ভূতের গল্প

বন্যা এবং এক পিশাচ !! লেখাঃ ভৌতিক হৃদয়

বন্যা এবং এক পিশাচ

সারাটা দিন আর রাত শুধু মুষলধারে বৃষ্টি হয়েই চলেছে,মনে হচ্চে আকাশকে যেন কেউ ছিদ্র করে দিয়েছে যার জন্য এত্তো বৃষ্টি হচ্ছে।গণি মিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে,আর আরেকবার এক দৃষ্টিতে দেখছে তার ডুবে যাওয়া ক্ষেতটার দিকে। আর হাহাকার তার কন্ঠ থেকে ভেসে আসছে,আকাশের দিকে দু হাত তোলে আল্লাহর কাছে দোয়া করল,,,

 

গণি মিয়া: ইয়া আল্লাহ আমার ক্ষেতটাকে বাচাও,আর বৃষ্টি দিও না। আল্লাহ রহম কর আমাদের মতো সাধারণ মানুষগুলোর উপর।

পাশ দিয়ে যাচ্ছিল রহিম শেখ, গনি মিয়ার দোয়া তার কানে গেল।সে বলল,

রহিম শেখ: আরে গণি মিয়া তোমার তো শুধু ক্ষেত গেল,ওই চরের মানুষগুলোর কথা ভাব একবার, ওদের তো শুধু ক্ষেতই না, সাথে বাড়িঘর সব তলে গেছে।ওদের তুলনায় আমাদের কষ্ট তো কম।

গণি মিয়া: কথা ঠিক কইছ মিয়া।কিন্তু এতোদিন কাজ করলাম,আর এখন কিনা ফসল কাটার মৌসুমে এসে সব পানির তলে চলে গেল,হাহাকার করব না তো কী করব???

 

রহিম শেখ: যতো হাহাকার করবা মিয়া ততোটাই তোমার কষ্ট বাড়ব, তাই হাহাকার করা এখন বন্ধ করো। আর চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি চলো, বন্যায় আক্রান্তদের থাকার ব্যাবস্থা করার ব্যাপারে পরামর্শ হবে।

গণি মিয়া: চলো, গিয়ে দেখি।

 

রহিম শেখ আর গণি মিয়া কথা বলতে বলতে চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি আসল। প্রচুর মানুষ জমায়েত হয়েছে, পুরো গ্রামের প্রায় সবই চলে এসেছে। বন্যায় যারা এই গ্রামে উঠেছে তারাও আছে।সবার কথা বার্তা চলল খানিকক্ষণ।শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো গ্রামের নদীর দিকে যেই ফাঁকা জায়গাটা আছে ওইখানে ওদের জন্য কয়েকটা চালা বানিয়ে দেওয়া হবে। পরামর্শ শেষ হতে না হতেই শ্রাবণ মাসের প্রমাণ স্বরূপ ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই গ্রামের যুবকরা তাদের কাজ করতে লাগল।সন্ধ্যা নাগাদ সব কিছু তৈরী করাও শেষ হলো।

 

[২]

গ্রামের মানুষ আজ আবারও জমা হয়েছে চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে। এবারের কারণ বন্যা নয়, এবারের কারণটা গুরুতর। কারণ গ্রামে এক অজানা প্রানীর বা অজানা একটা কিছুর উপদ্রব শুরু হয়েছে। গ্রামের গরু ছাগল, হাস মুরগি মরে থাকতে দেখা যাচ্ছে।নদীর দিকের বাড়িগুলোর দিক থেকে শুরু হয়েছে এই উপদ্রব, ওইদিকের বাড়ির লোকের গৃহপালিত পশুর মৃতদেহ প্রতিদিন সকালে পাওয়া যাচ্ছে, একেকদিন একেক প্রাণী মরছে।প্রথমদিকে রহিম শেখের বাড়ির দিকে শুরু হলেও এখন পুরো গ্রামে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই সবাই আজ আবারও চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে জমা হয়েছে।

চেয়ারম্যান: সবার সমস্যা শুনলাম।এবার একটা ব্যাবস্থা নেওয়া দরকার। আপনাদের কী মনে হয় এটা কোনো শেয়াল বা কুকুর বা এমন কোনো জংলী জন্তুর কাজ???

রহিম শেখ: আমার তো এমন মনে হয় না চেয়ারম্যান সাহেব। কারণ আমার গরু দুইটা যে মরছে, ওদের শরীরে এক ফোঁটা রক্তও ছিল না। সাধারণ শেয়াল এরকম করবে কী করে??? পাগলা শেয়াল হতে পারে।

westbangla rain

চেয়ারম্যান : হ্যা,হতেই পারে।

কিন্তু গ্রামের হুজুর সাহেব বললেন অন্যকথা।

হুজুর: আমার তো মনে হয় কোনো শেয়াল বা অন্যকিছুর কাজ হতে পারে না।কারণ কিছু জ্বীন আছে যারা রক্ত পান করে।

গণি মিয়া: ওই সব বন্যার লোক আসার পর এইসব শুরু হয়েছে, ওরা কি এটার কারন নাকি।

চেয়ারম্যান : আরে ওরা কী করবে??? ওরা কারণ হবে কী করে। আর হুজুর সাহেবের কথা ঠিক হইতে পারে।

এতোক্ষণ লাঠিতে ভর দিয়ে দাড়িয়ে সব শুনছিলেন লাল মিয়া।এবার বললেন,

লাল মিয়া: তো চেয়ারম্যান সাহেব, কিছু তো করতে হবে এইসব বন্ধ করার জন্য।

চেয়ারম্যান : আমি ঠিক করেছি, গ্রামে পাহাড়ার ব্যাবস্থা করতে হবে।
সবাই রাজি তো???

সবার সম্মতিতে পাহাড়ার ব্যাবস্থা করা হলো। ঠিক হলো দশজন পাহাড়া দিবে। রহিম শেখ, গণি মিয়া এরকম যাদের গরু মারা গেছে তারা পাহাড়া দিতে তৈরী হলো,আরও কয়েকজন যুবক পাহাড়া দেওয়ার জন্য রাজি হলো।মোট দশজন পাহাড়া দিবে আজ রাত থেকে।

 

[৩]

আজ পাহাড়া শুরু হলো।একেকজন গ্রামের একেকদিকে পাহাড়া দিতে লাগল। পাহাড়া দেওয়ার পরও ওই রাতে একটা ছাগল মরে গেল।সকাল বেলা ছাগল মরা পাওয়া গেল, কিন্তু কারও নজরে কিছু পরে নি।এবার থেকে পাহাড়া আরও জোরদার করা হলো,যাতে আর কোনো গৃহপালিত পশুকে মরতে না হয়।

দ্বিতীয় রাতে সবাই পাহাড়া দিতে লাগল,ঝির ঝির করে বৃষ্টি হয়েই চলেছে।পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে, আকাশও মেঘে ঢাকা, মনে হচ্ছে যেন পুরো গ্রামটাকে কেউ কালো চাঁদরের নিচে ঢেকে দিয়েছে।তবে সেই কালো চাঁদরের নিচে দশজন লোক হারিকেন আর লাঠি নিয়ে পাহাড়ায় লেগে আছে। কিন্তু কারও নজরে কিছু পড়ছে না। মাঝেমাঝে পোকা মাকড়ের শব্দ ছাড়া আর কিছুর শব্দও কানে আসছে না, এক অসহ্যরকমের নিস্তব্দতা ঘিড়ে ধরেছে সবাইকে।তবে শেষরাতে সব নিস্তব্দতা ভেঙ্গে কারও একজনের আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসল। সবাই শব্দের দিকে গেল। সবার চোখেই ভয় দেখা যাচ্ছে, কারণ যে দশজন পাহাড়া দিচ্ছিল তাদের একজন মারা গেছে। তবে মৃত্যুটা অত্যন্ত ভয়াবহ, কারণ লাশটার পুরো শরীরের রক্ত কেউ শুষে নিয়েছে।ফ্যাকাশে হয়ে আছে শরীর, ঘাড়টা কেউ পুরো ১৮০ ডিগ্রিতে বাকিয়ে দিয়েছে, আর লাশের চোখ দুটো ভয়ে ভীত হয়ে বের হয়ে আছে। যারাই লাশটা দেখেছে সকলের শরীরের লোম খাড়া হয়ে গিয়েছে।

 

[৪]

এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে, গ্রামে এখন সন্ধ্যা হওয়ার পরই মৃত্যুপুরীর নিস্তব্দতা গ্রাস করে সবাইকে। একদিক দিয়ে বন্যার পানি বেড়েই চলেছে, অন্যদিকে দিয়ে যারা পাহারা দিচ্ছিল তাদের পাঁচজন মারা গেছে, বন্যায় আশ্রয় নেওয়া লোকদের কয়েজজনেরও ওইরকম শোচনীয় পরিণতি হয়েছে।গ্রামের মানুষ এখন সন্ধ্যা হওয়ার পরেই দরজা জানাল বন্ধ করে দেয়। ঘর হতে বের হয় না। তবে অতিসাহসী কয়েকজন এখনও পাহাড়া দেয়, তবে একা একা নয়, বরং দুইজন এক সাথে থেকে পাহাড়া দেয়।

একদিন মাঝরাতে রহিম শেখ গ্রামের ভিতর ঢুকে চিৎকার করো সবাইকে ডাকতে লাগলেন।রহিম শেখের চিৎকার শুনে সবাই বের হয়ে আসল। সকলের একই প্রশ্ন, কী হয়েছে??? এমন করছ কেন???

রহিম শেখের গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। গলা শুকিয়ে গেছে তার, ইশারায় পানি চাইল। পানি খেতে দেওয়া হলো তাকে, পানি খেয়ে সে যে কথা বলল তা শুনে সকলের মনের ভয় আরও বেড়ে গেল। কারণ রহিম শেখের বলা কথা মোটামোটি এরকম:

আমি আর শহীদ পাহাড়া দিচ্ছিলাম। হারিকেন আর লাঠি হাতে নিয়ে সাবধানে সবদিকে নজর রাখছিলাম। গ্রামের উত্তরের মাঠের কাছে যাওয়ার পর দেখলাম একটা লোক অতি উজ্জ্বল সাদা রংয়ের পোষাক পড়ে আছে, আমাদের দিকে আসছে।আমরা মনে করলাম কোনো পরহেজগার ব্যাক্তি,তাই মোসাফাহ করার জন্য হাত বাড়ালাম।কিন্তু লোকটার হাত বরফের মতো ঠান্ডা লাগল, এর কারণ জিজ্ঞেস করলাম লোকটাকে।লোকটা আমাদের কিছু বলল না,ইশারায় তার পিছন পিছন আসতে বলল।আমরাও যেন সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। লোকটার পিছন পিছন চললাম, লোকটা বন্যার পানির দিকে আমাদের নিয়ে আসল।তখন কথা বলার মাঝখানে খপ করে শহীদকে ধরে ওর ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে দিল ওই লোক, শহীদ ছুটতে পারছিল না।আমার অবস্থা এমন হয়ে গিয়েছিল নড়তে পারছিলাম না।লোকটা শহীদের ঘাড় মটকে দিয়ে আমার দিকে তাকায়,আর তখন আমার শরীরে কোথা থেকে যেন শক্তি চলে আসে,দৌড়াতে থাকি।পিছন ফিরে দেখেছি ওই লোকটা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। সবাই আমার সাথে চলো।

সকলেই রহিম শেখের পিছন পিছন অগ্রসর হলো।দেখল সত্যিই শহীদ ভয়াবহ ভাবে মারা গেছে।

 

[৫]

গ্রামের সবাই এখন নিজের জান বাঁচাতে ব্যাস্ত,কারণ আজকাল গরু ছাগল নয়,বরং মানুষ মরে যাচ্চে। রহিম শেখ ছাড়া আর যারা পাহাড়া দিত সবই মারা গেছে। গ্রামের লোক সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল গঞ্জ হতে মফিজ হুজুরকে আনা হবে, অনেক আল্লাওয়ালা আর ধার্মিক লোক ওনি। জ্বীন বিষয়ক বা এরকম কাজে অনেক বেশি পারদর্শী ওনি। সবার সিদ্ধান্তে ওনাকে নিয়ে আসা হলো। মফিজ হুজুর পুরো গ্রামটা একবার ঘুরে ঘুরে দেখলেন।তারপর চেয়ারম্যান সাহেবের উঠানের সামনে বসলেন। সব জনতাও অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে হুজুর কী বলে তা শুনার জন্য।

মফিজ হুজুর: আপনাদের গ্রামের সব সমস্যাই বুঝলাম। এখন রহিম শেখ কোথায়???

চেয়ারম্যান : রহিম শেখ তো আপনার সামনেই আছে।কেন দরকার নাকি ওনাকে???

মফিজ হুজুর: ওনাকে সবাই হাত দিয়ে ধরে রাখুন তো।

জনতা রহিম শেখকে ধরে রাখল, তবে সবার প্রশ্ন,রহিম শেখকে ধরে রাখতে বলা হলো কেন।হুজুর এবার সব বলা শুরু করলেন।

মফিজ হুজুর: আপনাদের গ্রামে যারা পাহাড়া দিত সবাই মারা গেছ, শুধু রহিম শেখ মরে নি। এটা অবাক লাগছে না আপনাদের কাছে???

চেয়ারম্যান : ওর ভাগ্য ভালো তাই বেঁচে আছ,অবাক হওয়ার কী হলো???

মফিজ হুজুর: আরে এ আসলে রহিম শেখই নয়।বরং এ হলো সেই ছদ্মবেশী জ্বীন,যে সকলকে মারছে।

গণি মিয়া: কী বলছেন এসব??? বুঝিয়ে বলুন।

 

মফিজ হুজুর: আসল রহিম শেখকে এই জ্বীন পানিতে ডুবিয়ে মেরে দিয়েছে। তারপর ওর রূপ নিয়ে সুযোগ বুঝে সকলকে মারছে ও।ও যদি মানুষই হতো তাহলে অন্যদের মতো ও মারা যেত। চর এলাকার একটা কবরে এই জ্বীনকে আটকে রাখা হয়েছিল।বন্যার ফলে সেই কবর ভেঙ্গে যায় আর ও মুক্তি পায়। তখন থেকেই সব কিছু মারা শুরু করেছে এই জ্বীন। রহিম শেখকেও একদিন সুযোগ পেয়ে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে।

চেয়ারম্যান : পানিতে যদি মরে থাকে তাহলে তার লাশ পেলাম না কেন???

মফিজ হুজুর: আপনারা নদীর ঘাটে গিয়ে ৩০ ফুট দূরে জাল ফেলুন, দেখবেন সেখানে লাশ আছে।

কথামতো জাল ফেলা হলো,হ্যা,ঠিকই ওইখানে লাশ পাওয়া গেল।তখন তো সবাই ভয় পেয়ে গেছে। অনেকেই রহিম শেখ রূপি জ্বীনকে ছেড়ে দিচ্ছিল ভয়ে,কিন্তু মফিজ হুজুর মানা করলেন ছাড়তে। একটা তাবিজে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে সেই তাবিজ ওই রহিম শেখ রূপি জ্বীনের গলায় পড়িয়ে দিলেন, আর সকলের সামনে ওই জ্বীন পুড়ে যেতে লাগল।এভাবে গ্রামের অভিশাপ শেষ হলো।

[ কেমন লাগল??? গল্পে কোনো ভুল নজরে এলে বলবেন]

বি.দ্র.: অনেক সময় এবং শ্রম কাজে লাগিয়ে গল্প লিখি।তাই দয়া করে আমার নাম ছাড়া কপি করবেন না।

আল বিদা,,,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *