মায়াবিনী

® মায়াবিনী—– পর্ব- ৪

লেখাঃ নিলয় রসূল
অয়নী: নাহ্..! আর না, আর কতো অনেকতো সহ্য করেছি আর করেও চলছি। এবার হয়তো নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়টা এসে গেছে…!
রাত তিনটে, অয়নী ঘুমজোড়া চোখ নিয়ে উঠে পড়লো। মাথায় হাজারো চিন্তা আর সাথে যন্ত্রনা। মনে হচ্ছিলো মাথার ভারে আর উঠে দাড়াতে পারবেনা। পড়ে যাবে। কিন্তু তা কি করে হয়।
পাশে তাকিয়ে দেখে সুপ্ত টিনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে, আর টিনাও। এক অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু অয়নীর আজ আর কিছুই করার নেই। পরিবেশ তাকে আজ এক ভযংকর সিদ্ধান্তে আনতে বাধ্য করেছে।
অয়নী আস্তে করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। তারপর ধীরে ধীরে রাজীবের ঘরে প্রবেশ করলো। ধীর পায়ে ড্রেসিংটেবিল এর দিকে এগিয়ে চলেছে। সেখানে ডয়ারে রাখা ছিলো ডিভোর্স পেপার….!
অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর অয়নী সই করে দিলো….!
সই করার সময় হাতটা বড্ড কাপছিলো অয়নীর। তবুও মনের জোর সব থেকে বড় জিনিস। সই করার সময় অয়নীর চোখ থেকে কয়েকফোটা রহস্যভেদ্য নোনা জল গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু তারপর আর জল পড়লনা। চোখটা বড্ড জ্বলছিলো তখন। একবারে রক্তিমাকার ধারন করেছিলো। বাড়াবাড়িটা চরম পর্যায়ে পৌছে গেছিলো তাই হয়তো….!
আলমারি থেকে নিজের কিছু জামাকাপড় আর সুপ্তকে তার বাবা কিছু টাকা দিয়েছিলেন সেগুলো নিয়ে নিলো। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় একবার রাজীবের দিকে তাকালো। ঘুমন্ত মুখটা দেখে মনে হচ্ছে কত্তো নিরীহ….!
কিন্তু বাস্তবে..!
সারাদিন ব্যাস্ত থাকার কারণে টিনাও আজ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো। সুপ্তকে আস্তে করে টিনার কোল থেকে বের করে নিলো অয়নী। অয়নীর বার বার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, “আল্লাহ্‌ জীবনে কি পাপ করেছিলাম জানতে পারি….? কেনো আমাকে এতো শাস্তি দিচ্ছো কেনো,, কেনো…! আমি তো কারোর কোনো ক্ষতি করিনি তাহলে আমার সাথেই এসব কেনো হয় বলতে পারো…! আর কতো…! বলো আল্লাহ্‌ আর কতো..! আমি কি এতটাই পাপিষ্ঠ। আমার দিকে কি একটু মুখ তুলে তাকানো যায়না….! কেনো আল্লাহ্‌,, আমি তো রাজীবকে ভালোবেসেছিলাম। আপন করে নিয়েছিলাম ওর পরিবারকে। নিজের সুখের কথা না ভেবে পরিবারের কথা ভেবেছি এটাই কি আমার অপরাধ.. এটাই কি আমার দোষ…!”
এখন প্রায় ভোর হওয়া হওয়া ভাব। অয়নী জামাকাপড়, জমানো টাকা আর নিজের প্রান সুপ্তকে নিয়ে পা বাড়ালো এক অজানা ভবিষ্যতের পথে…!
আগেরবার তো একটা গন্তব্যস্থান ছিলো কিন্তু আজ….!
বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে চলেছে ও। রাস্তায় উদ্বাস্তুর মতো হাটছে আর বার বার ভাবছে, ” এই রাজীবকে আমি ভালবেসেছিলাম…! ছিঃ সেদিন ও বারবার আমাকে বলেছিলো রজীব ভালো ছেলে নয়। কিন্তু আমি সেদিন অনেক অপমান করেছলাম যা নয় তায় বলেছিলাম। ওর মতো মানুষকে বলেছিলাম মানুষের সুখ সহ্য হয়না। আসলে আমি বড্ড বোকে মরীচিকার পিছনে ছুটে ছুটে কোনটা বাস্তব আর কোনটা মরীচিকা সে জ্ঞান হারিয়েছি….! সব ফ্রেন্ডরা বলেছিলো রাজীব ভালোনা আর আমি…!”
অয়নী চোখ মুছছে আর হেটে চলেছে..! বুঝতে পারছে পিছনে কয়েকটা বাজে লোক তাকে ফলো করে চলেছে অনেকক্ষণ ধরে। অয়নীর বার বার ভয়ে কুকড়ে যাচ্ছিলো। গলা শুকিয়ে আসছিলো। আর নিজের ভিতরে একটা অজানা আতংক আর অস্বস্তি তৈরি হচ্ছিলো।
অয়নী জেরে জোরে হাটতে লাগলো। পিছনে লোকগুলো জোরে জোরে হাটতে লাগলো। চারিদিকে একপ্রকার থমথমে আবহাওয়া বিরাজ করছে। আগত সময়ের কথা ভেবে গা শিউরে উঠলো অয়নীর। কলেজে পড়াকালীন অয়নীর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো নীল। সে সবকিছুই জানতো অয়নীর। আর অয়নীয়ও। অয়নীকে সে বারবার বলতো
: অরু এবার তো নিজেকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন আত্মরক্ষা কৌশল শিখে নে। কখন কার দরকার হয় কেও বলতে পারেনা।
: আরে ধুর…! তোদের মতো ফ্রেন্ড থাকতে আমার কে কি করবে রে।
আর যদি কেও সেই সাহসিকতা দেখায় তবে তোরা আছিস কেন রে…
: অরু তোর এই পরনির্ভরশীলতাটা না আমার খুব বিরক্ত লাগে…
: মানে
: কেনো অপরের ওপর নির্ভর করতে হবে সবসময়। তুই নিজে করতে পারবিনা কেনো। বিপদ যখন আসে তখন না বলে আসে। আর তুই তখন দেখবি তোর পাশে কেও নেই। আর এটাই হলো মানুষ্যজীবের বৈশিষ্ট…!
