভেঙে গেলো। এর জন্য তো শুধুই আমি দায়ী সায়েম।
-হাহাহাহাহা। আজকে তোমায় একটা সত্যি কথা বলি? (উঠে দাঁড়িয়ে সায়েম)
-বলো৷
-আমি, এই ছেলেটাকে যতটা ভালো এখন দেখছো না? ওতটা ভালো আমি ছিলাম না। চার চারটা গার্লফ্রেন্ড ছিলো আমার। সারারাত এডাল্ট চ্যাটিং, সারাদিন মাস্তি এইসব করেই ভার্সিটিতে উঠলাম। তোমার বাসায় যখন তোমাকে প্রথম দেখতে গেলাম তখনো এসব চলছিলো। মাঝখানে তুর্নার মতো একটা মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হলো তবুও আমি সিরিয়াস ছিলাম না। আম্মু একটু একটু জানতো আমার বিষয়ে কিন্তু বাবা জানতো না, ভাইয়া জানতো না। যেদিন ভাইয়া মারা গেলো সেইদিন থেকে আমার মনে হচ্ছিলো আমি কেন এসব করছি? ভাইয়ার মতো যদি আমিও হুট করে চলে যাই? এরপর আস্তে আস্তে সব বাজে নেশা বাদ দিলাম, চেষ্টা করলাম প্রতিদিন নামাজ পড়ার। আর ভাগ্যবশত আমার জীবনে তখন তুমি আসলা। মনের কলুষতা সব দূর করার জন্য তোমার হাতটাই যথেষ্ট ছিলো। এরপর আর আমি পিছনে ফিরে তাঁকাই নাই। আলহামদুলিল্লাহ আর আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি যে উনি আমার কপালে তোমায় রেখেছেন বলে। তোমার মতো বউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি লাকী! অনেক বেশি লাকী! তুমি আমার জীবন নষ্ট করনি বরং পালটে দিয়েছো আমায়। দিনশেষে অনেক শান্তি পাই এইসব ভাবলে। আই লাভ ইউ! এসব বলো না আর!
-তোমার চারটা গার্লফ্রেন্ড ছিল? এখন কই তারা?
-সে খবর রেখে আমার লাভ কি? হয়ত বিয়ে হয়ে গেছে।
-কি ক্যারেক্টার ছিল তোমার! (মুখ বাঁকিয়ে নিশি)
-হেই শুধু প্রেম ই করেছি, ফিজিকাল এসল্টমেন্টে যাইনি। (নিশির হাত ধরে সায়েম)
-আর এডাল্ট চ্যাটিং তো আমি করতাম তাইনা?
-সেসব আমার অতীত ছিল। আর সত্যি বলেছি, ভুল তো কিছু বলিনি।
-হ্যা থাক৷ ঘুমাবে আসো।
-আমার সবচেয়ে বেশি ঘাম ঝড়াতে হয়েছিলো তোমায় স্বাভাবিক করতে। যেভাবে আমায় হুমকি দিতা! ভুলিনি সেসব আমি।
-আমিও ভুলিনি। সেইদিনগুলো খুব যন্ত্রনার ছিলো আমার কাছে। জানো সায়েম যতই তুমি আমার হাজবেন্ড হও বা কিছু কিন্তু মাহবুব আমার কাছে একদম ই অন্যরকম। মাহবুবের মতো করে আমায় কেউ বোঝেনি হয়তো বুঝবেও না। যাইহোক আসো।

নিশি ঘরে চলে আসে। সায়েম বারান্দার দরজা বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আধশোয়া নিশিকে সায়েম প্রশ্ন করলো,

-ভাইয়াকে এখনো ভুলো নি তাইনা?

সায়েমের প্রশ্ন শুনে নিশি নিঃশব্দে হাসলো। নিশির হাসির মানে সায়েম না বুঝলেও এতটুকু বুঝেছে যে প্রশ্নটা করা ওর উচিৎ হয়নি। সায়েম লাইটস অফ করে কম্বল টান দিয়ে শুয়ে পরলো। নিশি মাইসারার উপর হাত দিয়ে ঘুমাচ্ছে আর সায়েম পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরেছে। নিশি ও ঘুমিয়ে গেছে।

সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে,

নিশি সবাইকে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করছে আর মাইসারা ওর দিদুনের কোলে। সায়েম নিশিকে বলছে,

-পরটা খাব না আমি নিশি। নুডুলস বানিয়ে দাও আমায়।
-এইটা আগে বলতা। আধা ঘন্টা ফ্রি ছিলাম বানিয়ে নিতাম।
-তো এখন কি তুমি পারবেনা? না পারলে বলো আমি বাইরে গিয়ে খেয়ে আসছি। (টেবিল থেকে উঠে গিয়ে সায়েম)
-এই বসো। পারব না বলেছি কি? করে দিচ্ছি এখনি। (সায়েমের হাত ধরে নিশি)
-না দরকার নাই। (সায়েম চলে গেলো)
-মানে কি? (নিশি)
-বউমা ওর কি কিছু হয়েছে? কখনো তো এইভাবে কথা বলেনা। (ছোট মা)
-জানিনা মা। হঠাৎ কি হলো?
-তোমায় বলেনি?
-না কিছুই তো বলল না। আজকে ঘুম থেকে উঠে নিজে নিজেই নামাজ পড়তে চলে গেলো। এসে কফিও চাইলো না।
-তোমার সাথে কি ঝগড়া হয়েছে?
-কই না তো।
-আচ্ছা তুমি খেয়ে নাও। মাইসারা আমার কাছে থাকুক।
-না মা সায়েম আসুক। এরপর খাব।

নিশি ঘরে গিয়ে সায়েমকে ফোন করলো। কিন্তু সায়েম ফোন ধরছে না। শেষে নিশি নুডুলস রাঁধতে বসলো। নুডুলস রান্না শেষ করে আবারো সায়েমকে কল করলো। তখনো সায়েম ফোন ধরলো না। নিশি মন খারাপ করে কাজ করছে আর বোঝার চেষ্টা করছে সায়েমের হয়েছে টা কি। সায়েম বিকেল সাড়ে তিনটায় বাসায় আসলো। সায়েমের চুল এলোমেলো, ফর্সা চেহারা রোদে পুড়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। নিশি সায়েমকে জিজ্ঞেস করলো,

-সারা সকাল কোথায় ছিলে?
-তোমার জানা খুব জরুরি? (পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে সায়েম)
-হোয়াট ডু ইউ মিন সায়েম? আমার জানা জরুরি না মানে? (সায়েমের হাতের উপরের অংশ ধরে নিশি)
– গোসল করব ছাড়ো। (নিশির হাত ছাড়িয়ে সায়েম চলে গেলো)

নিশি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সায়েমকে দেখেই মনে হচ্ছে ও কিছুই খায়নি এখনো আর রোদে বসেছিলো। বেশ সময় নিয়েই সায়েম গোসল করলো। নিশি বেডরুমেই বসে আছে। সায়েম টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ঘরে এলো। সায়েম কোথাও যাবে হয়ত তাই আলমারি থেকে শার্ট আর প্যান্ট বের করছে।

-কোথায় যাবে? (নিশি)
-দেখি কোথায় যাওয়া যায়।
-যেখানেই যাও। আগে খাবে আসো। (সায়েমের হাত ধরে নিশি)
-না খাব না। (হাত ছাড়িয়ে সায়েম শার্ট পরছে)
-সায়েম কি হয়েছে তোমার? কেনো এমন করছো?
-কিছুইনা। আমি বের হচ্ছি। (বডি স্প্রে করে সায়েম)
-আমি তোমায় বডি স্প্রে ইউজ করতে নিষেধ করেছিলাম সায়েম।
-সো হোয়াট? আই হ্যাভ টু গো। (শার্টের হাতা ভাঁজ করে)
-খেয়ে যাও প্লিজ।
-রাতে ফিরতে লেট হবে।

এইটুকু বলেই সায়েম চলে গেলো। নিশি তখন কি করবে বুঝছে না। নিশিও সারাদিন কিছু খায়নি। মাইসারার পেছনেই সময় কেটে গেছে। রাতে আলমারি থেকে একটা কাগজ বের করতে গিয়ে নিশির চোখে পরলো গ্রে রঙের কাতান শাড়িটা। সায়েম সবসময় বলতো গ্রে রঙে নাকি নিশিকে মানায়। সব কাজ শেষ করে রাত এগারোটায় নিশি সায়েমের প্রিয় শাড়িটা নিয়ে সাজতে বসলো৷ নিজে নিজেই শাড়ি পরলো, চুরি পরলো, সাজলো। রাত বারোটা বেজে গেছে তখন। সায়েম এখনো আসেনি আর ফোন ও বন্ধ। নিশি অপেক্ষা করতে করতে ড্রেসিংটেবিল এর উপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গেছে। মাইসারা দিদুনের ঘরে ঘুমাচ্ছে। রাত পৌনে দুইটায় সায়েম প্রচন্ড টায়ার্ড হয়ে বাসায় ফিরে। ঘরের লাইট অন করতেই দেখে নিশি ড্রেসিংটেবিল এর উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে আর সায়েমের প্রিয় রঙের শাড়িটাই পরা। সায়েম সামনে গিয়ে নিচু হয়ে দেখলো নিশির ঠোঁটে লিপস্টিক। সায়েম আস্তে করে নিশিকে কোলে নিয়ে বিছানায় শোয়ালো। নিশিও অঘোরে ঘুমাচ্ছে। সায়েম ফ্রেশ হয়ে মাইসারার খোঁজ করতে গেলো আবার পরোক্ষণেই ভাবলো এত রাতে কাউকে বিরক্ত করা ঠিক হবেনা। সায়েম বাতি নিভিয়ে জানালা খুলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সায়েম নিজেই বলছে,

-এত কষ্ট কেন হচ্ছে আমার? সবকিছু কেনো এত বিষাদ লাগছে?

জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাসের আগমনে নিশির ঘুম ভাঙে। শীত শীত লাগছে ভীষণ। নিশি জেগে দেখে সায়েম দাঁড়িয়ে আছে। নিশি উঠে দাঁড়ালো। পেছন থেকে সায়েমকে জড়িয়ে ধরে নিশি। সায়েম চমকে যায়।

-কোথায় ছিলে সারাদিন? (নিশি)
-তুমি উঠলে কেন?
-তোমার কি হয়েছে সায়েম? আমার সাথে এমন কেন করছো? কষ্ট হচ্ছে আমার।
-কি করেছি?

চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *