সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 41

৫৭.
আজকে বাসায় বৌ-ভাতের অনুষ্ঠান হচ্ছে। আশেপাশে জাঁকজমক পরিবেশ! রেয়ানের মুখে লেগে আছে এক চিলতি হাসি। তবে রাহুল আহমেদ বেশ গম্ভীর হয়ে আছেন। আজকে রেয়ানকে বাড়ি থেকে বিদায় করতে চেয়ে ছিলেন উনি। কিন্তু ঘরভর্তি মেহমানের সামনে নতুন বর কিংবা তারই ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া নিত্যান্তই বাজে ব্যাপার! অসম্ভব বাজে ব্যাপার! তাই আজ আর তিনি নিজের কল্পিত কাজে সক্ষম হতে পারলেন না। বসে রইলেন গোমড়া মুখ নিয়ে।
এদিকে নীলা রাহমান বসে আছেন আমার পাশেই। নানা বিষয়ে আমার সাথে গল্প করছেন উনি। আশেপাশের আত্মীয়-স্বজন আমাদের গল্প করা দেখে মুখ টিপেটিপে হাসছেন। কেননা নতুন বৌয়ের সাথে শ্বাশুড়ির এত ভাব দেখে সবারই অবাক লাগছে। তবে এতে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কারন ইতিমধ্যে আপন মা-মেয়ের মতো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আমাদের। নীলা রাহমান অনেক মিশুক একজন মানুষ। একদম মামীর মতো। হঠাৎ নীলা রাহমান মুখে হাসি রেখে বলে উঠেন,
— “রেয়ান আর তোর শ্বশুড় আগে অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলো জানিস। বলতে পারিস দুই’জন দুই’জনের প্রাণ। তুই তো মনে হয় রওনক আর তীর্থকে চিনিস। রেয়ানের বন্ধু ওরা! পাজিও বটে। একবার মজা করে রেয়ানকে এলকোহোল খাইয়ে দিয়েছিলো ওরা। বাসায় এসে রেয়ানের সেই কি মাতলামো। তোর শ্বশুড় নেশা করার জন্য তাকে বকা দেওয়ায় আমার গুণধর ছেলে রান্নাঘর থেকে খুন্তি নিয়ে এসেছিলো। তোর শ্বশুড়ও কম কিসের! সেও একটা খুন্তি জোগার করে লেগে যায় রেয়ানের সাথে খুন্তি যুদ্ধ করতে। তুই-ই বল, রেয়ান নাহয় নেশা করেছে তাই এমন করছে। কিন্তু তোর শ্বশুড় কি জন্যে এমন করছিলো? আমি তাকে মানা করতেই সে কঠিন কণ্ঠে বলে উঠেছিলো আমায়-” আমার ছেলে আমাকে খুন্তি যুদ্ধের আহবান করছে। সেই আহবান শুনে আমি তার সাথে যুদ্ধ করবো না? তা কিভাবে সম্ভব। সরো তো সরো তো! যুদ্ধে বাঁধা দিও না। শান্তি মতো যুদ্ধ করতে দাও।”
কথাটা শুনে হাসি দমিয়ে রাখতে পারলাম না। নীলা রাহমানের সাথে হো হো করে হেসে দিলাম। সাথে সাথে পাশের এক মহিলা বলে উঠলেন,
— “দু’জনের দেখি তাহলে অনেক খাতির জমে গেছে।”
নীলা রাহমান গর্ভ করে বলে উঠলেন,
— “অবশ্যই! কার ছেলের বউ দেখতে হবে না।”
এবারও মুচকি হাসলাম আমি। হঠাৎ রেয়ানের দিকে চোখ পড়ল আমার। দেওয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে বুকে হাত গুঁজে পায়ের ওপর পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। আমি তাকাতেই একটা চোখ টিপ মারলেন। সাথে সাথে মুখ দিয়ে বিনা শব্দে উচ্চারণ করলাম- “অসভ্য, বেহায়া, নির্লজ্জ!” আমার ঠোঁট নাড়ানো হয়তো উনি বুঝতে পারলেন। বিনিময়ে একটা বাঁকা হাসি উপহার দিলেন আমায়। তবে সেটা নিলাম না আমি। চোখ ফিরিয়ে নিলাম তৎক্ষনাৎ। এর কিছুক্ষন পরই একটা ছোট্ট মেয়ে আমার কাছে এসে ছোট একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলো। আধো আধো কণ্ঠে উঠল,
— “মামনি এটা আতকেল দিয়েচে তোমাকে।”
মেয়েটার কথা শুনে হঠাৎ-ই হাসি পেল আমার। মাথায় হাত বুলিয়ে অন্য হাতে চিরকুট-টা মুঠোয় পুড়ে নিলাম। ক্ষানিকবাদ সবার আড়ালে খুলে পড়তে লাগলাম চিরকুটের ভেতরের লিখাটা। যেথায় লিখা,
— “এভাবেই আমার পরিবারের পাশে থেকো মরুভূমি। আমরা যে একেকটা মরুভূমির তৃষ্ণাক্ত পথিক। তোমায় যে খুব প্রয়োজন আমাদের। খুব বেশি!”
চিরকুট-টা পড়ে মুখের হাসিটা আরও প্রসস্ত হলো আমার। দু’চোখ দিয়ে খুঁজতে লাগলাম রেয়ানকে। পেয়েও গেলাম সাথে সাথেই। ড্রইংরুমের একপাশে চেয়ারে বসে অন্য চেয়ারে পা দুটো রেখে আয়েশ করে বসে আছেন উনি। কোলে ল্যাপটপ। হাতে মিষ্টি। কিছুক্ষন পর পর একটু একটু করে খাচ্ছেন উনি। অন্য হাত দিয়ে ল্যাপটপে কি যেন করছেন। হঠাৎ আমার দিকে না তাকিয়েই হাত দিয়ে “হাই” করার ইশারা করে হাসলেন রেয়ান। আকাশ সমান অবাক হলাম আমি। উনি কিভাবে জানলেন আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি? উনি না ল্যাপটপে কাজ করছেন! পরক্ষনেই দেখলাম উনি ল্যাপটপ আমার দিকে ঘুড়িয়ে দিয়েছেন। যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আমার বসে থাকা এড়িয়াটা। তবে কি উনি ল্যাপটপ দিয়ে আমার দিকে নজর রাখছেন। এখানে কি তাহলে কোনো ক্যামেরা-ট্যামেরা লাগানো নাকি?

________________
ভ্রুঁ কুঁচকে চরম বিরক্তি নিয়ে জেনির দিকে তাকিয়ে আছে দিহান। আর জেনি! সে নিচের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বসে আছে বেঞ্চে। চোখ দিয়ে বিরতিহীন পানি পড়ছে। যা দেখে অসম্ভব রকমের বিরক্ত দিহান। মেয়েটা এত কাঁদে কেন? সে কি তাকে মেরেছে নাকি? জেনির কান্নায় ত্যাক্ত হয়ে দিহান এবার কঠিন কণ্ঠে বলে উঠে,
— “এত কাঁদছো কেন হ্যাঁ? তোমার এসব ন্যাকা কান্না আমার বিরক্ত লাগে বুঝ না? কান্না বন্ধ করো জলদি।”
জেনি কান্না থামায় না। উল্টো কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে,
— “আমি সরি দিহান। ড্যাড যে এমন করবে জানতাম না আমি। আপনি যখন আমাকে রিজেক্ট করেছিলেন তখন ড্যাডকে আপনার ব্যাপারে বলেছিলাম। সাথে এটাও যে আমার আপনাকে যেকোনো মুল্যে চাই। ড্যাড সমসময় এত দেড়িতে সব কিছু করেন! আগেও রেয়ানের ব্যাপারটা পুরো চার মাস পর হ্যান্ডেল করেছিলেন। তখন আমাদের যোগাযোগ ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ। আর এখন! আপনার আর আমার মাঝে সব ঠিক হওয়ার পর ড্যাড এসেছেন আপনার সাথে কথা বলতে। বিশ্বাস করুন, আমি যদি জানতাম ড্যাড আপনাকে টাকার লোভ দেখাবেন তাহলে আমি কখনও তাকে আপনার ব্যাপারে বলতাম না।”
জেনি কেঁদেই চলেছে অনবরত। দিহানের রাগটা যেন উর্ধ হয়ে যায় মুর্হুতেই। চেঁচিয়ে বলে উঠে সে,

— “কি ভেবেছিস কি আমাকে হ্যাঁ? আমাকে কি খেলনা মনে হয় তোর? তুই জানতি না তোর বাবা আমাকে লোভ দেখাবে তাই তো? কিন্তু আমি এটা বিশ্বাস করব কেন? কি গেরান্টিতে বিশ্বাস করব। আচ্ছা যা তোর মুখ দেখে বিশ্বাস করেও নিলাম। কিন্তু এটা কি ধরণের কথা, আমাকে তোর যেকোনো মুল্যে চাই? খেলনা আমি? খেলনা? তোর আমাকে যেকোনো মুল্যে চাই, আবার তোর বাবা আমাকে টাকা দেখিয়ে লোভ দেখায় তোকে ভালোবাসতে। হ্যাঁ আমি মধ্যবিত্ত, টাকার প্রয়োজন হয় আমার। তাই বলে তোর বাবা আমাকে টাকার লোভ দেখাবে? তোকে টাকার জন্য ভালোবাসব আমি? তাহলে বল, কল বয় হয়ে রাস্তায় রাস্তাত ঘুড়ি। টাকার জন্য সবার চাহিদা মিটাবো বেড়াবো। এখন বলিস না কেন? বল!”
জেনির মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। সে অবাক আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে দিহানের দিকে। এ কোন দিহানকে দেখছে সে? এটা কি তার দিহান? শান্তশিষ্ট মানুষটা কিভাবে এত রাগী হয়ে গেল? তা বুঝে উঠতে পারছে না জেনি। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে দিহানের দিকে। দিহান সেখান থেকে চলে যেতে নিলেই জেনি হন্তদন্ত হয়ে হাত ধরে ফেলে তার। ভাঙ্গা গলা কম্পিত হয়ে কণ্ঠনালি থেকে শব্দ বের হয়ে আসে,
— “প্লিজ দিহান। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি সত্যি কিছু জানতাম না। না আপনাকে কখনও ছোট করে দেখেছি। আপনি লোভী না সেটা আমি জানি। প্লিজ আমার ওপর রাগ করবেন না। আমার ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে দিহান। প্লিজ আমাকে ছাড়ে যাবেন না।”
দিহান এক ঝটকায় জেনির হাত সরিয়ে ফেলে। জেনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সাথে সাথে। দিহানের কেন যেন সেই কান্না সহ্য হয় না। সে তাড়াতাড়ি জড়িয়ে ধরে জেনিকে। জেনিও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। কান্না বেগ ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে তার। তা দেখে আলতো করে জেনির মাথায় হাত বুলাতে শুরু করে দিহান। শান্ত কণ্ঠে বলে উঠে,
— “ভালোবাসো আমায় জেনি?”
জেনি কান্নারত অবস্থায়ই মাথা দোলায়। যার অর্থ হ্যাঁ। দিহান মৃদু হাসে। নিজের বুকের সাথে জেনির মাথা আলতো করে চেপে ধরে বলে উঠে,
— “বিয়ে করবে আমায়? আজ বা কাল? কিংবা এই মুহুর্তে?”
জেনির কান্না থেমে যায়। খামচে ধরে দিহানের শার্ট।
৫৬.
রাতের দিকে আবারও রাহুল আহমেদের নির্দেশে নীলা রাহমান আমার সাথে ঘুমাবেন। আর রেয়ান ছাদে! তবে এ নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই রেয়ানের।কেননা নীলা রাহমান আগে থেকেই বলে রেখেছেন তিনি রেয়ানের পক্ষে। তার যদি রাতে আমার সাথে দেখা করতে মন চায়। তাহলে সে নির্দিধায় রুমে ঢুকতে পারেন। যা শুনে এক প্রকার নীলা রাহমানকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খাচ্ছিলেন রেয়ান। আর বলছিলেন,
— “ইউর দা বেস্ট মা!”
কিন্তু বিপত্তি এতটুকুই যে এসব সম্পর্কে রাহুল আহমেদ সম্পূর্ণ রুপে অজ্ঞাত। যদি কোনো ভাবে জেনে যান, তাহলে আমাদের তিনজনকেই নাস্তানাবুদ করে ছাড়বেন উনি!

____________
রাত প্রায় ১টা বেজে ৫৫মিনিট। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আমি আর নীলা রাহমানও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুমের মাঝেই হঠাৎ মনে হলো আমি শূণ্যে ভাসছি। চোখ আর বন্ধ থাকতে চাইলো না আমার। তাড়াতাড়ি চোখ খুলে ফেললাম। কোনো এক ছায়ার মতো অবয় আমাকে কোলে করে হাঁটছে। তবে সেটা কে? রেয়ান নয়তো? অবশ্যই! তার শরীরের এক সুঘ্রাণই বলে দিচ্ছে এটা রেয়ান। তাই আর চিল্লানোর সুযোগটা হলো না আমার। তার বুকে মাথা রেখে লেপ্টে রইলাম আমি।উনি ছাদের ছোট ঘরটাতে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন আমায়।নিজেও আমার পাশে শুয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। গলায় মুখ ডুবিয়ে ফিসফসিয়ে বলে উঠলেন,
— “ঘুমাবো মরুভূমি। নড়াচড়া করো না। মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।”
কিন্তু কিভাবে? তার এক একটা নিশ্বাস যে গলায় পড়ছে আমার। আত্তা কেঁপে কেঁপে উঠছে আমার। তবুও কাঁপা কাঁপা হাতে মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম। ক্ষীণ সরে বললাম,
— “রেয়ান আমাকে রুমে রেখে আসুন। বাবা জেনে গেলে সমস্যা হবে।”
রেয়ান জবাব দিলেন না। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। আমি আবারও বললাম,
— “ছাড়ুন।”
— “উহু! ঘুমাবো।”
— “তাহলে ঘুমান। কিন্তু আমাকে দিয়ে আসুন।”
— “উহু! তুমিও ঘুমাবে আমার সাথে।”
চুপ করে রইলাম। হঠাৎ তার ঠোঁটের স্পর্শ গলায় লাগতেই জমে গেলাম আমি। তার চুল খামছে ধরতেই উনি বিরক্তি প্রকাশ করলেন। বললেন,
— “উফফ! ডিস্টার্ব করো না তো। ঘুমাতে দাও।”
আমি আর একটা শব্দও করলাম না। ঘুমানোর চেষ্টা করলাম প্রবল ভাবে। কিছুক্ষন পরেই মনে হলো উনি ঘুমের দেশে তলিয়ে গেছেন। ক্লান্ত থাকায় আমিও যে কখন ঘুমিয়ে গেলাম জানাই নেই।
.
.
চলবে…