:হু…বুঝলাম
: কি বুঝলি…!
: তোর সাধারন জ্ঞান অনেক বেশি রে..!
: কিহ্
: হুম তো। তুই জীবনে খুব দ্রুতো উন্নয়ন করতে পারবি দেখিস। একটা ভালো বৌ পাবি। সে তোর জ্ঞানের সীমা দেখে মুগ্ধ হয়ে বলবে,
“ওগো আমার জ্ঞানি স্বামী
তোমার কথাগুলে ভারি দামি,
কোথায় তোমার এই জ্ঞানের আধার
আমার জানাটা যে খুব দরকার….!”
: অরু…!
: হা হা হা
: তুই আমার কোনো কথা শুনবিনা তাইতো
: কোন কথাটা যেনো..!
: তুই এমন কেনো রে জীবন নিয়ে একটু তো সিরিয়াস হ…
: সরি…!
: কেনো..
: আমি এমনই। আর আমি আমার মতোই থাকতে ভালবাসি।
: তোকে বোঝানো আর আজকালকার এসিটিটির ঔষধ খাওয়া একই বিষয় বৃথা চেষ্টা। কোনো লাভ নেই
: হি হি হি
: হাসবিনা…! বলে দিলুম…
অয়নী রাস্তায় উদভ্রান্তের মতো হাটছিলো। আর ওর বেস্ট ফ্রেন্ড নীলের কথা ভাবছিলো। অবচেতন মনে হাটছিলো তাই হাটার গতি অনেকটা মন্থর হয়ে গেছিলো। এমন সময় একজন লোক এসে অয়নীর হাতের ব্যাগটা ছোঁ মেরে নিয়ে দৌড় দিলো। অয়নী চিৎকার করে বলে উঠলো
: আমার ব্যাগ, আমার ব্যাগ,,আমার ব্যাগ…!
কিন্তু ঘুমিয়ে থাকা শহরটি যে বড়ই নিশ্চুপ হয়ে রয়েছিলো সেদিন..!
পিছন থেকে বাজে লোকগুলে খিলখিল করে হেসে উঠলো। কি বিভৎসকার সে শব্দ ছিলো.. অয়নীর হাসির আওয়াজে গা গুলিয়ে উঠলো।
অয়নী আর তখন হাটছিলনা মোটামুটি দৌড়াচ্ছিলো। সুপ্তকে জড়িয়ে ধরে দৌড়াচ্ছিলো। পিছনে বাজে লোকগুলোও প্রচন্ড বাজে আর অশ্লীল ভাষা ব্যাবহার করছে আর এগিয়ে চলছে..! অয়নী নিজের সন্তান, জীবন আর নিজের অবশিষ্ট মানসম্মান বাঁচানের তাগিদে হাপাচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে। আর ভাবছে,
” আমি কি আবার কোনো ভূল করলাম ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে। আর কিছুক্ষণ পরি হয়তো সবাই জেগে উঠবে। দেখবে আমি নেই। আর যে যার মতো আমার চরিত্র নিয়ে গবেষণা শুরু করবে। তাই ফিরে যাওয়ার রাস্তা যে আর নেই। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ দৌড়াবো। মনে হচ্ছে আর জোর পাচ্ছিনা..কখন যে রাস্তায় পড়ে যাবো তার ঠিক নেই। জানোয়ার গুলো হয়তো আমাকে ছিড়ে খাবে..! কিন্তু আমার সুপ্ত…!”
অয়নী আর দৌড়াতে পারছেনা। চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই কয়েকদিন ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া নেই আর তারওপর অসুস্থ শরীর। কিন্তু আগত সময়ের কথা ভেবে গা শিউরে উঠছে ওর। নিস্তব্ধ শহরটা যে এখনো ঘুমিয়ে আছে। বাইরে কার কি হলো তাতে আমার কি, আমিতো ঠিক আছি এটাইতো নিস্তব্ধ ঘুমিয়ে থাকা শহরের ভাবনা।
অয়নী প্রাণপনে ছুটে চলেছে। মাথাটা প্ররচন্ডভাবে ঘুরছে।
হঠাৎ একটা গাড়ি তীব্র বেগে ছুটে আসছে। চারিদিকে অন্ধকার তাই গাড়ির সামনে আলোর বৃষ্টিতে অয়নী মাথা ঘুরে পড়ে গেলো ঠিক তীব্র বেগে ছুটে আসা গাড়ির সামনে….!
{তাহলে কি অয়নীর জীবনের সূর্যটা এখানেই অস্তমিতো গেলো…! নাকি চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজমান শহরের বুকে উদয় হলো নতুন কোনো সূর্যের।জানতে হলে পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন}
< <<চলবে>>>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *